alt

উপ-সম্পাদকীয়

পরকালই আমাদের একমাত্র ভরসা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ভারতের চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করেছে, দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের যাত্রা শেষে এই মহাকাশযান চাঁদের দক্ষিণাংশে কোন সমস্যা ব্যতিরেকে অবতরণ করল। ভারতের আগে আরও তিনটি দেশের মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করেছে; বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করল। ভারতের নতুন কৃতিত্ব হচ্ছে, চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারাই হলো প্রথম দেশ। ভারত তার প্রথম সূর্যাভিযানও শুরু করেছে; দেশটির প্রথম সূর্য পর্যবেক্ষণ মিশন ‘আদিত্য-এল ১’ সূর্যের বায়ুমন্ডলসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করবে।

এই সূর্যাভিযানে খরচ হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৪০০ কোটি। সূর্যাভিযানেও ভারত জাপান, আমেরিকা এবং জাপানের পর চতুর্থ দেশ। চন্দ্রযান-থ্রির ‘বিক্রম’ নামক ল্যান্ডারটি চাঁদের বুকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর মিশন সেন্টারে বিজ্ঞানীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা অভিনন্দন জানাতে থাকেন, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের বার্তা।

জাতীয় সাফল্যে দেশের মানুষের আনন্দে স্বর্গসুখ রয়েছে। চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতিটি মানুষ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে; রাস্তায় রাস্তায় আতশবাজি ফাটানো ছাড়াও মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়ে যায়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলায় স্পেন নেদারল্যান্ডসকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আমি স্কুল জীবনে কাদা পানিতে ফুটবল খেললেও পরবর্তীতে খেলার প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করিনি। তবুও আমার ছেলে অর্ণব এবং মেয়ে ঐশীর মন রক্ষার্থে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে একটি কলাম লিখেছি। ২০১০ সালে আমি সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে হঠাৎ গাড়ির অসংখ্য হর্ন শুনতে পাই। পশ্চিমের দেশগুলোতে কেউ হর্ন বাজায় না। খেয়াল করলাম, চারিদিকে হর্ন বেজেই চলেছে। অগত্যা একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, স্পেন বিশ্বকাপ জেতার কারণে স্পেন অভিবাসী গাড়ি চালকেরা হর্ন বাজিয়ে বিজয় উদযাপন করছে। যেদিন আমরা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেই ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানকে হারালাম সেদিনে বাঙালি জাতির আনন্দও আমি ঢাকার রাস্তায় দেখেছি।

টাকশালে আমার এককালের সহকর্মী অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জামিল আক্ষেপ করে উল্লেখ করেছেন, ভারত মাত্র ৬০০ কোটি রুপি খরচ করে চাঁদে পৌঁছাতে পারলে বাংলাদেশ পারে না কেন? তার বক্তব্য, সরকার দেশের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠাতেও আমাদের ফ্রান্সের সহায়তা নিতে হয়েছে; অথচ ভারত নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৫০টি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর অনেক বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানির কর্ণধার ভারতীয়।

জামিলের মাথায় সম্ভবত মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক গুরু মারাঠি গোপালকৃষ্ণ গোখলের কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। গোখলে বলেছিলেন, বাঙালি যা আজ ভাবে, বাকি ভারত ভাবে আগামীকাল। কিন্তু গোখলের কথা সত্য হয়নি। বিজ্ঞানের জগতে বাঙালির অবদান খুব বেশি নয়। বাঙালি সমাজে হাতেগোনা কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন; তাদের মধ্যে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আতাউল করিম, ড. জামালউদ্দিন, ড. মাকসুদুল আলম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। আরও কিছু বাঙালি দেশে নয়, বিদেশে বসে গবেষণা করে বিভিন্ন আবিষ্কার করেছেন; তারা বাঙালি হলেও বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমাদের গ্রামেগঞ্জে অল্প শিক্ষিত লোকদের নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সংবাদ শুনি, কিন্তু পৃষ্ঠপোষক না থাকায় সেগুলো আপনাআপনি হারিয়ে যায়। অন্যদিকে প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অবদান প্রায় শূন্য। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থায় ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই সব কাজের প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান নিতে হয়েছে বিদেশ থেকে, আমাদের লোকেরা শুধু কায়িক শ্রম দিয়েছে। কেন আমরা পারি না?

আসলে আমাদের পারার কোন কারণও নেই। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, উপচার্যরা নিয়োগ পান দলীয় অনুগত্যের ভিত্তিতে; আহমদ ছফার কথা মেনে নিয়ে বলতে হয়, উপাচার্য গরু লালনপালনে যত বেশি আগ্রহী বৈজ্ঞানিক গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে তত বেশি নিষ্কর্মক। অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের তুষ্টি সাধনে একজন উপাচার্যকে যেভাবে নতজানু হয়ে থাকতে হয় তাতে মেধার চর্চা করার আর সুযোগ থাকে না। অধিকাংশ শিক্ষক সময়মত ক্লাসে যান না, হালনাগাদ তথ্যে সমৃদ্ধ হওয়ার গরজ বোধও করেন না। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতিতে এত বেশি সম্পৃক্ত যে, অধিকাংশ ছাত্র অন্যের নোট পড়ে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসে।

আজকাল আরেকটি রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে, কারণ এই চাকরি স্বর্গের চেয়েও বেশি লোভনীয়। এই পদে ক্ষমতা এবং দাপট দুটোই সীমাহীন। তাই মানসিক বৈকল্য না থাকলে কোন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এখন আর শিক্ষক হতে চায় না। বিজ্ঞানের বর্তমান জগতে মুসলমানের অবদান না থাকলেও আমরা যারা বাঙালি মুসলমান তাদের অহঙ্কার আকাশচুম্বি। আমরা মনে করি, পৃথিবীর সব আবিষ্কারের সূত্র আমাদের ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, ওখান থেকে নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানরা সব আবিষ্কার করছে।

আমরা এত অথর্ব মুসলমান যে, এই কথার মধ্যে যে অফুরন্ত লজ্জা লুকায়িত রয়েছে তা-ও বুঝি না। আমাদের ধর্মগ্রন্থ গবেষণা করার ক্ষমতা আমাদের নেই, এই ক্ষমতা আছে ইহুদি-খ্রিস্টানদের। ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৯৯টি; ভিন্ন আদলের আরও অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদ্রাসার ছাত্র। এদের অনেকে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু এদের অধিকাংশ ওয়াজ করে টাকা কামাই করতে অভ্যস্ত, এরা কোরআন নিয়ে কোন গবেষণা করেন না, কোরআনে বিধৃত বিজ্ঞানের সূত্রগুলো তাদের নজরে পড়ে না, তাদের নজরে পড়ে নারীর দেহতত্ত্ব, হুরের রূপ, নারীর চালচলন ও পোশাকের বেলাল্লাপনা।

এক সময় মুসলিম সমাজেও অনেক বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল, তাদের জ্ঞানের বদৌলতে পশ্চিমের লোকেরা বিজ্ঞানে পান্ডিত্য লাভ করেছিল; কিন্তু ধর্মান্ধ মুসলমানেরা মুসলিম বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে দেশছাড়া করেছে, নির্যাতন করে বিজ্ঞান চর্চা থেকে বিরত রেখেছে। এমন অবদমন না থাকলে আজ মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান মানবজাতি অবনত চিত্তে স্মরণ করত। পাকিস্তানের মুহাম্মদ আবদুস সালামের কবরের এপিটাফে লেখা ছিল, ‘ফার্স্ট মুসলিম নোবেল লরিয়েট’; কিন্তু তার মৃত্যুর দুই বছর পরে এই এপিটাফটিও রেহাই পায়নি, তিনি কাদিয়ানি ছিলেন বিধায় এপিটাফ থেকে ‘মুসলমান’ শব্দটি মুছে দেয়া হয়েছে। শুধু মুসলমানদের দায়ী করে অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

যাদের মেধায় ভারত চাঁদে রকেট পাঠালো তাদের চেয়ারম্যান এস সোমনাথের দাবি, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদেই ছিল বিজ্ঞানের সমস্ত সূত্র, পশ্চিমি দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা তা খুঁজে পান অনেক পরে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন ইসরোর চেয়ারম্যানের দাবি, বেদের মৌলিক তত্ত্বগুলো থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। অথচ তিনি একজন মহাকাশ প্রকৌশলী এবং রকেট প্রযুক্তিবিদ। চাকরিজীবনে তিনি কখনো বেদের চর্চা করেছেন বলে জানা যায় না, বেদ চর্চা করে তিনি চাঁদে রকেট পাঠিয়েছেন তা-ও কিন্তু বলেননি। এদের এমন চতুর বক্তব্যের কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন; কারণ জনগণ এমন কথায় উৎফুল্ল হয়, নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবার উপকরণ খুঁজে পায়।

ধর্মগ্রন্থ বেদ এসেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে, আর কোরআন এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। ইহুদি এবং খ্রিস্টানদেরও ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। পৃথিবীতে ৪২০০টি ধর্ম থাকলেও সব ধর্মের গ্রন্থ নেই। প্রত্যেকে তার নিজ ধর্মগ্রন্থকে যাবতীয় বিজ্ঞানের সূতিকাগার মনে করে কিনা তা আমার জানা নেই। দুঃখের বিষয় হলো- ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের সূতিকাগার বলা হলেও ধার্মিকরা তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেন না। চন্দ্রযান-থ্রির সাফল্য কামনায় তাই গোটা ভারত মন্দির, মসজিদ, দরগায় প্রার্থনা করেছে।

রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে একটা উক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করে; তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রদের মানসিকতা নিয়ে একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন- ‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল, তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’

আমরা মনে করি, পৃথিবীর সব আবিষ্কারের সূত্র আমাদের ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, ওখান থেকে নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানরা সব আবিষ্কার করছে

তাই বোধহয় ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী হয়েও অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছেন। তিনি যদি মেকানিক্যাল ও এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার না হতেন, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে প্রযুক্তি নিয়ে লেখাপড়া না করতেন, শুধু বেদ চর্চা করে চন্দ্রাভিযান সফল করতেন, তাহলে তার কথা এক বাক্যে মেনে নেয়া যেত। তিনি ইসরোর অন্যান্য বিজ্ঞানী সহকর্মীদের নিয়ে এই সফলতা অর্জন করেছেন; তারা কেউই বেদ নিয়ে গবেষণা করার কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। বেদই যদি বিজ্ঞানের সূতিকাগার হয়, তাহলে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে এস সোমনাথকে সরিয়ে বেদ বিশেষজ্ঞ কাউকে বসানো হলে ভারতের সফলতা আরও আগেই আসত। গো-মূত্র ও গোবর গবেষণায় মত্ত থেকেও ভারত বিজ্ঞান ভোলেনি, ভুললে চাঁদে পাড়ি দিতে পারত না। গো-মূত্রের গবেষণা হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তা হতেই থাকবে।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার তীব্র বাসনায় মত্ত মুসলমানেরা শুধু উটের মূত্রের গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত, তারা খুশি হয় নব্য মুসলমানের সন্ধান পেলে, তারা খুশি হয় লন্ডনের মুসলমান মেয়রকে নিয়ে, তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয় হিজাব পরা মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের নিয়ে। এটা তো লন্ডন আর ওয়াশিংটনের উদারতা, মুসলমানদের কোন কৃতিত্ব নয়। জনসংখ্যার বিচারে যারা এক নম্বর হতে চান তারা ভুলে যান যে, আগের দিনে সংখ্যা দিয়ে মুসলমান দিগ্বিজয় করেনি, প্রতিপক্ষের সৈন্যের চেয়ে মুসলিম সেনা সংখ্যা সব সময় কমই ছিল, কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি ও রণকৌশলে মুসলমানরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সংখ্যা বাড়ার পর মুসলমানদের কোন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব নেই। সারা পৃথিবীতে এখন ইহুদির সংখ্যা মাত্র দেড় কোটি, ইসরায়েলে মাত্র এক কোটি।

মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো মুসলিম দেশ একজোট হয়েও ইসরাইলের সঙ্গে পারছে না; কারণ সংখ্যায় কম হলেও বিদ্যা-বুদ্ধিতে তারা শ্রেষ্ঠ। ইহকালে টিকে থাকা তাদের মূল লক্ষ্য, আর মুসলমানদের লক্ষ্য পরকালের বেহেশত। আমাদের দ্বারা বিজ্ঞান চর্চা হবে না, কারণ আমরা গবেষণা না করে ওয়াজে ব্যস্ত; ওয়াজে আছে শুধু পরকালের কথা। পরকালের সুখ-শান্তি প্রাপ্তির একমাত্র পথ ধর্ম চর্চা, বিজ্ঞান নয়। তাই বলে ইহকালের সুখ-শান্তি কিন্তু আমরা পরিত্যাগ করিনি; ইহকালের সুখ-শান্তি উপভোগে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইহুদিদের আবিষ্কার কিনে নিচ্ছি। লজ্জাশরম থাকলে অন্যান্য মুসলিম দেশও ইরানের মতো বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করত; অবশ্য ইরানের শিয়ারা পাকিস্তানের আবদুস সালামের মতো অনেক আলেমের দৃষ্টিতে মুসলিম নয়। পরকালই আমাদের একমাত্র ভরসা, ইহকালে না পারলেও পরকালে ইনশাল্লাহ পারব। তাই মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়াচ্ছি, স্কুলের সংখ্যা কমাচ্ছি, বিজ্ঞান বিমুখতাকে ক্রমাগত উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই মনে হয়, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ভাষায় আমাদের দর্জিগিরি করেই জীবনধারণ করতে হবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

সম্ভাবনাময় ইকোট্যুরিজম

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

হিন্দু কন্যা সন্তানদের সমানাধিকার প্রসঙ্গে

ছবি

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

ভরত থেকে ভারতবর্ষ অতঃপর হিন্দুস্তান ইন্ডিয়া হয়ে ভারত

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

রপ্তানি বহুমুখীকরণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত

আদিবাসীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা

ছবি

ডেঙ্গু রোধে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

ছবি

পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়

হরিনামের মায়াময় আবেদন

ছবি

হাওর অর্থনীতি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

ছবি

ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

বলা, শোনা এবং লেখার অধিকার

ছবি

আলুর দাম ও ভোক্তার ভোগান্তি

ছবি

ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কার কাছে শেখার কি কিছু আছে

ছবি

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী হেমনগর জমিদার বাড়ি

আদিবাসীদের অর্জন

ছবি

ভাষা প্রশ্নে আমাদের আবেগ এবং কর্মপ্রয়াস

ছবি

অরিগ্যানোর উপকারিতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পরকালই আমাদের একমাত্র ভরসা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ভারতের চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করেছে, দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের যাত্রা শেষে এই মহাকাশযান চাঁদের দক্ষিণাংশে কোন সমস্যা ব্যতিরেকে অবতরণ করল। ভারতের আগে আরও তিনটি দেশের মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করেছে; বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করল। ভারতের নতুন কৃতিত্ব হচ্ছে, চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারাই হলো প্রথম দেশ। ভারত তার প্রথম সূর্যাভিযানও শুরু করেছে; দেশটির প্রথম সূর্য পর্যবেক্ষণ মিশন ‘আদিত্য-এল ১’ সূর্যের বায়ুমন্ডলসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করবে।

এই সূর্যাভিযানে খরচ হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৪০০ কোটি। সূর্যাভিযানেও ভারত জাপান, আমেরিকা এবং জাপানের পর চতুর্থ দেশ। চন্দ্রযান-থ্রির ‘বিক্রম’ নামক ল্যান্ডারটি চাঁদের বুকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর মিশন সেন্টারে বিজ্ঞানীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা অভিনন্দন জানাতে থাকেন, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের বার্তা।

জাতীয় সাফল্যে দেশের মানুষের আনন্দে স্বর্গসুখ রয়েছে। চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতিটি মানুষ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে; রাস্তায় রাস্তায় আতশবাজি ফাটানো ছাড়াও মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়ে যায়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলায় স্পেন নেদারল্যান্ডসকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আমি স্কুল জীবনে কাদা পানিতে ফুটবল খেললেও পরবর্তীতে খেলার প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করিনি। তবুও আমার ছেলে অর্ণব এবং মেয়ে ঐশীর মন রক্ষার্থে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে একটি কলাম লিখেছি। ২০১০ সালে আমি সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে হঠাৎ গাড়ির অসংখ্য হর্ন শুনতে পাই। পশ্চিমের দেশগুলোতে কেউ হর্ন বাজায় না। খেয়াল করলাম, চারিদিকে হর্ন বেজেই চলেছে। অগত্যা একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, স্পেন বিশ্বকাপ জেতার কারণে স্পেন অভিবাসী গাড়ি চালকেরা হর্ন বাজিয়ে বিজয় উদযাপন করছে। যেদিন আমরা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেই ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানকে হারালাম সেদিনে বাঙালি জাতির আনন্দও আমি ঢাকার রাস্তায় দেখেছি।

টাকশালে আমার এককালের সহকর্মী অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জামিল আক্ষেপ করে উল্লেখ করেছেন, ভারত মাত্র ৬০০ কোটি রুপি খরচ করে চাঁদে পৌঁছাতে পারলে বাংলাদেশ পারে না কেন? তার বক্তব্য, সরকার দেশের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠাতেও আমাদের ফ্রান্সের সহায়তা নিতে হয়েছে; অথচ ভারত নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৫০টি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর অনেক বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানির কর্ণধার ভারতীয়।

জামিলের মাথায় সম্ভবত মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক গুরু মারাঠি গোপালকৃষ্ণ গোখলের কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। গোখলে বলেছিলেন, বাঙালি যা আজ ভাবে, বাকি ভারত ভাবে আগামীকাল। কিন্তু গোখলের কথা সত্য হয়নি। বিজ্ঞানের জগতে বাঙালির অবদান খুব বেশি নয়। বাঙালি সমাজে হাতেগোনা কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন; তাদের মধ্যে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আতাউল করিম, ড. জামালউদ্দিন, ড. মাকসুদুল আলম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। আরও কিছু বাঙালি দেশে নয়, বিদেশে বসে গবেষণা করে বিভিন্ন আবিষ্কার করেছেন; তারা বাঙালি হলেও বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমাদের গ্রামেগঞ্জে অল্প শিক্ষিত লোকদের নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সংবাদ শুনি, কিন্তু পৃষ্ঠপোষক না থাকায় সেগুলো আপনাআপনি হারিয়ে যায়। অন্যদিকে প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অবদান প্রায় শূন্য। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থায় ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই সব কাজের প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান নিতে হয়েছে বিদেশ থেকে, আমাদের লোকেরা শুধু কায়িক শ্রম দিয়েছে। কেন আমরা পারি না?

আসলে আমাদের পারার কোন কারণও নেই। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, উপচার্যরা নিয়োগ পান দলীয় অনুগত্যের ভিত্তিতে; আহমদ ছফার কথা মেনে নিয়ে বলতে হয়, উপাচার্য গরু লালনপালনে যত বেশি আগ্রহী বৈজ্ঞানিক গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে তত বেশি নিষ্কর্মক। অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের তুষ্টি সাধনে একজন উপাচার্যকে যেভাবে নতজানু হয়ে থাকতে হয় তাতে মেধার চর্চা করার আর সুযোগ থাকে না। অধিকাংশ শিক্ষক সময়মত ক্লাসে যান না, হালনাগাদ তথ্যে সমৃদ্ধ হওয়ার গরজ বোধও করেন না। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতিতে এত বেশি সম্পৃক্ত যে, অধিকাংশ ছাত্র অন্যের নোট পড়ে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসে।

আজকাল আরেকটি রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে, কারণ এই চাকরি স্বর্গের চেয়েও বেশি লোভনীয়। এই পদে ক্ষমতা এবং দাপট দুটোই সীমাহীন। তাই মানসিক বৈকল্য না থাকলে কোন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এখন আর শিক্ষক হতে চায় না। বিজ্ঞানের বর্তমান জগতে মুসলমানের অবদান না থাকলেও আমরা যারা বাঙালি মুসলমান তাদের অহঙ্কার আকাশচুম্বি। আমরা মনে করি, পৃথিবীর সব আবিষ্কারের সূত্র আমাদের ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, ওখান থেকে নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানরা সব আবিষ্কার করছে।

আমরা এত অথর্ব মুসলমান যে, এই কথার মধ্যে যে অফুরন্ত লজ্জা লুকায়িত রয়েছে তা-ও বুঝি না। আমাদের ধর্মগ্রন্থ গবেষণা করার ক্ষমতা আমাদের নেই, এই ক্ষমতা আছে ইহুদি-খ্রিস্টানদের। ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৯৯টি; ভিন্ন আদলের আরও অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদ্রাসার ছাত্র। এদের অনেকে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু এদের অধিকাংশ ওয়াজ করে টাকা কামাই করতে অভ্যস্ত, এরা কোরআন নিয়ে কোন গবেষণা করেন না, কোরআনে বিধৃত বিজ্ঞানের সূত্রগুলো তাদের নজরে পড়ে না, তাদের নজরে পড়ে নারীর দেহতত্ত্ব, হুরের রূপ, নারীর চালচলন ও পোশাকের বেলাল্লাপনা।

এক সময় মুসলিম সমাজেও অনেক বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল, তাদের জ্ঞানের বদৌলতে পশ্চিমের লোকেরা বিজ্ঞানে পান্ডিত্য লাভ করেছিল; কিন্তু ধর্মান্ধ মুসলমানেরা মুসলিম বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে দেশছাড়া করেছে, নির্যাতন করে বিজ্ঞান চর্চা থেকে বিরত রেখেছে। এমন অবদমন না থাকলে আজ মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান মানবজাতি অবনত চিত্তে স্মরণ করত। পাকিস্তানের মুহাম্মদ আবদুস সালামের কবরের এপিটাফে লেখা ছিল, ‘ফার্স্ট মুসলিম নোবেল লরিয়েট’; কিন্তু তার মৃত্যুর দুই বছর পরে এই এপিটাফটিও রেহাই পায়নি, তিনি কাদিয়ানি ছিলেন বিধায় এপিটাফ থেকে ‘মুসলমান’ শব্দটি মুছে দেয়া হয়েছে। শুধু মুসলমানদের দায়ী করে অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

যাদের মেধায় ভারত চাঁদে রকেট পাঠালো তাদের চেয়ারম্যান এস সোমনাথের দাবি, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদেই ছিল বিজ্ঞানের সমস্ত সূত্র, পশ্চিমি দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা তা খুঁজে পান অনেক পরে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন ইসরোর চেয়ারম্যানের দাবি, বেদের মৌলিক তত্ত্বগুলো থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। অথচ তিনি একজন মহাকাশ প্রকৌশলী এবং রকেট প্রযুক্তিবিদ। চাকরিজীবনে তিনি কখনো বেদের চর্চা করেছেন বলে জানা যায় না, বেদ চর্চা করে তিনি চাঁদে রকেট পাঠিয়েছেন তা-ও কিন্তু বলেননি। এদের এমন চতুর বক্তব্যের কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন; কারণ জনগণ এমন কথায় উৎফুল্ল হয়, নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবার উপকরণ খুঁজে পায়।

ধর্মগ্রন্থ বেদ এসেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে, আর কোরআন এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। ইহুদি এবং খ্রিস্টানদেরও ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। পৃথিবীতে ৪২০০টি ধর্ম থাকলেও সব ধর্মের গ্রন্থ নেই। প্রত্যেকে তার নিজ ধর্মগ্রন্থকে যাবতীয় বিজ্ঞানের সূতিকাগার মনে করে কিনা তা আমার জানা নেই। দুঃখের বিষয় হলো- ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের সূতিকাগার বলা হলেও ধার্মিকরা তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেন না। চন্দ্রযান-থ্রির সাফল্য কামনায় তাই গোটা ভারত মন্দির, মসজিদ, দরগায় প্রার্থনা করেছে।

রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে একটা উক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করে; তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রদের মানসিকতা নিয়ে একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন- ‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল, তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’

আমরা মনে করি, পৃথিবীর সব আবিষ্কারের সূত্র আমাদের ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, ওখান থেকে নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানরা সব আবিষ্কার করছে

তাই বোধহয় ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী হয়েও অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছেন। তিনি যদি মেকানিক্যাল ও এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার না হতেন, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে প্রযুক্তি নিয়ে লেখাপড়া না করতেন, শুধু বেদ চর্চা করে চন্দ্রাভিযান সফল করতেন, তাহলে তার কথা এক বাক্যে মেনে নেয়া যেত। তিনি ইসরোর অন্যান্য বিজ্ঞানী সহকর্মীদের নিয়ে এই সফলতা অর্জন করেছেন; তারা কেউই বেদ নিয়ে গবেষণা করার কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। বেদই যদি বিজ্ঞানের সূতিকাগার হয়, তাহলে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে এস সোমনাথকে সরিয়ে বেদ বিশেষজ্ঞ কাউকে বসানো হলে ভারতের সফলতা আরও আগেই আসত। গো-মূত্র ও গোবর গবেষণায় মত্ত থেকেও ভারত বিজ্ঞান ভোলেনি, ভুললে চাঁদে পাড়ি দিতে পারত না। গো-মূত্রের গবেষণা হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তা হতেই থাকবে।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার তীব্র বাসনায় মত্ত মুসলমানেরা শুধু উটের মূত্রের গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত, তারা খুশি হয় নব্য মুসলমানের সন্ধান পেলে, তারা খুশি হয় লন্ডনের মুসলমান মেয়রকে নিয়ে, তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয় হিজাব পরা মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের নিয়ে। এটা তো লন্ডন আর ওয়াশিংটনের উদারতা, মুসলমানদের কোন কৃতিত্ব নয়। জনসংখ্যার বিচারে যারা এক নম্বর হতে চান তারা ভুলে যান যে, আগের দিনে সংখ্যা দিয়ে মুসলমান দিগ্বিজয় করেনি, প্রতিপক্ষের সৈন্যের চেয়ে মুসলিম সেনা সংখ্যা সব সময় কমই ছিল, কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি ও রণকৌশলে মুসলমানরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সংখ্যা বাড়ার পর মুসলমানদের কোন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব নেই। সারা পৃথিবীতে এখন ইহুদির সংখ্যা মাত্র দেড় কোটি, ইসরায়েলে মাত্র এক কোটি।

মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো মুসলিম দেশ একজোট হয়েও ইসরাইলের সঙ্গে পারছে না; কারণ সংখ্যায় কম হলেও বিদ্যা-বুদ্ধিতে তারা শ্রেষ্ঠ। ইহকালে টিকে থাকা তাদের মূল লক্ষ্য, আর মুসলমানদের লক্ষ্য পরকালের বেহেশত। আমাদের দ্বারা বিজ্ঞান চর্চা হবে না, কারণ আমরা গবেষণা না করে ওয়াজে ব্যস্ত; ওয়াজে আছে শুধু পরকালের কথা। পরকালের সুখ-শান্তি প্রাপ্তির একমাত্র পথ ধর্ম চর্চা, বিজ্ঞান নয়। তাই বলে ইহকালের সুখ-শান্তি কিন্তু আমরা পরিত্যাগ করিনি; ইহকালের সুখ-শান্তি উপভোগে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইহুদিদের আবিষ্কার কিনে নিচ্ছি। লজ্জাশরম থাকলে অন্যান্য মুসলিম দেশও ইরানের মতো বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করত; অবশ্য ইরানের শিয়ারা পাকিস্তানের আবদুস সালামের মতো অনেক আলেমের দৃষ্টিতে মুসলিম নয়। পরকালই আমাদের একমাত্র ভরসা, ইহকালে না পারলেও পরকালে ইনশাল্লাহ পারব। তাই মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়াচ্ছি, স্কুলের সংখ্যা কমাচ্ছি, বিজ্ঞান বিমুখতাকে ক্রমাগত উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই মনে হয়, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ভাষায় আমাদের দর্জিগিরি করেই জীবনধারণ করতে হবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top