স্মরণ
মনজুরুল আহসান বুলবুল
আহমদুল কবির; জন্ম : ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩; মৃত্যু : ২৪ নভেম্বর, ২০০৩
একজন আহমদুল কবির। তার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ম মেধা, তার দেশপ্রেম, তার সাহস এবং কঠিন সময়েও তার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এসব সবারই জানা। আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের কাছে তিনি ছিলেন এসব ছাপিয়ে অনেক কাছের মানুষ। আমি সেই পেশাদার সাংবাদিকদের একজন- যার মূল পেশাজীবনের শুরুতে পেয়েছিলাম আহমদুল কবিরের অভিভাবকত্ব। আমি বিশেষভাবে ‘অভিভাবক’ শব্দটির ওপর জোর দিচ্ছি। একজন তরুণ যত মেধাবীই হন না কেন পেশাজীবনের শুরুতে যদি সঠিক অভিভাবক না পান, যদি যোগ্য পেশাদার নেতৃত্ব না পান তাহলে তিনি পেশাদার সাংবাদিক জীবনের শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারেন না। আমি সৌভাগ্যবান এইক্ষেত্রে, অভিভাবক হিসেবে আহমদুল কবিরকে আর পেশার নেতৃত্বে বজলুর রহমানকে পাওয়া। দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি- আমি তখন ‘সংবাদ’ ছেড়ে ‘যুগান্তর’ হয়ে ‘একুশে টেলিভিশনে’ থিতু হওয়ার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে আকস্মিক বজ্রপাত। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একুশে টেলিভিশন বন্ধ।
আমি আমার পুরো টিম নিয়ে বেকার। সবাই ভালো পেশাদার সাংবাদিক, বেতন-ভাতাও ভালো। নানা সমীকরণ চলছে। হঠাৎ একুশের ফোনে জনাব আহমদুল কবির, সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠ ‘মানযূর, আজ সন্ধ্যায় বাসায় চলে এসো’। কী জন্য তলব কিছুই জানি না। হাজির হলাম তার ইন্দিরা রোডের বাসায়। তার প্রথম উদ্বেগ, আমি এখন কী করব? আমি যতই বলি আলোচনা চলছে, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ততই তিনি মাথা নাড়েন। তার শেষ কথা, অপেক্ষা কর, কিছুই না হলে আমার সঙ্গে কথা বলো। শেষ পর্যন্ত কিছু হলো না। আমি তাকে বোঝালাম উঁচু বেতনের পুরো টিম সংবাদ নিতে পারবে না। তাই হলো, আমার পুরো টিম যোগ দিল এটিএন বাংলায়। কিন্তু তিনি আমাকে ছাড়লেন না। আমি আবার যোগ দিলাম সংবাদ-এ। বিপদের সময় যিনি বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেন তিনিই তো প্রকৃত অভিভাবক। আমার প্রতি তার আস্থা ছিল অপরিসীম। সংবাদ-এ আমার প্রতিটি কাজে তার কঠোর পরামর্শ আজও সাংবাদিকতায় আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল শক্তি। দ্বিতীয় ঘটনা বলি- সংবাদ সেসময় সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। সহসম্পাদক হিসেবে আমি যোগ দেই ওয়েজবোর্ডের তৃতীয় গ্রেডে। কর্মদক্ষতার কারণেই বাড়তি ইনক্রিমেন্ট হয়। দ্বিতীয় গ্রেড পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয় না। জটিলতা হলো যখন আমি গ্রেড-১ পেলাম। হঠাৎ আমার পরিচিত, ঘনিষ্ঠ শুভানুধ্যায়ীদের চেহারা বদলে গেল। পরিস্থিতির চাপেই আমি গেলাম কবির সাহেবের রুমে। তিনি নিশ্চয়ই সব জানতেন। চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, কী চাই?
সব শুনলেন, আবার প্রশ্ন : তুমি কী চাও।
আমি বললাম : আমার প্রমোশন নিয়ে যখন এত জটিলতা সেটা নিতে চাই না। তিনি আমার হাত থেকে আমার আবেদনটি নিয়ে না পড়েই ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমাকে প্রমোশন দিয়েছি আমি, তোমাকে প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব আমার। যাও তুমি তোমার কাজ করো। আমার প্রমোশন বাতিল হয়নি। আহা এমন একজন অভিভাবক কোথায় পাব? কিন্তু এই অভিভাবকের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তার জন্মশতবর্ষ ও তেমন করে পালন করা গেল না। পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কটা ‘আহমেদুল কবির সড়ক’ করার প্রস্তাবটি সিটি করপোরেশনে পড়ে আছে কতদিন! আমাদের অক্ষমতা ক্ষমা করবেন। প্রিয় অভিভাবক, আপনার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা।
[লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক]
স্মরণ
মনজুরুল আহসান বুলবুল
আহমদুল কবির; জন্ম : ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩; মৃত্যু : ২৪ নভেম্বর, ২০০৩
বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩
একজন আহমদুল কবির। তার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ম মেধা, তার দেশপ্রেম, তার সাহস এবং কঠিন সময়েও তার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এসব সবারই জানা। আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের কাছে তিনি ছিলেন এসব ছাপিয়ে অনেক কাছের মানুষ। আমি সেই পেশাদার সাংবাদিকদের একজন- যার মূল পেশাজীবনের শুরুতে পেয়েছিলাম আহমদুল কবিরের অভিভাবকত্ব। আমি বিশেষভাবে ‘অভিভাবক’ শব্দটির ওপর জোর দিচ্ছি। একজন তরুণ যত মেধাবীই হন না কেন পেশাজীবনের শুরুতে যদি সঠিক অভিভাবক না পান, যদি যোগ্য পেশাদার নেতৃত্ব না পান তাহলে তিনি পেশাদার সাংবাদিক জীবনের শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারেন না। আমি সৌভাগ্যবান এইক্ষেত্রে, অভিভাবক হিসেবে আহমদুল কবিরকে আর পেশার নেতৃত্বে বজলুর রহমানকে পাওয়া। দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি- আমি তখন ‘সংবাদ’ ছেড়ে ‘যুগান্তর’ হয়ে ‘একুশে টেলিভিশনে’ থিতু হওয়ার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে আকস্মিক বজ্রপাত। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একুশে টেলিভিশন বন্ধ।
আমি আমার পুরো টিম নিয়ে বেকার। সবাই ভালো পেশাদার সাংবাদিক, বেতন-ভাতাও ভালো। নানা সমীকরণ চলছে। হঠাৎ একুশের ফোনে জনাব আহমদুল কবির, সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠ ‘মানযূর, আজ সন্ধ্যায় বাসায় চলে এসো’। কী জন্য তলব কিছুই জানি না। হাজির হলাম তার ইন্দিরা রোডের বাসায়। তার প্রথম উদ্বেগ, আমি এখন কী করব? আমি যতই বলি আলোচনা চলছে, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ততই তিনি মাথা নাড়েন। তার শেষ কথা, অপেক্ষা কর, কিছুই না হলে আমার সঙ্গে কথা বলো। শেষ পর্যন্ত কিছু হলো না। আমি তাকে বোঝালাম উঁচু বেতনের পুরো টিম সংবাদ নিতে পারবে না। তাই হলো, আমার পুরো টিম যোগ দিল এটিএন বাংলায়। কিন্তু তিনি আমাকে ছাড়লেন না। আমি আবার যোগ দিলাম সংবাদ-এ। বিপদের সময় যিনি বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেন তিনিই তো প্রকৃত অভিভাবক। আমার প্রতি তার আস্থা ছিল অপরিসীম। সংবাদ-এ আমার প্রতিটি কাজে তার কঠোর পরামর্শ আজও সাংবাদিকতায় আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল শক্তি। দ্বিতীয় ঘটনা বলি- সংবাদ সেসময় সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। সহসম্পাদক হিসেবে আমি যোগ দেই ওয়েজবোর্ডের তৃতীয় গ্রেডে। কর্মদক্ষতার কারণেই বাড়তি ইনক্রিমেন্ট হয়। দ্বিতীয় গ্রেড পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয় না। জটিলতা হলো যখন আমি গ্রেড-১ পেলাম। হঠাৎ আমার পরিচিত, ঘনিষ্ঠ শুভানুধ্যায়ীদের চেহারা বদলে গেল। পরিস্থিতির চাপেই আমি গেলাম কবির সাহেবের রুমে। তিনি নিশ্চয়ই সব জানতেন। চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, কী চাই?
সব শুনলেন, আবার প্রশ্ন : তুমি কী চাও।
আমি বললাম : আমার প্রমোশন নিয়ে যখন এত জটিলতা সেটা নিতে চাই না। তিনি আমার হাত থেকে আমার আবেদনটি নিয়ে না পড়েই ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমাকে প্রমোশন দিয়েছি আমি, তোমাকে প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব আমার। যাও তুমি তোমার কাজ করো। আমার প্রমোশন বাতিল হয়নি। আহা এমন একজন অভিভাবক কোথায় পাব? কিন্তু এই অভিভাবকের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তার জন্মশতবর্ষ ও তেমন করে পালন করা গেল না। পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কটা ‘আহমেদুল কবির সড়ক’ করার প্রস্তাবটি সিটি করপোরেশনে পড়ে আছে কতদিন! আমাদের অক্ষমতা ক্ষমা করবেন। প্রিয় অভিভাবক, আপনার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা।
[লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক]