আগামী ১০ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে দশ শতাংশে উন্নীত করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল’ শিরোনামে প্রণীত এক কৌশলপত্রে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই কৌশলপত্রে মাত্র আড়াই শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিকে পর্যাপ্ত মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, যদি দশ বছরে সাড়ে দশ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপানে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে ‘পরিকল্পনাতেই গলদ’ আছে। কারণ অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাতকে স্টান্ডার্ড মনে করা হয়। আগামী ১০ বছরেও আমরা স্টান্ডার্ডে উঠতে পারবো না? প্রশ্ন রাখেন তারা।
২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল’ শিরোনামে প্রণীত এই কৌশলপত্রে বৈদেশিক ঋণর নির্ভরতা কমানো এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করতে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণকে (ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন বা ডিআরএম) গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছর ধরে ৭-৮ শতাংশে স্থীর থাকা কর-জিডিপি অনুপাত, কর ফাঁকি, কর পরিহারের সংস্কৃতি এবং দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মতো চ্যালেঞ্জের কারণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ব্যবস্থার সংস্কার একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন ও আধুনিকায়নমূলক সাম্প্রতিক অগ্রগতি ধরে রাখা জরুরি। সংস্কারে সমন্বিত একটি উদ্যোগ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত বিস্তৃত এই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস) বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শনিবার,(১০ মে ২০২৫) কথা হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে ২০২৪-২৫ অর্থবছর চলে। ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর আসতে আরও ১০ বছর বাকি। এই সময়ের মধ্যে কর-জিডিপি রেশিও মাত্র তিন শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করি তাহলে পরিকল্পনাতেই গলদ আছে। কারণ, ইকোনোমিক্সে ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি রেশিওকে স্টান্ডার্ড মনে করা হয়। আরও ১০ বছর পরও যদি আমরা স্টাডার্ডে না উঠতে পারি তাহলে কি পরিকল্পনা নির্ধারণ করলাম?’
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও কর-জিডিপি রেশিও অনেক বেশি জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নেপালের কর-জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের ওপরে। ভারতের অবস্থাও তাই। সেখানে আরও ১০ বছর পর বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও হবে ১০ শতাংশ। এটাকে কীভাবে যৌক্তিক বলবো বুঝতে পারছি না। পাকিস্তানেরও কর-জিডিপি রেশিও ১৫ শতাংশের কাছাকাছি।’
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো নেয়ার সময় আরও গবেষণা করে নেয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, ‘১০ বছর মেয়াদি একটা পরিকল্পনা অবশ্যই অনেক কিছু ভেবে চিন্তে নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব খুবই দ্রুত পরিবর্তনশীল। যুগের সঙ্গে আমাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।’
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানও একই কথা বলেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আগামী ১০ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করবে এনবিআর? আমার মনে হয় এটা কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া উচিত। যদি এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকে তাহলে সেটা অনেক কম হয়ে যায়। ভারত-পাকিস্তানের কর-জিডিপি অনুপাতই তো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। দশ বছর পরও আমরা তাদের সমান হতে পারবো না?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এনবিআর এর বাকি ৫টা লক্ষ্যমাত্রা ঠিকমতো কাজ করলে কর-জিডিপি অনুপাত আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বাকি লক্ষ্যমাত্রাগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে কর-জিডিপি অনুপাত আরও বাড়বে। এর জন্য এনবিআরকে করের আওতা বাড়াতে হবে, কর হার না। অর্থাৎ যে কর দিচ্ছে তাকে আরও কর দিতে চাপ দেয়া যাবে না। যে কর দেয় না তাকে করের আওতায় আনতে হবে।’
এই লক্ষ্যমাত্রাকে ছোট হিসেবে মনে করেন সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক তিন শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সরকার পূর্বাভাস দিয়েছে সাড়ে তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধির। যদি আগামী বছরগুলোয় নি¤œ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দেরি হয়, তাহলে সাড়ে ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও রাজস্ব আয়ের প্রকৃত পরিমাণ যতটা মনে হয়, তত বড় নাও হতে পারে।’
আগামীতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের পরবর্তী তিন বছর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখনই চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক বাড়বে। ধারণা করছি- রাজস্ব আদায় অনেক বাড়াতে পারে এমন সংস্কারের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় না নিয়েই সাড়ে ১০ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।’
এই কৌশলপত্রে, মধ্যমেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত এবং দীর্ঘমেয়াদ ২০৩০-৩১ থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত। ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মোট ছয়টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এগুলো হলো, প্রথম, এনবিআরের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সম্পূর্ণ অটোমেশন। দ্বিতীয়, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা। তৃতীয়, স্বেচ্ছায় কর প্রদানের প্রবণতা বৃদ্ধি। চতুর্থ, প্রকৃত ও সম্ভাব্য কর রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান কমানো। পঞ্চম, সবার উপর সমানভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ষষ্ঠ, সততা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।
এই ছয়টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য আরও চারটি মানদ- নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এনবিআর বলছে, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং এনবিআর এর নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই মানদ-গুলো সহযোগিতা করবে। এই চারটি স্তম্ভ হলো, প্রথম: কার্যকর নীতি ও আইনগত পরিবেশ গড়ে তোলা। দ্বিতীয়: এনবিআরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। তৃতীয়: মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। চতুর্থ: করদাতাদের সেবা ও স্বেচ্ছায় কর প্রদান বাড়ানো।
এছাড়া কৌশলপত্রে আরও বলা হয়েছে, এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য চারটি স্তম্ভের অধীনে মোট ৬০টি পদক্ষেপ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর নির্দিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তা একটি কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলো মূলত ভবিষ্যতের ধারাবাহিক সংস্কারের রূপরেখা নির্দেশ করে। অধিকাংশ পদক্ষেপ এনবিআরের তিনটি কার্যকরী শাখা, আয়কর, কাস্টমস এবং মূসক এর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য একটি সুসংহত বাস্তবায়ন কাঠামো গঠন করা হয়েছে। এর নেতৃত্ব দেবেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি হবেন স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান। গবেষণা ও পরিসংখ্যান শাখার মহাপরিচালকের নেতৃত্বে থাকবে কমিটি সচিবালয়। কাস্টমস, মূসক ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে গঠিত হবে বাস্তবায়ন সহায়ক দল। সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে, যা মূল কমিটি ও সচিবালয়কে সহযোগিতা করবে।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও সময়োপযোগী হালনাগাদের মাধ্যমে কৌশলের চলমান পরিবর্তন ও সংস্কার অগ্রাধিকার অনুযায়ী সাড়া দিতে পারবে। বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের মাধ্যমে অগ্রগতি, কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব যাচাই করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে যেন রাজস্ব আহরণে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যায়।
এই কৌশল অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের একটি সমন্বিত ও গতিশীল কৌশল যা বাংলাদেশের টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তুলবে এবং দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভবিষ্যতের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উল্লেখ্য করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও (৮ম পঞ্চবার্ষিকী) স্বীকৃত। চ্যালেঞ্জগুলো হলো, কর প্রশাসনের অভ্যন্তরে দক্ষতা, পদ্ধতি ও ব্যবস্থাগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কর আইন ও বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা ও নিয়মাবলির শক্তিশালীকরণ। কর প্রশাসন ও রাজস্ব আহরণে যুক্ত ব্যক্তিদের জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। করদাতারা যেন সহজে ও ইচ্ছাকৃতভাবে কর পরিশোধে আগ্রহী হন, সেই মানসিকতা গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা।
এই কৌশলপত্র প্রণয়নের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ না করায় তাদের মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি।
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
আগামী ১০ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে দশ শতাংশে উন্নীত করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল’ শিরোনামে প্রণীত এক কৌশলপত্রে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই কৌশলপত্রে মাত্র আড়াই শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিকে পর্যাপ্ত মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, যদি দশ বছরে সাড়ে দশ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপানে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে ‘পরিকল্পনাতেই গলদ’ আছে। কারণ অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাতকে স্টান্ডার্ড মনে করা হয়। আগামী ১০ বছরেও আমরা স্টান্ডার্ডে উঠতে পারবো না? প্রশ্ন রাখেন তারা।
২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল’ শিরোনামে প্রণীত এই কৌশলপত্রে বৈদেশিক ঋণর নির্ভরতা কমানো এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করতে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণকে (ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন বা ডিআরএম) গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছর ধরে ৭-৮ শতাংশে স্থীর থাকা কর-জিডিপি অনুপাত, কর ফাঁকি, কর পরিহারের সংস্কৃতি এবং দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মতো চ্যালেঞ্জের কারণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ব্যবস্থার সংস্কার একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন ও আধুনিকায়নমূলক সাম্প্রতিক অগ্রগতি ধরে রাখা জরুরি। সংস্কারে সমন্বিত একটি উদ্যোগ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত বিস্তৃত এই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস) বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শনিবার,(১০ মে ২০২৫) কথা হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে ২০২৪-২৫ অর্থবছর চলে। ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর আসতে আরও ১০ বছর বাকি। এই সময়ের মধ্যে কর-জিডিপি রেশিও মাত্র তিন শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করি তাহলে পরিকল্পনাতেই গলদ আছে। কারণ, ইকোনোমিক্সে ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি রেশিওকে স্টান্ডার্ড মনে করা হয়। আরও ১০ বছর পরও যদি আমরা স্টাডার্ডে না উঠতে পারি তাহলে কি পরিকল্পনা নির্ধারণ করলাম?’
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও কর-জিডিপি রেশিও অনেক বেশি জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নেপালের কর-জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের ওপরে। ভারতের অবস্থাও তাই। সেখানে আরও ১০ বছর পর বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও হবে ১০ শতাংশ। এটাকে কীভাবে যৌক্তিক বলবো বুঝতে পারছি না। পাকিস্তানেরও কর-জিডিপি রেশিও ১৫ শতাংশের কাছাকাছি।’
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো নেয়ার সময় আরও গবেষণা করে নেয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, ‘১০ বছর মেয়াদি একটা পরিকল্পনা অবশ্যই অনেক কিছু ভেবে চিন্তে নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব খুবই দ্রুত পরিবর্তনশীল। যুগের সঙ্গে আমাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।’
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানও একই কথা বলেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আগামী ১০ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করবে এনবিআর? আমার মনে হয় এটা কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া উচিত। যদি এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকে তাহলে সেটা অনেক কম হয়ে যায়। ভারত-পাকিস্তানের কর-জিডিপি অনুপাতই তো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। দশ বছর পরও আমরা তাদের সমান হতে পারবো না?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এনবিআর এর বাকি ৫টা লক্ষ্যমাত্রা ঠিকমতো কাজ করলে কর-জিডিপি অনুপাত আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বাকি লক্ষ্যমাত্রাগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে কর-জিডিপি অনুপাত আরও বাড়বে। এর জন্য এনবিআরকে করের আওতা বাড়াতে হবে, কর হার না। অর্থাৎ যে কর দিচ্ছে তাকে আরও কর দিতে চাপ দেয়া যাবে না। যে কর দেয় না তাকে করের আওতায় আনতে হবে।’
এই লক্ষ্যমাত্রাকে ছোট হিসেবে মনে করেন সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক তিন শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সরকার পূর্বাভাস দিয়েছে সাড়ে তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধির। যদি আগামী বছরগুলোয় নি¤œ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দেরি হয়, তাহলে সাড়ে ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও রাজস্ব আয়ের প্রকৃত পরিমাণ যতটা মনে হয়, তত বড় নাও হতে পারে।’
আগামীতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের পরবর্তী তিন বছর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখনই চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক বাড়বে। ধারণা করছি- রাজস্ব আদায় অনেক বাড়াতে পারে এমন সংস্কারের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় না নিয়েই সাড়ে ১০ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।’
এই কৌশলপত্রে, মধ্যমেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত এবং দীর্ঘমেয়াদ ২০৩০-৩১ থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত। ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মোট ছয়টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এগুলো হলো, প্রথম, এনবিআরের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সম্পূর্ণ অটোমেশন। দ্বিতীয়, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা। তৃতীয়, স্বেচ্ছায় কর প্রদানের প্রবণতা বৃদ্ধি। চতুর্থ, প্রকৃত ও সম্ভাব্য কর রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান কমানো। পঞ্চম, সবার উপর সমানভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ষষ্ঠ, সততা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।
এই ছয়টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য আরও চারটি মানদ- নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এনবিআর বলছে, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং এনবিআর এর নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই মানদ-গুলো সহযোগিতা করবে। এই চারটি স্তম্ভ হলো, প্রথম: কার্যকর নীতি ও আইনগত পরিবেশ গড়ে তোলা। দ্বিতীয়: এনবিআরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। তৃতীয়: মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। চতুর্থ: করদাতাদের সেবা ও স্বেচ্ছায় কর প্রদান বাড়ানো।
এছাড়া কৌশলপত্রে আরও বলা হয়েছে, এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য চারটি স্তম্ভের অধীনে মোট ৬০টি পদক্ষেপ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর নির্দিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তা একটি কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলো মূলত ভবিষ্যতের ধারাবাহিক সংস্কারের রূপরেখা নির্দেশ করে। অধিকাংশ পদক্ষেপ এনবিআরের তিনটি কার্যকরী শাখা, আয়কর, কাস্টমস এবং মূসক এর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য একটি সুসংহত বাস্তবায়ন কাঠামো গঠন করা হয়েছে। এর নেতৃত্ব দেবেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি হবেন স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান। গবেষণা ও পরিসংখ্যান শাখার মহাপরিচালকের নেতৃত্বে থাকবে কমিটি সচিবালয়। কাস্টমস, মূসক ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে গঠিত হবে বাস্তবায়ন সহায়ক দল। সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে, যা মূল কমিটি ও সচিবালয়কে সহযোগিতা করবে।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও সময়োপযোগী হালনাগাদের মাধ্যমে কৌশলের চলমান পরিবর্তন ও সংস্কার অগ্রাধিকার অনুযায়ী সাড়া দিতে পারবে। বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের মাধ্যমে অগ্রগতি, কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব যাচাই করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে যেন রাজস্ব আহরণে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যায়।
এই কৌশল অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের একটি সমন্বিত ও গতিশীল কৌশল যা বাংলাদেশের টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তুলবে এবং দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভবিষ্যতের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উল্লেখ্য করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও (৮ম পঞ্চবার্ষিকী) স্বীকৃত। চ্যালেঞ্জগুলো হলো, কর প্রশাসনের অভ্যন্তরে দক্ষতা, পদ্ধতি ও ব্যবস্থাগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কর আইন ও বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা ও নিয়মাবলির শক্তিশালীকরণ। কর প্রশাসন ও রাজস্ব আহরণে যুক্ত ব্যক্তিদের জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। করদাতারা যেন সহজে ও ইচ্ছাকৃতভাবে কর পরিশোধে আগ্রহী হন, সেই মানসিকতা গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা।
এই কৌশলপত্র প্রণয়নের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ না করায় তাদের মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি।