alt

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

: শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

অন্যদিকে সবুজ, রবি, গোলাম হায়দার এবং সফিকুর রহমানকে ধরে ফেলে শত্রুসেনারা প্রথমে গোলাম হায়দারকে হত্যা করে এবং বাকিদের দখলদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। একই জায়গা থেকে ছয়জন নিরস্ত্র বাঙালিকেও তারা ধরে নিয়ে আসে। সবুজ, রবি ও সফিকুর রহমানের সঙ্গে এ ছয়জনকেও হত্যা করে মাইজদী জেনারেল হাসপাতাল ভবনের পিছন পাশের পূর্ব-উত্তর কোণে বিল্ডিং এর পেছনে গণকবর দেয়। একই তারিখে খানসেনারা নগেন্দ্র সুর উকিল (রায় বাহাদুর) ও মানিক লাল চৌধুরীসহ আরও ১৩ জনকে ধরে নিয়ে আসে এবং গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়।

দমদমা দীঘিরপাড়ের গণহত্যা : মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নোয়াখালী জেলায় খানসেনারা প্রবেশ করার পর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা ও নির্যাতন চালাতে থাকে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জের দমদমা দীঘির পাড়ের গণহত্যা ছিল অন্যতম। ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বিজয়নগর এলাকায় ঢুকে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, ৩০-৪০ জনকে ধরে এনে দমদমা দীঘির পাড়ে হত্যা করে। এদের মধ্যে শামছুল হক, হায়দার আলী, মোহাম্মদ উল্যা, বাচ্চু মিয়া, মো. আব্দুল আলী, আব্দুল বারেক ও ছোলাইমান প্রমুখ গণহত্যার শিকার হন।

শহীদনগর গণহত্যা : জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া অন্তত ৩৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যাসহ শত শত মানুষকে আহত করে হানাদার ও স্থানীয় রাজাকার-আলবদররা।

একই দিনে বারইপটল, বাঘআছড়া, মেদুর ও ফুলদহের পাড়া গ্রামে অন্তত ৬৪ জন স্বাধীনতাকামী গ্রামবাসী শহীদ হওয়ায় তাদের সম্মানে সম্মিলিতভাবে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদনগর’। বর্তমান প্রজন্মকে এই লোমহর্ষক গণহত্যার ইতিহাস জানানোর জন্য এখানে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এসব গ্রাম। সরিষাবাড়ীর সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত পিংনা ইউনিয়নের পশ্চিমে প্রবহমান যমুনা নদী। আর এই পিংনা ইউনিয়নেই অবস্থিত জগন্নাথগঞ্জ ফেরিঘাট। এখান থেকে স্টিমারযোগে সিরাজগঞ্জে যাতায়াত করা যায়। এখানকার অধিকাংশ এলাকাই নিম্নাঞ্চল। বর্ষাকালে পানিতে উৎপাদনক্ষম আমন ধানই এখানকার একমাত্র অর্থকরী ফসল। গ্রামগুলো নদী ও বিলের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী নদীপথকে এড়িয়ে চলতো বলে মুক্তিযুদ্ধকালীন এলাকাটিকে মুক্তাঞ্চল ও নিরাপদ বিবেচনা করে বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত প্রায় ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে অবস্থান নিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা এলাকার আলিয়া মাদ্রাসায় ঘাঁটি স্থাপন করে হত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করত। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরপরাধ মানুষকে ধরে মাদ্রাসায় এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিত। তাছাড়াও জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাছাউনিতেও বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগণকে ধরে এনে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দিত। সরিষাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘শহীদনগর গণহত্যা’ অন্যতম।

সকাল ১০-১১টা। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে সকালের নাস্তা তৈরির আয়োজন চলছে। বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারাও নাস্তা খাওয়ায় ব্যস্ত। একজন রাজাকারের মাধ্যমে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর জানতে পেরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট সেনাছাউনি থেকে এক দল পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার খুব অল্প সময়ের মধ্যে এসব গ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে অনেকেই শহীদ হন। অনেক গ্রামবাসী দৌড়ে ঝোপজঙ্গলে, অনেকে সাঁতার কেটে ও নৌকাযোগে নদী পার হয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নেন। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও ধানক্ষেতে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ধানক্ষেত ঘেরাও করে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করতে থাকে।

গণহত্যা সংঘটন শেষে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়গ্রহণকারী গ্রামবাসী এসে এত লাশ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন। চারদিকে চলতে থাকে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। এতগুলো লাশ কিভাবে তারা দাফন করবেন, কোথায় পাবেন কাফনের কাপড়। অবশেষে পুরনো কাপড় দিয়ে কোনোমতে শহীদদের শরীর আবৃত করে এক একটি গর্তে ৪-৫ জন করে সমাহিত করা হয়। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। গণহত্যার সংবাদ পেয়ে তাদের আত্মীয়স্বজন এসেও লাশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান, কারণ ততদিনে লাশগুলো পচে গলে বিকৃত হয়ে গেছে, আবার অনেক লাশ শিয়াল আর কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

শহীদনগর গণহত্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা অন্যান্য এলাকার হওয়ায় তাদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- খন্দকার নুরুল ইসলাম, খন্দকার নুরুল আমিন, হাসমত আলী, সফুর আলী, মসলিম উদ্দিন, সেকান্দার আলী, জামাত আলী, আনার উদ্দিন, মনসের আলী, সমেশ উদ্দিন, কাঙালিয়া, দুদু মন্ডল, শামসুল হক, মতিয়ার রহমান দুদু, মমতাজ আলী, জব্বার আলী, বাদশা, সুনীল চন্দ্র বিশ্বাস, যতীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইন্দ্রবালা, প্রিয়বালা অধিকারী, দুলু শেখ, তোফাজ্জল হোসেন, জসিম উদ্দিন, হাবিবুর রহমান কুতুব, কোরবান আলী, আবুল হোসেন, নরেশ চন্দ্র বিশ্বাস, দিলীপ চন্দ্র অধিকারী, বাহার উদ্দিন, হাফিজুর রহমান, জহুরুল ইসলাম, আবদুল হালিম, বাবু খাঁ, আশরাফ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।

গজালিয়া গেট গণহত্যা : গজালিয়া গেটের অবস্থান হলো খুলনার বাটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুরখালী ইউনিয়ন ছিল রাজাকার অধ্যুষিত। আবার এই সুরখালী গ্রামেই ছিলেন আবদুল হামিদ সরদার নামক একজন বাম আন্দোলন কর্মী। বিস্ফোরক তৈরিতে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। খুলনায় অসহযোগ আন্দোলন ও পাকিস্তানি সেনাদের প্রাথমিক প্রতিরোধে যেসব বোমা ও বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছিল, তার অনেকগুলো এই হামিদ তৈরি করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন স্থানীয় রাজাকারদের টার্গেট। কিন্তু অধিকাংশ সময় আত্মগোপনে থাকায় রাজাকাররা তার নাগাল পেতো না। (চলবে)

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

অন্যদিকে সবুজ, রবি, গোলাম হায়দার এবং সফিকুর রহমানকে ধরে ফেলে শত্রুসেনারা প্রথমে গোলাম হায়দারকে হত্যা করে এবং বাকিদের দখলদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। একই জায়গা থেকে ছয়জন নিরস্ত্র বাঙালিকেও তারা ধরে নিয়ে আসে। সবুজ, রবি ও সফিকুর রহমানের সঙ্গে এ ছয়জনকেও হত্যা করে মাইজদী জেনারেল হাসপাতাল ভবনের পিছন পাশের পূর্ব-উত্তর কোণে বিল্ডিং এর পেছনে গণকবর দেয়। একই তারিখে খানসেনারা নগেন্দ্র সুর উকিল (রায় বাহাদুর) ও মানিক লাল চৌধুরীসহ আরও ১৩ জনকে ধরে নিয়ে আসে এবং গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়।

দমদমা দীঘিরপাড়ের গণহত্যা : মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নোয়াখালী জেলায় খানসেনারা প্রবেশ করার পর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা ও নির্যাতন চালাতে থাকে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জের দমদমা দীঘির পাড়ের গণহত্যা ছিল অন্যতম। ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বিজয়নগর এলাকায় ঢুকে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, ৩০-৪০ জনকে ধরে এনে দমদমা দীঘির পাড়ে হত্যা করে। এদের মধ্যে শামছুল হক, হায়দার আলী, মোহাম্মদ উল্যা, বাচ্চু মিয়া, মো. আব্দুল আলী, আব্দুল বারেক ও ছোলাইমান প্রমুখ গণহত্যার শিকার হন।

শহীদনগর গণহত্যা : জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া অন্তত ৩৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যাসহ শত শত মানুষকে আহত করে হানাদার ও স্থানীয় রাজাকার-আলবদররা।

একই দিনে বারইপটল, বাঘআছড়া, মেদুর ও ফুলদহের পাড়া গ্রামে অন্তত ৬৪ জন স্বাধীনতাকামী গ্রামবাসী শহীদ হওয়ায় তাদের সম্মানে সম্মিলিতভাবে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদনগর’। বর্তমান প্রজন্মকে এই লোমহর্ষক গণহত্যার ইতিহাস জানানোর জন্য এখানে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এসব গ্রাম। সরিষাবাড়ীর সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত পিংনা ইউনিয়নের পশ্চিমে প্রবহমান যমুনা নদী। আর এই পিংনা ইউনিয়নেই অবস্থিত জগন্নাথগঞ্জ ফেরিঘাট। এখান থেকে স্টিমারযোগে সিরাজগঞ্জে যাতায়াত করা যায়। এখানকার অধিকাংশ এলাকাই নিম্নাঞ্চল। বর্ষাকালে পানিতে উৎপাদনক্ষম আমন ধানই এখানকার একমাত্র অর্থকরী ফসল। গ্রামগুলো নদী ও বিলের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী নদীপথকে এড়িয়ে চলতো বলে মুক্তিযুদ্ধকালীন এলাকাটিকে মুক্তাঞ্চল ও নিরাপদ বিবেচনা করে বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত প্রায় ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে অবস্থান নিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা এলাকার আলিয়া মাদ্রাসায় ঘাঁটি স্থাপন করে হত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করত। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরপরাধ মানুষকে ধরে মাদ্রাসায় এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিত। তাছাড়াও জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাছাউনিতেও বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগণকে ধরে এনে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দিত। সরিষাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘শহীদনগর গণহত্যা’ অন্যতম।

সকাল ১০-১১টা। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে সকালের নাস্তা তৈরির আয়োজন চলছে। বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারাও নাস্তা খাওয়ায় ব্যস্ত। একজন রাজাকারের মাধ্যমে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর জানতে পেরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট সেনাছাউনি থেকে এক দল পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার খুব অল্প সময়ের মধ্যে এসব গ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে অনেকেই শহীদ হন। অনেক গ্রামবাসী দৌড়ে ঝোপজঙ্গলে, অনেকে সাঁতার কেটে ও নৌকাযোগে নদী পার হয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নেন। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও ধানক্ষেতে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ধানক্ষেত ঘেরাও করে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করতে থাকে।

গণহত্যা সংঘটন শেষে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়গ্রহণকারী গ্রামবাসী এসে এত লাশ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন। চারদিকে চলতে থাকে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। এতগুলো লাশ কিভাবে তারা দাফন করবেন, কোথায় পাবেন কাফনের কাপড়। অবশেষে পুরনো কাপড় দিয়ে কোনোমতে শহীদদের শরীর আবৃত করে এক একটি গর্তে ৪-৫ জন করে সমাহিত করা হয়। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। গণহত্যার সংবাদ পেয়ে তাদের আত্মীয়স্বজন এসেও লাশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান, কারণ ততদিনে লাশগুলো পচে গলে বিকৃত হয়ে গেছে, আবার অনেক লাশ শিয়াল আর কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

শহীদনগর গণহত্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা অন্যান্য এলাকার হওয়ায় তাদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- খন্দকার নুরুল ইসলাম, খন্দকার নুরুল আমিন, হাসমত আলী, সফুর আলী, মসলিম উদ্দিন, সেকান্দার আলী, জামাত আলী, আনার উদ্দিন, মনসের আলী, সমেশ উদ্দিন, কাঙালিয়া, দুদু মন্ডল, শামসুল হক, মতিয়ার রহমান দুদু, মমতাজ আলী, জব্বার আলী, বাদশা, সুনীল চন্দ্র বিশ্বাস, যতীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইন্দ্রবালা, প্রিয়বালা অধিকারী, দুলু শেখ, তোফাজ্জল হোসেন, জসিম উদ্দিন, হাবিবুর রহমান কুতুব, কোরবান আলী, আবুল হোসেন, নরেশ চন্দ্র বিশ্বাস, দিলীপ চন্দ্র অধিকারী, বাহার উদ্দিন, হাফিজুর রহমান, জহুরুল ইসলাম, আবদুল হালিম, বাবু খাঁ, আশরাফ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।

গজালিয়া গেট গণহত্যা : গজালিয়া গেটের অবস্থান হলো খুলনার বাটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুরখালী ইউনিয়ন ছিল রাজাকার অধ্যুষিত। আবার এই সুরখালী গ্রামেই ছিলেন আবদুল হামিদ সরদার নামক একজন বাম আন্দোলন কর্মী। বিস্ফোরক তৈরিতে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। খুলনায় অসহযোগ আন্দোলন ও পাকিস্তানি সেনাদের প্রাথমিক প্রতিরোধে যেসব বোমা ও বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছিল, তার অনেকগুলো এই হামিদ তৈরি করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন স্থানীয় রাজাকারদের টার্গেট। কিন্তু অধিকাংশ সময় আত্মগোপনে থাকায় রাজাকাররা তার নাগাল পেতো না। (চলবে)

back to top