চলতি বছর অতি দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক দাতা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের এই ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, চলতি বছরও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো যাবে না। তাদের এই আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, ‘বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি বাস করছেন। একটু টোকা লাগলেই তারা এর নিচে নেমে যাবেন।’
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, চলতি বছর বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হবে। তখন অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।
এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরে শ্রমবাজারের দুর্বল অবস্থা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের প্রকৃত আয় কমতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথগতির কারণে ঝুঁকিতে থাকা গরিব মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে। এতে বৈষম্য আরও বাড়বে।
শুধু অতি দারিদ্র্য হার নয়, জাতীয় দারিদ্র্য হারও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে উঠবে। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে।
এই আশঙ্কা অবশ্য দেশের সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোও করেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এই সূত্র ধরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ধারণা করছে, এই হার হয়েছে ২৩ দশমিক ১১ শতাংশ। যদিও বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ দেশব্যাপী অনেক বড় নমুনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আর বিআইডিএস পাঁচটি জেলার ওপর ধারণা জরিপ করেছে। বিআইডিএস বলেছে, তাদের জরিপটি খানা আয় ও ব্যয় জরিপের সঙ্গে তুলনা করার জন্য নয়। তবে সংস্থাটির ধারণা জরিপে এটি ফুটে উঠেছে, দুই বছর আগের চেয়ে দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার,(২৪ এপ্রিল) কথায় হয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তারাও চলতি বছর দেশের অর্থনীতির এই অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চলতি বছরও মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের মতো থাকবে। এতে অনেক মানুষ ক্রয়ক্ষমতার নিচে যাবে। আর সেটা হলে তারা হয়তো এখন দরিদ্র আছে তারা তখন অতি দরিদ্র হয়ে যাবে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা আমলে নেয়ার মতো।’
এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন জাহিদ হোসেনও। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এই আশঙ্কার প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশের বহু মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছেন। কোনো কারণে তাদের গায়ে একটু ধাক্কা লাগলেই তারা এর সীমার নিচে নেমে যাবে। যেমন, একজন দিন মজুর যদি এক সপ্তাহ বেকার থাকেন তাহলেই তার আয় কমে যাবে। আর আয় কমে গেলেই তিনি অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবেন। অর্থাৎ, তাদের অবস্থানটা ঝুঁকিপূর্ণ।’
২০২২ সালের জনশুমারিতে দেখা যায়, দেশের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি বিবেচনায় আনলে ২০২৫ সাল শেষে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হার বা গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৯০ লাখের মতো।
মূলত প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার কারণেই মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় কিংবা গরিব থেকে আরও গরিব বা অতি গরিব হয়। গরিব মানুষ বৃদ্ধির কারণে হিসেবে দুর্বল শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক শ্লথগতির কথাও বলেছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা দিয়ে গরিব মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতি দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। এটি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা।
তবে প্রতিটি দেশের জন্য নিজস্ব একটি দারিদ্র্যরেখা ঠিক করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদ- হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না
থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা গরিব হয়ে যাবেন। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আনেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তারা।
এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি আছে। অর্থাৎ পণ্য ও সেবা কিনতে আগের বছরের গড়ে ১০ শতাংশ দাম দিতে হচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়েনি। এতে প্রকৃত আয় কমেছে সাধারণ মানুষের।
প্রকৃত আয় কমার একটি সাধারণ উপায় হলো মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে, এর কম হারে মজুরি বাড়লে প্রকৃত আয় কমে যায়। ৩ বছর ৩ মাস বা ৩৯ মাস ধরে বাংলাদেশে মজুরির হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। বিবিএসের হিসাবমতো, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার বৃদ্ধি বেশি। এরপর ৩৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। গত ৩ বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে গরিব মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ২০২২ সালে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো ৩৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘চলতি বছরও যদি মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের উপরে থাকে তাহলে তো ব্যাংক পলিসি রেইট, ইন্টারেস্ট রেট এগুলোও মোটামুটিভাবে এরকমই থাকবে। এটা হলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকবে। আমাদের দেশে দুই দিন কাজ না থাকলে বিশ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।’
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে অর্থনীতির শ্লথগতি চলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ- এসব সূচকে চাঙা ভাব নেই। ৯ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ছয় বছরের মধ্যে এডিবি বাস্তবায়ন সবচেয়ে কম। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা খরচ গতবারের চেয়ে কমেছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও কমেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ কম। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কি করা যায় এই বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, আরও মানুষকে এটার আওতায় আনতে হবে। বলা হচ্ছে, এবার অতিরিক্ত সাত লাখ মানুষকে এটার আওতায় আনা হবে। এটা ভালো উদ্যোগ। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে তারপরে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ আরও ভালো করে বিনিয়োগ করতে পারলে আমাদের শোভন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তখন তো আর সমস্যা হয় না।’
এ ছাড়া দুর্বল শ্রমবাজার আগের মতো বিরাজমান। ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে দিনমজুরের মতো কাজ করেন, তাদের চাকরি বা কাজের নিশ্চয়তার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু এ বছর বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে প্রবৃদ্ধির হার কমার দিকে। মজুরির যে সুযোগটা আমরা দেখি সেটা একেবারে নিম্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের। এরা কৃষিতে কাজ করে। এদের মজুরি কিন্তু চল্লিশ মাস ধরেই ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে সেই হারে মজুরি বাড়েনি। তাই অতি দরিদ্রের ঝুঁকিতে বাস করছেন তারা। যেকোনো সময় তারা এর নিচে পড়ে যেতে পারেন।’
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
চলতি বছর অতি দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক দাতা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের এই ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, চলতি বছরও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো যাবে না। তাদের এই আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, ‘বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি বাস করছেন। একটু টোকা লাগলেই তারা এর নিচে নেমে যাবেন।’
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, চলতি বছর বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হবে। তখন অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।
এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরে শ্রমবাজারের দুর্বল অবস্থা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের প্রকৃত আয় কমতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথগতির কারণে ঝুঁকিতে থাকা গরিব মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে। এতে বৈষম্য আরও বাড়বে।
শুধু অতি দারিদ্র্য হার নয়, জাতীয় দারিদ্র্য হারও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে উঠবে। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে।
এই আশঙ্কা অবশ্য দেশের সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোও করেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এই সূত্র ধরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ধারণা করছে, এই হার হয়েছে ২৩ দশমিক ১১ শতাংশ। যদিও বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ দেশব্যাপী অনেক বড় নমুনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আর বিআইডিএস পাঁচটি জেলার ওপর ধারণা জরিপ করেছে। বিআইডিএস বলেছে, তাদের জরিপটি খানা আয় ও ব্যয় জরিপের সঙ্গে তুলনা করার জন্য নয়। তবে সংস্থাটির ধারণা জরিপে এটি ফুটে উঠেছে, দুই বছর আগের চেয়ে দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার,(২৪ এপ্রিল) কথায় হয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তারাও চলতি বছর দেশের অর্থনীতির এই অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চলতি বছরও মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের মতো থাকবে। এতে অনেক মানুষ ক্রয়ক্ষমতার নিচে যাবে। আর সেটা হলে তারা হয়তো এখন দরিদ্র আছে তারা তখন অতি দরিদ্র হয়ে যাবে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা আমলে নেয়ার মতো।’
এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন জাহিদ হোসেনও। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এই আশঙ্কার প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশের বহু মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছেন। কোনো কারণে তাদের গায়ে একটু ধাক্কা লাগলেই তারা এর সীমার নিচে নেমে যাবে। যেমন, একজন দিন মজুর যদি এক সপ্তাহ বেকার থাকেন তাহলেই তার আয় কমে যাবে। আর আয় কমে গেলেই তিনি অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবেন। অর্থাৎ, তাদের অবস্থানটা ঝুঁকিপূর্ণ।’
২০২২ সালের জনশুমারিতে দেখা যায়, দেশের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি বিবেচনায় আনলে ২০২৫ সাল শেষে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হার বা গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৯০ লাখের মতো।
মূলত প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার কারণেই মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় কিংবা গরিব থেকে আরও গরিব বা অতি গরিব হয়। গরিব মানুষ বৃদ্ধির কারণে হিসেবে দুর্বল শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক শ্লথগতির কথাও বলেছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা দিয়ে গরিব মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতি দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। এটি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা।
তবে প্রতিটি দেশের জন্য নিজস্ব একটি দারিদ্র্যরেখা ঠিক করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদ- হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না
থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা গরিব হয়ে যাবেন। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আনেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তারা।
এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি আছে। অর্থাৎ পণ্য ও সেবা কিনতে আগের বছরের গড়ে ১০ শতাংশ দাম দিতে হচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়েনি। এতে প্রকৃত আয় কমেছে সাধারণ মানুষের।
প্রকৃত আয় কমার একটি সাধারণ উপায় হলো মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে, এর কম হারে মজুরি বাড়লে প্রকৃত আয় কমে যায়। ৩ বছর ৩ মাস বা ৩৯ মাস ধরে বাংলাদেশে মজুরির হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। বিবিএসের হিসাবমতো, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার বৃদ্ধি বেশি। এরপর ৩৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। গত ৩ বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে গরিব মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ২০২২ সালে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো ৩৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘চলতি বছরও যদি মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের উপরে থাকে তাহলে তো ব্যাংক পলিসি রেইট, ইন্টারেস্ট রেট এগুলোও মোটামুটিভাবে এরকমই থাকবে। এটা হলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকবে। আমাদের দেশে দুই দিন কাজ না থাকলে বিশ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।’
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে অর্থনীতির শ্লথগতি চলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ- এসব সূচকে চাঙা ভাব নেই। ৯ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ছয় বছরের মধ্যে এডিবি বাস্তবায়ন সবচেয়ে কম। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা খরচ গতবারের চেয়ে কমেছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও কমেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ কম। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কি করা যায় এই বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, আরও মানুষকে এটার আওতায় আনতে হবে। বলা হচ্ছে, এবার অতিরিক্ত সাত লাখ মানুষকে এটার আওতায় আনা হবে। এটা ভালো উদ্যোগ। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে তারপরে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ আরও ভালো করে বিনিয়োগ করতে পারলে আমাদের শোভন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তখন তো আর সমস্যা হয় না।’
এ ছাড়া দুর্বল শ্রমবাজার আগের মতো বিরাজমান। ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে দিনমজুরের মতো কাজ করেন, তাদের চাকরি বা কাজের নিশ্চয়তার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু এ বছর বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে প্রবৃদ্ধির হার কমার দিকে। মজুরির যে সুযোগটা আমরা দেখি সেটা একেবারে নিম্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের। এরা কৃষিতে কাজ করে। এদের মজুরি কিন্তু চল্লিশ মাস ধরেই ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে সেই হারে মজুরি বাড়েনি। তাই অতি দরিদ্রের ঝুঁকিতে বাস করছেন তারা। যেকোনো সময় তারা এর নিচে পড়ে যেতে পারেন।’