alt

উপ-সম্পাদকীয়

হতশ্রী কারিগরি শিক্ষা

খন রঞ্জন রায়

: রোববার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত ২৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন তৈরির নীতিমালা অনুযায়ী সারাদেশের মাঠেঘাটে, অনলাইনে অবলাইনে নানা মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছে। ভাবনার গভীরতাবাহী মৌলিক তথ্যের দলিলপত্র সত্যাশ্রয়ীভাবে উপস্থাপনের জন্য আমি বিবিএসকে ধন্যবাদ জানাই।

নানারকম বাধাবিপত্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করে তৈরি করা প্রতিবেদনের ‘ক’ অংশ জাতিকে বেদনার গভীরে নিপতিত করেছে। অধ্যায়টি ‘শিক্ষা’। বিশেষ করে কর্মমুখী-কারিগরি-প্রযুক্তি ও ডিপ্লোমা শিক্ষা। হতাশা-ক্ষোভ-খেদোক্তি এখানেই। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ভগ্নাংশের হিসাবে। পূর্ণাঙ্গ সংখ্যায়ও নয়। মাত্র ০.৮১ শতাংশ। এই শিক্ষা নিয়ে যে অন্ধকারের ছায়া খেলা করে এ প্রতিবেদন তার জলন্ত-জলজ্যান্ত-দিগন্ত বিস্তৃত উদাহরণ।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ঠাট্টা-মশকরা করার মতো গলদ তা বিস্তৃত পরিসরে অস্তিত্বের মাপকাঠি নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। গত দশ বছরের তুলনামূলক চিত্রে সার্টিফিকেট অর্জননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় দেশচেতনাকে আত্মসাৎ করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বিবেচনায় যে ধরনের শিক্ষা দরকার তার ধারে-কাছে নেই। প্রযুক্তি দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না, দক্ষতার জন্য বিদেশ নির্ভর হতে হয়।

বড় অদ্ভুত বিদঘুটে নির্লিপ্ততায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। গত দশ বছরে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাহীন-কর্মের লক্ষ্যহীন মাস্টার্স শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। মানের নয়, সংখ্যার বিবেচনায়। কর্মপ্রাপ্তির বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা নিয়ে তুলনামূলকভাবে স্নাতক ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও গুণিতক হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিসর্জন নাটকে যেমন বলেছেন- ‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’ ঠিক তেমনি শিক্ষার নামে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাড়ানো হচ্ছে। অথচ উচ্চশিক্ষিতের চাহিদায় লোকানো বেদনা কাজ করছে। একুশ শতকের জটিলতম বিশ্ব পরিস্থিতিতে অনেক দেশের সমাজব্যবস্থায় যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি অস্তিত্বের দোলাচলে দুলছে, সেখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে স্বকীয়তার সাথে পথ চলতে পারার একমাত্র উপায় দক্ষ জনবলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

বর্তমান যুগপরিক্রমায় বিশ্বব্যাপী পরিত্যাক্ত বিএ, এমএ, স্নাতক, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীতে গদগদ হওয়ার শিক্ষাকে সব মহলের বিশেষ ঝোঁক দেশের কর্মকাঠামোতে উঁচু দেয়াল সৃষ্টি করছে। এই ভূখন্ডের শিক্ষার ইতিহাসে দেখা যায় প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন কোন না কোন দৃপ্তিময়ী ব্যক্তি। এই ধারাবাহিকতা এখনো প্রবাহমান-চলমান। ক্ষেত্রেবিশেষ ধাবমান। দীর্ঘপোষিত সেই অভ্যাস-চর্চায় এখনো স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠাতেই মনোযোগ অধিক। বরং অত্যাধিক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যারয় প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি পরিবর্তনের কোনো দরদি ভাবনা নেই। কখনো কখনো বেশ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তদারকির পাশাপাশি নতুনভাবে কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ যতিচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। পাড়ায়-মহল্লা গ্রামে-গ্রামে যত্রতত্র নাম ফুটানো কলেজ প্রতিষ্ঠা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের চিন্তাতে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। যেখানে ঘরের পাশে দেয়ালের ওপারে কলেজ শিক্ষার সুযোগ অবারিত। টানাটানিরত। সেখানে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কারিগরির কাঁধে কেন কাঁধ মেলাবে?

দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বিবেচনায় যে ধরনের শিক্ষা দরকার তার ধারে-কাছে নেই। প্রযুক্তি দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না, দক্ষতার জন্য বিদেশ নির্ভর হতে হয়

পুরনো কাসুন্দি টেনে আনার ইচ্ছা না থাকলেও প্রসঙ্গক্রমে লিখতেই হচ্ছে প্রাণহীন-মূল্যহীন-কর্মহীন কলেজ শিক্ষাবর্ষের এই সেশনেই লক্ষাধিক আসন খালি রয়েছে। কী দুর্বার গতিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার উত্তরাধিকারী দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। কলেজ শিক্ষার প্রতি এত বেশি আসক্তি মোট শিক্ষাব্যবস্থাকে মমতাহীন মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে অনুমোদিত কলেজে আসন খালি সেখানে কারিগরি, বৃত্তিমূলক, ডিপ্লোমা শিক্ষাতে শিক্ষার্থী ভর্তির আশা আত্মমর্যাদা ও স্বতন্ত্রবোধকে কুঠারাঘাত করা! হচ্ছেও তাই।

বিবিএস রিপোর্টে তা আলোকপাত নয়, নিরেট সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপাত যুক্তিসিদ্ধ কলেজ শিক্ষায় নলেজ! অর্জনে যেখানে লক্ষাধিক আসন খালি সেখানে কর্মমুখী ডিপ্লোমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-

‘তোমারে হারিয়ে খুঁজি শ্যামল প্রান্তর জুড়ে / বন বনান্তরে অবারিত সবুজ সমারোহে / কোথাও নেই তুমি ত্রিভুবন জুড়ে।’

এখানে কোনো মায়ামমতার ধার ধারে নয়। বাস্তবতায়। তুখোড় বাস্তবতায়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার। ৩৪টি ডিগ্রির অধীনে ৩৪৬টি টেকনোলজি/ট্রেড/স্পেশালাইজেশন বিভাগে উপরোক্ত পদসংখ্যার বিপরীতে ভর্তি হয়েছে ৯৮ হাজার। আসন ফাঁকা প্রায় ৫৭ হাজার। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাইরেও মেডিকেল টেকনোলজি, কৃষি টেকনোলজি, বন, টেক্সটাইল ইত্যাদি ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীর বিপুলসংখ্যক আসন খালি থাকছে।

কারিগরি শিক্ষা প্রসারে সরকার প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করছে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া হচ্ছে। শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য মাত্র ২.৫ জিপিএ নির্ধারণ করেছে। উপনিবেশিক আমল থেকে চলমান নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির বেলায় বয়সের যে সীমাবদ্ধতা ছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষায় যেকোনো বয়সের বাবা-ছেলে, নানা-নাতি, মামা-ভাগিনা, খালা-খালু এক সাথে, একত্রে, এক বেঞ্চে বসে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যের আমুল এই পরিবর্তন হিতে বিপরীত হয়েছে।

লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। নানা জটিল সমীকরণ থাকলেও মূলত যত্রতত্রের কলেজ; কারিগরিকে নিরাশ করছে। কলেজ শিক্ষার ঐতিহাসিক আবেগ আর অহংকার জনগুরুত্বের কারিগরিকে ভয়ংকর নৃশংতায় ফেলে দিচ্ছে। খেসারত গুনতে হচ্ছে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারাবাহিকতাতে। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের যুগোপযোগী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সাফল্যের দিকে তাকিয়ে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে এই শিক্ষার স্রোতধারায় আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

জলন্ত বাস্তবতা হচ্ছে ইতোমধ্যে জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ তরুণ-যুবকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সফলভাবে রূপায়িত করেছে এবং আশ্চার্য দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে।

শিউরে ওঠার মতো অবস্থানে বাংলাদেশ। ০.৮১ শতাংশ। আলোচনায় আসার মতোও কোনো পরিস্থিতিতে নেই। বেশ ভালো রকম ঘা খাওয়া আরেকটি তথ্য দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। দেশের মোট শিক্ষিতের মধ্যে সাধারণ শিক্ষা থেকে পড়াশোনা করছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ঈষৎ আক্ষেপ নয়; শিক্ষার প্রতি বীভৎসতার হিংস্র খেলা চলছে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের ৮৮০ কলেজের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে ঢালাওভাবে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কঠিন যন্ত্রণায় ফেলে দিচ্ছে। অবারিত দ্বার। ঘরে ঘরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। প্রয়োজন আছে কি?

কারিগরি-বৃত্তিমূলক ও ডিপ্লোমা শিক্ষাকে সর্বনাশা অবস্থান থেকে বাস্তবিক অর্থেই বের করতে হলে কলেজ শিক্ষা সীমিত করতে হবে। হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ চলমান রেখে বাকিসবে ডিপ্লোমা শিক্ষা কোর্স চালু করার সাহসী নির্দেশনা দিতে হবে। তখন আর নড়াচড়ার উপায় থাকবে না। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পূর্ণিমার সন্ধ্যার মতো মোহময় আবেশ ছড়াতে থাকবে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণের অসম্পূর্ণ জায়গাগুলোতে কিছুটা হলেও পূর্ণতা দিতে পারবে। সেই মায়াবী ছায়ায় সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

[লেখক : সমাজকর্মী]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

হতশ্রী কারিগরি শিক্ষা

খন রঞ্জন রায়

রোববার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত ২৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন তৈরির নীতিমালা অনুযায়ী সারাদেশের মাঠেঘাটে, অনলাইনে অবলাইনে নানা মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছে। ভাবনার গভীরতাবাহী মৌলিক তথ্যের দলিলপত্র সত্যাশ্রয়ীভাবে উপস্থাপনের জন্য আমি বিবিএসকে ধন্যবাদ জানাই।

নানারকম বাধাবিপত্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করে তৈরি করা প্রতিবেদনের ‘ক’ অংশ জাতিকে বেদনার গভীরে নিপতিত করেছে। অধ্যায়টি ‘শিক্ষা’। বিশেষ করে কর্মমুখী-কারিগরি-প্রযুক্তি ও ডিপ্লোমা শিক্ষা। হতাশা-ক্ষোভ-খেদোক্তি এখানেই। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ভগ্নাংশের হিসাবে। পূর্ণাঙ্গ সংখ্যায়ও নয়। মাত্র ০.৮১ শতাংশ। এই শিক্ষা নিয়ে যে অন্ধকারের ছায়া খেলা করে এ প্রতিবেদন তার জলন্ত-জলজ্যান্ত-দিগন্ত বিস্তৃত উদাহরণ।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ঠাট্টা-মশকরা করার মতো গলদ তা বিস্তৃত পরিসরে অস্তিত্বের মাপকাঠি নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। গত দশ বছরের তুলনামূলক চিত্রে সার্টিফিকেট অর্জননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় দেশচেতনাকে আত্মসাৎ করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বিবেচনায় যে ধরনের শিক্ষা দরকার তার ধারে-কাছে নেই। প্রযুক্তি দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না, দক্ষতার জন্য বিদেশ নির্ভর হতে হয়।

বড় অদ্ভুত বিদঘুটে নির্লিপ্ততায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। গত দশ বছরে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাহীন-কর্মের লক্ষ্যহীন মাস্টার্স শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। মানের নয়, সংখ্যার বিবেচনায়। কর্মপ্রাপ্তির বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা নিয়ে তুলনামূলকভাবে স্নাতক ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও গুণিতক হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিসর্জন নাটকে যেমন বলেছেন- ‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’ ঠিক তেমনি শিক্ষার নামে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাড়ানো হচ্ছে। অথচ উচ্চশিক্ষিতের চাহিদায় লোকানো বেদনা কাজ করছে। একুশ শতকের জটিলতম বিশ্ব পরিস্থিতিতে অনেক দেশের সমাজব্যবস্থায় যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি অস্তিত্বের দোলাচলে দুলছে, সেখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে স্বকীয়তার সাথে পথ চলতে পারার একমাত্র উপায় দক্ষ জনবলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

বর্তমান যুগপরিক্রমায় বিশ্বব্যাপী পরিত্যাক্ত বিএ, এমএ, স্নাতক, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীতে গদগদ হওয়ার শিক্ষাকে সব মহলের বিশেষ ঝোঁক দেশের কর্মকাঠামোতে উঁচু দেয়াল সৃষ্টি করছে। এই ভূখন্ডের শিক্ষার ইতিহাসে দেখা যায় প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন কোন না কোন দৃপ্তিময়ী ব্যক্তি। এই ধারাবাহিকতা এখনো প্রবাহমান-চলমান। ক্ষেত্রেবিশেষ ধাবমান। দীর্ঘপোষিত সেই অভ্যাস-চর্চায় এখনো স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠাতেই মনোযোগ অধিক। বরং অত্যাধিক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যারয় প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি পরিবর্তনের কোনো দরদি ভাবনা নেই। কখনো কখনো বেশ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তদারকির পাশাপাশি নতুনভাবে কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ যতিচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। পাড়ায়-মহল্লা গ্রামে-গ্রামে যত্রতত্র নাম ফুটানো কলেজ প্রতিষ্ঠা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের চিন্তাতে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। যেখানে ঘরের পাশে দেয়ালের ওপারে কলেজ শিক্ষার সুযোগ অবারিত। টানাটানিরত। সেখানে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কারিগরির কাঁধে কেন কাঁধ মেলাবে?

দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বিবেচনায় যে ধরনের শিক্ষা দরকার তার ধারে-কাছে নেই। প্রযুক্তি দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না, দক্ষতার জন্য বিদেশ নির্ভর হতে হয়

পুরনো কাসুন্দি টেনে আনার ইচ্ছা না থাকলেও প্রসঙ্গক্রমে লিখতেই হচ্ছে প্রাণহীন-মূল্যহীন-কর্মহীন কলেজ শিক্ষাবর্ষের এই সেশনেই লক্ষাধিক আসন খালি রয়েছে। কী দুর্বার গতিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার উত্তরাধিকারী দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। কলেজ শিক্ষার প্রতি এত বেশি আসক্তি মোট শিক্ষাব্যবস্থাকে মমতাহীন মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে অনুমোদিত কলেজে আসন খালি সেখানে কারিগরি, বৃত্তিমূলক, ডিপ্লোমা শিক্ষাতে শিক্ষার্থী ভর্তির আশা আত্মমর্যাদা ও স্বতন্ত্রবোধকে কুঠারাঘাত করা! হচ্ছেও তাই।

বিবিএস রিপোর্টে তা আলোকপাত নয়, নিরেট সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপাত যুক্তিসিদ্ধ কলেজ শিক্ষায় নলেজ! অর্জনে যেখানে লক্ষাধিক আসন খালি সেখানে কর্মমুখী ডিপ্লোমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-

‘তোমারে হারিয়ে খুঁজি শ্যামল প্রান্তর জুড়ে / বন বনান্তরে অবারিত সবুজ সমারোহে / কোথাও নেই তুমি ত্রিভুবন জুড়ে।’

এখানে কোনো মায়ামমতার ধার ধারে নয়। বাস্তবতায়। তুখোড় বাস্তবতায়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার। ৩৪টি ডিগ্রির অধীনে ৩৪৬টি টেকনোলজি/ট্রেড/স্পেশালাইজেশন বিভাগে উপরোক্ত পদসংখ্যার বিপরীতে ভর্তি হয়েছে ৯৮ হাজার। আসন ফাঁকা প্রায় ৫৭ হাজার। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাইরেও মেডিকেল টেকনোলজি, কৃষি টেকনোলজি, বন, টেক্সটাইল ইত্যাদি ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীর বিপুলসংখ্যক আসন খালি থাকছে।

কারিগরি শিক্ষা প্রসারে সরকার প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করছে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া হচ্ছে। শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য মাত্র ২.৫ জিপিএ নির্ধারণ করেছে। উপনিবেশিক আমল থেকে চলমান নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির বেলায় বয়সের যে সীমাবদ্ধতা ছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষায় যেকোনো বয়সের বাবা-ছেলে, নানা-নাতি, মামা-ভাগিনা, খালা-খালু এক সাথে, একত্রে, এক বেঞ্চে বসে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যের আমুল এই পরিবর্তন হিতে বিপরীত হয়েছে।

লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। নানা জটিল সমীকরণ থাকলেও মূলত যত্রতত্রের কলেজ; কারিগরিকে নিরাশ করছে। কলেজ শিক্ষার ঐতিহাসিক আবেগ আর অহংকার জনগুরুত্বের কারিগরিকে ভয়ংকর নৃশংতায় ফেলে দিচ্ছে। খেসারত গুনতে হচ্ছে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারাবাহিকতাতে। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের যুগোপযোগী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সাফল্যের দিকে তাকিয়ে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে এই শিক্ষার স্রোতধারায় আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

জলন্ত বাস্তবতা হচ্ছে ইতোমধ্যে জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ তরুণ-যুবকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সফলভাবে রূপায়িত করেছে এবং আশ্চার্য দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে।

শিউরে ওঠার মতো অবস্থানে বাংলাদেশ। ০.৮১ শতাংশ। আলোচনায় আসার মতোও কোনো পরিস্থিতিতে নেই। বেশ ভালো রকম ঘা খাওয়া আরেকটি তথ্য দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। দেশের মোট শিক্ষিতের মধ্যে সাধারণ শিক্ষা থেকে পড়াশোনা করছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ঈষৎ আক্ষেপ নয়; শিক্ষার প্রতি বীভৎসতার হিংস্র খেলা চলছে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের ৮৮০ কলেজের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে ঢালাওভাবে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কঠিন যন্ত্রণায় ফেলে দিচ্ছে। অবারিত দ্বার। ঘরে ঘরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। প্রয়োজন আছে কি?

কারিগরি-বৃত্তিমূলক ও ডিপ্লোমা শিক্ষাকে সর্বনাশা অবস্থান থেকে বাস্তবিক অর্থেই বের করতে হলে কলেজ শিক্ষা সীমিত করতে হবে। হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ চলমান রেখে বাকিসবে ডিপ্লোমা শিক্ষা কোর্স চালু করার সাহসী নির্দেশনা দিতে হবে। তখন আর নড়াচড়ার উপায় থাকবে না। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পূর্ণিমার সন্ধ্যার মতো মোহময় আবেশ ছড়াতে থাকবে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণের অসম্পূর্ণ জায়গাগুলোতে কিছুটা হলেও পূর্ণতা দিতে পারবে। সেই মায়াবী ছায়ায় সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

[লেখক : সমাজকর্মী]

back to top