alt

উপ-সম্পাদকীয়

মৎস্য খাত : অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
image

মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে

পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ রপ্তানি করে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে, এই অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে।

উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষিঋণ, প্রশিক্ষণ দেয়াসহ সরকার নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী স্মার্ট মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদেশ থেকে মাছের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান আসে, সেগুলোও এ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাতে মাছ উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে অস্বাস্থ্যকর কোন উপাদান প্রবেশ করতে না পারে।

শুধু মাছ উৎপাদন নয় বরং স্বাস্থ্যসম্মত ও খাবার উপযোগী নিরাপদ মাছ উৎপাদন সরকারের লক্ষ্য। আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি। এখন আমাদের লক্ষ্য দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে মাছের ভোক্তাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে মাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সরকার উৎসাহিত করছে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, তাদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ দেয়া হচ্ছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়াসহ সরকার নানারকম সহায়তা প্রদান করছে।

গ্রামাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মিঠা পানি ও বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে।

২০২০ সালে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্র সীমাসহ অন্যত্র যারা মাছ আহরণে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে; যাতে তাদের মনিটরিং এর আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি কোন মৎস্য নৌযান দুর্ঘটনায় পতিত হলে, তাদের অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দূষণের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন কমছে।

চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা হলো সেই চার দেশ। বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে। বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার গবেষণার ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোকে চাষিদের হাতে পৌঁছে দিতে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। জলাশয় ও নদ-নদীর দূষণ কমাতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।

মাছে ভাতে বাঙালি- এটা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ; কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের নদী খাল বিল হাওর-বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ পদ্ধতি ফের দেশকে মাছের বাড়তি জোগান এনে দিয়েছে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের সরবরাহ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাড়ছে রফতানি। তবে এ খাতে এখন পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান সামান্যই। এখন সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের আওতায় এসেছে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা।

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫, অথচ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব্লু-ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এ সম্পদ দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষিদের এক অংকের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রকল্প।

মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫-১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এছাড়াও মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।

সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়

হরিনামের মায়াময় আবেদন

ছবি

হাওর অর্থনীতি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

ছবি

ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

বলা, শোনা এবং লেখার অধিকার

ছবি

আলুর দাম ও ভোক্তার ভোগান্তি

ছবি

ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কার কাছে শেখার কি কিছু আছে

ছবি

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী হেমনগর জমিদার বাড়ি

আদিবাসীদের অর্জন

ছবি

ভাষা প্রশ্নে আমাদের আবেগ এবং কর্মপ্রয়াস

ছবি

অরিগ্যানোর উপকারিতা

একাত্তরের গণহত্যার খণ্ডচিত্র

প্রাথমিক চিকিৎসা ও জনসচেতনতা

মানবিক শিল্পবিপ্লব

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

বিমানবন্দরে লকার থেকে সোনা গায়েব

একটি সহজ সুযোগ হাতছাড়া হলো

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস

পরকালই আমাদের একমাত্র ভরসা

ছবি

স্মরণ : মুক্তিযুদ্ধের কলমসৈনিক আগরতলার সাংবাদিক ভূপেন্দ্র দত্ত

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

ছবি

কেমন আছে বিত্তহীন মানুষেরা

আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফিজিওথেরাপি

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মৎস্য খাত : অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা

রেজাউল করিম খোকন

image

মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে

বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ রপ্তানি করে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে, এই অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে।

উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষিঋণ, প্রশিক্ষণ দেয়াসহ সরকার নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী স্মার্ট মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদেশ থেকে মাছের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান আসে, সেগুলোও এ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাতে মাছ উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে অস্বাস্থ্যকর কোন উপাদান প্রবেশ করতে না পারে।

শুধু মাছ উৎপাদন নয় বরং স্বাস্থ্যসম্মত ও খাবার উপযোগী নিরাপদ মাছ উৎপাদন সরকারের লক্ষ্য। আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি। এখন আমাদের লক্ষ্য দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে মাছের ভোক্তাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে মাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সরকার উৎসাহিত করছে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, তাদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ দেয়া হচ্ছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়াসহ সরকার নানারকম সহায়তা প্রদান করছে।

গ্রামাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মিঠা পানি ও বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে।

২০২০ সালে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্র সীমাসহ অন্যত্র যারা মাছ আহরণে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে; যাতে তাদের মনিটরিং এর আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি কোন মৎস্য নৌযান দুর্ঘটনায় পতিত হলে, তাদের অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দূষণের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন কমছে।

চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা হলো সেই চার দেশ। বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে। বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার গবেষণার ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোকে চাষিদের হাতে পৌঁছে দিতে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। জলাশয় ও নদ-নদীর দূষণ কমাতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।

মাছে ভাতে বাঙালি- এটা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ; কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের নদী খাল বিল হাওর-বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ পদ্ধতি ফের দেশকে মাছের বাড়তি জোগান এনে দিয়েছে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের সরবরাহ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাড়ছে রফতানি। তবে এ খাতে এখন পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান সামান্যই। এখন সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের আওতায় এসেছে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা।

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫, অথচ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব্লু-ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এ সম্পদ দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষিদের এক অংকের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রকল্প।

মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫-১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এছাড়াও মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।

সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top