alt

উপ-সম্পাদকীয়

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

জিল্লুর রহমান

: বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
image

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাজারে অগ্নিমূল্যে ভোক্তারা নির্বিকার, বিশেষভাবে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না।

সাম্প্রতিক সময়ের পেঁয়াজ, আলু, ডিম, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মাসিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০২ শতাংশ, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উল্লিখিত ৫.৬ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমিত ৭.৫ শতাংশ উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৩ এর জন্য মুদ্রানীতির বিবৃতি মতে ২০২২ অর্থবছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.১৫ শতাংশ। উদ্বেগজনকভাবে সর্বশেষ বিবিএসের তথ্য বলছে- আগস্ট ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশের মতো উচ্চতায় পৌঁছেছে; যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে ২০১১ সালের অক্টোবরে ১২.৮২ শতাংশ সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে, সেখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ; যা গত জুলাইয়ে ছিল ৯.৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪০ শতাংশ। এমন এক সময়ে এই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে যখন আশপাশের দেশ ভারত পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে।

আমাদের দেশে আয় যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কয়েকগুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সব থেকে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষ। অধিকাংশ প্রবীণ সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ চাকরি জীবনের তাদের সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেন নুন আনতে পানতে ফুরায় অবস্থা কিংবা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছেন তা সর্বসাধারণের বিচার্য। তাদের কার্যক্রম অনেকটা লোক দেখানো।

বর্তমানে চাল, তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা একেকটি অজুহাত দাঁড় করান এবং সরকারও তাদের সঙ্গে সমস্বরে সুর মিলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোন পণ্য নেই, যা বাজারে পাওয়া যায় না; অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত নামক সিন্ডিকেট চক্র। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ। নিত্যদিন তাদের পকেট কাটছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই, ভোক্তারা চরম অসহায়।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন খরচ, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সেহারে মানুষের আয় বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা সংকটকে আরও প্রকট করছে। পুরো অর্থনীতিতে এখনো ডলার-সংকটের মারাত্মক প্রভাব। এর ফলে সরকারের লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির চাপ। গোটা অর্থনীতিতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বহু বছর ধরে রেখেছিল। ফলে যে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়েছে, তাও হুমকির মুখে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতিতেই আগ্রহ বেশি সরকারের। এতে সংকট আরও বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুনাফাখোর সমাজের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তা। দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকল থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করতে হবে।

[লেখক : ব্যাংকার]

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন কোনো ফর্মুলাই কাজ করছে না?

ছবি

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের সৌন্দর্যের সন্ধানে

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

গাজায় মানবিক সংকট

প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে সংস্কার দরকার

ফিকে হচ্ছে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়ন, এআই এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ

অতীতটা হয়ে যাক দূর

রম্যগদ্য: নিমক-হারাম

হ্যালোইনে আমি একা

প্রসঙ্গ : প্রতিযোগিতামূলক দর

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি বন্ধ হয়েছে

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের সমস্যা

মানুষ গড়ার কারিগর

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ

জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ণয়ে প্রযুক্তি

অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কেন বেশি?

জাতিসংঘ ভবন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

জিল্লুর রহমান

image

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে

বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাজারে অগ্নিমূল্যে ভোক্তারা নির্বিকার, বিশেষভাবে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না।

সাম্প্রতিক সময়ের পেঁয়াজ, আলু, ডিম, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মাসিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০২ শতাংশ, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উল্লিখিত ৫.৬ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমিত ৭.৫ শতাংশ উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৩ এর জন্য মুদ্রানীতির বিবৃতি মতে ২০২২ অর্থবছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.১৫ শতাংশ। উদ্বেগজনকভাবে সর্বশেষ বিবিএসের তথ্য বলছে- আগস্ট ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশের মতো উচ্চতায় পৌঁছেছে; যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে ২০১১ সালের অক্টোবরে ১২.৮২ শতাংশ সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে, সেখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ; যা গত জুলাইয়ে ছিল ৯.৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪০ শতাংশ। এমন এক সময়ে এই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে যখন আশপাশের দেশ ভারত পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে।

আমাদের দেশে আয় যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কয়েকগুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সব থেকে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষ। অধিকাংশ প্রবীণ সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ চাকরি জীবনের তাদের সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেন নুন আনতে পানতে ফুরায় অবস্থা কিংবা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছেন তা সর্বসাধারণের বিচার্য। তাদের কার্যক্রম অনেকটা লোক দেখানো।

বর্তমানে চাল, তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা একেকটি অজুহাত দাঁড় করান এবং সরকারও তাদের সঙ্গে সমস্বরে সুর মিলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোন পণ্য নেই, যা বাজারে পাওয়া যায় না; অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত নামক সিন্ডিকেট চক্র। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ। নিত্যদিন তাদের পকেট কাটছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই, ভোক্তারা চরম অসহায়।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন খরচ, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সেহারে মানুষের আয় বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা সংকটকে আরও প্রকট করছে। পুরো অর্থনীতিতে এখনো ডলার-সংকটের মারাত্মক প্রভাব। এর ফলে সরকারের লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির চাপ। গোটা অর্থনীতিতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বহু বছর ধরে রেখেছিল। ফলে যে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়েছে, তাও হুমকির মুখে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতিতেই আগ্রহ বেশি সরকারের। এতে সংকট আরও বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুনাফাখোর সমাজের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তা। দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকল থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করতে হবে।

[লেখক : ব্যাংকার]

back to top