alt

উপ-সম্পাদকীয়

অবরোধে কি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

: বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩
image

হরতাল-অবরোধের কারণে রাজস্ব আদায় কমছে। এমনিতেই রাজস্ব আদায়ের গতিতে ভাটার টান, তার ওপর চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অবস্থায় রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক বা তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ সময়ে ১৪.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮১৯৫.৬৩ কোটি টাকা। আয়কর, ভ্যাট কিংবা কাস্টমসের কোনো বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) রাজস্ব ঘাটতি ছিল চার হাজার ৮৭ কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর প্রথম প্রান্তিকে বা তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৯৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মূল্যস্ফীতির কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম দ্বিগুণ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে ছিল আয়কর। এই খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পরও ভ্যাটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৫৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর আমদানি ও রপ্তানি শুল্কে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় গত বছরের তুলনায় একই সময়ে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.০৭ শতাংশ, আয়করে ১৭. ৪৭ শতাংশ আর শুল্কে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৪৫ শতাংশ। যদিও শুল্ক খাতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ভালো না হলেও লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশেরও বেশি আদায় হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এ সময়ে শুল্ক বিভাগ আদায় করেছে ২৪ হাজার ১২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর তিন মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ হাজার ১৩৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ২৮ হাজার ৯৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভ্যাট আদায়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১৫৪.৬৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর বিভাগের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে আয়কর বিভাগ আদায় করেছে ২৩ হাজার ৬৪১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে মূসক থেকে এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা, আয়কর থেকে এক লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও আমদানি-রপ্তানি শুল্ক থেকে এক লাখ ১৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ৫৯.৮ শতাংশ অর্থায়নের দায় রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঁধে। এবার এক লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এই হিসাবে এনবিআরকে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪১০ কোটি টাকা। যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। অথচ টানা অবরোধ, বিক্ষিপ্ত হরতালসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতিতে পড়বে এনবিআর। এতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি মাঝপথে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহ কমবে। অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

অবরোধ, হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক-রাজস্বের এ তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় সম্ভব হচ্ছে না। একদিনের হরতাল, অবরোধে সমুদবন্দরে গড়ে ৪০০ কনটেইনার কম ওঠানামা করে। এতে প্রতিদিন ৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক না থাকায় স্থলবন্দরে দৈনিক ১৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় দোকানপাটে স্বাভাবিক বেচাকেনা হচ্ছে না। এতে মূসক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম আদায় হয়। ফলে দৈনিক ৩৫ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। চলতিবারে সবচেয়ে নেতিবাচক পরিস্থিতি শুল্ক খাতে।

টানা অবরোধে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধে আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক থাকলে স্থলবন্দরের প্রতিটিতে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসে। অবরোধের প্রথম দিকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক পুলিশ পাহারায় এলেও ট্রাক আসার সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে স্থলবন্দরে অন্য দেশ থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক এসে পৌঁছালেও তা অবরোধের কারণে বাংলাদেশের মধ্যে নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছতে পারছে না। টানা অবরোধে স্থলবন্দরে আটকা পড়েছে পণ্য বোঝাই দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ট্রাক। অন্যদিকে সমুদ্রবন্দরে রাজস্ব কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বন্দরে পণ্য নেয়ার হার কমেছে কয়েকগুণ। একইভাবে জাহাজে পণ্য এসে পৌঁছালেও তা খালাস করে দেশের মধ্যে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।

ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য রপ্তানি হয়। টানা অবরোধে আখাউড়া স্থলবন্দরে পণ্য রপ্তানি কমে গেছে। একইভাবে অন্যান্য স্থলবন্দরেও রপ্তানি আয় কমেছে।

অর্থবছরের গত ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি রয়েছে। এ সময়ে ২৪ হাজার ১২২ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। আদায়ে এ নেতিবাচক ধারার মধ্যেই চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চলমান অবরোধে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের মধ্যে স্বাভাবিক পণ্য পরিবহন নেই। পুলিশ পাহারায় সীমিতভাবে কিছু পরিবহন চলছে। এতে ছোট-বড় অনেক দোকানের মজুদ শেষ হয়ে এলেও আবার দোকানে পণ্য আনতে পারছে না বিক্রেতারা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পণ্য সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এতে স্বাভাবিক বেচাকেনা ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি রাজস্ব কর্মকর্তারা ভ্যাট আদায়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে ভ্যাট পরিশোধে সময় বাড়ানোর আবেদন করছে ব্যবসায়ীরা। অতীতে দেশের মধ্যে ভ্যাট খাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আদায় সবচেয়ে বেশি হলেও এ দুই অঞ্চলে অবরোধে বিপাকে থাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আয়কর আদায়ে। অথচ রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আয়কর খাতে। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হয়। এতে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় বাধ্য হয়েই এডিপি কাটছাঁট করতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এত বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা থাকছে। এতে ব্যয় নির্বাহে সরকার বেকায়দায় পড়বে। ঋণ করতে বাধ্য হবে। বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহ কমবে। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

[লেখক: সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অবরোধে কি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

image

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

হরতাল-অবরোধের কারণে রাজস্ব আদায় কমছে। এমনিতেই রাজস্ব আদায়ের গতিতে ভাটার টান, তার ওপর চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অবস্থায় রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক বা তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ সময়ে ১৪.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮১৯৫.৬৩ কোটি টাকা। আয়কর, ভ্যাট কিংবা কাস্টমসের কোনো বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) রাজস্ব ঘাটতি ছিল চার হাজার ৮৭ কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর প্রথম প্রান্তিকে বা তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৯৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মূল্যস্ফীতির কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম দ্বিগুণ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে ছিল আয়কর। এই খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পরও ভ্যাটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৫৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর আমদানি ও রপ্তানি শুল্কে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় গত বছরের তুলনায় একই সময়ে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.০৭ শতাংশ, আয়করে ১৭. ৪৭ শতাংশ আর শুল্কে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৪৫ শতাংশ। যদিও শুল্ক খাতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ভালো না হলেও লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশেরও বেশি আদায় হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এ সময়ে শুল্ক বিভাগ আদায় করেছে ২৪ হাজার ১২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর তিন মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ হাজার ১৩৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ২৮ হাজার ৯৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভ্যাট আদায়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১৫৪.৬৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর বিভাগের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে আয়কর বিভাগ আদায় করেছে ২৩ হাজার ৬৪১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে মূসক থেকে এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা, আয়কর থেকে এক লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও আমদানি-রপ্তানি শুল্ক থেকে এক লাখ ১৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ৫৯.৮ শতাংশ অর্থায়নের দায় রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঁধে। এবার এক লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এই হিসাবে এনবিআরকে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪১০ কোটি টাকা। যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। অথচ টানা অবরোধ, বিক্ষিপ্ত হরতালসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতিতে পড়বে এনবিআর। এতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি মাঝপথে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহ কমবে। অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

অবরোধ, হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক-রাজস্বের এ তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় সম্ভব হচ্ছে না। একদিনের হরতাল, অবরোধে সমুদবন্দরে গড়ে ৪০০ কনটেইনার কম ওঠানামা করে। এতে প্রতিদিন ৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক না থাকায় স্থলবন্দরে দৈনিক ১৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় দোকানপাটে স্বাভাবিক বেচাকেনা হচ্ছে না। এতে মূসক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম আদায় হয়। ফলে দৈনিক ৩৫ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। চলতিবারে সবচেয়ে নেতিবাচক পরিস্থিতি শুল্ক খাতে।

টানা অবরোধে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধে আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক থাকলে স্থলবন্দরের প্রতিটিতে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসে। অবরোধের প্রথম দিকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক পুলিশ পাহারায় এলেও ট্রাক আসার সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে স্থলবন্দরে অন্য দেশ থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক এসে পৌঁছালেও তা অবরোধের কারণে বাংলাদেশের মধ্যে নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছতে পারছে না। টানা অবরোধে স্থলবন্দরে আটকা পড়েছে পণ্য বোঝাই দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ট্রাক। অন্যদিকে সমুদ্রবন্দরে রাজস্ব কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বন্দরে পণ্য নেয়ার হার কমেছে কয়েকগুণ। একইভাবে জাহাজে পণ্য এসে পৌঁছালেও তা খালাস করে দেশের মধ্যে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।

ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য রপ্তানি হয়। টানা অবরোধে আখাউড়া স্থলবন্দরে পণ্য রপ্তানি কমে গেছে। একইভাবে অন্যান্য স্থলবন্দরেও রপ্তানি আয় কমেছে।

অর্থবছরের গত ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি রয়েছে। এ সময়ে ২৪ হাজার ১২২ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। আদায়ে এ নেতিবাচক ধারার মধ্যেই চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চলমান অবরোধে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের মধ্যে স্বাভাবিক পণ্য পরিবহন নেই। পুলিশ পাহারায় সীমিতভাবে কিছু পরিবহন চলছে। এতে ছোট-বড় অনেক দোকানের মজুদ শেষ হয়ে এলেও আবার দোকানে পণ্য আনতে পারছে না বিক্রেতারা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পণ্য সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এতে স্বাভাবিক বেচাকেনা ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি রাজস্ব কর্মকর্তারা ভ্যাট আদায়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে ভ্যাট পরিশোধে সময় বাড়ানোর আবেদন করছে ব্যবসায়ীরা। অতীতে দেশের মধ্যে ভ্যাট খাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আদায় সবচেয়ে বেশি হলেও এ দুই অঞ্চলে অবরোধে বিপাকে থাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আয়কর আদায়ে। অথচ রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আয়কর খাতে। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হয়। এতে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় বাধ্য হয়েই এডিপি কাটছাঁট করতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এত বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা থাকছে। এতে ব্যয় নির্বাহে সরকার বেকায়দায় পড়বে। ঋণ করতে বাধ্য হবে। বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহ কমবে। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

[লেখক: সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]

back to top