alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাথমিকে পঠন দক্ষতা অর্জনে সহায়ক কর্মকান্ড

সন্ধ্যা রানী সাহা

: রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। শিক্ষকরা যোগ্যতাসম্পন্ন এবং নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কেউ কেউ আবার বিদেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে এবং সেটা অত্যাধুনিক পন্থায় চলছে। তারপরও শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকগুলো কেন পড়তে পারছে না? সবাই বিদ্যালয়ে যে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী রয়েছে এমন নয়। অল্প যে কয়েকটি বিদ্যালয়ে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী রয়েছে সেখানে কিভাবে সফলতার সঙ্গে পাঠদান করা যায় শিক্ষকদের সেই সব প্রশিক্ষণও সময়ে সময়ে দেয়া হচ্ছে। এরপরও কাজ হচ্ছে না।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ ১১ বছরের স্কুলজীবনের ৪ বছরই তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখেছি কোনো কোনো শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে কিন্তু প্রথম শ্রেণীর বই শুদ্ধ করে পড়তে পারছে না। আবার এও লক্ষ্য করেছি পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকটি পড়তে পারছে; কিন্তু অন্ধের মতো করে। পাঠগুলো মুখস্থ করানো হয়েছে। যে কোনো পৃষ্ঠার পাঠ শিশুরা পড়তে পারছে কিন্তু পাঠের নিচে লেখা নির্দেশনা কেউ পড়তে পারছে না। ওই অংশটুকু শিক্ষকের জন্য নির্ধারিত বলে শিক্ষার্থীদের শেখানো বা মুখস্থ করানো হয়নি।

প্রশিক্ষণকালে যে পদ্ধতিই শেখানো হোক না কেন শ্রেণীতে শিক্ষা চলে সেকেলে পদ্ধতিতে। এর কারণ প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণকালে ‘শেখানো উপায়ে’ পাঠদান চলছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব সেভাবে পালন করেন না। আবার ইউ-আর-সি কিংবা পিটিআইয়ের নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রশিক্ষণকালে যা বলা হয় তা যে বিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না তা তারা অনুধাবন করতে পারেন না। কারণ তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা নেই। বর্তমানে চাহিদাভিত্তিক সাবক্লাস্টার এর ম্যানুয়ালগুলো ইউ-আর-সি ইন্সট্রাক্টরদের মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি অবলোকন করে নিজস্ব সৃজনশীলতা দিয়ে তৈরি করার কথা; কিন্তু তারা তা করছেন না। পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণ- ম্যানুয়াল থেকে হুবহু শব্দ এবং বাক্য চয়ন করে সেগুলো তৈরি করা হচ্ছে।

তাই বেশিরভাগ শিক্ষকরাও কষ্ট করতে চান না। দেখা যায় যে, পাঠ্যপুস্তক ছাড়া কোনরূপ পাঠসংশ্লিষ্ট আকর্ষণীয় উপকরণ শিক্ষকের সঙ্গে নাই। শিক্ষক উচ্চস্বরে পড়া বলে যাচ্ছেন। শিশুরা তা শুনে সমস্বরে বলছে। এভাবে এক শ্রেণীর শব্দ আরেক শ্রেণীতে গিয়ে বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে না বুঝেই শিশুদের পাঠটি আয়ত্ব করতে হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনে গিয়ে দেখেছি যেখানে শিক্ষক প্রথমে শ্রেণীতে ঢুকেই বোর্ডে লিখতে শুরু করেন। শিশুরা তা দেখে লিখে-লিখে পাতা বোঝাই করে। কী লিখছে তা বোঝার অবকাশ নাই। শিক্ষক ব্যতিরেকে অন্যকেউ কিছু লিখতে দিলে শিশুরা তা পারছে না। এ অবস্থা আর চলতে পারে না।

চাকরি জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষকদের বলে আসছি যে শিশুদের ‘পড়তে পারাটা’ শিখিয়ে দিতে হবে। দৌলতপুরে যোগদানের আগে আমি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে কর্তব্যরত ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন একদিন (১৪-১১-২০১৭) গাজীপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জনাব শফিউল হক স্যারের সঙ্গে আমার রানীগঞ্জ ক্লাস্টারের চাকৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ হয়। স্যার সারাদিন ব্যয় করে শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুত সাবলীলভাবে পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে পারে সে উপায়গুলো সম্বন্ধে শিক্ষকদেরকে নির্দেশনা প্রদান করেন। আমি অবশ্য আগে থেকেই চেষ্টায় ছিলাম; কিন্তু স্যার যেদিন গেলেন সেদিন থেকে মাত্র সাত কিংবা দশ দিনের মধ্যে ওই বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী সাবলীলভাবে পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে সক্ষম হয়। সেই থেকে বুঝতে পারি যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাগুলো খুবই কাজের। বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন স্যার শিক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারার বিষয়ে যেভাবে জোর দিয়েছেন তাতে মাঠ পর্যায়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে আশা করি।

আমি আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে যে সব স্থানে গিয়েছি সর্বত্রই দেখেছি একই অবস্থা- শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে না। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা একই কথা বলছে। দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে পারে না। ইংরেজি এবং গণিতের অবস্থা আরও খারাপ। যাই হোক যারা পারে তাদের জিজ্ঞাসা করেছি ‘পড়তে-পারা’ কে শিখিয়েছে? উত্তরে কেউ বলেছে মা, কেউ বলেছে বাবা। কেউ বলেছে বড় ভাই বা বোন। আবার কেউ বলেছে গৃহশিক্ষক। আমি আমার সহকর্মী এবং কিছু শিক্ষককে কৌতূহলবশত একই প্রশ্ন করেছি। তারাও একই উত্তর দিয়েছেন।

তাহলে কী দাঁড়ালো? যাদের বাড়িতে পড়া শেখানোর কেউ নেই, শিক্ষকেরা না শিখিয়ে দিলে তাদের উপায় কি! যেহেতু পাঠের বিষয় পড়তে পারে না সেহেতু তারা তা বুঝতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থী যত উপরের শ্রেণীতে উঠতে থাকে পড়ালেখা তার কাছে তত বেশি বোঝাস্বরূপ মনে হতে থাকে। এক পর্যায়ে সে এই বোঝা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের আশা ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ সে ঝরে পড়ে। এ ভাবে তার অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। প্রকারান্তরে তাকে অন্ধ করে ছেড়ে দেয়া হয় আর কি। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। কেউ অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কাজ করতে যায়। কেউ মানব-পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়। আবার কেউ অপরাধ জগতে পা বাড়ায়।

বেকারত্ব দূর করা আমাদের সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক হিসেবে দেশে ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ বেকার। ৭৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। অথচ এই দেশেই তিন লাখ বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশাদারি পদে কর্মরত। কারণ বর্তমানে পেশার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কাজ পেতে হলে শুধু লেখাপড়া নয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও করায়ত্ব করতে হচ্ছে। দুর্বল শিক্ষার্থী দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি করায়ত্ব করা সম্ভব নয়।

আমরা জানি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশটা সত্যি ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো কিনা তার পরিমাপকসমূহের অন্যতম সূচক হবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। বিষয়টি উপলদ্ধিতে এনে শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্রুত এগোতে হবে।

বাংলাদেশে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মানহীন শিক্ষা নিয়ে বড় হওয়ার অর্থ সামগ্রিকভাবে দেশ পিছিয়ে পড়া। তাই দেশের সবাই প্রকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে- কিভাবে শেখাবেন তা আপনারাই ভালো জানেন। তবে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবাই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকগুলো সাবলীলভাবে ‘পড়তে পারাটা’ শিখিয়ে দিন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ ১১ বছরের স্কুলজীবনের ৪ বছরই তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

এবারে এই ‘পড়তে পারা শিখানো’ বিষয়ক আমার একটি অসমাপ্ত উদ্যোগের কথা বলি যা দিয়ে আমার এ লেখাটি শুরু করেছিলাম। বলেছিলাম যে আমার আবেদনে ওখানকার (দৌলতপুর) অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক সাড়া দিয়েছিলেন। দু-একজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। আমি সকাল ৯টা এবং বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে বিদ্যালয় পরিদর্র্শন করতে থাকি। শিক্ষকরা অতি অল্প সময়ে আমার এই তৎপরতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু। আর মার্চ ২০১৮ এর মাসিক সমন্বয় সভায় ঘোষণা দেই যে ‘পড়তে পারা’ বিষয়ে বিদ্যালয়, ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে অংশগ্রহণকারী এবং বিজয়ী ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করা শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা হবে। শিক্ষকরা এতে উৎসাহিত হয়ে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে এই ‘পড়তে পারা’ শিখানোর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন যে, আমার কর্মকালীন কোনো শিক্ষক এমন কোনো অশোভন আচরণ করেননি যারা জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এভাবে চলার পর বিদ্যালয় পর্র্যায়ে পাঠ্যপুস্তক ‘পড়তে পারার’ প্রতিযোগিতা শুরু হয় মার্চ ২০১৯ সালে।

সীমাবদ্ধতার কারণে ৩য়, ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বিদ্যালয়ে প্রথমস্থান অধিকারী তাদের আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় ডাকা হয় । এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করি যে, এই প্রতিযোগিতাকে উপলক্ষ্য করে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষার্থীদের পড়তে পারা বা রিডিং পড়া শিখিয়ে চলেছে। এর পরের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ৯ এপ্রিল ২০১৯, খুলসী ইউনিয়নে। এখনও মনের কোনে উঁকি দেয় দৌলতপুরের ওই দুর্গম চরাঞ্চলের অবহেলিত শিক্ষার্থীরা। যাদের হোম ভিজিট করে দেখেছি পড়ার জন্য কোন চেয়ার-টেবিল নেই। শিক্ষিত মা নেই। কে তাদের দায়িত্ব নিয়ে এই ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলবে?

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার, পাকুন্দিয়া, সিরাজগঞ্জ]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাথমিকে পঠন দক্ষতা অর্জনে সহায়ক কর্মকান্ড

সন্ধ্যা রানী সাহা

রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। শিক্ষকরা যোগ্যতাসম্পন্ন এবং নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কেউ কেউ আবার বিদেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে এবং সেটা অত্যাধুনিক পন্থায় চলছে। তারপরও শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকগুলো কেন পড়তে পারছে না? সবাই বিদ্যালয়ে যে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী রয়েছে এমন নয়। অল্প যে কয়েকটি বিদ্যালয়ে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী রয়েছে সেখানে কিভাবে সফলতার সঙ্গে পাঠদান করা যায় শিক্ষকদের সেই সব প্রশিক্ষণও সময়ে সময়ে দেয়া হচ্ছে। এরপরও কাজ হচ্ছে না।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ ১১ বছরের স্কুলজীবনের ৪ বছরই তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখেছি কোনো কোনো শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে কিন্তু প্রথম শ্রেণীর বই শুদ্ধ করে পড়তে পারছে না। আবার এও লক্ষ্য করেছি পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকটি পড়তে পারছে; কিন্তু অন্ধের মতো করে। পাঠগুলো মুখস্থ করানো হয়েছে। যে কোনো পৃষ্ঠার পাঠ শিশুরা পড়তে পারছে কিন্তু পাঠের নিচে লেখা নির্দেশনা কেউ পড়তে পারছে না। ওই অংশটুকু শিক্ষকের জন্য নির্ধারিত বলে শিক্ষার্থীদের শেখানো বা মুখস্থ করানো হয়নি।

প্রশিক্ষণকালে যে পদ্ধতিই শেখানো হোক না কেন শ্রেণীতে শিক্ষা চলে সেকেলে পদ্ধতিতে। এর কারণ প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণকালে ‘শেখানো উপায়ে’ পাঠদান চলছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব সেভাবে পালন করেন না। আবার ইউ-আর-সি কিংবা পিটিআইয়ের নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রশিক্ষণকালে যা বলা হয় তা যে বিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না তা তারা অনুধাবন করতে পারেন না। কারণ তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা নেই। বর্তমানে চাহিদাভিত্তিক সাবক্লাস্টার এর ম্যানুয়ালগুলো ইউ-আর-সি ইন্সট্রাক্টরদের মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি অবলোকন করে নিজস্ব সৃজনশীলতা দিয়ে তৈরি করার কথা; কিন্তু তারা তা করছেন না। পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণ- ম্যানুয়াল থেকে হুবহু শব্দ এবং বাক্য চয়ন করে সেগুলো তৈরি করা হচ্ছে।

তাই বেশিরভাগ শিক্ষকরাও কষ্ট করতে চান না। দেখা যায় যে, পাঠ্যপুস্তক ছাড়া কোনরূপ পাঠসংশ্লিষ্ট আকর্ষণীয় উপকরণ শিক্ষকের সঙ্গে নাই। শিক্ষক উচ্চস্বরে পড়া বলে যাচ্ছেন। শিশুরা তা শুনে সমস্বরে বলছে। এভাবে এক শ্রেণীর শব্দ আরেক শ্রেণীতে গিয়ে বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে না বুঝেই শিশুদের পাঠটি আয়ত্ব করতে হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনে গিয়ে দেখেছি যেখানে শিক্ষক প্রথমে শ্রেণীতে ঢুকেই বোর্ডে লিখতে শুরু করেন। শিশুরা তা দেখে লিখে-লিখে পাতা বোঝাই করে। কী লিখছে তা বোঝার অবকাশ নাই। শিক্ষক ব্যতিরেকে অন্যকেউ কিছু লিখতে দিলে শিশুরা তা পারছে না। এ অবস্থা আর চলতে পারে না।

চাকরি জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষকদের বলে আসছি যে শিশুদের ‘পড়তে পারাটা’ শিখিয়ে দিতে হবে। দৌলতপুরে যোগদানের আগে আমি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে কর্তব্যরত ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন একদিন (১৪-১১-২০১৭) গাজীপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জনাব শফিউল হক স্যারের সঙ্গে আমার রানীগঞ্জ ক্লাস্টারের চাকৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ হয়। স্যার সারাদিন ব্যয় করে শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুত সাবলীলভাবে পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে পারে সে উপায়গুলো সম্বন্ধে শিক্ষকদেরকে নির্দেশনা প্রদান করেন। আমি অবশ্য আগে থেকেই চেষ্টায় ছিলাম; কিন্তু স্যার যেদিন গেলেন সেদিন থেকে মাত্র সাত কিংবা দশ দিনের মধ্যে ওই বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী সাবলীলভাবে পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে সক্ষম হয়। সেই থেকে বুঝতে পারি যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাগুলো খুবই কাজের। বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন স্যার শিক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারার বিষয়ে যেভাবে জোর দিয়েছেন তাতে মাঠ পর্যায়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে আশা করি।

আমি আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে যে সব স্থানে গিয়েছি সর্বত্রই দেখেছি একই অবস্থা- শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে না। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা একই কথা বলছে। দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে পারে না। ইংরেজি এবং গণিতের অবস্থা আরও খারাপ। যাই হোক যারা পারে তাদের জিজ্ঞাসা করেছি ‘পড়তে-পারা’ কে শিখিয়েছে? উত্তরে কেউ বলেছে মা, কেউ বলেছে বাবা। কেউ বলেছে বড় ভাই বা বোন। আবার কেউ বলেছে গৃহশিক্ষক। আমি আমার সহকর্মী এবং কিছু শিক্ষককে কৌতূহলবশত একই প্রশ্ন করেছি। তারাও একই উত্তর দিয়েছেন।

তাহলে কী দাঁড়ালো? যাদের বাড়িতে পড়া শেখানোর কেউ নেই, শিক্ষকেরা না শিখিয়ে দিলে তাদের উপায় কি! যেহেতু পাঠের বিষয় পড়তে পারে না সেহেতু তারা তা বুঝতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থী যত উপরের শ্রেণীতে উঠতে থাকে পড়ালেখা তার কাছে তত বেশি বোঝাস্বরূপ মনে হতে থাকে। এক পর্যায়ে সে এই বোঝা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের আশা ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ সে ঝরে পড়ে। এ ভাবে তার অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। প্রকারান্তরে তাকে অন্ধ করে ছেড়ে দেয়া হয় আর কি। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। কেউ অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কাজ করতে যায়। কেউ মানব-পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়। আবার কেউ অপরাধ জগতে পা বাড়ায়।

বেকারত্ব দূর করা আমাদের সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক হিসেবে দেশে ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ বেকার। ৭৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। অথচ এই দেশেই তিন লাখ বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশাদারি পদে কর্মরত। কারণ বর্তমানে পেশার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কাজ পেতে হলে শুধু লেখাপড়া নয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও করায়ত্ব করতে হচ্ছে। দুর্বল শিক্ষার্থী দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি করায়ত্ব করা সম্ভব নয়।

আমরা জানি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশটা সত্যি ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো কিনা তার পরিমাপকসমূহের অন্যতম সূচক হবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। বিষয়টি উপলদ্ধিতে এনে শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্রুত এগোতে হবে।

বাংলাদেশে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মানহীন শিক্ষা নিয়ে বড় হওয়ার অর্থ সামগ্রিকভাবে দেশ পিছিয়ে পড়া। তাই দেশের সবাই প্রকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে- কিভাবে শেখাবেন তা আপনারাই ভালো জানেন। তবে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবাই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকগুলো সাবলীলভাবে ‘পড়তে পারাটা’ শিখিয়ে দিন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ ১১ বছরের স্কুলজীবনের ৪ বছরই তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

এবারে এই ‘পড়তে পারা শিখানো’ বিষয়ক আমার একটি অসমাপ্ত উদ্যোগের কথা বলি যা দিয়ে আমার এ লেখাটি শুরু করেছিলাম। বলেছিলাম যে আমার আবেদনে ওখানকার (দৌলতপুর) অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক সাড়া দিয়েছিলেন। দু-একজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। আমি সকাল ৯টা এবং বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে বিদ্যালয় পরিদর্র্শন করতে থাকি। শিক্ষকরা অতি অল্প সময়ে আমার এই তৎপরতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু। আর মার্চ ২০১৮ এর মাসিক সমন্বয় সভায় ঘোষণা দেই যে ‘পড়তে পারা’ বিষয়ে বিদ্যালয়, ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে অংশগ্রহণকারী এবং বিজয়ী ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করা শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা হবে। শিক্ষকরা এতে উৎসাহিত হয়ে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে এই ‘পড়তে পারা’ শিখানোর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন যে, আমার কর্মকালীন কোনো শিক্ষক এমন কোনো অশোভন আচরণ করেননি যারা জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এভাবে চলার পর বিদ্যালয় পর্র্যায়ে পাঠ্যপুস্তক ‘পড়তে পারার’ প্রতিযোগিতা শুরু হয় মার্চ ২০১৯ সালে।

সীমাবদ্ধতার কারণে ৩য়, ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বিদ্যালয়ে প্রথমস্থান অধিকারী তাদের আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় ডাকা হয় । এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করি যে, এই প্রতিযোগিতাকে উপলক্ষ্য করে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষার্থীদের পড়তে পারা বা রিডিং পড়া শিখিয়ে চলেছে। এর পরের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ৯ এপ্রিল ২০১৯, খুলসী ইউনিয়নে। এখনও মনের কোনে উঁকি দেয় দৌলতপুরের ওই দুর্গম চরাঞ্চলের অবহেলিত শিক্ষার্থীরা। যাদের হোম ভিজিট করে দেখেছি পড়ার জন্য কোন চেয়ার-টেবিল নেই। শিক্ষিত মা নেই। কে তাদের দায়িত্ব নিয়ে এই ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলবে?

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার, পাকুন্দিয়া, সিরাজগঞ্জ]

back to top