alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘ইনসাফ’ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি সংযোজন

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

একদিকে যখন কাজের দাবিতে, কর্মসংস্থানের দাবিতে বামপন্থি ছাত্র-যুবদের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে ‘ইনসাফ যাত্রা’ করেছে, সেই কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে, যুবদের ডাকে ব্রিগেডে এই কর্মসংস্থানের বিষয়টিকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়ে নোতুন বছরের শুরুতে, জানুয়ারি মাসে সমাবেশ হবে-এমন একটা যুগ সন্ধিক্ষণেই প্রয়াত হলেন সুহৃদ দত্ত। তিনি রাজ্যস্থরের নেতা ছিলেন না। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু, মহঃ সেলিমের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের যেমন দেশের ভূগোল অতিক্রম করেও মানুষ চেনেন, জানেন-তেমন বহুল পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুহৃদ দত্ত ছিলেন না। কিন্তু সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার তাদের কাজের অগ্রাধিকারে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যে শিল্পায়নকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই কর্মসূচিকে সফল করার একজন ভূমিস্তরের নীরব অথচ দক্ষ কর্মী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত এই মানুষটি। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে তারই সহযোদ্ধারা হুগলী জেলার সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর গাড়ির কারখানার বিষয়টিকে সফল করবার উদ্দেশে যে অসম্ভব কে সম্ভব করে তুলতে শুরু করেছিলেন, তার মাশুল হিসেবেই গোটা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দম বন্ধ করা ষড়যন্ত্রে কার্যত দগ্ধে দগ্ধে মরতে হলো কমরেড সুহৃদ দত্তের।

বেকারত্ব পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছে যে দিল্লির শাসক বা এই রাজ্যের শাসক, কোনো শিবিরেরই শিক্ষিত- বেকারেরা আর মুখ বুজে থাকতে চাইছে না। অবাম রাজনৈতিক শিবিরের শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা, যারা নিজেদের যোগ্যতায় পেটের ভাত জোগাড় করতে চায়, শাসক বদান্যতায় করে কম্মে খেতে চায় না, শাসকের ভয়ে সরাসরি কর্মসংস্থানের দাবিতে বামেদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে দ্বিধান্বিত হলেও, মন থেকে এইসব কর্মসূচিগুলোর প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানাচ্ছেন। ইনসাফ যাত্রা পশ্চিমবঙ্গের যেসব গ্রাম-গঞ্জ, শহর অতিক্রম করছে, সেখানে যে সাধারণ মানুষ এই কর্মসূচিকে ঘিরে ভিড় জমাচ্ছেন, তাদের ভেতরে এমন একটা অংশের মানুষ ও আছেন, যাদের ছেলেমেয়েরা দায়ে পড়ে শাসক শিবিরে আছে। কিন্তু তাদের বাবা-মায়েরা খুব ভালো করেই জানেন যে, শাসক শিবিরে থেকে সোজা বাঁকা পথে কখনো সখনো হাতে কিছু টাকা এলেও, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকারের যে নীতি, সেই নীতিতে তাদের সন্তানেরা কখনো কোনো স্থায়ী চাকরি পাবে না।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূলের প্রায় সব অংশের নেতাদের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা, সেই জায়গা থেকে রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণাটাও খুব শক্তপোক্ত হয়ে গেছে যে, চাকরির আশায় তৃণমূলের লোকদের ঘুষ দিলে, হয় সেই টাকাটাই গায়েব হয়ে যাবে, নচেৎ যে চাকরি তারা পাবেন, বেআইনি পথে পাওয়া সেই চাকরি তারা শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। ফলে সিপিআই (এম) এর যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফের এই ইনসাফ যাত্রাতে পথের দুপাশে এমন মানুষের সংখ্যাই দিনের পর দিন বাড়ছে, যারা হয়তো কোনো না কোনো ভাবে শাসকের দ্বারা বেনিফিশারি, তা সত্ত্বেও তারা এখন খুব ভালোভাবে বুঝে গেছেন যে, ওই দুটো, পাঁচটা টাকা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্যে স্থায়ী চাকরি চাই, স্থায়ী ব্যবসা চাই। দিল্লি বা নবান্ন, কোনো শাসকের ই নোতুন প্রজন্মের স্থায়ী কর্মসংস্থান ঘিরে আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। স্থায়ী কর্মসংস্থানের পরিকাঠামো তৈরির বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নেই। গত বারো বছরে একটাও বড় শিল্প পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়নি। বরঞ্চ যেসব শিল্পের এককালে এই রাজ্যে বেশ ভালো রমরমা ছিল, সেইসব শিল্পের অধিকাংশই এখন পাততাড়ি গুটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে।

যে কৃষির দোহাই দিয়ে টাটা কোম্পানিকে একদিন সিঙ্গুরে কারখানা করতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস, তারা ক্ষমতায় আসার পর এই রাজ্যের কৃষি উৎপাদন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। যে জোতদার, মজুতদারদের রাজনৈতিক ভাবে ঠেকিয়ে রেখে বামপন্থিরা কৃষককে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বাজার দর পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের শাসনকালে, সেই জোতদার, মজুতদারেরাই গত শতকের চার, পাঁচ, ছয়ের দশকের মতো আবার জাঁকিয়ে বসেছে গোটা গ্রামীণ বাংলা জুড়ে। বামফ্রন্ট সরকার যে ভূমি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গরিব, ভূমিহীনদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল, আজ তৃণমূলের ছত্রছায়ায় থাকা নতুন জোতদাররা মহাজনেরা গরিব চাষাভুষো মানুষের সেইসব জমির মালিক হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের গোটা কৃষি পরিকাঠামোটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এবং সরকারের বদান্যতায় এখন আধা সামন্তান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। কৃষি সরঞ্জাম, সার ইত্যাদির দামে দিল্লির সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর রাজ্যে সেগুলো কেনবার ক্ষেত্রে গরিব চাষি, ক্ষেত মুজরদের ওপরে চলছে তৃণমূলের ভয়ংকর সিন্ডিকেট রাজ। এলাকার তৃণমূলের হত্তাকত্তা যে দোকান ঠিক করে দেবে, যে দাম ঠিক করে দেবে, সেই দোকান থেকেই চাষিকে কৃষি সরঞ্জাম, সার কিনতে হবে। দাম যাচাই করে কেনবার কোনো সুযোগ নেই কৃষকের।

ক্ষুদ্র সেচে বামফ্রন্টের আমলে যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল, সেখানেও থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। নতুন করে গজিয়ে ওঠা জোতদার, সামন্তপ্রভুরা মাত্রাতিরিক্ত জল বৈদ্যুতিক পাম্প ইত্যাদির সাহায্যে তুলে নিচ্ছে। ফলে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষি নিজের ট্যাকের জোরে মাটির নিচের জল তুলবে, সে তো তার কাছে দুরাশা, যারা বড় শ্যালো করে জল তুলছে, তাদের থেকে জল কিনে চাষ করতে গিয়ে জলমহাজনের ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়ছে। সরকারি উদ্যোগে ক্ষুদ্রসেচ ব্যবস্থা তৃণমূল সরকার, তাদের দলের লোকজনদের করেকম্মে খাওয়ার সুযোগ করে দিতেই প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে।

ইনসাফ যাত্রার দুপাশে যে মানুষের ঢল নেমেছে, সেই মানুষদের ভেতরে গ্রামগঞ্জের এইসব চাষাভুষোর দল, বিশেষ করে তাদের পরিবারের মহিলারা যেভাবে ভিড় জমাচ্ছেন, সেটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিম-লেও একটা নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মহঃ সেলিম পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই (এম) দলের সম্পাদকের দায়িত্বভার নেয়ার পর বামপন্থি আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে চিরাচরিত পথকে জপমন্ত্র করে আঁকড়ে ধরে থাকেননি। নীতি- আদর্শগত প্রশ্নে অবিকল্প থেকে কর্মসূচির প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে আধুনিক, সময় ও যুগোপযোগী পথে হাঁটছেন, তা যেমন একদিকে বামপন্থি আন্দোলনের ধার বাড়াচ্ছে, তেমন ভাবেই আন্দোলনের কায়দার ভেতর দিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, যা অচিরেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতায় নিজেকে পরিণত করে ফেলে, সেই অশুভ পন্থাকে প্রতিহত এবং আক্রমণ করবার ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিচ্ছে।

ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আজ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া জোগাতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। ভাষার হিন্দুত্ব এখন ধর্মান্ধ এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে সমাজের বুকে বিষ সঞ্চারণে একটা বিশেষ কৌশল। এই কৌশলকে প্রতিহত করতে আরবি শব্দ ইনসাফ অর্থাৎ; বিচারের দাবিটিকে সেলিম যেভাবে হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির বৈঠকখানা আর দহলিজকে মিলিয়ে মিশিয়ে একটা নতুন সাংস্কৃতিক যোগের শুরুয়াত করলেন, তা এই বাংলার রাজনৈতিক পরিম-লে সত্যিই একটা নতুন ধারার উদ্বোধন ঘটাল।

বেকারত্ব পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছে যে দিল্লির শাসক বা এই রাজ্যের শাসক, কোনো শিবিরেরই শিক্ষিত- বেকারেরা আর মুখ বুজে থাকতে চাইছে না

বাম আমলে রিজায়ানুরের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে তার মায়ের মুখে এই ইনসাফ শব্দটিকে যে সঙ্কীর্ণ অর্থে, মমতার নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছিল, আনিস খান কে মমতার পুলিশ হত্যা করবার পর, এই ইনসাফ শব্দটিকে সেলিম যে ভাবে বাঙালি চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করলেন, তা প্রবহমান ভারত, যে ভারত, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়; একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়ার উন্মোচন এই বাংলার বুকে নতুন করে ঘটাতে সক্ষম হলো।

শুধু রাজনীতির প্রশ্নে নয়া, সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে বাম-ডান, অতিবাম অতিডান-সবাইকে একটি শব্দকে প্রতিষ্ঠিত করে এপার বাংলার আত্মক্লান্ত বাঙালিকে সেলিম একটা আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত করতে পারলেন। ঘোরতর বামবিরোধীর কাছে ও আজ এই আরবি শব্দ ইনসাফ ঘিরে আলোচনা, উত্তেজনা। নজরুলের গানের সুর ঘিরে বিতর্কে যখন নজরুলের সৃষ্টিতে আরবি, ফার্সির ব্যবহার ঘিরে একটা কথা বলবার লোক ও এখন ধীরে ধীরে অপসৃত হতে শুরু করেছে, এমন একটা সময়ে ইনসাফ শব্দটিকে বাঙালির হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাশে সামাজিক সংস্কৃতিতে সেলিম যে মাত্রা সংযুক্ত করলেন তাতে তার নাম ওদুদ, অন্নদাশঙ্করের সঙ্গেই উচ্চারিত হওয়ার দাবি রাখে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘ইনসাফ’ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি সংযোজন

গৌতম রায়

শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

একদিকে যখন কাজের দাবিতে, কর্মসংস্থানের দাবিতে বামপন্থি ছাত্র-যুবদের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে ‘ইনসাফ যাত্রা’ করেছে, সেই কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে, যুবদের ডাকে ব্রিগেডে এই কর্মসংস্থানের বিষয়টিকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়ে নোতুন বছরের শুরুতে, জানুয়ারি মাসে সমাবেশ হবে-এমন একটা যুগ সন্ধিক্ষণেই প্রয়াত হলেন সুহৃদ দত্ত। তিনি রাজ্যস্থরের নেতা ছিলেন না। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু, মহঃ সেলিমের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের যেমন দেশের ভূগোল অতিক্রম করেও মানুষ চেনেন, জানেন-তেমন বহুল পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুহৃদ দত্ত ছিলেন না। কিন্তু সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার তাদের কাজের অগ্রাধিকারে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যে শিল্পায়নকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই কর্মসূচিকে সফল করার একজন ভূমিস্তরের নীরব অথচ দক্ষ কর্মী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত এই মানুষটি। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে তারই সহযোদ্ধারা হুগলী জেলার সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর গাড়ির কারখানার বিষয়টিকে সফল করবার উদ্দেশে যে অসম্ভব কে সম্ভব করে তুলতে শুরু করেছিলেন, তার মাশুল হিসেবেই গোটা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দম বন্ধ করা ষড়যন্ত্রে কার্যত দগ্ধে দগ্ধে মরতে হলো কমরেড সুহৃদ দত্তের।

বেকারত্ব পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছে যে দিল্লির শাসক বা এই রাজ্যের শাসক, কোনো শিবিরেরই শিক্ষিত- বেকারেরা আর মুখ বুজে থাকতে চাইছে না। অবাম রাজনৈতিক শিবিরের শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা, যারা নিজেদের যোগ্যতায় পেটের ভাত জোগাড় করতে চায়, শাসক বদান্যতায় করে কম্মে খেতে চায় না, শাসকের ভয়ে সরাসরি কর্মসংস্থানের দাবিতে বামেদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে দ্বিধান্বিত হলেও, মন থেকে এইসব কর্মসূচিগুলোর প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানাচ্ছেন। ইনসাফ যাত্রা পশ্চিমবঙ্গের যেসব গ্রাম-গঞ্জ, শহর অতিক্রম করছে, সেখানে যে সাধারণ মানুষ এই কর্মসূচিকে ঘিরে ভিড় জমাচ্ছেন, তাদের ভেতরে এমন একটা অংশের মানুষ ও আছেন, যাদের ছেলেমেয়েরা দায়ে পড়ে শাসক শিবিরে আছে। কিন্তু তাদের বাবা-মায়েরা খুব ভালো করেই জানেন যে, শাসক শিবিরে থেকে সোজা বাঁকা পথে কখনো সখনো হাতে কিছু টাকা এলেও, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকারের যে নীতি, সেই নীতিতে তাদের সন্তানেরা কখনো কোনো স্থায়ী চাকরি পাবে না।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূলের প্রায় সব অংশের নেতাদের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা, সেই জায়গা থেকে রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণাটাও খুব শক্তপোক্ত হয়ে গেছে যে, চাকরির আশায় তৃণমূলের লোকদের ঘুষ দিলে, হয় সেই টাকাটাই গায়েব হয়ে যাবে, নচেৎ যে চাকরি তারা পাবেন, বেআইনি পথে পাওয়া সেই চাকরি তারা শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। ফলে সিপিআই (এম) এর যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফের এই ইনসাফ যাত্রাতে পথের দুপাশে এমন মানুষের সংখ্যাই দিনের পর দিন বাড়ছে, যারা হয়তো কোনো না কোনো ভাবে শাসকের দ্বারা বেনিফিশারি, তা সত্ত্বেও তারা এখন খুব ভালোভাবে বুঝে গেছেন যে, ওই দুটো, পাঁচটা টাকা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্যে স্থায়ী চাকরি চাই, স্থায়ী ব্যবসা চাই। দিল্লি বা নবান্ন, কোনো শাসকের ই নোতুন প্রজন্মের স্থায়ী কর্মসংস্থান ঘিরে আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। স্থায়ী কর্মসংস্থানের পরিকাঠামো তৈরির বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নেই। গত বারো বছরে একটাও বড় শিল্প পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়নি। বরঞ্চ যেসব শিল্পের এককালে এই রাজ্যে বেশ ভালো রমরমা ছিল, সেইসব শিল্পের অধিকাংশই এখন পাততাড়ি গুটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে।

যে কৃষির দোহাই দিয়ে টাটা কোম্পানিকে একদিন সিঙ্গুরে কারখানা করতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস, তারা ক্ষমতায় আসার পর এই রাজ্যের কৃষি উৎপাদন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। যে জোতদার, মজুতদারদের রাজনৈতিক ভাবে ঠেকিয়ে রেখে বামপন্থিরা কৃষককে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বাজার দর পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের শাসনকালে, সেই জোতদার, মজুতদারেরাই গত শতকের চার, পাঁচ, ছয়ের দশকের মতো আবার জাঁকিয়ে বসেছে গোটা গ্রামীণ বাংলা জুড়ে। বামফ্রন্ট সরকার যে ভূমি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গরিব, ভূমিহীনদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল, আজ তৃণমূলের ছত্রছায়ায় থাকা নতুন জোতদাররা মহাজনেরা গরিব চাষাভুষো মানুষের সেইসব জমির মালিক হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের গোটা কৃষি পরিকাঠামোটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এবং সরকারের বদান্যতায় এখন আধা সামন্তান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। কৃষি সরঞ্জাম, সার ইত্যাদির দামে দিল্লির সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর রাজ্যে সেগুলো কেনবার ক্ষেত্রে গরিব চাষি, ক্ষেত মুজরদের ওপরে চলছে তৃণমূলের ভয়ংকর সিন্ডিকেট রাজ। এলাকার তৃণমূলের হত্তাকত্তা যে দোকান ঠিক করে দেবে, যে দাম ঠিক করে দেবে, সেই দোকান থেকেই চাষিকে কৃষি সরঞ্জাম, সার কিনতে হবে। দাম যাচাই করে কেনবার কোনো সুযোগ নেই কৃষকের।

ক্ষুদ্র সেচে বামফ্রন্টের আমলে যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল, সেখানেও থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। নতুন করে গজিয়ে ওঠা জোতদার, সামন্তপ্রভুরা মাত্রাতিরিক্ত জল বৈদ্যুতিক পাম্প ইত্যাদির সাহায্যে তুলে নিচ্ছে। ফলে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষি নিজের ট্যাকের জোরে মাটির নিচের জল তুলবে, সে তো তার কাছে দুরাশা, যারা বড় শ্যালো করে জল তুলছে, তাদের থেকে জল কিনে চাষ করতে গিয়ে জলমহাজনের ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়ছে। সরকারি উদ্যোগে ক্ষুদ্রসেচ ব্যবস্থা তৃণমূল সরকার, তাদের দলের লোকজনদের করেকম্মে খাওয়ার সুযোগ করে দিতেই প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে।

ইনসাফ যাত্রার দুপাশে যে মানুষের ঢল নেমেছে, সেই মানুষদের ভেতরে গ্রামগঞ্জের এইসব চাষাভুষোর দল, বিশেষ করে তাদের পরিবারের মহিলারা যেভাবে ভিড় জমাচ্ছেন, সেটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিম-লেও একটা নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মহঃ সেলিম পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই (এম) দলের সম্পাদকের দায়িত্বভার নেয়ার পর বামপন্থি আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে চিরাচরিত পথকে জপমন্ত্র করে আঁকড়ে ধরে থাকেননি। নীতি- আদর্শগত প্রশ্নে অবিকল্প থেকে কর্মসূচির প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে আধুনিক, সময় ও যুগোপযোগী পথে হাঁটছেন, তা যেমন একদিকে বামপন্থি আন্দোলনের ধার বাড়াচ্ছে, তেমন ভাবেই আন্দোলনের কায়দার ভেতর দিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, যা অচিরেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতায় নিজেকে পরিণত করে ফেলে, সেই অশুভ পন্থাকে প্রতিহত এবং আক্রমণ করবার ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিচ্ছে।

ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আজ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া জোগাতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। ভাষার হিন্দুত্ব এখন ধর্মান্ধ এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে সমাজের বুকে বিষ সঞ্চারণে একটা বিশেষ কৌশল। এই কৌশলকে প্রতিহত করতে আরবি শব্দ ইনসাফ অর্থাৎ; বিচারের দাবিটিকে সেলিম যেভাবে হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির বৈঠকখানা আর দহলিজকে মিলিয়ে মিশিয়ে একটা নতুন সাংস্কৃতিক যোগের শুরুয়াত করলেন, তা এই বাংলার রাজনৈতিক পরিম-লে সত্যিই একটা নতুন ধারার উদ্বোধন ঘটাল।

বেকারত্ব পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছে যে দিল্লির শাসক বা এই রাজ্যের শাসক, কোনো শিবিরেরই শিক্ষিত- বেকারেরা আর মুখ বুজে থাকতে চাইছে না

বাম আমলে রিজায়ানুরের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে তার মায়ের মুখে এই ইনসাফ শব্দটিকে যে সঙ্কীর্ণ অর্থে, মমতার নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছিল, আনিস খান কে মমতার পুলিশ হত্যা করবার পর, এই ইনসাফ শব্দটিকে সেলিম যে ভাবে বাঙালি চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করলেন, তা প্রবহমান ভারত, যে ভারত, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়; একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়ার উন্মোচন এই বাংলার বুকে নতুন করে ঘটাতে সক্ষম হলো।

শুধু রাজনীতির প্রশ্নে নয়া, সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে বাম-ডান, অতিবাম অতিডান-সবাইকে একটি শব্দকে প্রতিষ্ঠিত করে এপার বাংলার আত্মক্লান্ত বাঙালিকে সেলিম একটা আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত করতে পারলেন। ঘোরতর বামবিরোধীর কাছে ও আজ এই আরবি শব্দ ইনসাফ ঘিরে আলোচনা, উত্তেজনা। নজরুলের গানের সুর ঘিরে বিতর্কে যখন নজরুলের সৃষ্টিতে আরবি, ফার্সির ব্যবহার ঘিরে একটা কথা বলবার লোক ও এখন ধীরে ধীরে অপসৃত হতে শুরু করেছে, এমন একটা সময়ে ইনসাফ শব্দটিকে বাঙালির হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাশে সামাজিক সংস্কৃতিতে সেলিম যে মাত্রা সংযুক্ত করলেন তাতে তার নাম ওদুদ, অন্নদাশঙ্করের সঙ্গেই উচ্চারিত হওয়ার দাবি রাখে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]

back to top