alt

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্বের বহু দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরেও গেছে। যেমন- সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। আবার গ্রিস ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তেমনি রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে সংস্কার দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হলেই তা টেকসই হবে। জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জীবনমানের উন্নয়ন করতে না পারলে তা কাজে আসবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দিতে হবে।

গত পাঁচ দশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর অভিযোজন। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৭৪ গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আবার গড় আয়ুও বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে বাজারনির্ভর অর্থনীতি, বেসরকারি খাতে সহায়তা, প্রযুক্তি পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গোটাপাঁচেক শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ বছরেই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল।

কোরিয়া কিভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হলো? ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আয়বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে কোরিয়া। আর ২০২১ সালে ২৬ বছরে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৯৯৮ ডলার। এর বদৌলতে কোরিয়া এখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। কোরিয়ার এই উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশ পাঁচটি শিক্ষা নিতে পারে। এগুলো হলো, বাজারনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টেকসইভাবে সহায়তা প্রদান, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সংস্কার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।

রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের বাণিজ্যনীতি নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রপ্তানি ঝুড়িতে পোশাক খাতের বাইরের পণ্য বাড়াতে হবে।এ ছাড়া উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে আমরা এই ফাঁদ এড়াতে পারব। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান তা প্রমাণ করেছে। আবার এই দুটো জিনিসের অভাবে আর্জেন্টিনার আটকে পড়াকে অনেকেই ফাঁদ ভেবে সান্তনা নিচ্ছে। পুরোটাই দেশগুলোর নিজস্ব গতিময়তা বা কুশাসনের ফল।

যে রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ ডলারের কম, তা নিম্ন আয়ের অর্থনীতিতে হিসেবে পরিগণিত। মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ থেকে ১৩,২০৫ ডলারের মধ্যে থাকলে তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। মাথাপিছু আয় ১৩,২০৫ ডলারের ওপরে তুলতে পারলেই সে দেশ উচ্চ আয়ের বাসিন্দা। মধ্যম আয়ের প্রথম ধাপকে নিম্ন মধ্যম আয় বলা হয়, যেখানে মাথাপিছু আয়ের বন্ধনী ১,০৮৬ থেকে ৪,২৫৫ ডলার। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ মানে তার মাথাপিছু আয় ৪,২৫৬ থেকে ১৩,২০৫ পর্যন্ত। এ সংখ্যাগুলো সময়ে সময়ে বাড়ানো হয় মূলত মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে। মধ্যম আয়ের ফাঁদ বলতে প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১৩ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের মধ্যে আটকে থাকার ঘটনাকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশের সামনে ধাপ দুটো। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, যার জন্য দরকার প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় করা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, যার জন্য দরকার হবে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন। বর্তমানের ২ হাজার ৮০০ ডলারের আয় নিয়ে ৫-৬ ভাগের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে এ দেশ ৭ থেকে ৯ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ে পৌঁছাতে পারবে, যা ঘটবে ২০৩১ সালের পর।

কিন্তু উন্নত দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে কমপক্ষে ২৭ বছর সময় লাগবে, যদি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৬ ভাগ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ ভাগ ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৩ ভাগ। এ থেকে এক ভাগ কমিয়ে ধরলে উচ্চ আয়ের দেশ হতে ৩২ বছরের মতো সময় লাগবে। কে যে ২০৪১-কে উন্নত দেশ হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন? ২৭-৩২ বছরের হিসাবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে ২০৫১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৮০ বছর পূর্তির বছর বা তার পর। কিন্তু মেধাভিত্তিক সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললে এ মাহেন্দ্রক্ষণের আগমন হবে আরও বিলম্বিত।

কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার আগে ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে চমৎকারভাবে এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মহামারির কারণে গত এক দশকের টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্জন স্থবির হয়ে পড়ে। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করতেই নতুন করে আবারও বাধা আসে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। ওলটপালট হয়ে যায় পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট বইয়ে ভারসাম্যের হিসাব ও উন্নত প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশলগত প্রচেষ্টা। বিশ্ব-অর্থনীতির ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখা যায়, এ যাত্রাটা কখনো এক শতকের হতে পারে আবার এক দশকের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র মাথাপিছু আয়ের উত্তরণ ঘটাতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তার ওপর। নিম্ন মাথাপিছু আয় থেকে উচ্চ মাথাপিছু আয়ে পৌঁছাতে এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে কম সময় নিয়েছে। আবার অনেক দেশ আছে যেগুলো মাথাপিছু আয়ের একটি পর্যায়েই পড়ে আছে কয়েক দশক ধরে। এহেন পরিস্থিতিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’।

মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উচ্চ আয়ের পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন, তা প্রণয়ন করা দুষ্কর। বিশেষত প্রতিটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার স্বাতন্ত্র্য এ কাজটিকে আরও কঠিন করে তোলে। অর্থনীতিবিদদের দেখানো বিভিন্ন প্রমাণ অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনামূলক অল্প সময়ের ব্যবধানে আয়সীমায় দুইবার সফল উত্তরণের অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সতর্কবার্তা এখন অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। বর্তমান মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং ২০৩১ ও ২০৪১ সালের মধ্যে যথাক্রমে উচ্চ-মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নের পেছনে ছোটার রাস্তায় অবিচল থাকার জন্য বাংলাদেশকে এখন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট সমাধানের জন্য সুদূরপ্রসারি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানই রয়েছে ওই সব সতর্কতবার্তায়। এ স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সামনে এখনো অসংখ্য বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারপরও এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব যদি দেশের অর্থনৈতিক খাতকে খোলনলচে বদলানো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খারাপ প্রভাবের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার প্রবল ইচ্ছা থাকে। কিন্তু সবার আগে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে সৃষ্ট বর্তমান ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে।

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্বের বহু দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরেও গেছে

সাম্প্রতিক কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির মাধ্যমে যায়নি, ফলে এর আগে কখনো সংস্কারে প্রয়োজনীয়তাও এত বেশি জরুরি মনে হয়নি। অর্থনৈতিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঘুষের মচ্ছব থাকলেও করোনা মহামারির আগে গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দারুণ প্রবৃদ্ধি ঘটছিল। ওই দশকটি ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কিছু বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির মিশ্র দশক। কিন্তু এ সময়ে এসে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বৈত ধাক্কা দেশের অর্থনীতির দুর্বলতাগুলোকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এসব ধাক্কার কারণে বাংলাদেশ এখন বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋত ও ব্যালান্স অভ পেমেন্টের চাপের সঙ্গে লড়াই করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত রাখার জন্য সরকারকে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ জারি করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন ও মান উন্নয়নে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়িক নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই কর্তৃপক্ষকে সংস্কারের কথা বলছেন। সরকারের এজেন্ডায় সংস্কার উদ্যোগ মাঝেমধ্যে ছিল, তবে তা কখনই অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চলমান মন্দা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং মহামারিপূর্ব প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যেতে হবে। মহামারির আগে বেশ কয়েক বছর এ প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ ছিল। করোনা হানা দেয়ার আগের বছরে তো প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে

রেজাউল করিম খোকন

রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্বের বহু দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরেও গেছে। যেমন- সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। আবার গ্রিস ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তেমনি রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে সংস্কার দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হলেই তা টেকসই হবে। জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জীবনমানের উন্নয়ন করতে না পারলে তা কাজে আসবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দিতে হবে।

গত পাঁচ দশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর অভিযোজন। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৭৪ গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আবার গড় আয়ুও বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে বাজারনির্ভর অর্থনীতি, বেসরকারি খাতে সহায়তা, প্রযুক্তি পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গোটাপাঁচেক শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ বছরেই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল।

কোরিয়া কিভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হলো? ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আয়বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে কোরিয়া। আর ২০২১ সালে ২৬ বছরে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৯৯৮ ডলার। এর বদৌলতে কোরিয়া এখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। কোরিয়ার এই উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশ পাঁচটি শিক্ষা নিতে পারে। এগুলো হলো, বাজারনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টেকসইভাবে সহায়তা প্রদান, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সংস্কার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।

রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের বাণিজ্যনীতি নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রপ্তানি ঝুড়িতে পোশাক খাতের বাইরের পণ্য বাড়াতে হবে।এ ছাড়া উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে আমরা এই ফাঁদ এড়াতে পারব। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান তা প্রমাণ করেছে। আবার এই দুটো জিনিসের অভাবে আর্জেন্টিনার আটকে পড়াকে অনেকেই ফাঁদ ভেবে সান্তনা নিচ্ছে। পুরোটাই দেশগুলোর নিজস্ব গতিময়তা বা কুশাসনের ফল।

যে রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ ডলারের কম, তা নিম্ন আয়ের অর্থনীতিতে হিসেবে পরিগণিত। মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ থেকে ১৩,২০৫ ডলারের মধ্যে থাকলে তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। মাথাপিছু আয় ১৩,২০৫ ডলারের ওপরে তুলতে পারলেই সে দেশ উচ্চ আয়ের বাসিন্দা। মধ্যম আয়ের প্রথম ধাপকে নিম্ন মধ্যম আয় বলা হয়, যেখানে মাথাপিছু আয়ের বন্ধনী ১,০৮৬ থেকে ৪,২৫৫ ডলার। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ মানে তার মাথাপিছু আয় ৪,২৫৬ থেকে ১৩,২০৫ পর্যন্ত। এ সংখ্যাগুলো সময়ে সময়ে বাড়ানো হয় মূলত মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে। মধ্যম আয়ের ফাঁদ বলতে প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১৩ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের মধ্যে আটকে থাকার ঘটনাকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশের সামনে ধাপ দুটো। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, যার জন্য দরকার প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় করা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, যার জন্য দরকার হবে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন। বর্তমানের ২ হাজার ৮০০ ডলারের আয় নিয়ে ৫-৬ ভাগের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে এ দেশ ৭ থেকে ৯ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ে পৌঁছাতে পারবে, যা ঘটবে ২০৩১ সালের পর।

কিন্তু উন্নত দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে কমপক্ষে ২৭ বছর সময় লাগবে, যদি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৬ ভাগ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ ভাগ ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৩ ভাগ। এ থেকে এক ভাগ কমিয়ে ধরলে উচ্চ আয়ের দেশ হতে ৩২ বছরের মতো সময় লাগবে। কে যে ২০৪১-কে উন্নত দেশ হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন? ২৭-৩২ বছরের হিসাবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে ২০৫১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৮০ বছর পূর্তির বছর বা তার পর। কিন্তু মেধাভিত্তিক সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললে এ মাহেন্দ্রক্ষণের আগমন হবে আরও বিলম্বিত।

কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার আগে ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে চমৎকারভাবে এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মহামারির কারণে গত এক দশকের টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্জন স্থবির হয়ে পড়ে। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করতেই নতুন করে আবারও বাধা আসে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। ওলটপালট হয়ে যায় পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট বইয়ে ভারসাম্যের হিসাব ও উন্নত প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশলগত প্রচেষ্টা। বিশ্ব-অর্থনীতির ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখা যায়, এ যাত্রাটা কখনো এক শতকের হতে পারে আবার এক দশকের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র মাথাপিছু আয়ের উত্তরণ ঘটাতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তার ওপর। নিম্ন মাথাপিছু আয় থেকে উচ্চ মাথাপিছু আয়ে পৌঁছাতে এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে কম সময় নিয়েছে। আবার অনেক দেশ আছে যেগুলো মাথাপিছু আয়ের একটি পর্যায়েই পড়ে আছে কয়েক দশক ধরে। এহেন পরিস্থিতিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’।

মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উচ্চ আয়ের পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন, তা প্রণয়ন করা দুষ্কর। বিশেষত প্রতিটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার স্বাতন্ত্র্য এ কাজটিকে আরও কঠিন করে তোলে। অর্থনীতিবিদদের দেখানো বিভিন্ন প্রমাণ অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনামূলক অল্প সময়ের ব্যবধানে আয়সীমায় দুইবার সফল উত্তরণের অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সতর্কবার্তা এখন অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। বর্তমান মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং ২০৩১ ও ২০৪১ সালের মধ্যে যথাক্রমে উচ্চ-মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নের পেছনে ছোটার রাস্তায় অবিচল থাকার জন্য বাংলাদেশকে এখন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট সমাধানের জন্য সুদূরপ্রসারি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানই রয়েছে ওই সব সতর্কতবার্তায়। এ স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সামনে এখনো অসংখ্য বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারপরও এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব যদি দেশের অর্থনৈতিক খাতকে খোলনলচে বদলানো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খারাপ প্রভাবের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার প্রবল ইচ্ছা থাকে। কিন্তু সবার আগে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে সৃষ্ট বর্তমান ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে।

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্বের বহু দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরেও গেছে

সাম্প্রতিক কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির মাধ্যমে যায়নি, ফলে এর আগে কখনো সংস্কারে প্রয়োজনীয়তাও এত বেশি জরুরি মনে হয়নি। অর্থনৈতিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঘুষের মচ্ছব থাকলেও করোনা মহামারির আগে গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দারুণ প্রবৃদ্ধি ঘটছিল। ওই দশকটি ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কিছু বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির মিশ্র দশক। কিন্তু এ সময়ে এসে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বৈত ধাক্কা দেশের অর্থনীতির দুর্বলতাগুলোকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এসব ধাক্কার কারণে বাংলাদেশ এখন বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋত ও ব্যালান্স অভ পেমেন্টের চাপের সঙ্গে লড়াই করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত রাখার জন্য সরকারকে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ জারি করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন ও মান উন্নয়নে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়িক নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই কর্তৃপক্ষকে সংস্কারের কথা বলছেন। সরকারের এজেন্ডায় সংস্কার উদ্যোগ মাঝেমধ্যে ছিল, তবে তা কখনই অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চলমান মন্দা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং মহামারিপূর্ব প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যেতে হবে। মহামারির আগে বেশ কয়েক বছর এ প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ ছিল। করোনা হানা দেয়ার আগের বছরে তো প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top