কাজী মাসুদুর রহমান
‘শিক্ষা’ গভীর সংজ্ঞায়িত ও ব্যাপক বিবৃত একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সংক্ষেপে বলতে- শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত রিপু সমষ্টি (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) অবদমনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটিয়ে ব্যক্তির সাথে সৃষ্টির এক হিতৈষী মেলবন্ধন সৃষ্টি করে সুসভ্যতার জাগরণ ঘটায়। শিক্ষার মূল দর্শনই হলো ‘নৈতিকতা’। কালের আবর্তে সভ্যতার ক্রমবিকাশমান ধারায় শিক্ষার বিচিত্র বিষয়ভিত্তিক শাখা-প্রশাখা (যেমন-বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কলা, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রকৌশল ইত্যাদি) সৃষ্টি হলেও, শিক্ষার এই ভিত্তিমূলকে (নৈতিকতা) অস্বীকার বা হেয় জ্ঞান করে তা কখনই সার্থক হতে পারে না।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পুস্তক ও প্রতিষ্ঠান শিক্ষার দুই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এ দুটি উপকরণ শিক্ষার্থীর শিক্ষা চর্চাকে পদ্ধতিগতভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। শিক্ষক হলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, পুস্তক ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ামক ও সঞ্চালক। তিনি একটি সুসভ্য সমাজ বিনির্মাণের কারিগরও বটে যদি তার প্রদর্শিত শিক্ষার মধ্যে উল্লেখিত নৈতিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটে। এই মহতী বিচারে শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, এটি একটি মহান ‘ব্রত’ ও বটে। আমাদের সমাজে শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশায় কতটুকু আদর্শিক হতে পারছে তা বহুবিচিত্র ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে কখনো-কখনো একটি জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়, যা এই স্বল্প পরিসরে সবিস্তারে বিবৃত করা সম্ভব নয়।
গত ৮ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা চলাকালে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে কর্তব্যরত এক শিক্ষক দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের খাতা কেড়ে নেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রটি শিক্ষককে কক্ষের সব ছাত্রের সামনে চড়-থাপ্পড় মারে যার ভিডিও রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পরের দিন ৯ অক্টোবর পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার আরজ বেগি এসএ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক ছাত্র নির্বাচনী পরীক্ষার ফি পরিশোধ না করায় প্রধান শিক্ষক তাকে অশ্রাব্য ভাষায় অপমান পূর্বক চড়-থাপ্পড় মেরে লাঞ্ছিত করে। পরে ছাত্রটি অভিমানে আত্মহত্যা করে। উল্লেখ্য, ছাত্রটি ওই বিদ্যালয়েরই সাবেক প্রধান শিক্ষক মৃত গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র। আর্থিক অনটনের কারণে সে ফিস দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ঘটনাটি খুবই হৃদয়বিদারক মর্মে সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে।
ঘটনা দুটির বৈশ্লষণিক ব্যবচ্ছেদ করলে- প্রথম ঘটনায় ছাত্রের এবং দ্বিতীয় ঘটনায় শিক্ষকের নৈতিক দৈন্যতার হিংসাত্মক চিত্র ভয়াবহ রূপে ফুটে উঠেছে! বলাবাহুল্য, এ জাতীয় ঘটনা আমাদের শিক্ষা সমাজে নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন জাগে, দিন-দিন শিক্ষা সমাজ কেন এমন অসহিষ্ণু ও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে? তবে কি শিক্ষা প্রণয়ন ও প্রয়োগের মধ্যেই কোনো গলদ লুকিয়ে আছে? এগুলো এখন সময়োচিত জিজ্ঞাসা। ২০০০ সালের পূর্বের দশকগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন ঘটতে দেখা যায়নি। তখন শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা-ভক্তির শিষ্টাচার কাজ করতো। কোনো কারণে শিক্ষকের আশীর্বাদ ও স্নেহচ্যুতি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সতর্ক থাকতো।
পাশাপাশি শিক্ষকরাও নিজেদের শ্রদ্ধাশীল ও আদর্শিক অবস্থানকে সযত্নে লালন করতো। কোনো কারণে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর ওপর শাসন-অনুশাসন চালালেও পরবর্তীতে ওই শিক্ষকের পিতৃ-মাতৃতুল্য স্নেহের আবেশে শিক্ষার্থীর মননে পরিশুদ্ধ বোধের চেতনা জাগতো। শিক্ষকদের আদর্শিক ব্যক্তিত্ব এতো প্রখর ছিল যে, পাড়ার উচ্ছৃঙ্খল যুবক বা সন্ত্রাসীরাও রাস্তাঘাটে শিক্ষকদের দেখলে অনেক সময় লুকিয়ে যেত অথবা শ্রদ্ধাবনত হয়ে সম্মান জানাতো। কোথায় গেল সেই দিনগুলো? তবে এখন আমরা কি শিখছি, কি শেখাচ্ছি?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্যায়। সমগ্র শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্তর হলো প্রাথমিক; কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শিশু উপযোগী হয়ে ওঠেনি। অধিকাংশেরও বেশি শিক্ষকরা শিশুবান্ধব শিক্ষাদানে পারদর্শী নন।
উল্লেখ্য, প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে শিশুদের পড়াশুনায় শিক্ষকরা যতটা যত্নশীল তার ধারের কাছেও সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা নেই। অথচ শহরকেন্দ্রিক অনেক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা মাত্র ১৫০০-২০০০ টাকা মাসিক বেতনেও শিক্ষা দান করছেন। আর মফস্বল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের অবস্থা তো খুবই করুণ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এ দুটি বয়সি শিক্ষার্থীদের কোমল মননে যত সহজে শিক্ষা ও দীক্ষার বীজ বপন করা যায় তা অন্যতে এত সহজে যায় না। মূলত পাঠ, অনুধাবন, আত্মস্থকরণ ও প্রয়োগ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই চার মূলকৌশলকে আয়ত্ত করে শিক্ষার্থীদের চিন্তার প্রসারতা বাড়াতে সৃজনশীল পদ্ধতির অবতারণা করা হয়। ২০০৮ সাল থেকে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়ে ২০১০ সাল থেকে তা পূর্ণরূপে চালু হয়।
উন্নত বিশ্বের সফলতা অনুকরণে এ পদ্ধতি চালু হলেও বাংলাদেশে এর সফলতা এখনো যথেষ্ট লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। কেননা সৃজনশীল পদ্ধতি চর্চার ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক ধারণার বাইরে যে তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় তা অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঠাগার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। শ্রেণীভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুচিন্তার প্রসারতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব পাঠাগারের প্রচলন করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য সিংহভাগ ছাত্র ও শিক্ষকরা লাইব্রেরি ওয়ার্ক করেন না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় পাঠাগারই অকার্যকর থাকে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষাচর্চার বেহাল দশার কথা তো এখন মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে লাইব্রেরি ওয়ার্ক তো দূরের কথা, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম গড় হাজিরাই ঠিকমতো হয় না। এখানে অনুশাসনিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। এখানকার পড়াশোনা সাধারণত বর্ষগণনা ও সিলেবাস সার্চিংয়ের মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ।
বলাবাহুল্য, শিক্ষকদেরই যদি পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে জ্ঞানচর্চার স্পৃহা না জন্মে তবে শিক্ষার্থীর মধ্যে কিভাবে জন্মাবে? প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্তর ভেদে মননশীল নৈতিক শিক্ষা দান অত্যন্ত জরুরি। কেননা এ সময়ের নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষাই তার জীবনের পরবর্তী স্তরে পাথেয় রূপে কাজ করে। এ শিক্ষা দানে শিক্ষকদের যে বিশেষায়িত ধারণা থাকা উচিত তা অধিকাংশ শিক্ষকদেরই নাই বলা চলে। আবার ধারণা প্রয়োগে যে মোটিভেশনাল কৌশল জানা উচিৎ তাও অধিকাংশেরও বেশিদের নাই মর্মে পরস্থিতি পর্যবেক্ষণে তা প্রতীয়মান হয়।
কেননা আজকাল তরুণ শিক্ষার্থীরা হতাশায় নিমজ্জিত। এদের মধ্যে জীবনের মর্মবোধ নাই বললেই চলে। নাই কোনো সামজিক দায়িত্ব বোধও। হতাশার কোপানলে পরে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে- শুধু ২০২২ সালেই ৫৩২ জন তরুণ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে; যা রীতিমতো লোমহর্ষক। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ জন। এমন ভয়াবহতা আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যতই প্রশ্নবিদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সৃজনশীল শিক্ষা শুধু কাঠামোবদ্ধ পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এই আবদ্ধ পাঠ থেকে জন্ম নিচ্ছে জিপিএ গ্রেড পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা! এ অসুস্থতায় আক্রান্ত এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ গোটা শিক্ষক সমাজ।
শিক্ষার্থীদের মননে মগজে জন্ম নিচ্ছ না কোনো সৃষ্টিশীল চেতনা। ফলে তাদের মধ্যে উদ্রেক হয় না- মানব প্রেম, স্বদেশ প্রেমের মতো মানবীয় গুণাবলীগুলো। বহু তরুণ মেধাবীরা মাতৃ-স্বদেশকে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসক ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিন্তু সেবক ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে নয়। এমনকি মেডিকেল, প্রকৌশলের মতো গণমুখী সেবার পেশা বাদ দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে ঝুঁকছে মেধাবীরা। ক্ষমতা, বিত্ত-বৈভবই যেন শিক্ষার সার্বিক সার্থকতা! উচ্চশিক্ষা স্তরের এক শ্রেণীর শিক্ষকরা(?) ইতিহাস বিকৃতির অনৈতিক চর্চায় মত্ত। সন্দিগ্ধ হচ্ছে প্রজন্মের জাতীয়তাবোধ।
নৈতিকতার শিক্ষণীয় কথা এখন যেন আষাঢ়ের গল্প কথার মতো অপাংক্তেয় বচন। একশ্রেণীর শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিতরা এখন ছোট-বড় করপোরেট ও নন-করপোরেট দুর্নীতিবাজ। মাতৃভূমি, স্বদেশ যেন তাদের কাছে রঙ্গলীলা মঞ্চ। এদের অনৈতিক আভিজাত্য সমাজকে ক্রমশ গ্রাস করছে। এতে প্রভাবিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। ফলে যেভাবেই হোক বিত্ত বনে যেতে হবে- শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মগজে এমন ধারণাটি এখন বদ্ধমূল হয়ে গেছে। পড়াশোনা যেন কেবলই বিত্ত-বৈভব সৃষ্টির মেশিন! ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চরে সে’- বিগত শিশুর কোমল মননে বেনিয়া ব্রিটিশ সৃষ্ট এই পুঁজিবাদী চেতনা এখন প্রজন্ম পরম্পরা গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে পড়ালেখা শিখে যেভাবেই হোক আমার গাড়ি চাই, বাড়ি চাই। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে শ্রেণী-বৈষম্য। ফলে ভুলূণ্ঠিত হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য। কবির ভাষায়- ‘লেখাপড়া করে যে/গুণে মানে বড় সে’; ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি...’ এবং ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর...’-শিশুর মননে, মগজে এমনই সৃজনশীল শিক্ষার মর্মবোধ গ্রোথিত হোক। শিক্ষার্থীদের সমগ্র জীবনে প্রতিফলিত হোক এমনই নৈতিক শিক্ষার নীতিবোধ। কেননা আজকের শিক্ষার্থী আগামীতে শিক্ষক। শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন যে আঙ্গিকেই হোক না কেন, নৈতিকতাপুষ্ট সৃজনশীল শিক্ষার এই নীতিবোধ যেন শিক্ষার্থীর জীবনে আমরণ অটুট থাকে। তবেই দূর হবে সব আঁধার। সার্থকতা পাবে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
কাজী মাসুদুর রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৩
‘শিক্ষা’ গভীর সংজ্ঞায়িত ও ব্যাপক বিবৃত একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সংক্ষেপে বলতে- শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত রিপু সমষ্টি (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) অবদমনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটিয়ে ব্যক্তির সাথে সৃষ্টির এক হিতৈষী মেলবন্ধন সৃষ্টি করে সুসভ্যতার জাগরণ ঘটায়। শিক্ষার মূল দর্শনই হলো ‘নৈতিকতা’। কালের আবর্তে সভ্যতার ক্রমবিকাশমান ধারায় শিক্ষার বিচিত্র বিষয়ভিত্তিক শাখা-প্রশাখা (যেমন-বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কলা, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রকৌশল ইত্যাদি) সৃষ্টি হলেও, শিক্ষার এই ভিত্তিমূলকে (নৈতিকতা) অস্বীকার বা হেয় জ্ঞান করে তা কখনই সার্থক হতে পারে না।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পুস্তক ও প্রতিষ্ঠান শিক্ষার দুই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এ দুটি উপকরণ শিক্ষার্থীর শিক্ষা চর্চাকে পদ্ধতিগতভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। শিক্ষক হলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, পুস্তক ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ামক ও সঞ্চালক। তিনি একটি সুসভ্য সমাজ বিনির্মাণের কারিগরও বটে যদি তার প্রদর্শিত শিক্ষার মধ্যে উল্লেখিত নৈতিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটে। এই মহতী বিচারে শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, এটি একটি মহান ‘ব্রত’ ও বটে। আমাদের সমাজে শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশায় কতটুকু আদর্শিক হতে পারছে তা বহুবিচিত্র ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে কখনো-কখনো একটি জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়, যা এই স্বল্প পরিসরে সবিস্তারে বিবৃত করা সম্ভব নয়।
গত ৮ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা চলাকালে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে কর্তব্যরত এক শিক্ষক দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের খাতা কেড়ে নেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রটি শিক্ষককে কক্ষের সব ছাত্রের সামনে চড়-থাপ্পড় মারে যার ভিডিও রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পরের দিন ৯ অক্টোবর পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার আরজ বেগি এসএ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক ছাত্র নির্বাচনী পরীক্ষার ফি পরিশোধ না করায় প্রধান শিক্ষক তাকে অশ্রাব্য ভাষায় অপমান পূর্বক চড়-থাপ্পড় মেরে লাঞ্ছিত করে। পরে ছাত্রটি অভিমানে আত্মহত্যা করে। উল্লেখ্য, ছাত্রটি ওই বিদ্যালয়েরই সাবেক প্রধান শিক্ষক মৃত গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র। আর্থিক অনটনের কারণে সে ফিস দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ঘটনাটি খুবই হৃদয়বিদারক মর্মে সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে।
ঘটনা দুটির বৈশ্লষণিক ব্যবচ্ছেদ করলে- প্রথম ঘটনায় ছাত্রের এবং দ্বিতীয় ঘটনায় শিক্ষকের নৈতিক দৈন্যতার হিংসাত্মক চিত্র ভয়াবহ রূপে ফুটে উঠেছে! বলাবাহুল্য, এ জাতীয় ঘটনা আমাদের শিক্ষা সমাজে নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন জাগে, দিন-দিন শিক্ষা সমাজ কেন এমন অসহিষ্ণু ও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে? তবে কি শিক্ষা প্রণয়ন ও প্রয়োগের মধ্যেই কোনো গলদ লুকিয়ে আছে? এগুলো এখন সময়োচিত জিজ্ঞাসা। ২০০০ সালের পূর্বের দশকগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন ঘটতে দেখা যায়নি। তখন শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা-ভক্তির শিষ্টাচার কাজ করতো। কোনো কারণে শিক্ষকের আশীর্বাদ ও স্নেহচ্যুতি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সতর্ক থাকতো।
পাশাপাশি শিক্ষকরাও নিজেদের শ্রদ্ধাশীল ও আদর্শিক অবস্থানকে সযত্নে লালন করতো। কোনো কারণে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর ওপর শাসন-অনুশাসন চালালেও পরবর্তীতে ওই শিক্ষকের পিতৃ-মাতৃতুল্য স্নেহের আবেশে শিক্ষার্থীর মননে পরিশুদ্ধ বোধের চেতনা জাগতো। শিক্ষকদের আদর্শিক ব্যক্তিত্ব এতো প্রখর ছিল যে, পাড়ার উচ্ছৃঙ্খল যুবক বা সন্ত্রাসীরাও রাস্তাঘাটে শিক্ষকদের দেখলে অনেক সময় লুকিয়ে যেত অথবা শ্রদ্ধাবনত হয়ে সম্মান জানাতো। কোথায় গেল সেই দিনগুলো? তবে এখন আমরা কি শিখছি, কি শেখাচ্ছি?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্যায়। সমগ্র শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্তর হলো প্রাথমিক; কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শিশু উপযোগী হয়ে ওঠেনি। অধিকাংশেরও বেশি শিক্ষকরা শিশুবান্ধব শিক্ষাদানে পারদর্শী নন।
উল্লেখ্য, প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে শিশুদের পড়াশুনায় শিক্ষকরা যতটা যত্নশীল তার ধারের কাছেও সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা নেই। অথচ শহরকেন্দ্রিক অনেক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা মাত্র ১৫০০-২০০০ টাকা মাসিক বেতনেও শিক্ষা দান করছেন। আর মফস্বল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের অবস্থা তো খুবই করুণ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এ দুটি বয়সি শিক্ষার্থীদের কোমল মননে যত সহজে শিক্ষা ও দীক্ষার বীজ বপন করা যায় তা অন্যতে এত সহজে যায় না। মূলত পাঠ, অনুধাবন, আত্মস্থকরণ ও প্রয়োগ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই চার মূলকৌশলকে আয়ত্ত করে শিক্ষার্থীদের চিন্তার প্রসারতা বাড়াতে সৃজনশীল পদ্ধতির অবতারণা করা হয়। ২০০৮ সাল থেকে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়ে ২০১০ সাল থেকে তা পূর্ণরূপে চালু হয়।
উন্নত বিশ্বের সফলতা অনুকরণে এ পদ্ধতি চালু হলেও বাংলাদেশে এর সফলতা এখনো যথেষ্ট লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। কেননা সৃজনশীল পদ্ধতি চর্চার ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক ধারণার বাইরে যে তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় তা অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঠাগার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। শ্রেণীভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুচিন্তার প্রসারতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব পাঠাগারের প্রচলন করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য সিংহভাগ ছাত্র ও শিক্ষকরা লাইব্রেরি ওয়ার্ক করেন না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় পাঠাগারই অকার্যকর থাকে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষাচর্চার বেহাল দশার কথা তো এখন মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে লাইব্রেরি ওয়ার্ক তো দূরের কথা, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম গড় হাজিরাই ঠিকমতো হয় না। এখানে অনুশাসনিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। এখানকার পড়াশোনা সাধারণত বর্ষগণনা ও সিলেবাস সার্চিংয়ের মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ।
বলাবাহুল্য, শিক্ষকদেরই যদি পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে জ্ঞানচর্চার স্পৃহা না জন্মে তবে শিক্ষার্থীর মধ্যে কিভাবে জন্মাবে? প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্তর ভেদে মননশীল নৈতিক শিক্ষা দান অত্যন্ত জরুরি। কেননা এ সময়ের নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষাই তার জীবনের পরবর্তী স্তরে পাথেয় রূপে কাজ করে। এ শিক্ষা দানে শিক্ষকদের যে বিশেষায়িত ধারণা থাকা উচিত তা অধিকাংশ শিক্ষকদেরই নাই বলা চলে। আবার ধারণা প্রয়োগে যে মোটিভেশনাল কৌশল জানা উচিৎ তাও অধিকাংশেরও বেশিদের নাই মর্মে পরস্থিতি পর্যবেক্ষণে তা প্রতীয়মান হয়।
কেননা আজকাল তরুণ শিক্ষার্থীরা হতাশায় নিমজ্জিত। এদের মধ্যে জীবনের মর্মবোধ নাই বললেই চলে। নাই কোনো সামজিক দায়িত্ব বোধও। হতাশার কোপানলে পরে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে- শুধু ২০২২ সালেই ৫৩২ জন তরুণ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে; যা রীতিমতো লোমহর্ষক। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ জন। এমন ভয়াবহতা আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যতই প্রশ্নবিদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সৃজনশীল শিক্ষা শুধু কাঠামোবদ্ধ পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এই আবদ্ধ পাঠ থেকে জন্ম নিচ্ছে জিপিএ গ্রেড পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা! এ অসুস্থতায় আক্রান্ত এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ গোটা শিক্ষক সমাজ।
শিক্ষার্থীদের মননে মগজে জন্ম নিচ্ছ না কোনো সৃষ্টিশীল চেতনা। ফলে তাদের মধ্যে উদ্রেক হয় না- মানব প্রেম, স্বদেশ প্রেমের মতো মানবীয় গুণাবলীগুলো। বহু তরুণ মেধাবীরা মাতৃ-স্বদেশকে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসক ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিন্তু সেবক ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে নয়। এমনকি মেডিকেল, প্রকৌশলের মতো গণমুখী সেবার পেশা বাদ দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে ঝুঁকছে মেধাবীরা। ক্ষমতা, বিত্ত-বৈভবই যেন শিক্ষার সার্বিক সার্থকতা! উচ্চশিক্ষা স্তরের এক শ্রেণীর শিক্ষকরা(?) ইতিহাস বিকৃতির অনৈতিক চর্চায় মত্ত। সন্দিগ্ধ হচ্ছে প্রজন্মের জাতীয়তাবোধ।
নৈতিকতার শিক্ষণীয় কথা এখন যেন আষাঢ়ের গল্প কথার মতো অপাংক্তেয় বচন। একশ্রেণীর শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিতরা এখন ছোট-বড় করপোরেট ও নন-করপোরেট দুর্নীতিবাজ। মাতৃভূমি, স্বদেশ যেন তাদের কাছে রঙ্গলীলা মঞ্চ। এদের অনৈতিক আভিজাত্য সমাজকে ক্রমশ গ্রাস করছে। এতে প্রভাবিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। ফলে যেভাবেই হোক বিত্ত বনে যেতে হবে- শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মগজে এমন ধারণাটি এখন বদ্ধমূল হয়ে গেছে। পড়াশোনা যেন কেবলই বিত্ত-বৈভব সৃষ্টির মেশিন! ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চরে সে’- বিগত শিশুর কোমল মননে বেনিয়া ব্রিটিশ সৃষ্ট এই পুঁজিবাদী চেতনা এখন প্রজন্ম পরম্পরা গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে পড়ালেখা শিখে যেভাবেই হোক আমার গাড়ি চাই, বাড়ি চাই। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে শ্রেণী-বৈষম্য। ফলে ভুলূণ্ঠিত হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য। কবির ভাষায়- ‘লেখাপড়া করে যে/গুণে মানে বড় সে’; ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি...’ এবং ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর...’-শিশুর মননে, মগজে এমনই সৃজনশীল শিক্ষার মর্মবোধ গ্রোথিত হোক। শিক্ষার্থীদের সমগ্র জীবনে প্রতিফলিত হোক এমনই নৈতিক শিক্ষার নীতিবোধ। কেননা আজকের শিক্ষার্থী আগামীতে শিক্ষক। শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন যে আঙ্গিকেই হোক না কেন, নৈতিকতাপুষ্ট সৃজনশীল শিক্ষার এই নীতিবোধ যেন শিক্ষার্থীর জীবনে আমরণ অটুট থাকে। তবেই দূর হবে সব আঁধার। সার্থকতা পাবে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]