alt

উপ-সম্পাদকীয়

অর্থনীতিকে টেকসই করতে কৃষিভিত্তিক শিল্পে জোর দিতে হবে

জহুরা ইয়াসমিন

: শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষ এ খাতের প্রসারে প্রচুর শ্রম ব্যয় করছেন। কৃষিকে গুরুত্বহীন করে শুধু শিল্প খাতের উন্নয়নে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ দেখাবে না। কৃষির যথাযথ বিকাশ সাধনের পাশাপাশি শিল্পের ও সেবা খাতের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হলে তা মজবুত অর্থনীতির ভিত গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের অবস্থা তেমন সমৃদ্ধ নয়। কৃষিভিত্তিক পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, চিনি শিল্প, চা শিল্প- এই কয়েকটা বাদ দিলে বাকিগুলোর তথ্য-উপাত্ত তেমন নেই। আজ শুরু তো কাল শেষ। শুরুটা যেমন সুপরিকল্পিত নয়, তেমনি কিভাবে শেষ হয় তারও কোন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় তেমন পরিকল্পনা বা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কৃষি উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের নামে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে কৃষিভিত্তিক শিল্পের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা খোঁজ নেয়া দরকার। অথচ কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে কৃষি শিল্প যে কোন শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেত। আমদানিনির্ভর কাঁচামাল দিয়ে গড়া শিল্প কারখানা সাধারণত লাভজনক হয় না।

কারণ এতে মূল্য সংযোজন হয় না। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি কাঁচামাল সহজলভ্য। কৃষিপণ্যকে যদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গণ্য করে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনা যাচাই করে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হয়, তাহলে বাংলাদেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে, বর্তমান থেকে আরও অনেক উন্নতিতে।

চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নানাবিধ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। কৃষিপণ্য ব্যবহার করে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে। বরিশাল ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিপুল পরিমাণ সুস্বাদু পেয়ারা উৎপাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও টাঙ্গাইলের মধুপুরের মিষ্টি ও সুস্বাদু আনারস দেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের উর্বর মাটিতে বিপুল পরিমাণ তরমুজ, বাংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার রসালো মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। মৌসুমের সময় কৃষকরা নামেমাত্র মূল্যে এসব ফল বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। অথচ কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠা করে এই সবাই পেয়ারা, আনারসসহ অন্যান্য মৌসুমি ফল ব্যবহার করে জেলি, জুস, স্কোয়াস ও অন্যান্য নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল সারা দেশে উৎপাদিত হলেও জয়দেবপুরে লাল মাটিতে কাঁঠালের উৎপাদন খুবই বেশি হয়। কাঁঠালের মৌসুমে প্রকৃত উৎপাদনকারীরা একেবারেই মূল্য পায় না; যা কিছু উপার্জন করে তা মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং খুচরা বিক্রেতারা। অথচ থাইল্যান্ডে কাঁঠালের কোষ এর ‘চিপস’ তৈরি করে সুন্দর মোড়কে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত স্থানীয় জাতের কলা অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। স্থানীয় বাজারের চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত কলার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে ওই কলা বিক্রি করার জন্য সাধারণত চট্টগ্রাম শহরের বাজারে সরবরাহ করা হয়। এই সুস্বাদু কলার ‘চিপস‘ তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়।

আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে কলা, কাঁঠালের চিপসসহ বিভিন্ন প্রকার ফলের তৈরি রকমারি খাবারের বাজার রয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের উৎপাদিত আম, আনারস, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রকার ফল ও কৃষিপণ্য দিয়ে তৈরি উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে। শুধু তাই নয় সম্প্রতি জাপানে বাংলাদেশে উৎপাদিত মিষ্টি আলুর চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশে কয়েক ধরনের মিষ্টি আলুর চাষ হয়। সাম্প্রতিক চাহিদার কারণে জাপানিদের পছন্দনীয় জাতের মিষ্টি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। জাপানে মিষ্টি আলু রপ্তানি করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মিষ্টি আলু বিদেশে রপ্তানিযোগ্য হওয়ায় মিষ্টি আলুর মূল্যও বেড়েছে। মিষ্টি আলু দিয়ে জাপানিদের পছন্দনীয় রকমারি খাবার তৈরি করেও রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ফলে মিষ্টি আলুর তৈরি খাবারে মূল্য সংযোজিত হবে। কৃষক অধিক মূল্য পাবে, মিষ্টি আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এমনিভাবে অন্যান্য ফল উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষায়িত কৃষিপণ্য রপ্তানি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে চাহিদা মোতাবেক চাষাবাদ, ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে রপ্তানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত দুধের ৮১ ভাগ মিষ্টির দোকানে ও চায়ের দোকানে ব্যবহার করা হয়। তৃণমূল খামারীরা মিষ্টির দোকানদার ও চা দোকানদার এর মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়। যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তবে দুধ বিক্রি হয় না। প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদিত দুধ ক্রয়কারী ছোট ছোট ব্যবসায়ীদেরও উৎসাহিত করার জন্য নগদ অর্থ প্রদান করছেন।

কিন্তু এরপর কী? এই ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ক্রয় করা দুধ সমন্বয় করে বৃহৎ দুগ্ধশিল্প স্থাপন করে চাহিদা অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দুধ পাস্তুরিত করে প্যাকেটজাত করা যেতে পারে এবং অধিকসংখ্যক গুঁড়াদুধ উৎপাদনের শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করা যায়। এই গুঁড়াদুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরির মুল উপাদান ‘দুধের ছানা’ তৈরি করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত দুধ উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সামাজিক অস্থিরতার কারণে বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বা যে কোন কারণে দুগ্ধ খামারিদের ব্যবসা, বিনিয়োগ, বিপণন মিষ্টির দোকানদারদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল হবে না। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দুধের ‘মূল্য সংযোজন’ হবে, দুধের অতিরিক্ত মূল্য পেয়ে খামারিরা গাভী পালনে আরও উৎসাহিত হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। নিজের দেশে উৎপাদিত মানসম্মত গুঁড়াদুধ দিয়ে চাহিদা মিটাতে পারলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

সাধারত কোন পণ্য যখন রাসায়নিক ক্রিয়া বা যে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় বা নতুন পণ্য হিসেবে তৈরি হয় যাতে নতুন বা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় সেটাই শিল্পজাত দ্রব্য। কৃষিপণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্য সংযোজন করে বাজারজাত করাই কৃষিভিত্তিক শিল্প। কৃষি শিল্প বলতে শস্যবীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে জৈব সার উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে রকমারি খাবার প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ, রপ্তানিকরণ, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য খাবার, মৎস্য খামার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গোখাদ্য-পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, পোল্ট্রি হ্যাচারি, ডিম-দুধ-মাছ-মাংস উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্পে সহজলভ্যে প্রাপ্ত কৃষি পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে উৎপাদিত পণ্যে মূল্য সংযোজন হয়, ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পেয়ে অধিক পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করার পর অতিরিক্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। ফলে দেশের অর্থনীতি মজবুত ও টেকসই হবে।

[লেখক : ব্যবস্থাপক, জনসংযোগ উপ-বিভাগ, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অর্থনীতিকে টেকসই করতে কৃষিভিত্তিক শিল্পে জোর দিতে হবে

জহুরা ইয়াসমিন

শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষ এ খাতের প্রসারে প্রচুর শ্রম ব্যয় করছেন। কৃষিকে গুরুত্বহীন করে শুধু শিল্প খাতের উন্নয়নে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ দেখাবে না। কৃষির যথাযথ বিকাশ সাধনের পাশাপাশি শিল্পের ও সেবা খাতের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হলে তা মজবুত অর্থনীতির ভিত গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের অবস্থা তেমন সমৃদ্ধ নয়। কৃষিভিত্তিক পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, চিনি শিল্প, চা শিল্প- এই কয়েকটা বাদ দিলে বাকিগুলোর তথ্য-উপাত্ত তেমন নেই। আজ শুরু তো কাল শেষ। শুরুটা যেমন সুপরিকল্পিত নয়, তেমনি কিভাবে শেষ হয় তারও কোন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় তেমন পরিকল্পনা বা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কৃষি উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের নামে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে কৃষিভিত্তিক শিল্পের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা খোঁজ নেয়া দরকার। অথচ কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে কৃষি শিল্প যে কোন শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেত। আমদানিনির্ভর কাঁচামাল দিয়ে গড়া শিল্প কারখানা সাধারণত লাভজনক হয় না।

কারণ এতে মূল্য সংযোজন হয় না। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি কাঁচামাল সহজলভ্য। কৃষিপণ্যকে যদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গণ্য করে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনা যাচাই করে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হয়, তাহলে বাংলাদেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে, বর্তমান থেকে আরও অনেক উন্নতিতে।

চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নানাবিধ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। কৃষিপণ্য ব্যবহার করে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে। বরিশাল ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিপুল পরিমাণ সুস্বাদু পেয়ারা উৎপাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও টাঙ্গাইলের মধুপুরের মিষ্টি ও সুস্বাদু আনারস দেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের উর্বর মাটিতে বিপুল পরিমাণ তরমুজ, বাংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার রসালো মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। মৌসুমের সময় কৃষকরা নামেমাত্র মূল্যে এসব ফল বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। অথচ কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠা করে এই সবাই পেয়ারা, আনারসসহ অন্যান্য মৌসুমি ফল ব্যবহার করে জেলি, জুস, স্কোয়াস ও অন্যান্য নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল সারা দেশে উৎপাদিত হলেও জয়দেবপুরে লাল মাটিতে কাঁঠালের উৎপাদন খুবই বেশি হয়। কাঁঠালের মৌসুমে প্রকৃত উৎপাদনকারীরা একেবারেই মূল্য পায় না; যা কিছু উপার্জন করে তা মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং খুচরা বিক্রেতারা। অথচ থাইল্যান্ডে কাঁঠালের কোষ এর ‘চিপস’ তৈরি করে সুন্দর মোড়কে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত স্থানীয় জাতের কলা অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। স্থানীয় বাজারের চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত কলার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে ওই কলা বিক্রি করার জন্য সাধারণত চট্টগ্রাম শহরের বাজারে সরবরাহ করা হয়। এই সুস্বাদু কলার ‘চিপস‘ তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়।

আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে কলা, কাঁঠালের চিপসসহ বিভিন্ন প্রকার ফলের তৈরি রকমারি খাবারের বাজার রয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের উৎপাদিত আম, আনারস, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রকার ফল ও কৃষিপণ্য দিয়ে তৈরি উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে। শুধু তাই নয় সম্প্রতি জাপানে বাংলাদেশে উৎপাদিত মিষ্টি আলুর চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশে কয়েক ধরনের মিষ্টি আলুর চাষ হয়। সাম্প্রতিক চাহিদার কারণে জাপানিদের পছন্দনীয় জাতের মিষ্টি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। জাপানে মিষ্টি আলু রপ্তানি করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মিষ্টি আলু বিদেশে রপ্তানিযোগ্য হওয়ায় মিষ্টি আলুর মূল্যও বেড়েছে। মিষ্টি আলু দিয়ে জাপানিদের পছন্দনীয় রকমারি খাবার তৈরি করেও রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ফলে মিষ্টি আলুর তৈরি খাবারে মূল্য সংযোজিত হবে। কৃষক অধিক মূল্য পাবে, মিষ্টি আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এমনিভাবে অন্যান্য ফল উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষায়িত কৃষিপণ্য রপ্তানি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে চাহিদা মোতাবেক চাষাবাদ, ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে রপ্তানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত দুধের ৮১ ভাগ মিষ্টির দোকানে ও চায়ের দোকানে ব্যবহার করা হয়। তৃণমূল খামারীরা মিষ্টির দোকানদার ও চা দোকানদার এর মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়। যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তবে দুধ বিক্রি হয় না। প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদিত দুধ ক্রয়কারী ছোট ছোট ব্যবসায়ীদেরও উৎসাহিত করার জন্য নগদ অর্থ প্রদান করছেন।

কিন্তু এরপর কী? এই ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ক্রয় করা দুধ সমন্বয় করে বৃহৎ দুগ্ধশিল্প স্থাপন করে চাহিদা অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দুধ পাস্তুরিত করে প্যাকেটজাত করা যেতে পারে এবং অধিকসংখ্যক গুঁড়াদুধ উৎপাদনের শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করা যায়। এই গুঁড়াদুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরির মুল উপাদান ‘দুধের ছানা’ তৈরি করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত দুধ উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সামাজিক অস্থিরতার কারণে বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বা যে কোন কারণে দুগ্ধ খামারিদের ব্যবসা, বিনিয়োগ, বিপণন মিষ্টির দোকানদারদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল হবে না। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দুধের ‘মূল্য সংযোজন’ হবে, দুধের অতিরিক্ত মূল্য পেয়ে খামারিরা গাভী পালনে আরও উৎসাহিত হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। নিজের দেশে উৎপাদিত মানসম্মত গুঁড়াদুধ দিয়ে চাহিদা মিটাতে পারলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

সাধারত কোন পণ্য যখন রাসায়নিক ক্রিয়া বা যে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় বা নতুন পণ্য হিসেবে তৈরি হয় যাতে নতুন বা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় সেটাই শিল্পজাত দ্রব্য। কৃষিপণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্য সংযোজন করে বাজারজাত করাই কৃষিভিত্তিক শিল্প। কৃষি শিল্প বলতে শস্যবীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে জৈব সার উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে রকমারি খাবার প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ, রপ্তানিকরণ, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য খাবার, মৎস্য খামার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গোখাদ্য-পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, পোল্ট্রি হ্যাচারি, ডিম-দুধ-মাছ-মাংস উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্পে সহজলভ্যে প্রাপ্ত কৃষি পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে উৎপাদিত পণ্যে মূল্য সংযোজন হয়, ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পেয়ে অধিক পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করার পর অতিরিক্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। ফলে দেশের অর্থনীতি মজবুত ও টেকসই হবে।

[লেখক : ব্যবস্থাপক, জনসংযোগ উপ-বিভাগ, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন]

back to top