সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা সংসদে পাস হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য (এমপি) তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ কিছু কমিশন গঠন করে। এর অংশ হিসেবে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থ বিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া উচিত।
এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি দলের সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ভোট দিতে পারবেন। এতে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে কোনো প্রধানমন্ত্রী আস্থা ভোটে হেরে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার দল ক্ষমতা হারাবে না। নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পেলে তিনি হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী।
বিতর্ক
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই অনুচ্ছেদটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যারা এর বিপক্ষে তারা বলছেন, এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে
একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা দেয়। অন্যদিকে যারা এটা রাখার পক্ষে তাদের যুক্তি, এই বিধান বাদ দিলে সরকারের স্থিতিশীলতা থাকবে না। কিছুদিন পরপর সরকার ও সংসদ ভেঙে যেতে পারে। সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বড় ধরনের অর্থের লেনদেনও হতে পারে।
অবশ্য ৭০ অনুচ্ছেদ এখন যেভাবে আছে, সেটা সংস্কারের পক্ষেই আলোচনা জোরদার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে ৪৫ হাজার ৯২৫ জনের মধ্যে জরিপ চালিয়েছিল সংস্কার কমিশন। সেখানে ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছেন, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার অধিকার থাকা উচিত।
*বাহাত্তরের সংবিধান*
১৯৭২ সালে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কীভাবে যুক্ত হয়েছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব ছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের।
তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুই বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে- সঙ্গে আমিও ছিলাম। তার প্রথম বক্তব্য ছিল...দ্বিতীয়বারে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দল বদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তার সদস্যপদ চলে যাবে- এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচনে বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন না, সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।’
তবে গণপরিষদেই ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আনিসুজ্জামান তার বইয়ে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, (গণপরিষদ সদস্য) আ ক ম মোশাররফ হোসেন আকন্দ, আছাদুজ্জামান খান, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, হাফেজ হাবিবুর রহমান এই অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেছিলেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান- তার মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে।’
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া হাফেজ হাবিবুর রহমান
*বিএনপি-জামায়াতের বক্তব্য*
সংস্কার প্রস্তাব তৈরির আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ বিষয়ে লিখিত মতামত চেয়েছিল সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং একটি জনমত জরিপও চালিয়েছিল তারা। অনেক দল তাদের প্রস্তাবে ৭০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে বলেছিল।
বিএনপি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, সিপিবিসহ অনেকে আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না- এমন বিধান রেখে অনুচ্ছেদটি সংশোধনের পক্ষে। আর জামায়াতে ইসলামী আরও দুই মেয়াদ ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল।
বিএনপি তাদের প্রস্তাবে বলেছে, সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে ৭০ অনুচ্ছেদে ‘ফ্লোর ক্রসিং’- সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। তবে তারা সংসদে আস্থা ভোট, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে আসন শূন্য হবে এমন বিধান রাখতে বলেছে।
জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, ফ্লোর ক্রসিং এখন বন্ধ করা উচিত নয়। এটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে যুক্ত করা হয়েছিল। তারা এটি আরও দুই মেয়াদ পর্যন্ত রাখার পক্ষে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আস্থা ভোট ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার ক্ষমতা দেয়ার পক্ষে মত দেয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, ৭০ অনুচ্ছেদের কঠোরতা খর্ব করতে হবে। সংসদ সদস্যরা দল বদল করলে তথা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে বা দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলে বা অব্যাহতি দেয়া হলে তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে। আস্থা ভোটে দলের বিপরীতে ভোট দেয়া যাবে না। অন্য যে কোনো বিষয়ে তিনি স্বাধীন থাকবেন, দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
*কমিশনের বক্তব্য*
তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন মনে করে, আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার ক্ষমতা না পেলে প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব নয়। তাদের সংস্কার প্রস্তাবের অন্যতম লক্ষ্য ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো। যাতে ভবিষ্যতে সাংবিধানিকভাবে কোনো প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সুযোগ না পান।
*ক্ষমতার ভারসাম্য*
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংস্কার কমিশন কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো; বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন; একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন নাÑ এমন বিধান এবং সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি বদল করার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে।
*যৌক্তিকতা*
সংসদ সদস্যদের ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করার পেছনে যৌক্তিকতা কী, সেটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের নিজ দলের প্রস্তাবিত যে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত অকপটে মেনে নিতে বাধ্য করে। যদিও তাদের মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে, কিন্তু দলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। সংবিধান দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের নামে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতে বাধা দেয়।
সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা সংসদে পাস হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য (এমপি) তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ কিছু কমিশন গঠন করে। এর অংশ হিসেবে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থ বিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া উচিত।
এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি দলের সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ভোট দিতে পারবেন। এতে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে কোনো প্রধানমন্ত্রী আস্থা ভোটে হেরে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার দল ক্ষমতা হারাবে না। নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পেলে তিনি হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী।
বিতর্ক
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই অনুচ্ছেদটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যারা এর বিপক্ষে তারা বলছেন, এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে
একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা দেয়। অন্যদিকে যারা এটা রাখার পক্ষে তাদের যুক্তি, এই বিধান বাদ দিলে সরকারের স্থিতিশীলতা থাকবে না। কিছুদিন পরপর সরকার ও সংসদ ভেঙে যেতে পারে। সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বড় ধরনের অর্থের লেনদেনও হতে পারে।
অবশ্য ৭০ অনুচ্ছেদ এখন যেভাবে আছে, সেটা সংস্কারের পক্ষেই আলোচনা জোরদার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে ৪৫ হাজার ৯২৫ জনের মধ্যে জরিপ চালিয়েছিল সংস্কার কমিশন। সেখানে ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছেন, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার অধিকার থাকা উচিত।
*বাহাত্তরের সংবিধান*
১৯৭২ সালে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কীভাবে যুক্ত হয়েছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব ছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের।
তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুই বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে- সঙ্গে আমিও ছিলাম। তার প্রথম বক্তব্য ছিল...দ্বিতীয়বারে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দল বদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তার সদস্যপদ চলে যাবে- এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচনে বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন না, সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।’
তবে গণপরিষদেই ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আনিসুজ্জামান তার বইয়ে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, (গণপরিষদ সদস্য) আ ক ম মোশাররফ হোসেন আকন্দ, আছাদুজ্জামান খান, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, হাফেজ হাবিবুর রহমান এই অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেছিলেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান- তার মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে।’
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া হাফেজ হাবিবুর রহমান
*বিএনপি-জামায়াতের বক্তব্য*
সংস্কার প্রস্তাব তৈরির আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ বিষয়ে লিখিত মতামত চেয়েছিল সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং একটি জনমত জরিপও চালিয়েছিল তারা। অনেক দল তাদের প্রস্তাবে ৭০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে বলেছিল।
বিএনপি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, সিপিবিসহ অনেকে আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না- এমন বিধান রেখে অনুচ্ছেদটি সংশোধনের পক্ষে। আর জামায়াতে ইসলামী আরও দুই মেয়াদ ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল।
বিএনপি তাদের প্রস্তাবে বলেছে, সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে ৭০ অনুচ্ছেদে ‘ফ্লোর ক্রসিং’- সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। তবে তারা সংসদে আস্থা ভোট, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে আসন শূন্য হবে এমন বিধান রাখতে বলেছে।
জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, ফ্লোর ক্রসিং এখন বন্ধ করা উচিত নয়। এটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে যুক্ত করা হয়েছিল। তারা এটি আরও দুই মেয়াদ পর্যন্ত রাখার পক্ষে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আস্থা ভোট ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার ক্ষমতা দেয়ার পক্ষে মত দেয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, ৭০ অনুচ্ছেদের কঠোরতা খর্ব করতে হবে। সংসদ সদস্যরা দল বদল করলে তথা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে বা দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলে বা অব্যাহতি দেয়া হলে তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে। আস্থা ভোটে দলের বিপরীতে ভোট দেয়া যাবে না। অন্য যে কোনো বিষয়ে তিনি স্বাধীন থাকবেন, দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
*কমিশনের বক্তব্য*
তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন মনে করে, আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার ক্ষমতা না পেলে প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব নয়। তাদের সংস্কার প্রস্তাবের অন্যতম লক্ষ্য ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো। যাতে ভবিষ্যতে সাংবিধানিকভাবে কোনো প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সুযোগ না পান।
*ক্ষমতার ভারসাম্য*
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংস্কার কমিশন কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো; বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন; একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন নাÑ এমন বিধান এবং সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি বদল করার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে।
*যৌক্তিকতা*
সংসদ সদস্যদের ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করার পেছনে যৌক্তিকতা কী, সেটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের নিজ দলের প্রস্তাবিত যে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত অকপটে মেনে নিতে বাধ্য করে। যদিও তাদের মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে, কিন্তু দলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। সংবিধান দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের নামে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতে বাধা দেয়।