alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসানীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকা তাদের চার মাস আগে ঘোষিত ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে। যারা ভিসানীতির আওতাভুক্ত তারা হলো- আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অতীতে যারা দায়ী ছিল এবং ভবিষ্যতে যারা দায়ী হবে তাদের ক্ষেত্রেও এই ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হচ্ছে, ভোট কারচুপির সঙ্গে জড়িত থাকা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া এবং মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা।

জো বাইডেনের আগে যারা প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মাথা এত ঘামাননি, ঘামালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এত অপকর্ম হতো না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কয়েকটি আসনে বিরোধী প্রার্থীকে ভয় দেখিয়ে উইথড্র করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ-না ভোটে জিয়াউর রহমান একাই প্রার্থী ছিলেন। ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা হ্যাঁ ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার না গেলেও ৮৮.১% ভোট কাস্ট হয়েছিল এবং ভোট গণনায় দেখা গেল ৯৮.৯% হ্যাঁ এবং ১.১% না-ভোট। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বিএনপি তাদের কয়েকজন প্রার্থীকে ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত করে বিরোধী দলকে জিতিয়ে দিয়েছিল। একই নীতি ২০১৮ সালের নির্বাচনে নেয়া হলে আজ ভিসানীতির প্রয়োগ হতো না।

জিয়াউর রহমানের ভোটনীতি অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গরজ বোধ করেননি; তার আমলেও ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি, ভোট প্রদান শুরু হওয়ার এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত। জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদও ১৯৮৫ সালে গণভোট করেন, সেই নির্বাচনে তিনি ৯৪.৫ শতাংশ ভোট পান। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে। ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তোলে।

ক্ষমতায় এসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে অস্বীকার করে। খালেদা জিয়া বললেন, পাগল আর শিশু ছাড়া আর কেউ নিরপেক্ষ নয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে; ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, কিন্তু আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। একই বছর জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং বিএনপি স্থুল কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। মেয়াদান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোসহ বিএনপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে।

নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভিসানীতির কথা কারো মনে থাকবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোন রাজনৈতিক দলই আতঙ্কিত নয়, কারণ আমেরিকায় যাওয়ার চেয়ে দেশে ক্ষমতা ভোগ করা তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয়

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের পছন্দমতো প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার অভিপ্রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়। কে এম হাসান হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী লেফট্যানেন্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের ভায়রা ভাই। তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও বিএনপির দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এভাবে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় সরকারে পরিণত করে। বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও বিএনপির অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেই পরাজিত দলের অভিযোগ ছিল। শুধু পরাজিত বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পছন্দ করেনি। অন্যদিকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ২০১১ সালে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করেছে। ফলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করার আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অধিকাংশ প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণে বাধা দেয়া এবং দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং এর জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বিএনপির নেতাদের আলোচনা, পর্যালাচনা ও বিশ্লেষণ শুনলে মনে হয়, আমেরিকা বিএনপির সঙ্গে যুক্তি করে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারকে শায়েস্তা করতে এই নীতি ঘোষণা করেছে। আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বানচাল করার ক্ষেত্রে বিএনপির আন্দোলন ও সংগ্রামের বিরুদ্ধে এই ভিসানীতি।

ভিসানীতির ভয়ে বিএনপি নিশ্চয়ই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ঘরে বসে থাকবে না। বিএনপির আন্দোলনের ছক হচ্ছে রাজপথে অবস্থান নেয়া, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয় ঘেরাও করা, ঢাকা শহর অবরোধ করা। বিএনপি যদি তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক অগ্রসর হয় তাহলে রাজনৈতিক মাঠ হিংসাত্মক হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার তখন নিশ্চয়ই ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে একশন নেয়া থেকে বিরত থাকবে না। তবে প্রাথমিক অবস্থায় উভয় পক্ষ কিছুটা সংযত আচরণ করতে পারে, কিন্তু নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভিসানীতির কথা কারো মনে থাকবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোন রাজনৈতিক দলই আতঙ্কিত নয়, কারণ আমেরিকায় যাওয়ার চেয়ে দেশে ক্ষমতা ভোগ করা তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয়।

ভিসানীতির গোপন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কারণ নিজ স্বার্থে শত্রুকে মিত্র করতে আমেরিকার এক সেকেন্ডও লাগে না। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী যে নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সেই মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেরিকার মাটিতে লাল গালিচার সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুর্নীতিবাজ, ভয়ঙ্কর ও দুর্র্ধর্ষ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তাকে ভিসা না দিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ঠিকই নরেন্দ্র মোদির মতো আমেরিকা তাকে লাল গালিচার সংবর্ধনা দেবে।

সৌদি আরব, জর্ডান প্রভৃতি দেশে তো নির্বাচনই নেই, অথচ ওই সব দেশের ওপর আমেরিকার কোন ভিসানীতি নেই। প্রকৃতপক্ষে ভিসানীতি হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় আমেরিকার অবস্থান এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। আমেরিকার এই গোপন নীতিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ইউরোপ সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এই চাপ তখনই রিলিজ হবে যখন বাংলাদেশ ওই দুটি ক্ষেত্রে আমেরিকার পক্ষে যাবে। দেশে অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তাই যে কোন চাপ বা সমঝোতায় নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক- এই প্রত্যাশা সবার।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসানীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকা তাদের চার মাস আগে ঘোষিত ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে। যারা ভিসানীতির আওতাভুক্ত তারা হলো- আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অতীতে যারা দায়ী ছিল এবং ভবিষ্যতে যারা দায়ী হবে তাদের ক্ষেত্রেও এই ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হচ্ছে, ভোট কারচুপির সঙ্গে জড়িত থাকা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া এবং মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা।

জো বাইডেনের আগে যারা প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মাথা এত ঘামাননি, ঘামালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এত অপকর্ম হতো না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কয়েকটি আসনে বিরোধী প্রার্থীকে ভয় দেখিয়ে উইথড্র করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ-না ভোটে জিয়াউর রহমান একাই প্রার্থী ছিলেন। ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা হ্যাঁ ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার না গেলেও ৮৮.১% ভোট কাস্ট হয়েছিল এবং ভোট গণনায় দেখা গেল ৯৮.৯% হ্যাঁ এবং ১.১% না-ভোট। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বিএনপি তাদের কয়েকজন প্রার্থীকে ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত করে বিরোধী দলকে জিতিয়ে দিয়েছিল। একই নীতি ২০১৮ সালের নির্বাচনে নেয়া হলে আজ ভিসানীতির প্রয়োগ হতো না।

জিয়াউর রহমানের ভোটনীতি অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গরজ বোধ করেননি; তার আমলেও ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি, ভোট প্রদান শুরু হওয়ার এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত। জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদও ১৯৮৫ সালে গণভোট করেন, সেই নির্বাচনে তিনি ৯৪.৫ শতাংশ ভোট পান। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে। ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তোলে।

ক্ষমতায় এসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে অস্বীকার করে। খালেদা জিয়া বললেন, পাগল আর শিশু ছাড়া আর কেউ নিরপেক্ষ নয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে; ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, কিন্তু আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। একই বছর জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং বিএনপি স্থুল কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। মেয়াদান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোসহ বিএনপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে।

নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভিসানীতির কথা কারো মনে থাকবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোন রাজনৈতিক দলই আতঙ্কিত নয়, কারণ আমেরিকায় যাওয়ার চেয়ে দেশে ক্ষমতা ভোগ করা তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয়

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের পছন্দমতো প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার অভিপ্রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়। কে এম হাসান হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী লেফট্যানেন্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের ভায়রা ভাই। তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও বিএনপির দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এভাবে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় সরকারে পরিণত করে। বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও বিএনপির অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেই পরাজিত দলের অভিযোগ ছিল। শুধু পরাজিত বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পছন্দ করেনি। অন্যদিকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ২০১১ সালে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করেছে। ফলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করার আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অধিকাংশ প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণে বাধা দেয়া এবং দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং এর জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বিএনপির নেতাদের আলোচনা, পর্যালাচনা ও বিশ্লেষণ শুনলে মনে হয়, আমেরিকা বিএনপির সঙ্গে যুক্তি করে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারকে শায়েস্তা করতে এই নীতি ঘোষণা করেছে। আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বানচাল করার ক্ষেত্রে বিএনপির আন্দোলন ও সংগ্রামের বিরুদ্ধে এই ভিসানীতি।

ভিসানীতির ভয়ে বিএনপি নিশ্চয়ই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ঘরে বসে থাকবে না। বিএনপির আন্দোলনের ছক হচ্ছে রাজপথে অবস্থান নেয়া, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয় ঘেরাও করা, ঢাকা শহর অবরোধ করা। বিএনপি যদি তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক অগ্রসর হয় তাহলে রাজনৈতিক মাঠ হিংসাত্মক হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার তখন নিশ্চয়ই ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে একশন নেয়া থেকে বিরত থাকবে না। তবে প্রাথমিক অবস্থায় উভয় পক্ষ কিছুটা সংযত আচরণ করতে পারে, কিন্তু নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভিসানীতির কথা কারো মনে থাকবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোন রাজনৈতিক দলই আতঙ্কিত নয়, কারণ আমেরিকায় যাওয়ার চেয়ে দেশে ক্ষমতা ভোগ করা তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয়।

ভিসানীতির গোপন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কারণ নিজ স্বার্থে শত্রুকে মিত্র করতে আমেরিকার এক সেকেন্ডও লাগে না। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী যে নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সেই মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেরিকার মাটিতে লাল গালিচার সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুর্নীতিবাজ, ভয়ঙ্কর ও দুর্র্ধর্ষ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তাকে ভিসা না দিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ঠিকই নরেন্দ্র মোদির মতো আমেরিকা তাকে লাল গালিচার সংবর্ধনা দেবে।

সৌদি আরব, জর্ডান প্রভৃতি দেশে তো নির্বাচনই নেই, অথচ ওই সব দেশের ওপর আমেরিকার কোন ভিসানীতি নেই। প্রকৃতপক্ষে ভিসানীতি হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় আমেরিকার অবস্থান এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। আমেরিকার এই গোপন নীতিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ইউরোপ সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এই চাপ তখনই রিলিজ হবে যখন বাংলাদেশ ওই দুটি ক্ষেত্রে আমেরিকার পক্ষে যাবে। দেশে অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তাই যে কোন চাপ বা সমঝোতায় নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক- এই প্রত্যাশা সবার।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]

back to top