গৌতম রায়
ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী সিঙ্গুরে টাটাদের তৈরি কারখানা ডিনোমাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সুদসহ একটা মোটা অঙ্কের টাকা টাটা গোষ্ঠীকে দিতে হবে। ইতোমধ্যেই এই টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন। কুযুক্তিরও অবতারণা করছেন। এই রায় ভেস্তে দিতে আদালতের স্মরণ নেওয়ার প্রস্তুতি যে করছেন তা আর আলাদা করে বলবার দরকার নেই।
টাটা গোষ্ঠীর তৈরি কারখানা ডিনোমাইট দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার আর্থিক খেসারত মমতার সরকার কতদিনে দেবেন, আদৌ দেবেন কি না- এসব তর্কে না ঢুকে গোটা বিষয়টি ঘিরে প্রথমেই একটা প্রশ্ন তোলা যাক। বিশ্বের কোন দেশে একটা নির্বাচিত সরকার কেবলমাত্র সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া একটা কারখানা, যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান হতে পারতো, যে কারখানাকে ঘিরে আরও বহু অনুসারী শিল্প হতো, যার জেরে আরও বহু বেকার মানুষের চাকরি হতো, গোটা রাজ্যেরই কেবল নয়, ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিটাই বদলে যেতে পারতো, এমন কোন কারখানাকে ডিনোমাইট দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে- তার একটিও নজির আছে?
মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির রাজ্য গুজরাটে গণহত্যা বিজেপিকে বাঁচাতে টাটার ন্যানো কারখানা সেখানকার সানন্দে পাঠানোর সবধরনের দায়বদ্ধতা যে মমতার ছিল, তা আর আজ নতুন করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে বোঝাবার দরকার নেই; কিন্তু মোদির স্বার্থপূরণের ইনাম হিসেবে নিজে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে বসবার পর, টাটার সঙ্গে নতুন করে কথা বলে, নিজের দাবি মতো জমি ছাড়ের বিষয়টি ঘিরে একটা সমঝোতা করে কি সিঙ্গুরে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া ওই কারখানাটাকে টাটাদের দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারতেন না মমতা? রাজনৈতিক প্রশ্নে বামেদের সঙ্গে তার যত বিরোধই থাকুক না কেন, মতদ্বৈত থাকুক না কেন, সিঙ্গুরে টাটাদের ছেড়ে যাওয়া কারখানা, যা প্রায় চালু হওয়ার মতো অবস্থাতে এসে গিয়েছিল, সেখানে যদি মমতা টাটাদের আবার নিয়ে আসবার অন্তত একটা প্রস্তাবও দিতেন, তখন সুস্থ থাকা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি রাজ্যের বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে সেদিন এতটুকু বিরোধিতা করতেন? নাকি মমতার ডাকে ইতিবাচক অবস্থান নেওয়ার জন্যে টাটাদের প্রতি আহ্বান জানাতেন বুদ্ধবাবু ও তার সতীর্থরা?
সিঙ্গুরের জমি ঘিরে মামলা হলো ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে। রায়কে কতোখানি প্রভাবিত করা হয়েছে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আছে। রায় আদালত যাই দিন না কেন, প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিকে আবার চাষযোগ্য করে তোলা বাস্তবসম্মত বিষয় হতে পারে না- এটা প্রতিটি স্তরের মানুষ জানতেন। তাহলে সেখানে প্রতীকী চাষের উদ্ধেশ্যে মমতার যে সরষে ছড়ানো, সেটা কি মানুষের সঙ্গে সর্ব অর্থে প্রতারণা নয়? যদি ওই জমি চাষের উপযুক্ত মনে করেই মমতা চাষের উদ্দেশে সেখানে সরষে ছিটিয়ে থাকেন প্রচারমাধ্যমের বহর নিয়ে, তাহলে কেন ওই জমিতে এতকাল পরেও একটা ধান বা অন্য কোনো ফসলের আবাদ হলো না? আর যদি প্রায় শেষ হয়ে আসা কারখানার জমি আর চাষের উপযোগী অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা কৃষিবিজ্ঞান অনুযায়ী না থেকে থাকে, তাহলে সরষে ছিটিয়ে চাষযোগ্য করবার অভিনয় কেন করলেন মুখ্যমন্ত্রী? রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, সরকারি পদে বসে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে এতখানি মিথ্যাচার করছেন, মমতার আগে এই দৃশ্য দেখবার দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের আর হয়নি।
সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি ন্যানোর কারখানা যদি টাটারা তৈরি করতে পারতেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতো তার জেরে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষে এই রাজ্য থেকে বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করা সুদূরপরাহত বিষয় ছিল। ঠিক সেই কারণেই সিঙ্গুরকে একটা উপলক্ষ করে মমতাকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির একটা বড় রকমের বোঝাপড়া সেদিন হয়েছিল। সেই বোঝাপড়াতে সব থেকে বড় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল কমিউনিস্ট নামধারী সমস্ত রকমের অকিউনিস্টরা। দুঃখজনক হলেও এটা স্বীকার করতে হয়, একদা শ্রেণী সহযোগিতাবাদী সিপিআই নেতৃত্বের গীতা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর রাজনৈতিক চরিত্রের যে স্খলন ঘটেছিল, তার জেরে কমিউনিস্টদের দুর্বল করাটাই হয়ে উঠেছিল সিপিআই নেতাদের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। সিপিআই নেতা নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ, আরএসপি নেতা ক্ষিতি গোস্বামীদের তখন একটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল- মমতার শক্তি বৃদ্ধি করে বুদ্ধবাবুকে খাটো করা। আজকের তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মাধ্যমে মমতার সঙ্গে অশোক ঘোষ, নন্দগোপালের মতো ভেকধারী বামপন্থিদের তখন যোগসূত্র ছিল সিপিআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এনজিও ‘বিশ্বকোষ পরিষদের’ পার্থ সেনগুপ্ত।
এই পরিসর রচনার কি খেসারত পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আজ দিতে হচ্ছে, তা কেবল তৃণমূল বিরোধী মানুষজনেরাই নন, খোদ তৃণমূলের অতিবড় সমর্থকেরাও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। যদি আজ হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ছোট গাড়ি ন্যানো তৈরির কারখানাটি শেষপর্যন্ত গড়ে উঠতে পারতো, তাহলে কেবল সিঙ্গুর বা হুগলি জেলার আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উপরেই তার প্রভাব পড়তো না। জামশেদপুরে (ঝড়খন্ড) টাটা কোম্পানির যে স্টিল প্লান্ট, টিসকো, সেই কোম্পানি গোটা অবিভক্ত বিহারে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কি ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, সেদিকে যদি আমরা একটু নজর দিই, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারব যে, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ন্যানো গাড়ির কারখানা তৈরি হলে এই রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কি ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসা সম্ভবপর ছিল।
জামশেদপুরে কেবল তো টাটা কোম্পানির টিসকোই নয়, টিসকোর সহযোগী যেসব অনুসারী শিল্প সেখানে গড়ে উঠেছে, যেমন- টেলকো, টিনপ্লেট ইত্যাদি, এসব অনুসারী শিল্পতেও একটা বড় অংশের কর্মসংস্থান ঘটেছে। এই কর্মসংস্থানের বিষয়টি যে কেবল সাবেক কালের অবিভক্ত বিহার রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। টিসকোসহ সেখানকার সমস্ত অনুসারী শিল্পে আজ গোটা দেশের মানুষ নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানে যুক্ত আছে। পশ্চিমবঙ্গের রেল শহর খড়গপুর যেমন একটা বৈচিত্র্যময় ভারতের ক্ষুদ্র সংস্করণ, ঠিক তেমনই জামশেদপুরও আজ বৈচিত্র্যময় ভারতের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। যদি সিঙ্গুরে কারখানা হতো, তবে কেবল সিঙ্গুর নয়, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ ও আজ বৈচিত্র্যময় ভারতের একটা মিনি সংস্করণ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারতো। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার দোসর হিসেবে যে জাত-ভাষা-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আজ পশ্চিমবঙ্গকে ক্রমশ ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করাচ্ছে, এমন সুযোগ প্রতিক্রিশীল শক্তি আদৌ পেতোই না।
শিল্পতাড়–য়া হিসেবে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পর শিল্পায়ন তো দূরের কথা, কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে মমতার সরকার এতটুকু গুরুত্ব দেয়নি। সরকারি স্তরে যেসব চাকরি হয়েছে, তার ভিতর বেশিরভাগই হয়েছে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে। মমতার শাসনকাল শুরু হওয়ার পর এই রাজ্যে সরকারি স্তরে যতগুলো চাকরি হয়েছে, সেসব চাকরির প্রায় প্রতিটিই এখন হয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইইডির স্কানারের নিচে, নতুবা মহামান্য হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের স্কানারের ভিতরে। একজন-দুজন মানুষ, যারা হয়তো যোগ্যতার নিরিখে চাকরি পেয়েছেন, তারাও আজ নানারকম সামাজিক ট্রোলের শিকার। তাদেরও আজ মুড়ি মিছরি একদর হিসেবে সমাজ দেখতে শুরু করেছে।
কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে শিকেয় তুলে রেখে মমতা ও তার প্রশাসন এমন এক অদ্ভুত ডোল প্রক্রিয়া গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে কায়েম করেছেন যার সুবাদে মার্কসের ভাষায় সমাজের যে অংশকে ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েট’ বা ‘সামাজিক আবর্জনা’ বলা হয়, সেই অংশ টাকেই কুক্ষিগত করে, তাদের দিয়েই গোটা সামাজিক পরিকাঠামোটাকে পরিচালিত করছেন। গোটা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে এখন এই সামাজিক আবর্জনাদের কাছে লুটে পুটে খাওয়ার এক অনবদ্য মুক্তাঞ্চলে পরিণত করেছে যৌথভাবে দিল্লির শাসকেরা এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসকেরা। মানুষের মর্যাদাবোধকে এই দুই শাসক যৌথভাবে নামিয়ে এনেছে পাঁচশ বা হাজার টাকার কোনো সরকারি ডোল প্রকল্পের হাতছানির ভিতরে।
যে অংশের মানুষকে তথাকথিত সিঙ্গুর আন্দোলনের নামে মমতা একদিন রাজ্যে কৃষি সঙ্কটের একটা কাল্পনিক ভয়ভহকতার গল্প শুনিয়েছিলেন, সমাজের সেই অংশের মানুষ, যাদের প্রথাগত শিক্ষার তেমন একটা সুযোগ ঘটেনি, সেই অংশের মানুষকে এখন দুই-পাঁচশ টাকা ডোল দিয়ে, পাড়া শাসন করবার ছাড়পত্র দিয়ে, সিন্ডিকেট রাজের মাধ্যমে করেকম্মে খেয়ে পড়ে থাকবার সুযোগ করে দিয়ে, কোথায় গেল আমার চাষের জমি, টাটা তো কারখানা করলো না, বিনিময়ে আমরা সাধারণ মানুষ কি পেলাম? আমরা খাব কি? আমরা থাকব কোথায়? আমদের পরনের কাপড় কোথায়? আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা কোথায়? স্বাস্থ্য কোথায়? এসব প্রশ্ন তুলতেই ভুলিয়ে দিয়েছে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ১০ নভেম্বর ২০২৩
ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী সিঙ্গুরে টাটাদের তৈরি কারখানা ডিনোমাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সুদসহ একটা মোটা অঙ্কের টাকা টাটা গোষ্ঠীকে দিতে হবে। ইতোমধ্যেই এই টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন। কুযুক্তিরও অবতারণা করছেন। এই রায় ভেস্তে দিতে আদালতের স্মরণ নেওয়ার প্রস্তুতি যে করছেন তা আর আলাদা করে বলবার দরকার নেই।
টাটা গোষ্ঠীর তৈরি কারখানা ডিনোমাইট দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার আর্থিক খেসারত মমতার সরকার কতদিনে দেবেন, আদৌ দেবেন কি না- এসব তর্কে না ঢুকে গোটা বিষয়টি ঘিরে প্রথমেই একটা প্রশ্ন তোলা যাক। বিশ্বের কোন দেশে একটা নির্বাচিত সরকার কেবলমাত্র সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া একটা কারখানা, যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান হতে পারতো, যে কারখানাকে ঘিরে আরও বহু অনুসারী শিল্প হতো, যার জেরে আরও বহু বেকার মানুষের চাকরি হতো, গোটা রাজ্যেরই কেবল নয়, ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিটাই বদলে যেতে পারতো, এমন কোন কারখানাকে ডিনোমাইট দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে- তার একটিও নজির আছে?
মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির রাজ্য গুজরাটে গণহত্যা বিজেপিকে বাঁচাতে টাটার ন্যানো কারখানা সেখানকার সানন্দে পাঠানোর সবধরনের দায়বদ্ধতা যে মমতার ছিল, তা আর আজ নতুন করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে বোঝাবার দরকার নেই; কিন্তু মোদির স্বার্থপূরণের ইনাম হিসেবে নিজে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে বসবার পর, টাটার সঙ্গে নতুন করে কথা বলে, নিজের দাবি মতো জমি ছাড়ের বিষয়টি ঘিরে একটা সমঝোতা করে কি সিঙ্গুরে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া ওই কারখানাটাকে টাটাদের দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারতেন না মমতা? রাজনৈতিক প্রশ্নে বামেদের সঙ্গে তার যত বিরোধই থাকুক না কেন, মতদ্বৈত থাকুক না কেন, সিঙ্গুরে টাটাদের ছেড়ে যাওয়া কারখানা, যা প্রায় চালু হওয়ার মতো অবস্থাতে এসে গিয়েছিল, সেখানে যদি মমতা টাটাদের আবার নিয়ে আসবার অন্তত একটা প্রস্তাবও দিতেন, তখন সুস্থ থাকা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি রাজ্যের বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে সেদিন এতটুকু বিরোধিতা করতেন? নাকি মমতার ডাকে ইতিবাচক অবস্থান নেওয়ার জন্যে টাটাদের প্রতি আহ্বান জানাতেন বুদ্ধবাবু ও তার সতীর্থরা?
সিঙ্গুরের জমি ঘিরে মামলা হলো ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে। রায়কে কতোখানি প্রভাবিত করা হয়েছে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আছে। রায় আদালত যাই দিন না কেন, প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিকে আবার চাষযোগ্য করে তোলা বাস্তবসম্মত বিষয় হতে পারে না- এটা প্রতিটি স্তরের মানুষ জানতেন। তাহলে সেখানে প্রতীকী চাষের উদ্ধেশ্যে মমতার যে সরষে ছড়ানো, সেটা কি মানুষের সঙ্গে সর্ব অর্থে প্রতারণা নয়? যদি ওই জমি চাষের উপযুক্ত মনে করেই মমতা চাষের উদ্দেশে সেখানে সরষে ছিটিয়ে থাকেন প্রচারমাধ্যমের বহর নিয়ে, তাহলে কেন ওই জমিতে এতকাল পরেও একটা ধান বা অন্য কোনো ফসলের আবাদ হলো না? আর যদি প্রায় শেষ হয়ে আসা কারখানার জমি আর চাষের উপযোগী অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা কৃষিবিজ্ঞান অনুযায়ী না থেকে থাকে, তাহলে সরষে ছিটিয়ে চাষযোগ্য করবার অভিনয় কেন করলেন মুখ্যমন্ত্রী? রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, সরকারি পদে বসে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে এতখানি মিথ্যাচার করছেন, মমতার আগে এই দৃশ্য দেখবার দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের আর হয়নি।
সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি ন্যানোর কারখানা যদি টাটারা তৈরি করতে পারতেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতো তার জেরে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষে এই রাজ্য থেকে বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করা সুদূরপরাহত বিষয় ছিল। ঠিক সেই কারণেই সিঙ্গুরকে একটা উপলক্ষ করে মমতাকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির একটা বড় রকমের বোঝাপড়া সেদিন হয়েছিল। সেই বোঝাপড়াতে সব থেকে বড় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল কমিউনিস্ট নামধারী সমস্ত রকমের অকিউনিস্টরা। দুঃখজনক হলেও এটা স্বীকার করতে হয়, একদা শ্রেণী সহযোগিতাবাদী সিপিআই নেতৃত্বের গীতা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর রাজনৈতিক চরিত্রের যে স্খলন ঘটেছিল, তার জেরে কমিউনিস্টদের দুর্বল করাটাই হয়ে উঠেছিল সিপিআই নেতাদের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। সিপিআই নেতা নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ, আরএসপি নেতা ক্ষিতি গোস্বামীদের তখন একটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল- মমতার শক্তি বৃদ্ধি করে বুদ্ধবাবুকে খাটো করা। আজকের তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মাধ্যমে মমতার সঙ্গে অশোক ঘোষ, নন্দগোপালের মতো ভেকধারী বামপন্থিদের তখন যোগসূত্র ছিল সিপিআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এনজিও ‘বিশ্বকোষ পরিষদের’ পার্থ সেনগুপ্ত।
এই পরিসর রচনার কি খেসারত পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আজ দিতে হচ্ছে, তা কেবল তৃণমূল বিরোধী মানুষজনেরাই নন, খোদ তৃণমূলের অতিবড় সমর্থকেরাও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। যদি আজ হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ছোট গাড়ি ন্যানো তৈরির কারখানাটি শেষপর্যন্ত গড়ে উঠতে পারতো, তাহলে কেবল সিঙ্গুর বা হুগলি জেলার আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উপরেই তার প্রভাব পড়তো না। জামশেদপুরে (ঝড়খন্ড) টাটা কোম্পানির যে স্টিল প্লান্ট, টিসকো, সেই কোম্পানি গোটা অবিভক্ত বিহারে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কি ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, সেদিকে যদি আমরা একটু নজর দিই, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারব যে, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ন্যানো গাড়ির কারখানা তৈরি হলে এই রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কি ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসা সম্ভবপর ছিল।
জামশেদপুরে কেবল তো টাটা কোম্পানির টিসকোই নয়, টিসকোর সহযোগী যেসব অনুসারী শিল্প সেখানে গড়ে উঠেছে, যেমন- টেলকো, টিনপ্লেট ইত্যাদি, এসব অনুসারী শিল্পতেও একটা বড় অংশের কর্মসংস্থান ঘটেছে। এই কর্মসংস্থানের বিষয়টি যে কেবল সাবেক কালের অবিভক্ত বিহার রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। টিসকোসহ সেখানকার সমস্ত অনুসারী শিল্পে আজ গোটা দেশের মানুষ নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানে যুক্ত আছে। পশ্চিমবঙ্গের রেল শহর খড়গপুর যেমন একটা বৈচিত্র্যময় ভারতের ক্ষুদ্র সংস্করণ, ঠিক তেমনই জামশেদপুরও আজ বৈচিত্র্যময় ভারতের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। যদি সিঙ্গুরে কারখানা হতো, তবে কেবল সিঙ্গুর নয়, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ ও আজ বৈচিত্র্যময় ভারতের একটা মিনি সংস্করণ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারতো। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার দোসর হিসেবে যে জাত-ভাষা-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আজ পশ্চিমবঙ্গকে ক্রমশ ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করাচ্ছে, এমন সুযোগ প্রতিক্রিশীল শক্তি আদৌ পেতোই না।
শিল্পতাড়–য়া হিসেবে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পর শিল্পায়ন তো দূরের কথা, কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে মমতার সরকার এতটুকু গুরুত্ব দেয়নি। সরকারি স্তরে যেসব চাকরি হয়েছে, তার ভিতর বেশিরভাগই হয়েছে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে। মমতার শাসনকাল শুরু হওয়ার পর এই রাজ্যে সরকারি স্তরে যতগুলো চাকরি হয়েছে, সেসব চাকরির প্রায় প্রতিটিই এখন হয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইইডির স্কানারের নিচে, নতুবা মহামান্য হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের স্কানারের ভিতরে। একজন-দুজন মানুষ, যারা হয়তো যোগ্যতার নিরিখে চাকরি পেয়েছেন, তারাও আজ নানারকম সামাজিক ট্রোলের শিকার। তাদেরও আজ মুড়ি মিছরি একদর হিসেবে সমাজ দেখতে শুরু করেছে।
কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে শিকেয় তুলে রেখে মমতা ও তার প্রশাসন এমন এক অদ্ভুত ডোল প্রক্রিয়া গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে কায়েম করেছেন যার সুবাদে মার্কসের ভাষায় সমাজের যে অংশকে ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েট’ বা ‘সামাজিক আবর্জনা’ বলা হয়, সেই অংশ টাকেই কুক্ষিগত করে, তাদের দিয়েই গোটা সামাজিক পরিকাঠামোটাকে পরিচালিত করছেন। গোটা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে এখন এই সামাজিক আবর্জনাদের কাছে লুটে পুটে খাওয়ার এক অনবদ্য মুক্তাঞ্চলে পরিণত করেছে যৌথভাবে দিল্লির শাসকেরা এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসকেরা। মানুষের মর্যাদাবোধকে এই দুই শাসক যৌথভাবে নামিয়ে এনেছে পাঁচশ বা হাজার টাকার কোনো সরকারি ডোল প্রকল্পের হাতছানির ভিতরে।
যে অংশের মানুষকে তথাকথিত সিঙ্গুর আন্দোলনের নামে মমতা একদিন রাজ্যে কৃষি সঙ্কটের একটা কাল্পনিক ভয়ভহকতার গল্প শুনিয়েছিলেন, সমাজের সেই অংশের মানুষ, যাদের প্রথাগত শিক্ষার তেমন একটা সুযোগ ঘটেনি, সেই অংশের মানুষকে এখন দুই-পাঁচশ টাকা ডোল দিয়ে, পাড়া শাসন করবার ছাড়পত্র দিয়ে, সিন্ডিকেট রাজের মাধ্যমে করেকম্মে খেয়ে পড়ে থাকবার সুযোগ করে দিয়ে, কোথায় গেল আমার চাষের জমি, টাটা তো কারখানা করলো না, বিনিময়ে আমরা সাধারণ মানুষ কি পেলাম? আমরা খাব কি? আমরা থাকব কোথায়? আমদের পরনের কাপড় কোথায়? আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা কোথায়? স্বাস্থ্য কোথায়? এসব প্রশ্ন তুলতেই ভুলিয়ে দিয়েছে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]