alt

উপ-সম্পাদকীয়

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

সামসুল ইসলাম টুকু

: রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জমির মালিকানা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। চরাঞ্চলে জমির দখল নিয়ে খুনখারাবি আরও বেশি; কিন্তু এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কেন ঘটে? এর মূল কারণ জমির মালিকানা নিশ্চিত না হওয়া। মালিকানার বিরোধ যেমন নতুন কিছু নয় তেমনি তার সংখ্যাও হাজারে হাজার। দেশের প্রতিটি কোর্ট-কাছারিতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সমাগমের অন্যতম কারণ হচ্ছে জমির মালিকানা নিয়ে মামলা। আর উকিল মুহরিদের আয়-রোজগারের উৎস হচ্ছে জমির মালিকানা দাবিদারেরা।

এ বিরোধের জন্ম দেয় কারা? অনেকেই বলবেন, ভূমি বিভাগ। কারণ জমির কাগজপত্র রেকর্ড প্রভৃতি দেখে মালিকানা বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ভূমি বিভাগের। জমির রেকর্ডপত্র তাদের হাতেই বা রেকর্ড রুমে রক্ষিত থাকে। অন্যদিকে জমির মালিক দাবিদারেরা যে কাগজপত্র দাখিল করে তার কোনটি ঠিক, কোনটি ঠিক নয়, কোনটি জাল অবৈধ, কোন দলিল আগে কোনটা পরে এসবের বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারে প্রকৃত মালিক কে বা কেউই নয়। জমির কাগজপত্র তারা যত বোঝে এমনটা অন্য কেউ বা কোন সংস্থা বোঝে না বলে তারা দাবিও করে। শুধু তা-ই-নয় এই ভূমি বিভাগের সিদ্ধান্ত বা রায় চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় আইনসম্মতভাবে। তারপরেও বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণও তারাই। ভূমি বিভাগ তথা মূলত এসিল্যান্ড সিদ্ধান্ত দিতে ভুল করে, বিভিন্ন অজুহাতে জটিলতা সৃষ্টি করে, অথবা সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় ফেলে রাখে। তখন মানুষ আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। তা হচ্ছে ভূমি বিভাগ দখলি স্বত্বকে গুরুত্ব দেয়। অনেকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী দাঙ্গাবাজদের কাছ থেকে দুর্বল মানুষেরা জমি দখল নিতে পারে না। অন্যদিকে দাঙ্গাবাজেরা কিছু অবৈধ কাগজপত্র সৃষ্টি করে বছরের পর বছর দখলিস্বত্ব বহাল রাখে ও ভোগ দখল করে। এ বিষয়টি যে ভূমিবিভাগ বোঝে না তা নয়। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত দেয় না বা দুর্বলের পক্ষে দাঁড়িয়ে দখল নিয়ে দেয় না। দুর্বল তখন আদালতে গিয়ে মামলা করে। ১০/১৫ বছর পরে হয়তো মামলার রায় পায় এবং আদালত পুলিশ নিয়ে জমির দখল বুঝিয়ে দেয়। অথচ এই কাজটি ভূমিবিভাগ করতেই পারে। তাহলে প্রকৃত জমির মালিককে বছরের পর বছর কোর্টে হয়রান হতে হয় না, অর্থ ব্যয় করতে হয় না, মারদাঙ্গা খুনোখুনি ও হয় না।

ভূমিবিভাগের ত্রুটির অন্ত নেই। যেমন বিভিন্ন সময় জমি জরিপ হয়েছে। সেখানে বহু ভুল থেকে গেছে, যেমন একজনের জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড হয়েছে, এক জমার জমি অন্য জমায় রেকর্ড হয়েছে, দাগ ও পরিমাণে ভুল হয়েছে। যাকে ভূমি বিভাগের ভাষায় করণিক ভুল বলা হয়। অথচ তাদের কৃত এই ভুলগুলো তারা সংশোধন করে দেয় না। বলা হয় অন্যের ভুলের দায় তারা নেবে না। এই অজুহাতে ওইসব জমির মালিকদের রেকর্ড সংশোধন করার জন্য ঠেলে দেয় আদালতপাড়ায়। ভূমি বিভাগের অধীনস্থ রেকর্ড রুমটি যথেষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। সেখানে রেকর্ডের ভলিউম বই থাকে। সেই ভলিউম বই থেকেও রেকর্ডের কোন কোন পাতা হারিয়ে যায়, যা ওই অফিসের কর্মচারীরাই অর্থের বিনিময়ে করে থাকে। যারা এ কাজটি করিয়ে নেয় তারা ওই সংক্রান্ত জমি দখলের উদ্দেশ্যেই করে থাকে। অন্যদিকে প্রকৃত জমির মালিক ওই রেকর্ডের অভাবে তার দলিলে লিখিত জমি প্রমাণে ব্যর্থ হয়। প্রতিপক্ষ সেই সুযোগ গ্রহণ করে। ভূমি বিভাগ এ দায়ও নিতে চায় না। তাদের অফিস থেকে রেকর্ড হারিয়ে যাবে তদপুরি এজন্য কোন জবাবদিহিতা নেই। এমন দুর্নীতির কারণে প্রকৃত জমির মালিককে দাঙ্গায় জড়াতে বাধ্য হতে হয়। অথচ ভূমি বিভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষকে আদালতেই যেতে হতো না।

ভূমি বিভাগের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয় এসিল্যান্ড অফিসে জমি খারিজ করা নিয়ে। এসিল্যান্ডের দায়িত্ব হচ্ছে জমির মালিককে খারিজ নামক সেবা দেয়া। কিন্তু সেই সেবা তো দূরের কথা বরং এজন্য ঘুষ দিতে হয় যেমনটা এসিল্যান্ডের কর্মচারীরা দাবি করে। সেই দাবি পূরণ করতে না পারলে তার জমি খারিজ হবে না। দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকে বিভিন্ন অজুহাতে। অথচ এসিল্যান্ড অফিসের সামনে রক্ষিত বিল বোর্ডে লেখা রয়েছে দালাল ধরবেন না, কারো সঙ্গে টাকা লেনদেন করবেন না, সরাসরি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আপনার জমি রক্ষার দায়িত্ব ভূমি বিভাগের ইত্যাদি। এ কথাগুলো মূলত তাদের শপথ।

কিন্তু তারা সেই শপথের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে। এর কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ করেও। কারণ ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ এর কাগজে-কলমে কোন প্রমাণ থাকে না। তাছাড়া আজান দিয়ে এই দুর্নীতির প্রাপ্ত অর্থ উপর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাই এ সংক্রান্ত বিচার চাইতে যাওয়া অরন্যে রোদন। এজন্য তাদের বর্ণিত সহজ সরল পথ ঘুষ দিয়ে খারিজ করে নেয়াই উত্তম। দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। এই তো হচ্ছে মফস্বলের জেলা উপজেলার সংস্কৃতি, কিন্তু ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় সিটি করপোরেশনের জমি খারিজ করতে ৫/১০ লাখ টাকার কমে হয় না। এটা সরকারের কাছে ওপেন সিক্রেট। এদের বিচার ও হয় না চাকরিও যায় না। এ ব্যবস্থা অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত, প্রতিকারহীন এবং দীর্ঘকালের। সরকারের বিধি অনুযায়ী খাস জমি বা অন্য সম্পত্তি ভূমিহীনদের বাৎসরিক লিজ দেয়ার কথা থাকলেও দেখা যায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ধনীদের ৯৯ বছরের লিজ দেয়া হয়। এমন নজির তো ভুরিভুরি। এর বিচার কে করবে। এছাড়া হুকুম দখল করা জমির দাম দেয়ার ক্ষেত্রে, বালু মহল লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে, ফলকর-জলকর লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের (ভূমি) দুর্নীতি মোটেও কম নয়। ভূমি বিভাগের দুর্নীতির কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা সরকারি জমিসহ সাধারণ মানুষের জমি জবরদখল করে বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করছে এবং কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। সেখানেও ভূমি বিভাগের কিছু করার নেই। অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে।

প্রায় প্রতিটি সরকার মাঝে মাঝে জমিসংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে জনসাধারণকে স্বস্তি দেয়ার জন্য। বলা হয় এরপরে আর জমিসংক্রান্ত সমস্যা থাকবে না। কদিন আগেও নতুন আইন হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে দলিল যার জমি তার। কোন অবৈধ দলিল বা জাল জোচ্চুরি করে জমির মালিক হওয়া যাবে না। তারপর-ও-কি সত্যি সত্যি সঠিক মালিকানা নিশ্চিত করতে ভূমি বিভাগ ভূমিকা নেবে? দেশবাসী এই খুন-দাঙ্গা থেকে মুক্তি পাবে, প্রত্যেকের জমি নিরাপদ হবে? অবৈধ দখলদার জাল দলিলকারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে? এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে আদালতের বিচারে বা ভূমি বিভাগের বিচারে অবৈধ দখলদার, জাল দলিলকারক হিসেবে প্রমাণ হলেও এবং মামলায় হেরে গেলেও তাদের কোন শাস্তি হয় না। এজন্য প্রকৃত মালিককে পৃথক মামলা করতে হবে। এই মামলায় দীর্ঘ বিড়ম্বনার পরে আবার নতুন বিড়ম্বনা মাথায় নেয়ার ধৈর্য থাকে না। কিন্তু আদালত বা ভূমি বিভাগ এ বিষয়টি অনায়াসে করতে পারে। ওই মামলাতেই বিচারকরা জালিয়াতদের শাস্তি দিতে পারেন। সে বিধান রয়েছে এবং দু-একটি উদাহারণও আছে। কিন্তু তা করা হয় না বলেই জালিয়াতেরা পুনরায় নতুন জালিয়াতি শুরু করে। জমিজমা নিয়ে এই অসংখ্য জটিলতা থেকে দেশের মানুষ আদৌ মুক্তি পাবে কি?

[লেখক: সাংবাদিক]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

সামসুল ইসলাম টুকু

রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জমির মালিকানা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। চরাঞ্চলে জমির দখল নিয়ে খুনখারাবি আরও বেশি; কিন্তু এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কেন ঘটে? এর মূল কারণ জমির মালিকানা নিশ্চিত না হওয়া। মালিকানার বিরোধ যেমন নতুন কিছু নয় তেমনি তার সংখ্যাও হাজারে হাজার। দেশের প্রতিটি কোর্ট-কাছারিতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সমাগমের অন্যতম কারণ হচ্ছে জমির মালিকানা নিয়ে মামলা। আর উকিল মুহরিদের আয়-রোজগারের উৎস হচ্ছে জমির মালিকানা দাবিদারেরা।

এ বিরোধের জন্ম দেয় কারা? অনেকেই বলবেন, ভূমি বিভাগ। কারণ জমির কাগজপত্র রেকর্ড প্রভৃতি দেখে মালিকানা বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ভূমি বিভাগের। জমির রেকর্ডপত্র তাদের হাতেই বা রেকর্ড রুমে রক্ষিত থাকে। অন্যদিকে জমির মালিক দাবিদারেরা যে কাগজপত্র দাখিল করে তার কোনটি ঠিক, কোনটি ঠিক নয়, কোনটি জাল অবৈধ, কোন দলিল আগে কোনটা পরে এসবের বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারে প্রকৃত মালিক কে বা কেউই নয়। জমির কাগজপত্র তারা যত বোঝে এমনটা অন্য কেউ বা কোন সংস্থা বোঝে না বলে তারা দাবিও করে। শুধু তা-ই-নয় এই ভূমি বিভাগের সিদ্ধান্ত বা রায় চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় আইনসম্মতভাবে। তারপরেও বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণও তারাই। ভূমি বিভাগ তথা মূলত এসিল্যান্ড সিদ্ধান্ত দিতে ভুল করে, বিভিন্ন অজুহাতে জটিলতা সৃষ্টি করে, অথবা সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় ফেলে রাখে। তখন মানুষ আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। তা হচ্ছে ভূমি বিভাগ দখলি স্বত্বকে গুরুত্ব দেয়। অনেকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী দাঙ্গাবাজদের কাছ থেকে দুর্বল মানুষেরা জমি দখল নিতে পারে না। অন্যদিকে দাঙ্গাবাজেরা কিছু অবৈধ কাগজপত্র সৃষ্টি করে বছরের পর বছর দখলিস্বত্ব বহাল রাখে ও ভোগ দখল করে। এ বিষয়টি যে ভূমিবিভাগ বোঝে না তা নয়। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত দেয় না বা দুর্বলের পক্ষে দাঁড়িয়ে দখল নিয়ে দেয় না। দুর্বল তখন আদালতে গিয়ে মামলা করে। ১০/১৫ বছর পরে হয়তো মামলার রায় পায় এবং আদালত পুলিশ নিয়ে জমির দখল বুঝিয়ে দেয়। অথচ এই কাজটি ভূমিবিভাগ করতেই পারে। তাহলে প্রকৃত জমির মালিককে বছরের পর বছর কোর্টে হয়রান হতে হয় না, অর্থ ব্যয় করতে হয় না, মারদাঙ্গা খুনোখুনি ও হয় না।

ভূমিবিভাগের ত্রুটির অন্ত নেই। যেমন বিভিন্ন সময় জমি জরিপ হয়েছে। সেখানে বহু ভুল থেকে গেছে, যেমন একজনের জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড হয়েছে, এক জমার জমি অন্য জমায় রেকর্ড হয়েছে, দাগ ও পরিমাণে ভুল হয়েছে। যাকে ভূমি বিভাগের ভাষায় করণিক ভুল বলা হয়। অথচ তাদের কৃত এই ভুলগুলো তারা সংশোধন করে দেয় না। বলা হয় অন্যের ভুলের দায় তারা নেবে না। এই অজুহাতে ওইসব জমির মালিকদের রেকর্ড সংশোধন করার জন্য ঠেলে দেয় আদালতপাড়ায়। ভূমি বিভাগের অধীনস্থ রেকর্ড রুমটি যথেষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। সেখানে রেকর্ডের ভলিউম বই থাকে। সেই ভলিউম বই থেকেও রেকর্ডের কোন কোন পাতা হারিয়ে যায়, যা ওই অফিসের কর্মচারীরাই অর্থের বিনিময়ে করে থাকে। যারা এ কাজটি করিয়ে নেয় তারা ওই সংক্রান্ত জমি দখলের উদ্দেশ্যেই করে থাকে। অন্যদিকে প্রকৃত জমির মালিক ওই রেকর্ডের অভাবে তার দলিলে লিখিত জমি প্রমাণে ব্যর্থ হয়। প্রতিপক্ষ সেই সুযোগ গ্রহণ করে। ভূমি বিভাগ এ দায়ও নিতে চায় না। তাদের অফিস থেকে রেকর্ড হারিয়ে যাবে তদপুরি এজন্য কোন জবাবদিহিতা নেই। এমন দুর্নীতির কারণে প্রকৃত জমির মালিককে দাঙ্গায় জড়াতে বাধ্য হতে হয়। অথচ ভূমি বিভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষকে আদালতেই যেতে হতো না।

ভূমি বিভাগের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয় এসিল্যান্ড অফিসে জমি খারিজ করা নিয়ে। এসিল্যান্ডের দায়িত্ব হচ্ছে জমির মালিককে খারিজ নামক সেবা দেয়া। কিন্তু সেই সেবা তো দূরের কথা বরং এজন্য ঘুষ দিতে হয় যেমনটা এসিল্যান্ডের কর্মচারীরা দাবি করে। সেই দাবি পূরণ করতে না পারলে তার জমি খারিজ হবে না। দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকে বিভিন্ন অজুহাতে। অথচ এসিল্যান্ড অফিসের সামনে রক্ষিত বিল বোর্ডে লেখা রয়েছে দালাল ধরবেন না, কারো সঙ্গে টাকা লেনদেন করবেন না, সরাসরি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আপনার জমি রক্ষার দায়িত্ব ভূমি বিভাগের ইত্যাদি। এ কথাগুলো মূলত তাদের শপথ।

কিন্তু তারা সেই শপথের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে। এর কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ করেও। কারণ ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ এর কাগজে-কলমে কোন প্রমাণ থাকে না। তাছাড়া আজান দিয়ে এই দুর্নীতির প্রাপ্ত অর্থ উপর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাই এ সংক্রান্ত বিচার চাইতে যাওয়া অরন্যে রোদন। এজন্য তাদের বর্ণিত সহজ সরল পথ ঘুষ দিয়ে খারিজ করে নেয়াই উত্তম। দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। এই তো হচ্ছে মফস্বলের জেলা উপজেলার সংস্কৃতি, কিন্তু ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় সিটি করপোরেশনের জমি খারিজ করতে ৫/১০ লাখ টাকার কমে হয় না। এটা সরকারের কাছে ওপেন সিক্রেট। এদের বিচার ও হয় না চাকরিও যায় না। এ ব্যবস্থা অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত, প্রতিকারহীন এবং দীর্ঘকালের। সরকারের বিধি অনুযায়ী খাস জমি বা অন্য সম্পত্তি ভূমিহীনদের বাৎসরিক লিজ দেয়ার কথা থাকলেও দেখা যায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ধনীদের ৯৯ বছরের লিজ দেয়া হয়। এমন নজির তো ভুরিভুরি। এর বিচার কে করবে। এছাড়া হুকুম দখল করা জমির দাম দেয়ার ক্ষেত্রে, বালু মহল লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে, ফলকর-জলকর লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের (ভূমি) দুর্নীতি মোটেও কম নয়। ভূমি বিভাগের দুর্নীতির কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা সরকারি জমিসহ সাধারণ মানুষের জমি জবরদখল করে বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করছে এবং কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। সেখানেও ভূমি বিভাগের কিছু করার নেই। অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে।

প্রায় প্রতিটি সরকার মাঝে মাঝে জমিসংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে জনসাধারণকে স্বস্তি দেয়ার জন্য। বলা হয় এরপরে আর জমিসংক্রান্ত সমস্যা থাকবে না। কদিন আগেও নতুন আইন হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে দলিল যার জমি তার। কোন অবৈধ দলিল বা জাল জোচ্চুরি করে জমির মালিক হওয়া যাবে না। তারপর-ও-কি সত্যি সত্যি সঠিক মালিকানা নিশ্চিত করতে ভূমি বিভাগ ভূমিকা নেবে? দেশবাসী এই খুন-দাঙ্গা থেকে মুক্তি পাবে, প্রত্যেকের জমি নিরাপদ হবে? অবৈধ দখলদার জাল দলিলকারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে? এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে আদালতের বিচারে বা ভূমি বিভাগের বিচারে অবৈধ দখলদার, জাল দলিলকারক হিসেবে প্রমাণ হলেও এবং মামলায় হেরে গেলেও তাদের কোন শাস্তি হয় না। এজন্য প্রকৃত মালিককে পৃথক মামলা করতে হবে। এই মামলায় দীর্ঘ বিড়ম্বনার পরে আবার নতুন বিড়ম্বনা মাথায় নেয়ার ধৈর্য থাকে না। কিন্তু আদালত বা ভূমি বিভাগ এ বিষয়টি অনায়াসে করতে পারে। ওই মামলাতেই বিচারকরা জালিয়াতদের শাস্তি দিতে পারেন। সে বিধান রয়েছে এবং দু-একটি উদাহারণও আছে। কিন্তু তা করা হয় না বলেই জালিয়াতেরা পুনরায় নতুন জালিয়াতি শুরু করে। জমিজমা নিয়ে এই অসংখ্য জটিলতা থেকে দেশের মানুষ আদৌ মুক্তি পাবে কি?

[লেখক: সাংবাদিক]

back to top