মনিপুরীদের বর্ণিল উৎসব -সংবাদ
ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম মণিপুরী। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে।
মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতের মণিপুর, আসাম, ও ত্রিপুরা রাজ্যের ও বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এবং মায়ানমারে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোক বাস করে।
লৌহ যুগ এবং প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতে আগমন তাদের। তবে এ সম্পর্কে লিখিত ইতিহাস তেমন পাওয়া যায় না। তাদের জাতিগত-ভাষাগত পটভূমিসহ এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস অনেকাংশেই অজানা।
মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব হয়। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও ম-পগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়।
কার্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবণ। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্তম উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপূর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রি. থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে দূরদূরান্তের লাখ লাখ ভক্ত-দর্শক সিলেটের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়াম-প ও আদমপুর বাজারের সংলগ্ন তেতই গাঁওস্থ রাস ম-পে এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন।
বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এ সময় পালাকীর্তনের জনপ্রিয় ধারা ‘হোলি’ পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ-তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ‘মতমগী মণিপুর’ প্রথম মণিপুরী চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। পাওখুম আমা (১৯৮৩) হলো মণিপুরের প্রথম পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের রঙিন ফিচার ফিল্ম (একটি ফিচার ফিল্মের অ্যাকাডেমির সংজ্ঞা অনুসারে) এবং এটি ছিল পরিচালনা করেছেন অরিবম শ্যাম শর্মা। লাম্মেই (২০০২) হলো প্রথম মণিপুরি ভিডিও ফিল্ম। একটি থিয়েটারে এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী হয়েছে। ভিডিও ফিল্ম নির্মাণের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মণিপুর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রসারিত হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ৪০-৫০টি চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে অধিকাংশ মণিপুরী হিন্দুধর্ম অনুসারী। কিছু মণিপুরী হিন্দুধর্মের সনামাহী ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। রাসলীলা, জন্মাষ্টমী, হোলি, লাই হারাওবা, চৈরাওবা (নববর্ষ), য়াওশঙ, থাবল চোংবা, রথযাত্রা, দীপাবলি, রাম নবমী উৎসব পালন করেন তারা। পাশাপাশি ইসলাম ও খ্রীস্টধর্মের অনুসারীরাও রয়েছেন তাদের মধ্যে।
মণিপুরীরা প্রধানত কৃষিজীবী যেখানে ধান তাদের প্রধান ফসল। তবে তারা আম, লেবু, আনারস, কমলা, পেয়ারা এবং অন্য ফলও জন্মায়। মাছ ধরাও মেইতেইদের একটি পেশা বা শখ। খাদ্য সামগ্রী, টেক্সটাইল এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বিক্রেতা হিসেবে নারীদের পদচারণা দেখা যায় স্থানীয় বাজারে ।
ঐতিহ্যবাহী মেইতেই খেলাগুলো এখনও বিদ্যমান। কিছু এমনকি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
মণিপুরী মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী উপ-পরিবারের দলে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়। মনিপুরী মহারাষ্ট্রী-সৌরসেনী ভাষাশ্রেণীর আবার কেউ কেউ একে ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপশ্রেণীর তালিকাভুক্ত করা সমীচীন মনে করেন। শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে মণিপুরী মৈতৈ ভাষাতে ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।
১৮৮৯ সনে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ভাষা শ্রেণী বিভাগের প্রধান ভিত্তি স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে মৈতৈ মণিপুরী ভাষাকে মণিপুরের অন্যতম ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মনিপুরী ভাষা ভারতে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে ইন্ডিয়ান সরকার মণিপুরী মৈতৈ মণিপুরী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মণিপুরী (মৈতৈ) ভাষা ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা। মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় স্নাতকোত্তর ও পি.এইচ.ডি. পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে, মণিপুরীরা নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে নিজের ভাষায় কথা বলে। নৃতাত্ত্বিক মণিপুরীরা তাদের আদি মণিপুরী ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় শিক্ষিত হয়। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে মনিপুরী ভাষায় পাঠদান কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে ‘মণিপুরী অনুষ্ঠান’ শিরোনামে পর্যায়ক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় এবং এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার এখনও অব্যাহত রয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের শিকার হয়ে এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়, ত্রিপুরা রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে।
বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু বহু মণিপুরী তাদের নতুন স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আসা মণিপুরীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরী পাড়া এবং প্রধানত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।
বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখায়, সিলেটের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে।
ব্রিটিশ শাসনামলে মণিপুরী কৃষকদের সংগ্রামের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। ১৯৪৩ সালে জমিদারি ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার ভানুগাছ পরগনার ভানুবিল মৌজার নয়টি গ্রামের মণিপুরি সম্প্রদায়ের কৃষকরা।
১৯৭১ সনে মণিপুরী জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই সম্প্রদায়ের অসংখ্য তরুণ মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। মণিপুরী নারী ও গৃহবধুরাও নানানভাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতা করেন।
মনিপুরীদের বর্ণিল উৎসব -সংবাদ
শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম মণিপুরী। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে।
মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতের মণিপুর, আসাম, ও ত্রিপুরা রাজ্যের ও বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এবং মায়ানমারে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোক বাস করে।
লৌহ যুগ এবং প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতে আগমন তাদের। তবে এ সম্পর্কে লিখিত ইতিহাস তেমন পাওয়া যায় না। তাদের জাতিগত-ভাষাগত পটভূমিসহ এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস অনেকাংশেই অজানা।
মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব হয়। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও ম-পগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়।
কার্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবণ। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্তম উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপূর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রি. থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে দূরদূরান্তের লাখ লাখ ভক্ত-দর্শক সিলেটের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়াম-প ও আদমপুর বাজারের সংলগ্ন তেতই গাঁওস্থ রাস ম-পে এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন।
বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এ সময় পালাকীর্তনের জনপ্রিয় ধারা ‘হোলি’ পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ-তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ‘মতমগী মণিপুর’ প্রথম মণিপুরী চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। পাওখুম আমা (১৯৮৩) হলো মণিপুরের প্রথম পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের রঙিন ফিচার ফিল্ম (একটি ফিচার ফিল্মের অ্যাকাডেমির সংজ্ঞা অনুসারে) এবং এটি ছিল পরিচালনা করেছেন অরিবম শ্যাম শর্মা। লাম্মেই (২০০২) হলো প্রথম মণিপুরি ভিডিও ফিল্ম। একটি থিয়েটারে এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী হয়েছে। ভিডিও ফিল্ম নির্মাণের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মণিপুর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রসারিত হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ৪০-৫০টি চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে অধিকাংশ মণিপুরী হিন্দুধর্ম অনুসারী। কিছু মণিপুরী হিন্দুধর্মের সনামাহী ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। রাসলীলা, জন্মাষ্টমী, হোলি, লাই হারাওবা, চৈরাওবা (নববর্ষ), য়াওশঙ, থাবল চোংবা, রথযাত্রা, দীপাবলি, রাম নবমী উৎসব পালন করেন তারা। পাশাপাশি ইসলাম ও খ্রীস্টধর্মের অনুসারীরাও রয়েছেন তাদের মধ্যে।
মণিপুরীরা প্রধানত কৃষিজীবী যেখানে ধান তাদের প্রধান ফসল। তবে তারা আম, লেবু, আনারস, কমলা, পেয়ারা এবং অন্য ফলও জন্মায়। মাছ ধরাও মেইতেইদের একটি পেশা বা শখ। খাদ্য সামগ্রী, টেক্সটাইল এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বিক্রেতা হিসেবে নারীদের পদচারণা দেখা যায় স্থানীয় বাজারে ।
ঐতিহ্যবাহী মেইতেই খেলাগুলো এখনও বিদ্যমান। কিছু এমনকি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
মণিপুরী মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী উপ-পরিবারের দলে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়। মনিপুরী মহারাষ্ট্রী-সৌরসেনী ভাষাশ্রেণীর আবার কেউ কেউ একে ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপশ্রেণীর তালিকাভুক্ত করা সমীচীন মনে করেন। শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে মণিপুরী মৈতৈ ভাষাতে ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।
১৮৮৯ সনে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ভাষা শ্রেণী বিভাগের প্রধান ভিত্তি স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে মৈতৈ মণিপুরী ভাষাকে মণিপুরের অন্যতম ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মনিপুরী ভাষা ভারতে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে ইন্ডিয়ান সরকার মণিপুরী মৈতৈ মণিপুরী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মণিপুরী (মৈতৈ) ভাষা ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা। মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় স্নাতকোত্তর ও পি.এইচ.ডি. পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে, মণিপুরীরা নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে নিজের ভাষায় কথা বলে। নৃতাত্ত্বিক মণিপুরীরা তাদের আদি মণিপুরী ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় শিক্ষিত হয়। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে মনিপুরী ভাষায় পাঠদান কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে ‘মণিপুরী অনুষ্ঠান’ শিরোনামে পর্যায়ক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় এবং এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার এখনও অব্যাহত রয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের শিকার হয়ে এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়, ত্রিপুরা রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে।
বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু বহু মণিপুরী তাদের নতুন স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আসা মণিপুরীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরী পাড়া এবং প্রধানত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।
বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখায়, সিলেটের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে।
ব্রিটিশ শাসনামলে মণিপুরী কৃষকদের সংগ্রামের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। ১৯৪৩ সালে জমিদারি ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার ভানুগাছ পরগনার ভানুবিল মৌজার নয়টি গ্রামের মণিপুরি সম্প্রদায়ের কৃষকরা।
১৯৭১ সনে মণিপুরী জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই সম্প্রদায়ের অসংখ্য তরুণ মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। মণিপুরী নারী ও গৃহবধুরাও নানানভাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতা করেন।