গৌরমোহন দাস
সনাতন ধর্মের উৎসবাদী কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না। হয় তিথি অনুসারে। মাসে দুটি পক্ষ; সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথির নাম ‘মহালয়া’। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা হয় শুরু। মহাভারতে আছে- দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন তো স্বর্ণই দান করেছেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনো দিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই, স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।
সৌর উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন, দক্ষিণায়ন হলো রাত। উত্তরায়ণের ৬ মাস দেবতারা জাগ্রত থাকেন, আর দক্ষিণায়নের ৬ মাস নিদ্রায় আসক্ত থাকেন দেবতাগণ। উত্তরায়ণের প্রথম দিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসবেন মর্ত্যলোকে। সনাতন ধর্ম অনুসারে এ দিনে প্রয়াতগণের আত্মা মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। আরও একটু পরিস্কার করে বলতে হয়- ‘মহালয়’ বলতে বোঝায় মহান+আলয়= মহালয়। তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত ‘আ’। মহালয় হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। কিন্তু তাহলে মহালয়া (স্ত্রীলিঙ্গ) হলো কেন? পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি, তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরায়ণের লগ্নটির নাম ‘মহালয়া’।
মর্ত্যে এসে প্রয়াতের আত্মা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর থাকেন। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত। জলদানের মাধ্যেমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হলো ‘তর্পণ’। তর্পণ কেন করা হয়? ‘তর্পণ’ মানে খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষগণের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, তাদেরকে খুশি করে শুভ কাজটি করতে ব্রতী হয়। যাদের পিতা-মাতা প্রয়াত তাদের পিতা-মাতার জন্য, সঙ্গে সমগ্র জীব-জগতের জন্য ‘তর্পণ’ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। পিতৃতর্পণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমরা মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করি, তাদেরই প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি।
আশ্বিন মাসের এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানবজীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই। শুধু তাই নয়, মহালয়ায় আমরা প্রার্থনা করি- যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু, যারা জন্ম-জন্মান্তরে আত্মীয় বন্ধু ছিলেন, তারা সবাইই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই, স্মরণ করার জন্যে যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই, তাদেরকেও মহালয়ায় স্মরণ ও মঙ্গলের প্রার্থনা করা হয়- তাদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক। মহালয়ার মহতী ও সার্বজনীন প্রার্থনা সম্পর্কে মার্ক-েয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ তর্পণে/শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
[লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]
গৌরমোহন দাস
শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৩
সনাতন ধর্মের উৎসবাদী কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না। হয় তিথি অনুসারে। মাসে দুটি পক্ষ; সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথির নাম ‘মহালয়া’। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা হয় শুরু। মহাভারতে আছে- দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন তো স্বর্ণই দান করেছেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনো দিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই, স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।
সৌর উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন, দক্ষিণায়ন হলো রাত। উত্তরায়ণের ৬ মাস দেবতারা জাগ্রত থাকেন, আর দক্ষিণায়নের ৬ মাস নিদ্রায় আসক্ত থাকেন দেবতাগণ। উত্তরায়ণের প্রথম দিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসবেন মর্ত্যলোকে। সনাতন ধর্ম অনুসারে এ দিনে প্রয়াতগণের আত্মা মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। আরও একটু পরিস্কার করে বলতে হয়- ‘মহালয়’ বলতে বোঝায় মহান+আলয়= মহালয়। তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত ‘আ’। মহালয় হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। কিন্তু তাহলে মহালয়া (স্ত্রীলিঙ্গ) হলো কেন? পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি, তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরায়ণের লগ্নটির নাম ‘মহালয়া’।
মর্ত্যে এসে প্রয়াতের আত্মা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর থাকেন। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত। জলদানের মাধ্যেমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হলো ‘তর্পণ’। তর্পণ কেন করা হয়? ‘তর্পণ’ মানে খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষগণের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, তাদেরকে খুশি করে শুভ কাজটি করতে ব্রতী হয়। যাদের পিতা-মাতা প্রয়াত তাদের পিতা-মাতার জন্য, সঙ্গে সমগ্র জীব-জগতের জন্য ‘তর্পণ’ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। পিতৃতর্পণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমরা মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করি, তাদেরই প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি।
আশ্বিন মাসের এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানবজীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই। শুধু তাই নয়, মহালয়ায় আমরা প্রার্থনা করি- যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু, যারা জন্ম-জন্মান্তরে আত্মীয় বন্ধু ছিলেন, তারা সবাইই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই, স্মরণ করার জন্যে যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই, তাদেরকেও মহালয়ায় স্মরণ ও মঙ্গলের প্রার্থনা করা হয়- তাদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক। মহালয়ার মহতী ও সার্বজনীন প্রার্থনা সম্পর্কে মার্ক-েয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ তর্পণে/শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
[লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]