পার্বত্য চট্টগ্রামে খাগড়াছড়ির চেংগি নদীতে এভাবেই ফুল ভাসিয়ে শুরু হয় এবারের ‘বৈসাবি’ উদযাপন -সংবাদ
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলাতে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব ‘বৈসাবি’। শনিবার ১২ এপ্রিল ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ মধ্য দিয়ে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী বিজু-বৈসু-সাংগ্রাই তথা বৈসাবি উৎসব। উৎসব ঘিরে পাহাড় জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা।
চাকমারা এই উৎসবকে ‘বিঝু’ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘বৈসুক’, মারমা জনগোষ্ঠী ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ‘বিসু’ এবং অহমিয়ারা ‘বিহু’ বলে। তবে ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা এই তিন জনগোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে বৈসাবি, যা নববর্ষসহ হয় বৈসাবিন। ভোর থেকে পাহাড়ী নারীরা বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে একে একে আসতে থাকেন চেঙ্গী নদী তীরের উত্তর খবংপুড়িয়া, দক্ষিন খবং পুড়িয়া, চেঙ্গী নদী ব্রীজ সংলগ্নসহ ৩টি স্পটে। পুরনো বছরের সব গ্লানি, ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে ফেলতে পানিতে ভাসানো হয় ফুল। এর মধ্য দিয়ে প্রার্থনা জানানো হয় নতুন বছরে সবক্ষেত্রে মঙ্গলের।
শনিবার সকালে উৎসবের শুরুতে এসব জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে চেঙ্গী নদীর পাড়ে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি ২০৩ রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আমান হাসান, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েলসহ সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
তবে বৈসাবির ফুল বিজুর সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে সাংবাদিকদের বাধা দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত বলে মন্তব্য করেছেন খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি তরণ কুমার ভট্টাচার্য। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি আয়োজক কমিটির নেতারা।
১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন সম্প্রদায়ের কয়েকটি সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে এই উৎসব পালন শুরু হয়। তখন থেকেই ‘বৈসাবি’ নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩টি নৃগোষ্ঠী প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।
এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’ দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা’ দিন বলেন। আর ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’, দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ বলে। মারমা বা
মঘরা প্রথম দিনকে ‘পাইংছুয়ে’ দ্বিতীয় দিনকে ‘আক্যে’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘আতাদা’ বা ‘আপ্যাইং’ দিন বলেন।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, উৎসব আনন্দঘন পরিবেশের পালনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বৈসাবি উৎসব ঘিরে তিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়িরা নানা আয়োজনে উদযাপন করে তাদের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক উৎসব। বৈসাবি উপলক্ষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন বৈসাবি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। এতে নানা ক্ষুদ্র-নৃ- গোষ্ঠির নিজস্ব বর্নিল পোশাকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় ও সেই ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। দিন শেষে সেই ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেয়া হয়।
এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় সুস্বাদু ‘পাজন’। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয় চাকমাদের বিখ্যাত এই খাবার। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলে-মেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বয়স্করা দেশীয় মদ ‘জগরা বা ‘কাঞ্জি পান করেন। বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাবারের সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
ত্রিপুরাদের বুইসুক বা বৈসুক চৈত্রের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুইদিনের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’।
উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেয়া হয় খুব ভোরে। পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পড়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলে-মেয়েরা। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে। ১৩ এপ্রিল দেবতা পুকুরে গিয়ে সবপাপ মুছে গোসল করানো হয়। ১৪ এপ্রিল দেবতা পুকুর বা গভীর নদীতে মানস পূন্যার্থে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে পূজা বা পাঠাবলি দেয়া হয়।
পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ প্রত্যেক ঘরের উঠোনে ‘গরয়া’ নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহসত্ত’কে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পূজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাকে তিনবছর পর পর অংশ নিতে হয়। নয়তো তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। এই লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করে।
বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে খাদ্য সামগ্রী ছিটিয়ে দেয়। খুব ভোরে উঠে গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেয়া হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা তরুণ-তরুণীরা পিঠা বানাতে চালের গুড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ উৎসব হয়। সাংগ্রাই উৎসব এবং জলকেলী খেলা এখন যেন একে অন্যের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় তরুণ-তরুণীরা একে অন্যের দিকে পানি ছুঁড়েন। এছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে অষ্টমী ধর্মীয় বাণী শোনেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়। সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
১৩ এপ্রিল আর চৈত্র সংক্রান্তির দিনকে বলা হয় মূল বিজু। এদিন ঘরে ঘরে রান্না হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাচন’। তা দিয়ে দিন ভর চলে শুধু অতিথি আপ্যায়ন। আর ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ উৎসবের তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি তথা পানি খেলা উৎসব। মাসব্যাপী এই পানি খেলা উৎসবের মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব। বৈসাবি উৎসবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস পাহাড়ের নববর্ষ বরনে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়াবে এমন প্রত্যাশা সবার।
পার্বত্য চট্টগ্রামে খাগড়াছড়ির চেংগি নদীতে এভাবেই ফুল ভাসিয়ে শুরু হয় এবারের ‘বৈসাবি’ উদযাপন -সংবাদ
শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলাতে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব ‘বৈসাবি’। শনিবার ১২ এপ্রিল ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ মধ্য দিয়ে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী বিজু-বৈসু-সাংগ্রাই তথা বৈসাবি উৎসব। উৎসব ঘিরে পাহাড় জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা।
চাকমারা এই উৎসবকে ‘বিঝু’ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘বৈসুক’, মারমা জনগোষ্ঠী ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ‘বিসু’ এবং অহমিয়ারা ‘বিহু’ বলে। তবে ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা এই তিন জনগোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে বৈসাবি, যা নববর্ষসহ হয় বৈসাবিন। ভোর থেকে পাহাড়ী নারীরা বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে একে একে আসতে থাকেন চেঙ্গী নদী তীরের উত্তর খবংপুড়িয়া, দক্ষিন খবং পুড়িয়া, চেঙ্গী নদী ব্রীজ সংলগ্নসহ ৩টি স্পটে। পুরনো বছরের সব গ্লানি, ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে ফেলতে পানিতে ভাসানো হয় ফুল। এর মধ্য দিয়ে প্রার্থনা জানানো হয় নতুন বছরে সবক্ষেত্রে মঙ্গলের।
শনিবার সকালে উৎসবের শুরুতে এসব জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে চেঙ্গী নদীর পাড়ে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি ২০৩ রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আমান হাসান, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েলসহ সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
তবে বৈসাবির ফুল বিজুর সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে সাংবাদিকদের বাধা দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত বলে মন্তব্য করেছেন খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি তরণ কুমার ভট্টাচার্য। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি আয়োজক কমিটির নেতারা।
১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন সম্প্রদায়ের কয়েকটি সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে এই উৎসব পালন শুরু হয়। তখন থেকেই ‘বৈসাবি’ নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩টি নৃগোষ্ঠী প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।
এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’ দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা’ দিন বলেন। আর ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’, দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ বলে। মারমা বা
মঘরা প্রথম দিনকে ‘পাইংছুয়ে’ দ্বিতীয় দিনকে ‘আক্যে’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘আতাদা’ বা ‘আপ্যাইং’ দিন বলেন।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, উৎসব আনন্দঘন পরিবেশের পালনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বৈসাবি উৎসব ঘিরে তিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়িরা নানা আয়োজনে উদযাপন করে তাদের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক উৎসব। বৈসাবি উপলক্ষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন বৈসাবি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। এতে নানা ক্ষুদ্র-নৃ- গোষ্ঠির নিজস্ব বর্নিল পোশাকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় ও সেই ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। দিন শেষে সেই ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেয়া হয়।
এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় সুস্বাদু ‘পাজন’। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয় চাকমাদের বিখ্যাত এই খাবার। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলে-মেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বয়স্করা দেশীয় মদ ‘জগরা বা ‘কাঞ্জি পান করেন। বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাবারের সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
ত্রিপুরাদের বুইসুক বা বৈসুক চৈত্রের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুইদিনের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’।
উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেয়া হয় খুব ভোরে। পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পড়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলে-মেয়েরা। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে। ১৩ এপ্রিল দেবতা পুকুরে গিয়ে সবপাপ মুছে গোসল করানো হয়। ১৪ এপ্রিল দেবতা পুকুর বা গভীর নদীতে মানস পূন্যার্থে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে পূজা বা পাঠাবলি দেয়া হয়।
পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ প্রত্যেক ঘরের উঠোনে ‘গরয়া’ নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহসত্ত’কে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পূজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাকে তিনবছর পর পর অংশ নিতে হয়। নয়তো তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। এই লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করে।
বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে খাদ্য সামগ্রী ছিটিয়ে দেয়। খুব ভোরে উঠে গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেয়া হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা তরুণ-তরুণীরা পিঠা বানাতে চালের গুড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ উৎসব হয়। সাংগ্রাই উৎসব এবং জলকেলী খেলা এখন যেন একে অন্যের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় তরুণ-তরুণীরা একে অন্যের দিকে পানি ছুঁড়েন। এছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে অষ্টমী ধর্মীয় বাণী শোনেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়। সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
১৩ এপ্রিল আর চৈত্র সংক্রান্তির দিনকে বলা হয় মূল বিজু। এদিন ঘরে ঘরে রান্না হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাচন’। তা দিয়ে দিন ভর চলে শুধু অতিথি আপ্যায়ন। আর ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ উৎসবের তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি তথা পানি খেলা উৎসব। মাসব্যাপী এই পানি খেলা উৎসবের মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব। বৈসাবি উৎসবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস পাহাড়ের নববর্ষ বরনে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়াবে এমন প্রত্যাশা সবার।