আহমদ খলিল
আগরতলার বিশিষ্ট সাংবাদিক ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আগরতলায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি সাংবাদিক নিবেদিতপ্রাণ হয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর গণহত্যার বিবরণ এবং বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের খবর তাদের পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন; কিন্তু ভুপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক তার চেয়েও বেশি কিছু করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। একাত্তরে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লাগোয়া ত্রিপুরা রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদের মালিক-সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে এই দৈনিক সংবাদ শুধু ত্রিপুরাই নয়, প্রায় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছে দিতে কার্যকর অবদান রেখেছে। সংবাদের এ কর্মকান্ডের পেছনে ছিলেন অকৃত্রিম বাংলাদেশ প্রেমিক ভূপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক। আজ ৯ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুবার্ষিকী। এ দিনে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করি তাকে।
ত্রিপুরার সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃত পুরুষ ক্ষণজন্মা ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশের কুমিল্লার সন্তান। বিভাগপূর্ব সময়ে তার বাবা ত্রিপুরায় গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হন। ফলে তার অন্তরজুড়েই ছিল বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও মমত্ববোধ এবং একই সঙ্গে দায়িত্ববোধও। তিনি জন্মভিটার ঋণ শোধ করেছেন একাত্তরে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় তার শ্রম ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে। বাংলাদেশও তাকে মনে রেখেছে, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। ২০১২ সালে ২০ অক্টোবর ঢাকায় তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু’ মর্যাদা (মরণোত্তর) দিয়ে সম্মানিত করেছে। তার স্বজনরা ঢাকায় এসে সেই সম্মাননা গ্রহণ করেছেন।
একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার পর বাংলাদেশে সব সংবাদপত্রও দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানিরা যে বাংলাদেশে হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তা বাংলাদেশের কোন পত্রিকার প্রকাশ করার মতো অবস্থা ছিল না। তখন বিদেশি পত্রপত্রিকাই ছিল একমাত্র ভরসা। সেই সময় আগরতলার কৃতী সাংবাদিক ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক প্রথম এগিয়ে আসেন। তিনি তার নিজের সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদকে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা এবং পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করতে বাঙালিরা যে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে সেসব খবর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করান।
মুক্তিযুদ্ধের খবর সবার আগে ভারতবাসী বিশেষ করে ত্রিপুরাবাসীর কাছে পৌঁছাতে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রকাশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে রিপোর্টার পাঠানো থেকে শুরু করে ভারতের অন্য এলাকার সংবাদপত্রগুলোর কাছে সেই খবর পাঠানো, ত্রিপুরার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশের পক্ষে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করাসহ তার পক্ষে সম্ভব এমন কোন কাজ নেই, যা তিনি করেননি। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে ভুপেন দত্ত শুধু সাংবাদিকতা করেই সহযোগিতা করেননি, তিনি প্রত্যক্ষভাবে ছুটে গেছেন শরণার্থী শিবিরে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে, হাসপাতালে গেছেন পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে আহতদের দেখতে। তিনি অসংখ্য শরণার্থীকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, অনেককে ওষুধ কিনে দিয়েছেন, খাওয়ার টাকা দিয়েছেন। ভূপেন দত্ত ভৌমিককে নিয়ে এমন অনেক ঘটনা স্বাধীনতার পর খবর হিসেবে পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে দলে দলে মানুষ পালিয়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে ত্রিপুরার স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে বেশি শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। ফলে ভারতের বাংলাদেশ সংলগ্ন অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে বেশি ধকল পোহাতে হয় ত্রিপুরার মানুষকে। সেই সময়ে ত্রিপুরার মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্দিন সম্পর্কে সচতেনতা সৃষ্টি করা, কোথায় শরণার্থী দুর্দশায় আছেন, কোথায় আহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য রক্ত প্রয়োজন- এমন অসংখ্য খবর তিনিই প্রথম তার পত্রিকায় তুলে ধরতেন।
ভারতের যেসব সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগন্য ছিলেন ভূপেন দত্ত ভৌমিক। তার দৈনিক সংবাদ একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। তার অবদান ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]
আহমদ খলিল
শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আগরতলার বিশিষ্ট সাংবাদিক ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আগরতলায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি সাংবাদিক নিবেদিতপ্রাণ হয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর গণহত্যার বিবরণ এবং বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের খবর তাদের পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন; কিন্তু ভুপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক তার চেয়েও বেশি কিছু করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। একাত্তরে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লাগোয়া ত্রিপুরা রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদের মালিক-সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে এই দৈনিক সংবাদ শুধু ত্রিপুরাই নয়, প্রায় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছে দিতে কার্যকর অবদান রেখেছে। সংবাদের এ কর্মকান্ডের পেছনে ছিলেন অকৃত্রিম বাংলাদেশ প্রেমিক ভূপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক। আজ ৯ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুবার্ষিকী। এ দিনে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করি তাকে।
ত্রিপুরার সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃত পুরুষ ক্ষণজন্মা ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশের কুমিল্লার সন্তান। বিভাগপূর্ব সময়ে তার বাবা ত্রিপুরায় গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হন। ফলে তার অন্তরজুড়েই ছিল বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও মমত্ববোধ এবং একই সঙ্গে দায়িত্ববোধও। তিনি জন্মভিটার ঋণ শোধ করেছেন একাত্তরে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় তার শ্রম ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে। বাংলাদেশও তাকে মনে রেখেছে, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। ২০১২ সালে ২০ অক্টোবর ঢাকায় তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু’ মর্যাদা (মরণোত্তর) দিয়ে সম্মানিত করেছে। তার স্বজনরা ঢাকায় এসে সেই সম্মাননা গ্রহণ করেছেন।
একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার পর বাংলাদেশে সব সংবাদপত্রও দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানিরা যে বাংলাদেশে হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তা বাংলাদেশের কোন পত্রিকার প্রকাশ করার মতো অবস্থা ছিল না। তখন বিদেশি পত্রপত্রিকাই ছিল একমাত্র ভরসা। সেই সময় আগরতলার কৃতী সাংবাদিক ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক প্রথম এগিয়ে আসেন। তিনি তার নিজের সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদকে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা এবং পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করতে বাঙালিরা যে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে সেসব খবর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করান।
মুক্তিযুদ্ধের খবর সবার আগে ভারতবাসী বিশেষ করে ত্রিপুরাবাসীর কাছে পৌঁছাতে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রকাশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে রিপোর্টার পাঠানো থেকে শুরু করে ভারতের অন্য এলাকার সংবাদপত্রগুলোর কাছে সেই খবর পাঠানো, ত্রিপুরার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশের পক্ষে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করাসহ তার পক্ষে সম্ভব এমন কোন কাজ নেই, যা তিনি করেননি। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে ভুপেন দত্ত শুধু সাংবাদিকতা করেই সহযোগিতা করেননি, তিনি প্রত্যক্ষভাবে ছুটে গেছেন শরণার্থী শিবিরে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে, হাসপাতালে গেছেন পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে আহতদের দেখতে। তিনি অসংখ্য শরণার্থীকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, অনেককে ওষুধ কিনে দিয়েছেন, খাওয়ার টাকা দিয়েছেন। ভূপেন দত্ত ভৌমিককে নিয়ে এমন অনেক ঘটনা স্বাধীনতার পর খবর হিসেবে পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে দলে দলে মানুষ পালিয়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে ত্রিপুরার স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে বেশি শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। ফলে ভারতের বাংলাদেশ সংলগ্ন অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে বেশি ধকল পোহাতে হয় ত্রিপুরার মানুষকে। সেই সময়ে ত্রিপুরার মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্দিন সম্পর্কে সচতেনতা সৃষ্টি করা, কোথায় শরণার্থী দুর্দশায় আছেন, কোথায় আহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য রক্ত প্রয়োজন- এমন অসংখ্য খবর তিনিই প্রথম তার পত্রিকায় তুলে ধরতেন।
ভারতের যেসব সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগন্য ছিলেন ভূপেন দত্ত ভৌমিক। তার দৈনিক সংবাদ একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। তার অবদান ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]