সাজেদুল ইসলাম
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত একটি দিবস যা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়কে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া, এবং প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা, অধিকার ও তাদের কল্যাণের ইস্যুটির প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তকরণের কারণে কতখানি সুবিধা অর্জিত হয়, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোও এই দিবসের লক্ষ্য।
এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন।’
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। প্রতিবন্ধী হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, তবে বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগ প্রতিবন্ধী হওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ। সময়মতো চিকিৎসায় যদিও কুষ্ঠরোগ আরোগ্য হয়, এই রোগের কারণে আমাদের দেশে অনেক ব্যক্তি প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করা ও উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এই রোগে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছে। অর্থাৎ কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধযোগ্য।
স্বাস্থ্যসেবার অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, কিন্তু কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে এখনো যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। এটা শুধু শারীরিক রোগ নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি এবং বৈষম্যের কারণ।
কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের কারণে পঙ্গু হলে হাত ও পায়ের কার্যক্রম অচল হয়ে যায়, যন্ত্রণাপূর্ণ ঘাঁ ও ইনফেকশন দেখা দেয়, এমনকি অন্ধত্বও দেখা দেয়। কুষ্ঠ সাধারণত আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়।
কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকান হন এবং বয়কটের কারণে সমাজচ্যুত হয়ে পড়েন, এর ফলে জীবিকা ও চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয়ে তাদের জীবন হুমকির মুখে পতিত হয়। সম্প্রদায়, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, ক্ষতিকর অপবাদ এবং কুসংস্কারের কারণে সুসম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হয়।
জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রচুরসংখ্যক কুষ্ঠরোগী শনাক্তকরণের বাইরে রয়ে গেছে। প্রতি বছর ৩০০০-৩৫০০ জন শনাক্ত হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে কুষ্ঠরোগের উচ্চহার সম্পন্ন ২৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ এবং কুষ্ঠজনিত বিকলাঙ্গাতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম।
দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) এর তথ্যমতে, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে প্রায় ৬% থেকে ৮% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে পঙ্গু হয়ে যায়। তাছাড়া, আরো ৫% রোগী প্রথমদিকে হাতের অনুভূতি শক্তি হারানোর মতো সমস্যার মুখোমুখি হন, তারা পরবর্তীতে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
যখন কোনো নতুন কুষ্ঠরোগী ওষধ গ্রহণ শুরু করেন, তখন এর জন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে, এটা যথাযথভাবে না সামলাতে পারলে রোগী প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে, কারণ এর জন্য কুসংস্কারের জন্ম হয়, পক্ষান্তরে অন্যান্য কারণে প্রতিবন্ধিতার জন্য সেটা হয় না।
কুষ্ঠের কারণে যারা প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, প্রাথমিক অবস্থায় তাদের জন্য রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা করা গেলে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসমূহে রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা করা দরকার।
আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য ’প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ রয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এখানে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কোনো বিষয় এর উল্ল্খে নেই। যে কারণে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি সাহায্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, এই আইনটি যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করা যাতে করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সরকারি সব ধরনের সেবা পায়।
কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার জন্য মূলত দুটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো কুসংস্কার ও অন্যান্য অবিচারমূলক আচরণ এর ফলে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন পরিচালনা করা সার্বিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, দ্বিতীয়টি হলো আক্রান্তরা সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা তখন আর্থিকভাবে আর কোনো অবদান রাখতে পারেন না। অন্য কোনো উপায় না থাকায় তখন তারা জীবিকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়ে।
আমাদের জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। কেননা কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কারণে মানবিক, স্বাস্থ্যগত, সামজিক ও আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এই রোগটি চিকিৎসাযোগ্য, এর চিকিৎসা ও পরীক্ষা সারাদেশে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সময়মতো চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য গণমাধ্যমের সহযোগিতায় এই বিষয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনাতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।
স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সম্প্রদায়গত পুনর্বাসন ব্যবস্থা, অ্যাডভোকেসি, সক্ষমতা তৈরি করা, শিক্ষা, এবং ও কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের মনোযোগ প্রদান করা দরকার। প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা যাতে সহজে জীবিকা অর্জন করার সুবিধা পায় সেজন্য তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। তারা যাতে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
কুষ্ঠজনিত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও কুসংস্কারের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ, ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সেল্ফ-অ্যাডভোকেসিসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
আমাদের দেশের চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে যাতে তারা রোগীদের ভালোমানের চিকিৎসাসেবা দিতে পারে। দেশের জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসমূহ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে জটিল কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা যেমন রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা থাকা দরকার।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন কে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যাতে করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাবতীয় সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হয়।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপদানের জন্য এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই দিবস উপলক্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আসুন আমরা সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতার অন্যতম কারণ কুষ্ঠকে পরাজিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
সাজেদুল ইসলাম
শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত একটি দিবস যা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়কে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া, এবং প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা, অধিকার ও তাদের কল্যাণের ইস্যুটির প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তকরণের কারণে কতখানি সুবিধা অর্জিত হয়, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোও এই দিবসের লক্ষ্য।
এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন।’
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। প্রতিবন্ধী হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, তবে বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগ প্রতিবন্ধী হওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ। সময়মতো চিকিৎসায় যদিও কুষ্ঠরোগ আরোগ্য হয়, এই রোগের কারণে আমাদের দেশে অনেক ব্যক্তি প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করা ও উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এই রোগে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছে। অর্থাৎ কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধযোগ্য।
স্বাস্থ্যসেবার অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, কিন্তু কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে এখনো যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। এটা শুধু শারীরিক রোগ নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি এবং বৈষম্যের কারণ।
কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের কারণে পঙ্গু হলে হাত ও পায়ের কার্যক্রম অচল হয়ে যায়, যন্ত্রণাপূর্ণ ঘাঁ ও ইনফেকশন দেখা দেয়, এমনকি অন্ধত্বও দেখা দেয়। কুষ্ঠ সাধারণত আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়।
কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকান হন এবং বয়কটের কারণে সমাজচ্যুত হয়ে পড়েন, এর ফলে জীবিকা ও চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয়ে তাদের জীবন হুমকির মুখে পতিত হয়। সম্প্রদায়, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, ক্ষতিকর অপবাদ এবং কুসংস্কারের কারণে সুসম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হয়।
জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রচুরসংখ্যক কুষ্ঠরোগী শনাক্তকরণের বাইরে রয়ে গেছে। প্রতি বছর ৩০০০-৩৫০০ জন শনাক্ত হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে কুষ্ঠরোগের উচ্চহার সম্পন্ন ২৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ এবং কুষ্ঠজনিত বিকলাঙ্গাতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম।
দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) এর তথ্যমতে, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে প্রায় ৬% থেকে ৮% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে পঙ্গু হয়ে যায়। তাছাড়া, আরো ৫% রোগী প্রথমদিকে হাতের অনুভূতি শক্তি হারানোর মতো সমস্যার মুখোমুখি হন, তারা পরবর্তীতে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
যখন কোনো নতুন কুষ্ঠরোগী ওষধ গ্রহণ শুরু করেন, তখন এর জন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে, এটা যথাযথভাবে না সামলাতে পারলে রোগী প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে, কারণ এর জন্য কুসংস্কারের জন্ম হয়, পক্ষান্তরে অন্যান্য কারণে প্রতিবন্ধিতার জন্য সেটা হয় না।
কুষ্ঠের কারণে যারা প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, প্রাথমিক অবস্থায় তাদের জন্য রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা করা গেলে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসমূহে রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা করা দরকার।
আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য ’প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ রয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এখানে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কোনো বিষয় এর উল্ল্খে নেই। যে কারণে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি সাহায্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, এই আইনটি যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করা যাতে করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সরকারি সব ধরনের সেবা পায়।
কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার জন্য মূলত দুটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো কুসংস্কার ও অন্যান্য অবিচারমূলক আচরণ এর ফলে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন পরিচালনা করা সার্বিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, দ্বিতীয়টি হলো আক্রান্তরা সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা তখন আর্থিকভাবে আর কোনো অবদান রাখতে পারেন না। অন্য কোনো উপায় না থাকায় তখন তারা জীবিকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়ে।
আমাদের জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। কেননা কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার কারণে মানবিক, স্বাস্থ্যগত, সামজিক ও আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এই রোগটি চিকিৎসাযোগ্য, এর চিকিৎসা ও পরীক্ষা সারাদেশে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সময়মতো চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য গণমাধ্যমের সহযোগিতায় এই বিষয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনাতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।
স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সম্প্রদায়গত পুনর্বাসন ব্যবস্থা, অ্যাডভোকেসি, সক্ষমতা তৈরি করা, শিক্ষা, এবং ও কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের মনোযোগ প্রদান করা দরকার। প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা যাতে সহজে জীবিকা অর্জন করার সুবিধা পায় সেজন্য তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। তারা যাতে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
কুষ্ঠজনিত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও কুসংস্কারের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ, ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সেল্ফ-অ্যাডভোকেসিসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
আমাদের দেশের চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে যাতে তারা রোগীদের ভালোমানের চিকিৎসাসেবা দিতে পারে। দেশের জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসমূহ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে জটিল কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা যেমন রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির ব্যবস্থা থাকা দরকার।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন কে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যাতে করে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাবতীয় সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হয়।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপদানের জন্য এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই দিবস উপলক্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আসুন আমরা সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতার অন্যতম কারণ কুষ্ঠকে পরাজিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]