গৌতম রায়
আবার র্যাগিংয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। খবরের কাগজের সূত্রে এমনটাই জানা যাচ্ছে। শারদোৎসবের মৌসুমে এমন খবরে তেমন একটা মন নেই সবার। ফলে মাত্র কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার মতো কোনো শোরগোল নেই জনচিত্তে। সমাজের দায় যারা নিজেদের কাঁধে নিয়ে ঘাড়খানা প্রায় বাঁকিয়ে ফেলেছেন, তারাও এখন ব্যস্ত পুজো, পুজো সংখ্যা, প্যান্ডেল, ভিড়, উদ্বোধন, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো-এসব নিয়ে। তাই আপাতত বাম-ডান কোনো শিবিরেই এতটুকু হেলদোল নেই। শাসকশিবিরের খরচা বেঁচে গেল। মৃতের মাকে, বাবাকে কিনতে খরচ করতে হলো না চাকরি বা নোটের তাড়া।
কিন্তু যে যাওয়ার, সে গেছে। তার যাওয়া ঘিরে প্রশ্ন? সেটা বুকের গহীনে থাকবে তার মায়ের, বাবার। যদি সে মন দেয়া-নেয়া করে থাকে, তবে সে নারীর। হয়তো একদিন সে নারীর জীবনেও আসবে কোনো পুরুষ। নতুনের আগমনে হারিয়ে যাবে পুরনোর স্মৃতি। মৃত ছাত্রটি কেবলমাত্র জেগে থাকবে মায়ের স্মৃতিতে। বাবার বুকের বোবা কান্নায়। মায়ের হয়তো মনে হবে, হয়তো বা না ও মনে হতে পারে, আগের র্যাগিংয়ের শিকারের মা তো চাকরি পেল, আমি কেন পেলাম না- এ প্রশ্নটি।
প্রশ্ন উঠলেই যে উত্তর মিলবে, সহজেই মিলবে সেই উত্তর, এমন মাথার দিব্যি কে কবে কাউকে দিয়েছে? সমপ্রেমের বিয়ে ঘিরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। সেই বক্তব্য ঘিরে যার যা পাল্টা বক্তব্য থাকুক না কেন, সবাই তো একবাক্যে বলবেন, সমপ্রেমকে কখনো কোনো দন্ডনীয় অপরাধ বলে দেগে দেননি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটি রাগিংয়ের শিকার হয়েছিল, সেই ছেলেটির ব্যক্তি বিশ্বাসের জায়গা থেকে গলায় তুলসীর মালা থাকায়, দাদারা তাকে সমকামী বলে দেগে দিয়েছিল। একজন বুদ্ধিজীবী, সমাজভাবুক, তা তিনি ডান, বাম, সেনট্রিস্ট, যাই হোন না কেন, র্যাগিং ঘিরে অনেক কথা বললেও, এটা একবারের জন্যেও বলেননি যে, ছেলেটির ব্যক্তি জীবন ঘিরে একটা কথা বলবার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের কেবল একটাই কথা, কেন ছেলেটিকে মরতে হলো, এর জন্যে দায়ী কে? এটাই।
যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু যখনই ঘটে চারিদিকে একটা শোরগোল পড়ে যায়। সেই শোরগোলটা কিছুদিন চলতে থাকে। নানা সভাসমিতি, অবস্থান, মিছিল চলে। পোস্টার ফেস্টুনে দেওয়াল ভরে যায়। খবরের কাগজে অনেক প্রতিবাদী লেখা বের হয়। টেলিভিশনে জোরদার বিতর্ক সভা বসে। তারপর? সব কেমন ঠান্ডা মেরে যায়। খবরের কাগজ চলে যায় ঠোঙা হতে। মুখরোচক খাবার ফিরতে থাকে সেইসব রং বেরংয়ের ঠোঙায়। নোতুন ঘটনা এসে ফিকে করে দেয় আগের ঘটনাকে। তখন কেবল অমনধারা ঘটনা ঘটলে রেফারেন্স হিসেবে টানা হয় আগের ঘটনা কে। ব্যাস, ওই টুকুই। আগের ঘটনার সমাধান হয়নি। অপরাধী শাস্তি পায়নি-এসব গালভরা কথা নোতুন ঘটনার জেরে বারবার উঠে আসে।
সামাজিক অপরাধগুলোকে কি আমরা নিজেদের টিআরপি বৃদ্ধির একটা উপকরণ হিসেবেই তবে কেবলমাত্র ধরে নিয়েছি? সামাজিক অপরাধের শিকার যারা হচ্ছেন, তাদের পরিবার পরিজনেরা অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী থাকবেন। আবার অনেকেই শাসকের উপঢৌকনে খুশি হয়ে আত্মজনের অস্বাবিক মৃত্যুকে কার্যত বাজি তে পরিণত করছেন। মানবিকতার কারণে সন্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে যে আত্মজন চাকরি পেলেন বা মোটা অঙ্কের টাকা পেলেন, তাদের কেউ উপহাস করছেন। আবার কেউ বা বিবেকের তাড়নায় চুপ করে থাকছেন। আবার কেউ কেউ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কঠোর কথা কিছু বলছেন না কিন্তু মন থেকে গোটা ব্যাপারটা ঠিক ভালোভাবে মেনেও নিতে পারছেন না।
র্যাগিং একটা সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যধি দূর করতে আইন, আদালত, প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রী, উপাচার্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরাই সব নন। এই ব্যাধি দূর করতে প্রথম এবং প্রধান দরকার সামাজিক সচেতনতা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের বা তার থেকেও সিনিয়ার কোনো ছাত্র যদি মনে করে, আমি ও র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলাম হস্টেলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে পা দিয়ে। তাই নবাগত ছাত্রের ওপর আমার একটা র্যাগিংয়ের অধিকার এই কারণে জন্মে গেছে যেহেতু আমি নিজেও রাগড হয়েছি-এমন ভাবনা থেকে সিনিয়ার ছাত্রদের বের করে আনবার জন্যে সমাজের একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে। প্রতিশোধের আকাক্সক্ষা এই র্যাগিং ঘিরে যাতে কোনো স্তরের ছাত্রদের মধ্যেই তৈরি না হয়, সেজন্যে গোটা সামাজিক পরিকাঠামোর একটা বিশেষ দায় আছে, দায়িত্ব তো আছেই।
গোটা সমাজ কি তার দায়িত্ব পালন করছে? নাকি একে অন্যের ওপর দোষারোপ করে নিজের নিজের দায় এড়াতেই সমাজের উৎসাহ এবং তৎপরতা সবথেকে বেশি? উপাচার্য থেকে শুরু করে সব স্তরের আধিকারিক, কলেজ হলে অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে সবস্তরের আধিকারিকদের দায়ী করেই আমরা নিজেদের দায়টাকে সেরে ফেলতে চাই। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্নটা হলো, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া রাগিং এবং ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায়, যে ছেলেগুলি ওই নিরীহ গ্রামের ছেলেটিকে গলায় তুলসী মালা থেকে শুরু করে যৌনবোধ- এইসব কিছু নিয়ে উত্ত্যক্ত করতে করতে বিষয়টাকে এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে দিয়েছিল যার জেরে ছেলেটির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলো-ওই যে উত্ত্যক্ত করা ছেলেগুলো, ওরা তো আমাদেরই কারও না কারও ঘরের সন্তান। মৃত ছেলেটি যেমন আমার সন্তান হতে পারত, ঠিক তেমনই র্যাগিং এর গুরু ঠাকুর যে, সেই ছেলেটিও আমার সন্তান হতে পারত। যে ছেলেটি বা ছেলের দল ওই ছাত্রটিকে এমন মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করে যার জেরে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, আমি একজন পিতা, অভিভাবক, হিতাকাক্সক্ষী হিশেবে তাহলে ওই হামলাবাজ ছেলের দল কে এতকাল কি শিক্ষা দিলাম? অন্যায়ের উপশম যে প্রতিশোধ কল্পে অন্যায় হতে পারে না-এটা কি আমি আমার সন্তানকে শেখাতে পারিনি? অনেকেই বলতে পারেন, সন্তান লায়েক হয়ে গেলে, সে কি আর বাপ-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে? অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে? থাকে আবার থাকেও না। সন্তানকে সুপথে জীবনকে বইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অভিভাবকদের, আত্মীয় পরিজনদের একটা ভূমিকা থাকে বৈকি। সন্তান কখন বাবা- মায়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চায়? যখন সে তার মতো করে তৈরি হওয়া বিচারবোধের দ্বারা বাবা-মায়ের যাপন ঘিরে কোনো প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়ায়, তখন থেকেই সে ধীরে ধীরে নিজেকেও প্রশ্নবানে বিদ্ধ করতে থাকে। আর এই প্রশ্নের জবাব যদি প্রিয়জনদের কাছ থেকে না পায়, তাদের আচার-আচরণের ভেতরে না পায়, তাহলে সে তখন নিজের মনে ওঠা প্রশ্নাবলীর উত্তর ও নিজের মতো করেই করে নেয়। আর এই নিজের মতো করে উত্তর তৈরি করে নেয়ার পেছনে বেশিরভাগ সময়েই কোনো বাস্তবতা থাকে না। যুক্তি তো থাকেই না।
এই বাস্তবতা আর যুক্তিবোধ ছাড়া ধারণার ওপর ভিত্তি করে যখন একটা শিশু বেড়ে উঠতে থাকে, একটি কিশোর বিকশিত হয়, কিশোর সত্তা ধাবমান হয় যৌবনের দিকে তখন সমস্ত রকমের বৌদ্ধিক বিকাশই তো গড়ে ওঠে একটা ভুল ভাবনাকে কেন্দ্র করে। ভ্রান্ত বোধকে কেন্দ্র করে। তখন একটি কিশোর নিজের কিশোর বেলার উপান্তে এসে বা যৌবনের দ্বার প্রান্তে এসে সেই ভুল জীবনবোধের ফলশ্রুতিতেই কখনো তার উপরে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনার শোধ তুলতে যার উপরে সুযোগ পায়, তার প্রতিই একটা সময়ে নিজের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায় গুলোর পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। এই যে প্রতিহিংসা পরায়ণতা, এটা কিন্তু র্যাগিংয়ের ঘটনার ভেতরে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। আমি এমনটা টর্চারের শিকার হয়েছি, এখন আমার হাতে সুযোগ, আমার উপরে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের দ্বিগুণ প্রতিশোধ আমি কেন আমার অধস্তন কারও ওপরে তুলব না?- এই বোধটা তীব্র হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়া যাতে একটা সরলমতি ছাত্র বা ছাত্রীর উপরে তৈরি না হয়, তার জন্যে একজন বাবা বা মা কিংবা পরিবারের মানুষ হিসেবে আমি বা আমরা কতটা সক্রিয়, সদর্থক ভূমিকা পালন করেছি? নিজেকে বা নিজেদের এই প্রশ্নটা কখনো কি আমি করেছি? বা আমরা করেছি?
ধরা যাক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ে মৃত ছাত্রটির কথা। নদীয়ার প্রত্যন্ত এলাকার ছেলে। নিজের বিশ্বাস থেকেই হোক, পারিবারিক বিশ্বাস থেকেই হোক, প্রাতিষ্ঠানিক সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব ধারার আচার অনুযায়ী তার তুলসীর মালা পরা- এটা ঘিরে ওই র্যাগিংকারীর দলের খিল্লি-মনে হয়, ফ্যাসিবাদ? সে তো আমার ঘরের কোনাতেই ওতপেতে বসে আছে। নিজের বিশ্বাস থেকেই হোক, পারিবারিক চাপেই হোক একজন মানুষ যদি কোনো ধর্মীয় প্রতীক নিজের শরীরে ধারণ করে, তাহলে তাকে ঘিরে উপসাস, টিটকিরি-এটা কি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধাচারণ নয়? প্রতিটি মানুষের নিজস্ব বোধ অনুযায়ী তার ধর্মাচারণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ভারতের সংবিধান। ব্যক্তির এই মৌলিক অধিকার পালনের স্বীকৃতির প্রশ্নে ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা বস্তুবাদী কমিউনিস্টদের ও আদৌ কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু মজা হচ্ছে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার বহুত্ববাদী চরিত্রকে অস্বীকার করে একদল সবজান্তার দল, নিজেদের কখনো কমিউনিস্ট, কখনো নন কমিউনিস্ট বামপন্থি, কখনো রাডিকাল, কখনো হিউম্যানিস্ট-এসব হাজারো মত, পথের লোকেরা ধর্মীয় প্রতীক আর ধর্মান্ধতার প্রতীক দুটোকেই কেমন যেন গুলিয়ে ফেলে। আর সেখানেই ঘটতে থাকে গোড়ায় গলদ।
ধর্ম আর ধর্মান্ধতার ফারাক করতে আমরা ভুলে গেছি। ফলে যে মানুষটা ইহকালের সমস্যা আর পরকালের কর্মসূচির তাগিদে ধর্মকে আশ্রয় করেছে, তাদের কে আমরা গুলিয়ে ফেলি ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিদের সঙ্গে। বিশেষ করে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে ধর্মের যে রাজনৈতিক ব্যবহার চলছে, সেই নিরিখেই আমরা গ্রামগঞ্জের একজন সরল বিশ্বাসী মানুষ, যিনি হয়তো তিলক, তুলসীর মালা বা খিলকা অথবা ফেজটুপি পড়ে আছেন, তাদের ঘিরে উপহাস করে একটা বড় অংশের মানুষ নিজেদের প্রগতিশীল দেখাতে চান। সংস্কারমুক্ত হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর সেই বোধটাই সংক্রমিত হয়ে যায় নোতুন প্রজন্মের ভেতরেও। ফলে তারা খুব সহজেই গুলিয়ে ফেলে ধর্ম আর ধর্মান্ধতার ফারাকটাকে। ধর্ম মানলেই যে একজন মানুষ সাম্প্রদায়িক হবেন বা মৌলবাদী হবেন-তাতো কখনোই ভেবে নেয়া ঠিক না। কিন্তু অতি প্রগতিশীলতা দেখাতে গিয়ে এখানেই আমরা বিলকুল ভুল করে বসি। গুলিয়ে ফেলি সবকিছু। তাই যাদবপুরের ছেলেটির সঙ্গে ওভাবে আরোপিত হয়েছিল ছেলেটির যৌনবোধ ঘিরে একটা কাল্পনিক ভাবনাও।
এই বিষয়গুলো কিন্তু নিছক র্যাগিং করবার জন্যে র্যাগারদের অজুহাত হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। র্যাগারদের মনস্তত্ত্বের এই জায়গাটা ঘিরে সেভাবে আলাপ-আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। অপরাধ এবং অপরাধীর মনস্তত্ত্ব কিন্তু একটা বিজ্ঞান। বাংলা ভাষায় অপরাধ বিজ্ঞান ঘিরে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথমেই এসে পড়ে পঞ্চানন ঘোষালের নাম। কিন্তু তার সময়ের আলোচনায়, গবেষণায় এই র্যাগিং বিষয়টি সমাজের বুকে অপরাধ হিসেবে আজকের মতো দগদগে ঘা হয়ে ওঠেনি। ফলে পঞ্চাননবাবুর আলোচনায় এ বিষয়ে তেমন একটা আলোকপাত নেই।
সময় যত এগিয়েছে, ততোই এই র্যাগিং বিষয়টা সমাজের বুকে একটা অভিশাপের মত চেপে বসেছে। এই রাগিং যে কেবল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই একটা ক্ষতের মতো চেপে বসেছে, তা ভাবলে ভুল হবে। ছেলের বিয়ে হওয়ার পর নোতুন বৌমা শ্বশুরঘরে একধরণের রাগিংয়ের শিকার হন। চাকরিক্ষেত্রে ঘটে আর এক ধরণের রাগিং। আবার সামাজিক ক্ষেত্রে এই র্যাগিং যে কিভাবে চলে আসছে তা পঞ্চানন ঘোষালের মতো অপরাধ বিজ্ঞানীর চোখে সেকালে না পড়লেও বিষয়টা কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তার অনবদ্য ছোটগল্প ‘গিন্নি’ কিন্তু এই সামাজিক র্যাগিংয়েরই একটা অংশ। আমরা জীবনের সূচনাকালে, স্কুলে অনেক সময়ে বন্ধুবান্ধবদের নাম দিয়ে থাকি। সাধারণ ভাবে অর্থ, প্রতিপত্তিতে একটু কমজোরিদেরই এমন নাম দেয়া হয়ে থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, ছাত্রদের, তাদের সহপাঠীকে একটা বিকৃত নামে ডাকবার বিষয় একাংশের শিক্ষকদের কানে পৌঁছলে, তারা বিষয়টা ঘিরে কঠোর হওয়ার বদলে এই নামকরণটাকে বেশ উপভোগ করেন। আমাদের ছাত্র জীবনে এক শিক্ষক আমাদেরই এক বন্ধুর নামকরণ করেছিলেন, ‘সিঙারা’ । সেই শিক্ষকটি একটি স্কুলের সহশিক্ষক থেকে ক্রমে অপর একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার পি মিত্র সম্পর্কে বই লিখেছেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সেও এককালে ছাত্রদের যে নিত্যনতুন নামকরণ করে তিনি সেইসব ছেলেদের আজ ও স্থানীয় সমাজে র্যাগড হওয়ার অবস্থায় ফেলেন, এটা কখনোই স্বীকার করেন না। বরঞ্চ নিজের অতীতের ভূমিকা ঘিরে বেশ গৌরব বোধই করে থাকেন।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৩
আবার র্যাগিংয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। খবরের কাগজের সূত্রে এমনটাই জানা যাচ্ছে। শারদোৎসবের মৌসুমে এমন খবরে তেমন একটা মন নেই সবার। ফলে মাত্র কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার মতো কোনো শোরগোল নেই জনচিত্তে। সমাজের দায় যারা নিজেদের কাঁধে নিয়ে ঘাড়খানা প্রায় বাঁকিয়ে ফেলেছেন, তারাও এখন ব্যস্ত পুজো, পুজো সংখ্যা, প্যান্ডেল, ভিড়, উদ্বোধন, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো-এসব নিয়ে। তাই আপাতত বাম-ডান কোনো শিবিরেই এতটুকু হেলদোল নেই। শাসকশিবিরের খরচা বেঁচে গেল। মৃতের মাকে, বাবাকে কিনতে খরচ করতে হলো না চাকরি বা নোটের তাড়া।
কিন্তু যে যাওয়ার, সে গেছে। তার যাওয়া ঘিরে প্রশ্ন? সেটা বুকের গহীনে থাকবে তার মায়ের, বাবার। যদি সে মন দেয়া-নেয়া করে থাকে, তবে সে নারীর। হয়তো একদিন সে নারীর জীবনেও আসবে কোনো পুরুষ। নতুনের আগমনে হারিয়ে যাবে পুরনোর স্মৃতি। মৃত ছাত্রটি কেবলমাত্র জেগে থাকবে মায়ের স্মৃতিতে। বাবার বুকের বোবা কান্নায়। মায়ের হয়তো মনে হবে, হয়তো বা না ও মনে হতে পারে, আগের র্যাগিংয়ের শিকারের মা তো চাকরি পেল, আমি কেন পেলাম না- এ প্রশ্নটি।
প্রশ্ন উঠলেই যে উত্তর মিলবে, সহজেই মিলবে সেই উত্তর, এমন মাথার দিব্যি কে কবে কাউকে দিয়েছে? সমপ্রেমের বিয়ে ঘিরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। সেই বক্তব্য ঘিরে যার যা পাল্টা বক্তব্য থাকুক না কেন, সবাই তো একবাক্যে বলবেন, সমপ্রেমকে কখনো কোনো দন্ডনীয় অপরাধ বলে দেগে দেননি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটি রাগিংয়ের শিকার হয়েছিল, সেই ছেলেটির ব্যক্তি বিশ্বাসের জায়গা থেকে গলায় তুলসীর মালা থাকায়, দাদারা তাকে সমকামী বলে দেগে দিয়েছিল। একজন বুদ্ধিজীবী, সমাজভাবুক, তা তিনি ডান, বাম, সেনট্রিস্ট, যাই হোন না কেন, র্যাগিং ঘিরে অনেক কথা বললেও, এটা একবারের জন্যেও বলেননি যে, ছেলেটির ব্যক্তি জীবন ঘিরে একটা কথা বলবার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের কেবল একটাই কথা, কেন ছেলেটিকে মরতে হলো, এর জন্যে দায়ী কে? এটাই।
যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু যখনই ঘটে চারিদিকে একটা শোরগোল পড়ে যায়। সেই শোরগোলটা কিছুদিন চলতে থাকে। নানা সভাসমিতি, অবস্থান, মিছিল চলে। পোস্টার ফেস্টুনে দেওয়াল ভরে যায়। খবরের কাগজে অনেক প্রতিবাদী লেখা বের হয়। টেলিভিশনে জোরদার বিতর্ক সভা বসে। তারপর? সব কেমন ঠান্ডা মেরে যায়। খবরের কাগজ চলে যায় ঠোঙা হতে। মুখরোচক খাবার ফিরতে থাকে সেইসব রং বেরংয়ের ঠোঙায়। নোতুন ঘটনা এসে ফিকে করে দেয় আগের ঘটনাকে। তখন কেবল অমনধারা ঘটনা ঘটলে রেফারেন্স হিসেবে টানা হয় আগের ঘটনা কে। ব্যাস, ওই টুকুই। আগের ঘটনার সমাধান হয়নি। অপরাধী শাস্তি পায়নি-এসব গালভরা কথা নোতুন ঘটনার জেরে বারবার উঠে আসে।
সামাজিক অপরাধগুলোকে কি আমরা নিজেদের টিআরপি বৃদ্ধির একটা উপকরণ হিসেবেই তবে কেবলমাত্র ধরে নিয়েছি? সামাজিক অপরাধের শিকার যারা হচ্ছেন, তাদের পরিবার পরিজনেরা অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী থাকবেন। আবার অনেকেই শাসকের উপঢৌকনে খুশি হয়ে আত্মজনের অস্বাবিক মৃত্যুকে কার্যত বাজি তে পরিণত করছেন। মানবিকতার কারণে সন্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে যে আত্মজন চাকরি পেলেন বা মোটা অঙ্কের টাকা পেলেন, তাদের কেউ উপহাস করছেন। আবার কেউ বা বিবেকের তাড়নায় চুপ করে থাকছেন। আবার কেউ কেউ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কঠোর কথা কিছু বলছেন না কিন্তু মন থেকে গোটা ব্যাপারটা ঠিক ভালোভাবে মেনেও নিতে পারছেন না।
র্যাগিং একটা সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যধি দূর করতে আইন, আদালত, প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রী, উপাচার্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরাই সব নন। এই ব্যাধি দূর করতে প্রথম এবং প্রধান দরকার সামাজিক সচেতনতা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের বা তার থেকেও সিনিয়ার কোনো ছাত্র যদি মনে করে, আমি ও র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলাম হস্টেলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে পা দিয়ে। তাই নবাগত ছাত্রের ওপর আমার একটা র্যাগিংয়ের অধিকার এই কারণে জন্মে গেছে যেহেতু আমি নিজেও রাগড হয়েছি-এমন ভাবনা থেকে সিনিয়ার ছাত্রদের বের করে আনবার জন্যে সমাজের একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে। প্রতিশোধের আকাক্সক্ষা এই র্যাগিং ঘিরে যাতে কোনো স্তরের ছাত্রদের মধ্যেই তৈরি না হয়, সেজন্যে গোটা সামাজিক পরিকাঠামোর একটা বিশেষ দায় আছে, দায়িত্ব তো আছেই।
গোটা সমাজ কি তার দায়িত্ব পালন করছে? নাকি একে অন্যের ওপর দোষারোপ করে নিজের নিজের দায় এড়াতেই সমাজের উৎসাহ এবং তৎপরতা সবথেকে বেশি? উপাচার্য থেকে শুরু করে সব স্তরের আধিকারিক, কলেজ হলে অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে সবস্তরের আধিকারিকদের দায়ী করেই আমরা নিজেদের দায়টাকে সেরে ফেলতে চাই। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্নটা হলো, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া রাগিং এবং ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায়, যে ছেলেগুলি ওই নিরীহ গ্রামের ছেলেটিকে গলায় তুলসী মালা থেকে শুরু করে যৌনবোধ- এইসব কিছু নিয়ে উত্ত্যক্ত করতে করতে বিষয়টাকে এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে দিয়েছিল যার জেরে ছেলেটির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলো-ওই যে উত্ত্যক্ত করা ছেলেগুলো, ওরা তো আমাদেরই কারও না কারও ঘরের সন্তান। মৃত ছেলেটি যেমন আমার সন্তান হতে পারত, ঠিক তেমনই র্যাগিং এর গুরু ঠাকুর যে, সেই ছেলেটিও আমার সন্তান হতে পারত। যে ছেলেটি বা ছেলের দল ওই ছাত্রটিকে এমন মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করে যার জেরে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, আমি একজন পিতা, অভিভাবক, হিতাকাক্সক্ষী হিশেবে তাহলে ওই হামলাবাজ ছেলের দল কে এতকাল কি শিক্ষা দিলাম? অন্যায়ের উপশম যে প্রতিশোধ কল্পে অন্যায় হতে পারে না-এটা কি আমি আমার সন্তানকে শেখাতে পারিনি? অনেকেই বলতে পারেন, সন্তান লায়েক হয়ে গেলে, সে কি আর বাপ-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে? অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে? থাকে আবার থাকেও না। সন্তানকে সুপথে জীবনকে বইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অভিভাবকদের, আত্মীয় পরিজনদের একটা ভূমিকা থাকে বৈকি। সন্তান কখন বাবা- মায়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চায়? যখন সে তার মতো করে তৈরি হওয়া বিচারবোধের দ্বারা বাবা-মায়ের যাপন ঘিরে কোনো প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়ায়, তখন থেকেই সে ধীরে ধীরে নিজেকেও প্রশ্নবানে বিদ্ধ করতে থাকে। আর এই প্রশ্নের জবাব যদি প্রিয়জনদের কাছ থেকে না পায়, তাদের আচার-আচরণের ভেতরে না পায়, তাহলে সে তখন নিজের মনে ওঠা প্রশ্নাবলীর উত্তর ও নিজের মতো করেই করে নেয়। আর এই নিজের মতো করে উত্তর তৈরি করে নেয়ার পেছনে বেশিরভাগ সময়েই কোনো বাস্তবতা থাকে না। যুক্তি তো থাকেই না।
এই বাস্তবতা আর যুক্তিবোধ ছাড়া ধারণার ওপর ভিত্তি করে যখন একটা শিশু বেড়ে উঠতে থাকে, একটি কিশোর বিকশিত হয়, কিশোর সত্তা ধাবমান হয় যৌবনের দিকে তখন সমস্ত রকমের বৌদ্ধিক বিকাশই তো গড়ে ওঠে একটা ভুল ভাবনাকে কেন্দ্র করে। ভ্রান্ত বোধকে কেন্দ্র করে। তখন একটি কিশোর নিজের কিশোর বেলার উপান্তে এসে বা যৌবনের দ্বার প্রান্তে এসে সেই ভুল জীবনবোধের ফলশ্রুতিতেই কখনো তার উপরে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনার শোধ তুলতে যার উপরে সুযোগ পায়, তার প্রতিই একটা সময়ে নিজের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায় গুলোর পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। এই যে প্রতিহিংসা পরায়ণতা, এটা কিন্তু র্যাগিংয়ের ঘটনার ভেতরে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। আমি এমনটা টর্চারের শিকার হয়েছি, এখন আমার হাতে সুযোগ, আমার উপরে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের দ্বিগুণ প্রতিশোধ আমি কেন আমার অধস্তন কারও ওপরে তুলব না?- এই বোধটা তীব্র হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়া যাতে একটা সরলমতি ছাত্র বা ছাত্রীর উপরে তৈরি না হয়, তার জন্যে একজন বাবা বা মা কিংবা পরিবারের মানুষ হিসেবে আমি বা আমরা কতটা সক্রিয়, সদর্থক ভূমিকা পালন করেছি? নিজেকে বা নিজেদের এই প্রশ্নটা কখনো কি আমি করেছি? বা আমরা করেছি?
ধরা যাক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ে মৃত ছাত্রটির কথা। নদীয়ার প্রত্যন্ত এলাকার ছেলে। নিজের বিশ্বাস থেকেই হোক, পারিবারিক বিশ্বাস থেকেই হোক, প্রাতিষ্ঠানিক সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব ধারার আচার অনুযায়ী তার তুলসীর মালা পরা- এটা ঘিরে ওই র্যাগিংকারীর দলের খিল্লি-মনে হয়, ফ্যাসিবাদ? সে তো আমার ঘরের কোনাতেই ওতপেতে বসে আছে। নিজের বিশ্বাস থেকেই হোক, পারিবারিক চাপেই হোক একজন মানুষ যদি কোনো ধর্মীয় প্রতীক নিজের শরীরে ধারণ করে, তাহলে তাকে ঘিরে উপসাস, টিটকিরি-এটা কি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধাচারণ নয়? প্রতিটি মানুষের নিজস্ব বোধ অনুযায়ী তার ধর্মাচারণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ভারতের সংবিধান। ব্যক্তির এই মৌলিক অধিকার পালনের স্বীকৃতির প্রশ্নে ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা বস্তুবাদী কমিউনিস্টদের ও আদৌ কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু মজা হচ্ছে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার বহুত্ববাদী চরিত্রকে অস্বীকার করে একদল সবজান্তার দল, নিজেদের কখনো কমিউনিস্ট, কখনো নন কমিউনিস্ট বামপন্থি, কখনো রাডিকাল, কখনো হিউম্যানিস্ট-এসব হাজারো মত, পথের লোকেরা ধর্মীয় প্রতীক আর ধর্মান্ধতার প্রতীক দুটোকেই কেমন যেন গুলিয়ে ফেলে। আর সেখানেই ঘটতে থাকে গোড়ায় গলদ।
ধর্ম আর ধর্মান্ধতার ফারাক করতে আমরা ভুলে গেছি। ফলে যে মানুষটা ইহকালের সমস্যা আর পরকালের কর্মসূচির তাগিদে ধর্মকে আশ্রয় করেছে, তাদের কে আমরা গুলিয়ে ফেলি ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিদের সঙ্গে। বিশেষ করে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে ধর্মের যে রাজনৈতিক ব্যবহার চলছে, সেই নিরিখেই আমরা গ্রামগঞ্জের একজন সরল বিশ্বাসী মানুষ, যিনি হয়তো তিলক, তুলসীর মালা বা খিলকা অথবা ফেজটুপি পড়ে আছেন, তাদের ঘিরে উপহাস করে একটা বড় অংশের মানুষ নিজেদের প্রগতিশীল দেখাতে চান। সংস্কারমুক্ত হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর সেই বোধটাই সংক্রমিত হয়ে যায় নোতুন প্রজন্মের ভেতরেও। ফলে তারা খুব সহজেই গুলিয়ে ফেলে ধর্ম আর ধর্মান্ধতার ফারাকটাকে। ধর্ম মানলেই যে একজন মানুষ সাম্প্রদায়িক হবেন বা মৌলবাদী হবেন-তাতো কখনোই ভেবে নেয়া ঠিক না। কিন্তু অতি প্রগতিশীলতা দেখাতে গিয়ে এখানেই আমরা বিলকুল ভুল করে বসি। গুলিয়ে ফেলি সবকিছু। তাই যাদবপুরের ছেলেটির সঙ্গে ওভাবে আরোপিত হয়েছিল ছেলেটির যৌনবোধ ঘিরে একটা কাল্পনিক ভাবনাও।
এই বিষয়গুলো কিন্তু নিছক র্যাগিং করবার জন্যে র্যাগারদের অজুহাত হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। র্যাগারদের মনস্তত্ত্বের এই জায়গাটা ঘিরে সেভাবে আলাপ-আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। অপরাধ এবং অপরাধীর মনস্তত্ত্ব কিন্তু একটা বিজ্ঞান। বাংলা ভাষায় অপরাধ বিজ্ঞান ঘিরে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথমেই এসে পড়ে পঞ্চানন ঘোষালের নাম। কিন্তু তার সময়ের আলোচনায়, গবেষণায় এই র্যাগিং বিষয়টি সমাজের বুকে অপরাধ হিসেবে আজকের মতো দগদগে ঘা হয়ে ওঠেনি। ফলে পঞ্চাননবাবুর আলোচনায় এ বিষয়ে তেমন একটা আলোকপাত নেই।
সময় যত এগিয়েছে, ততোই এই র্যাগিং বিষয়টা সমাজের বুকে একটা অভিশাপের মত চেপে বসেছে। এই রাগিং যে কেবল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই একটা ক্ষতের মতো চেপে বসেছে, তা ভাবলে ভুল হবে। ছেলের বিয়ে হওয়ার পর নোতুন বৌমা শ্বশুরঘরে একধরণের রাগিংয়ের শিকার হন। চাকরিক্ষেত্রে ঘটে আর এক ধরণের রাগিং। আবার সামাজিক ক্ষেত্রে এই র্যাগিং যে কিভাবে চলে আসছে তা পঞ্চানন ঘোষালের মতো অপরাধ বিজ্ঞানীর চোখে সেকালে না পড়লেও বিষয়টা কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তার অনবদ্য ছোটগল্প ‘গিন্নি’ কিন্তু এই সামাজিক র্যাগিংয়েরই একটা অংশ। আমরা জীবনের সূচনাকালে, স্কুলে অনেক সময়ে বন্ধুবান্ধবদের নাম দিয়ে থাকি। সাধারণ ভাবে অর্থ, প্রতিপত্তিতে একটু কমজোরিদেরই এমন নাম দেয়া হয়ে থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, ছাত্রদের, তাদের সহপাঠীকে একটা বিকৃত নামে ডাকবার বিষয় একাংশের শিক্ষকদের কানে পৌঁছলে, তারা বিষয়টা ঘিরে কঠোর হওয়ার বদলে এই নামকরণটাকে বেশ উপভোগ করেন। আমাদের ছাত্র জীবনে এক শিক্ষক আমাদেরই এক বন্ধুর নামকরণ করেছিলেন, ‘সিঙারা’ । সেই শিক্ষকটি একটি স্কুলের সহশিক্ষক থেকে ক্রমে অপর একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার পি মিত্র সম্পর্কে বই লিখেছেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সেও এককালে ছাত্রদের যে নিত্যনতুন নামকরণ করে তিনি সেইসব ছেলেদের আজ ও স্থানীয় সমাজে র্যাগড হওয়ার অবস্থায় ফেলেন, এটা কখনোই স্বীকার করেন না। বরঞ্চ নিজের অতীতের ভূমিকা ঘিরে বেশ গৌরব বোধই করে থাকেন।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]