alt

উপ-সম্পাদকীয়

মৈমনসিংহ গীতিকার শতবর্ষ

মোস্তাফা জব্বার

: মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

দুই॥

মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা তুলে ধরতে পারি।

মহুয়া : গারো পাহাড়ের কাছে হিমানী পর্বতের উত্তরে এক গভীর বনে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা বাইদ্যা। ১৬ বছর আগে কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মনের ছ’মাস বয়সী মেয়েকে যে চুরি করে লালন পালন করে, খেলা- কসরত শেখায়। মেয়েটির নাম রাখে মহুয়া স্ন্দুরী। একবার বামনকান্দা গ্রামের ব্রাহ্মণ নদ্যার চান ঠাকুরের বাড়িতে খেলা দেখাতে আসে তারা। মহুয়ার কসরত দেখে নদ্যার চানসহ উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। নদ্যার চাঁদ তাদের প্রচুর বকশিশ দেন। এবং হুমরা বাইদ্যার অনুরোধে তাদের ‘উলুইয়াকান্দা’ নামক স্থানে বাড়ি করে বসবাস করার অনুমতি দেন। এক সন্ধ্যাবেলায় জলের ঘাটে নদ্যার চাঁদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের দুজনের মন দেয়া-নেয়া হয়। হুমরা বাইদ্যা বিষয়টি টের পেয়ে দলবল নিয়ে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। মহুয়াকে দেখতে না পেয়ে এদিকে নদ্যার চাঁদ পাগল হয়ে ওঠে। তীর্থের নামে মহুয়ার খোঁজে সে বেরিয়ে পড়ে। অবশেষে কংস নদীর পাড়ে মহুয়ার দেখা পায় সে। হুমরা বাইদ্যা বিষলক্ষের ছুরি মহুয়ার হাতে দিয়ে নদ্যার চাঁদকে হত্যা করতে বলে। কিন্তু কৌশলে নদ্যার চান আর মহুয়া পালিয়ে যায়। পথে পাহাড়িয়া নদী পার হওয়ার জন্য দুজনে সওদাগরের নৌকায় ওঠে। মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে তারা নদ্যার চানকে পানিতে ফেলে দেয়। বিপদ টের পেয়ে মহুয়া সবাইকে তক্ষকের বিষ মেশানো পান খাইয়ে অজ্ঞান করে ডিঙ্গা থেকে নেমে যান এবং জঙ্গলে এক ভাঙা মন্দিরের কাছে মৃতপ্রায় নদ্যার চানের দেখা পান। সেখানে এক সন্ন্যাসীর সহায়তায় নদ্যার চান ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ততক্ষণে সন্ন্যাসী মহুয়ার রূপে আকৃষ্ট হয়ে যায়। মহুয়া দুর্বল নদ্যার চানকে কাঁধে নিয়ে অন্যত্র চলে যান। কিছুদিন পার হলে নদ্যার চান সুস্থ হয়ে ওঠে। হুমরা বাইদ্যার দল খোঁজ পেয়ে মহুয়াদের আস্তানায় চলে আসে এবং মহুয়ার হাতে বিষলক্ষের ছুরি দিয়ে নদ্যার চানকে হত্যা করার জন্য ফের নির্দেশ দেন। কোন উপায় না দেখে মহুয়া নিজের বুকেই ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে বেদের দল নদ্যার চানকে হত্যা করে। দুজনের মিলন হয় পরপারে। জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকে এ পালার বন্ধনায় আপ্লুত হয়েছে।

লোকজ জীবনের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত মহুয়া পালার বন্দনা অংশজুড়ে। উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাশ পর্বত/ যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথথর/ পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান/ উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান/ সভা কইর‌্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান/ সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক সুনিপুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। মহুয়া নদের চাঁদের প্রেমাসক্ত জীবনের গভীর আকুতি যেন নিঃস্বার্থ প্রেমের উজ্জল দৃষ্টান্ত। যাত্রাপালায় ঢঙে রচিত ট্রাজিক এ পালাটিকে মনে করা হয় শ্রেষ্ঠ পালা। মহুয়ার মতো মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাজল রেখা, প্রত্যেকে স্বমহিয়ায় সাহিত্যের চিরন্তন মর্যাদা লাভ করেছে। এখনও ময়মনসিংহের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর পালা রামায়ণের অমর প্রেমের স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান। পাড়াগাঁয়ের নর-নারীর প্রেমের মাধুর্য মিশ্রিত এসব ঘটনাবলির গান সবশ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করে। নিম্নবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ আর নারী হৃদয়ের বিচিত্র বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনীগুলোই গীতিকার অন্যতম বিষয়বস্তু।

মলুয়া : মলুয়া পালার প্রধান চরিত্র ‘মলুয়া’। রচয়িতা অজ্ঞাত হলেও ধারণা করা হয় চন্দ্রাবতী নিজেই মলুয়া পালা রচনা করেছেন, নিজেই এ পালার চরিত্র। গরিব চাঁদ বিনোদের সঙ্গে গ্রামের মোড়লের সুন্দরী মেয়ে মলুয়ার বিবাহিত সম্পর্কের উত্থান-পতন, ক্ষমতাবান কাজীর দাপটের কাছে নত না হওয়া এক বাঙালি নারীর মর্যাদার লড়াইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মলুয়া পালার কাহিনী। গ্রামের মোড়লের সুন্দরী মেয়ে মলুয়া আর গরিবের ছেলে বিনোদ। দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ভালবাসার কথা জানিয়ে মলুয়ার বাড়িতে বিয়ের সম্মতি চাইলে মলুয়ার বাবা গরিব বিনোদের সঙ্গে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বড়লোকের মেয়ে পাঁচ ভাইয়ের আদরের বোন মলুয়াকে বিয়ে করার জন্য গরিব বিনোদ কুড়া পাখি শিকার করে অনেক অর্থ উপার্জন করে এবং ফিরে এসে মলুয়াকে বিয়ে করে। এদিকে গ্রামের দেয়ান মলুয়ার রূপে আকৃষ্ট হয়ে মলুয়াকে বিয়ে করতে চায়। মলুয়া রাজি না হলে দেয়ান ও কাজির চক্রান্তে বিনোদ সম্পত্তি হারায়। এমনকি মলুয়ার গায়ের গয়না বেচে তাদের সংসার চালাতে হয়। অর্থ সংকটে পড়ে উপার্জনের আশায় বিনোদ বাইরে চলে গেলে দুষ্ট কাজি মলুয়াকে তুলে নিয়ে দেয়ানকে দেয়। দেয়ান মলুয়াকে বিয়ে করতে চাইলে কৌশলে মলুয়া নিজেকে বাঁচিয়ে ফেরে। কিন্তু বিনোদ মলুয়াকে আর ঘরে নিতে চায় না। সে আবার বিয়ে করে। বাপের বাড়ি না গিয়ে মলুুয়া বিনোদের ঘরে দাসীর মতো পড়ে থাকে। বিনোদকে সাপে কামড়ালে মলুয়া ওঝার কাছে নিয়ে তাকে সারিয়ে তোলে। বিনোদ মলুয়াকে এরপর ঘরে নিতে সস্মত হয়। কিন্তু বিনোদের স্বজনরা বিরোধিতা করে। মলুয়া অভিমান করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

নারী হৃদয়ের শক্তি, উদারতা, মানবিক মূল্যবোধের সচিত্র ফুটে উঠেছে প্রায় প্রত্যেকটি পালায়। তেমনি আরেকটি বিয়োগাত্মক পালা চন্দ্রাবতী।

চন্দ্রাবতী : সপ্তদশ শতকের লোককবি চন্দ্রাবতী। লোকগীতিকা, পালাকাব্য গান, রামায়ণ কাহিনী চন্দ্রাবতীর ভালোবাসার সুখ-দুঃখের অমর রচনাশৈলী।

‘চাইরকোণা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর/ ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর’ ‘আমার বাড়ি তোমার বাড়ি ঐ না নদীর পার/ কি কারণে তুল কণ্যা মালতীর হার।’ ‘প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে/ বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।’

এখনও ময়মনসিংহের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর পালা, রামায়ণের অমর প্রেমের স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান। পাড়াগাঁয়ের নর-নারীর প্রেমের মাধুর্য মিশ্রিত এসব ঘটনাবলির গান সবশ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করে

সুন্দরী চন্দ্রাবতীর প্রণয় ছিল শৈশবের খেলার সাথী জয়ানন্দের সঙ্গে। প্রভাতে দুই বন্ধু মিলে পুজোর ফুল তুলে আনতেন। দুজনের প্রেম একসময় ট্রাজেডিতে রূপ নেয়। চন্দ্রাবতীর প্রেমিক নতুন করে প্রেমে পড়ে যান স্থানীয় কাজির সুন্দরী মেয়ে আসমানির। মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেন আসমানীকে। জীবন ওলটপালট হয়ে যায় চন্দ্রাবতীর। বাবার নির্দেশে জীবনভর কুমারী থাকা আর ফুলেশ্বর নদীর তীরে মন্দীর স্থাপন করে শিবপুজোয় মন দেন চন্দ্রা। একসময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রবতীর কাছে ছুটে আসেন প্রেমিক জয়ানন্দ। প্রেমিকাকে একটিবার দেখার আকুতি জয়ানন্দের সব আনন্দ যেন হারিয়ে যায়।

‘দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই/জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই। কোন আকুতি মিনতিতে অভিমানী চন্দ্রার মন গলেনি, খোলেননি মন্দিরের দরজা। অনেক ডাকাডাকির পর সন্ধ্যা মালতীর ফুল দিয়ে মন্দিরের কাঠের দরজায় চার লাইনের একটি বেদনাময় কাব্য লিখেন জয়ানন্দ। ‘শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৈবন কালের সাথী/ অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী/ পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত/ বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।’ অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিক জয়ানন্দ। অবশেষে আত্মহত্যা করেন। প্রেমিকের আত্মহত্যার খবরে চন্দ্রাবতীও আত্মহত্যা করেন।

কমলা : কাহিনীনির্ভর এ গীতিকার আরেকটি বিয়োগাত্মক পালা দ্বিজ ঈশানের ‘কমলা’। মূল চরিত্র কমলার নামে নামকরণ করা হয় পালাটির। প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণ করতে রাজা জানকীনাথ মল্লিক স্ত্রী কমলার নামে খনন করেন ‘কমলা সায়র’ দিঘি। কিন্তু দিঘিতে কোনো জল উঠলো না। আর এতে রাজার পূর্বপূরুষেরা নরকপ্রাপ্ত হতে পারেন বলে রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এক রাতে রাজা স্বপ্ন দেখেন রানী যদি ভরা কলসি নিয়ে দিঘির তলদেশে নামেন তবেই দিঘীতে জল উঠবে। রাজা রানীকে তার স্বপ্নের কথা বললেন।

‘তুমি যদি নামগো রাণী পুষ্কন্নীর তলে,

ভরিয়া উঠিবে তালাব পাতালের জলে।’

এটি শুনে রানী রাজাকে উদ্ধারে এগিয়ে এলেন। নিজের দুধের শিশুকে দাসীদের হাতে দিয়ে সদ্য খনন করা দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। রানীকে হারানোর শোক সইতে না পেরে রাজাও মৃত্যুবরণ করেন। এমন মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে রচিত হয় ‘কমলা’ পালা।

দেয়ান ভাবনা :

মৈমনসিংহ গীতিকার একটি করুণ রসাত্মক পালা দেয়ান ভাবনা। মাত্র দশ বছর বয়সে রূপসী সুনাই পিতৃহারা হয়ে মায়ের সঙ্গে মামা ভাড়–ক ঠাকুরের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। অসম্ভব রূপবতী সুনাইয়ের রূপের প্রশংসা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। এর মধ্যে একদিন জমিদার নন্দন মাধবের সঙ্গে সুনাইয়ের দৃষ্টিবিনিময় হয়। এবং দুজনের সম্পর্ক প্রণয়ে পরিণত হয়। কিন্তু দুর্জন সুনাইয়ের রূপ-গুণের খবর পেয়ে তার মামার কাছে নানা জমিজমা ও ধনসম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সুনাইয়ের লোভী মামা তাতে রাজি হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সুনাই মাধবের কাছে পত্র পাঠায় তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অন্যদিকে দেয়ান ভাবনার লোকেরা সুনাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে মাধবের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। মধাব সুনাইকে উদ্ধার করে নিয়ে বিয়ে করে ফেলে। এতে দেয়ান ভাবনা ক্ষিপ্ত হয়ে মাধবের বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। পিতাকে উদ্ধার করতে গেলে দেয়ান মাধবকে বন্দী করে তার পিতাকে ছেড়ে দেয় এবং বলে সুনাইকে ফিরিয়ে দিলে তাকে ছেড়ে দেবে। একমাত্র পুত্র মাধবকে রক্ষা করতে বললে সুনাই শ^শুরের কথায় দেয়ান ভাবনার কাছে চলে আসে। সুনাইকে পেয়ে দেয়ান মাধবকে ছেড়ে দেয়। সুনাইয়ের সঙ্গে মিলনের আশায় দেয়ান গভীর রাতে তার ঘরে গিয়ে দেখে সুনাই বিষমিশ্রিত লাড্ডু খেয়ে খাটের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। এতে সুনাইয়ের মৃত্যু হয়।

দস্যু-কেনারাম : পালাগুলোর মধ্যে যে পালাটিতে প্রেমের কোনো ভূমিকা নেই সেটি হলো দস্যু-কেনারাম পালা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রচনা এটি।

জালিয়া হাওর পারে বাকুলিয়া গ্রামে বাস করে দ্বিজ খেলারাম ও যশোধারা। সন্তানহীন এ দম্পতিকে গ্রামের মানুষ কটাক্ষ করে বলতো আটখুর। অপমান সইতে না পেরে মনের দুঃখে খেলারাম একদিন শপথ করে সন্তান না হলে তিনি কিছুই আহার করবেন না। এমনকি পানিও খাবেন না, সূর্যের মুখ দেখবেন না। দ্বিতীয় দিন পার হলে তৃতীয় দিন খেলারামের স্ত্রী যশোধারার স্বপ্নে দেখা দিলেন এক দেবী। জানালেন পুত্র সন্তান হবে তার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে দুজন আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে পাঠা বলি দিয়ে পুজো করলেন দেবীর চরণে। মাস না গড়াতেই যশোধারার শরীরে ফুটে ওঠে গর্ভবতীর চিন্থ। অবশেষে তাদের কোলে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় কেনারাম। জন্মের কিছু দিনের মধ্যে শিশু কেনারামকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। মাত্র সাত মাস বয়সে মাতৃহারা হয়ে আশ্রয় নিতে হয় মামার বাড়িতে। স্ত্রী হারানোর শোক সইতে না পেরে খেলারাম পাড়ি জমালেন নিরুদ্দেশে। মামির আদর শাসনে কেনারাম বেড়ে উঠতে থাকে। অনাবৃষ্টির কারণে এর মধ্যে একবার ফসল হয়নি কোথাও। ফলে খাবারের তীব্র অভাবে মাত্র ৫ কাঠা ধানের বিনিময়ে কেনারামকে তারা হালুয়া ডাকাতের কাছে বিক্রি করে দেয়। হালুয়ার সাত পুত্রই ডাকাতের সর্দার। একসময় ডাকাত পুত্রদের সঙ্গে ডাকাতি শুরু করল কেনারাম। অল্প দিনেই ভয়ংকর ডাকাত হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং সে দস্যুদের সর্দার হয়ে ওঠে। এক সন্নাসীর র্স্পশে অবশেষে তার দস্যুপনা বন্ধ হলো। সে তার জন্মদাতা পিতা। ধর্মের কথা বলে নরকের কথা বলে কেনারামকে মানুষ হত্যা থেকে ফিরে আসতে বলে। না হয় যেন পিতাকে হত্যা করে সে। পিতার এমন আর্জিতে পুত্রের মন বিগলিত হয়। এভাবে কেনারামকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে পিতা খেলারাম।

[লেখক: সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মৈমনসিংহ গীতিকার শতবর্ষ

মোস্তাফা জব্বার

মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

দুই॥

মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা তুলে ধরতে পারি।

মহুয়া : গারো পাহাড়ের কাছে হিমানী পর্বতের উত্তরে এক গভীর বনে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা বাইদ্যা। ১৬ বছর আগে কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মনের ছ’মাস বয়সী মেয়েকে যে চুরি করে লালন পালন করে, খেলা- কসরত শেখায়। মেয়েটির নাম রাখে মহুয়া স্ন্দুরী। একবার বামনকান্দা গ্রামের ব্রাহ্মণ নদ্যার চান ঠাকুরের বাড়িতে খেলা দেখাতে আসে তারা। মহুয়ার কসরত দেখে নদ্যার চানসহ উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। নদ্যার চাঁদ তাদের প্রচুর বকশিশ দেন। এবং হুমরা বাইদ্যার অনুরোধে তাদের ‘উলুইয়াকান্দা’ নামক স্থানে বাড়ি করে বসবাস করার অনুমতি দেন। এক সন্ধ্যাবেলায় জলের ঘাটে নদ্যার চাঁদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের দুজনের মন দেয়া-নেয়া হয়। হুমরা বাইদ্যা বিষয়টি টের পেয়ে দলবল নিয়ে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। মহুয়াকে দেখতে না পেয়ে এদিকে নদ্যার চাঁদ পাগল হয়ে ওঠে। তীর্থের নামে মহুয়ার খোঁজে সে বেরিয়ে পড়ে। অবশেষে কংস নদীর পাড়ে মহুয়ার দেখা পায় সে। হুমরা বাইদ্যা বিষলক্ষের ছুরি মহুয়ার হাতে দিয়ে নদ্যার চাঁদকে হত্যা করতে বলে। কিন্তু কৌশলে নদ্যার চান আর মহুয়া পালিয়ে যায়। পথে পাহাড়িয়া নদী পার হওয়ার জন্য দুজনে সওদাগরের নৌকায় ওঠে। মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে তারা নদ্যার চানকে পানিতে ফেলে দেয়। বিপদ টের পেয়ে মহুয়া সবাইকে তক্ষকের বিষ মেশানো পান খাইয়ে অজ্ঞান করে ডিঙ্গা থেকে নেমে যান এবং জঙ্গলে এক ভাঙা মন্দিরের কাছে মৃতপ্রায় নদ্যার চানের দেখা পান। সেখানে এক সন্ন্যাসীর সহায়তায় নদ্যার চান ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ততক্ষণে সন্ন্যাসী মহুয়ার রূপে আকৃষ্ট হয়ে যায়। মহুয়া দুর্বল নদ্যার চানকে কাঁধে নিয়ে অন্যত্র চলে যান। কিছুদিন পার হলে নদ্যার চান সুস্থ হয়ে ওঠে। হুমরা বাইদ্যার দল খোঁজ পেয়ে মহুয়াদের আস্তানায় চলে আসে এবং মহুয়ার হাতে বিষলক্ষের ছুরি দিয়ে নদ্যার চানকে হত্যা করার জন্য ফের নির্দেশ দেন। কোন উপায় না দেখে মহুয়া নিজের বুকেই ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে বেদের দল নদ্যার চানকে হত্যা করে। দুজনের মিলন হয় পরপারে। জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকে এ পালার বন্ধনায় আপ্লুত হয়েছে।

লোকজ জীবনের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত মহুয়া পালার বন্দনা অংশজুড়ে। উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাশ পর্বত/ যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথথর/ পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান/ উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান/ সভা কইর‌্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান/ সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক সুনিপুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। মহুয়া নদের চাঁদের প্রেমাসক্ত জীবনের গভীর আকুতি যেন নিঃস্বার্থ প্রেমের উজ্জল দৃষ্টান্ত। যাত্রাপালায় ঢঙে রচিত ট্রাজিক এ পালাটিকে মনে করা হয় শ্রেষ্ঠ পালা। মহুয়ার মতো মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাজল রেখা, প্রত্যেকে স্বমহিয়ায় সাহিত্যের চিরন্তন মর্যাদা লাভ করেছে। এখনও ময়মনসিংহের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর পালা রামায়ণের অমর প্রেমের স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান। পাড়াগাঁয়ের নর-নারীর প্রেমের মাধুর্য মিশ্রিত এসব ঘটনাবলির গান সবশ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করে। নিম্নবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ আর নারী হৃদয়ের বিচিত্র বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনীগুলোই গীতিকার অন্যতম বিষয়বস্তু।

মলুয়া : মলুয়া পালার প্রধান চরিত্র ‘মলুয়া’। রচয়িতা অজ্ঞাত হলেও ধারণা করা হয় চন্দ্রাবতী নিজেই মলুয়া পালা রচনা করেছেন, নিজেই এ পালার চরিত্র। গরিব চাঁদ বিনোদের সঙ্গে গ্রামের মোড়লের সুন্দরী মেয়ে মলুয়ার বিবাহিত সম্পর্কের উত্থান-পতন, ক্ষমতাবান কাজীর দাপটের কাছে নত না হওয়া এক বাঙালি নারীর মর্যাদার লড়াইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মলুয়া পালার কাহিনী। গ্রামের মোড়লের সুন্দরী মেয়ে মলুয়া আর গরিবের ছেলে বিনোদ। দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ভালবাসার কথা জানিয়ে মলুয়ার বাড়িতে বিয়ের সম্মতি চাইলে মলুয়ার বাবা গরিব বিনোদের সঙ্গে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বড়লোকের মেয়ে পাঁচ ভাইয়ের আদরের বোন মলুয়াকে বিয়ে করার জন্য গরিব বিনোদ কুড়া পাখি শিকার করে অনেক অর্থ উপার্জন করে এবং ফিরে এসে মলুয়াকে বিয়ে করে। এদিকে গ্রামের দেয়ান মলুয়ার রূপে আকৃষ্ট হয়ে মলুয়াকে বিয়ে করতে চায়। মলুয়া রাজি না হলে দেয়ান ও কাজির চক্রান্তে বিনোদ সম্পত্তি হারায়। এমনকি মলুয়ার গায়ের গয়না বেচে তাদের সংসার চালাতে হয়। অর্থ সংকটে পড়ে উপার্জনের আশায় বিনোদ বাইরে চলে গেলে দুষ্ট কাজি মলুয়াকে তুলে নিয়ে দেয়ানকে দেয়। দেয়ান মলুয়াকে বিয়ে করতে চাইলে কৌশলে মলুয়া নিজেকে বাঁচিয়ে ফেরে। কিন্তু বিনোদ মলুয়াকে আর ঘরে নিতে চায় না। সে আবার বিয়ে করে। বাপের বাড়ি না গিয়ে মলুুয়া বিনোদের ঘরে দাসীর মতো পড়ে থাকে। বিনোদকে সাপে কামড়ালে মলুয়া ওঝার কাছে নিয়ে তাকে সারিয়ে তোলে। বিনোদ মলুয়াকে এরপর ঘরে নিতে সস্মত হয়। কিন্তু বিনোদের স্বজনরা বিরোধিতা করে। মলুয়া অভিমান করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

নারী হৃদয়ের শক্তি, উদারতা, মানবিক মূল্যবোধের সচিত্র ফুটে উঠেছে প্রায় প্রত্যেকটি পালায়। তেমনি আরেকটি বিয়োগাত্মক পালা চন্দ্রাবতী।

চন্দ্রাবতী : সপ্তদশ শতকের লোককবি চন্দ্রাবতী। লোকগীতিকা, পালাকাব্য গান, রামায়ণ কাহিনী চন্দ্রাবতীর ভালোবাসার সুখ-দুঃখের অমর রচনাশৈলী।

‘চাইরকোণা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর/ ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর’ ‘আমার বাড়ি তোমার বাড়ি ঐ না নদীর পার/ কি কারণে তুল কণ্যা মালতীর হার।’ ‘প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে/ বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।’

এখনও ময়মনসিংহের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর পালা, রামায়ণের অমর প্রেমের স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান। পাড়াগাঁয়ের নর-নারীর প্রেমের মাধুর্য মিশ্রিত এসব ঘটনাবলির গান সবশ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করে

সুন্দরী চন্দ্রাবতীর প্রণয় ছিল শৈশবের খেলার সাথী জয়ানন্দের সঙ্গে। প্রভাতে দুই বন্ধু মিলে পুজোর ফুল তুলে আনতেন। দুজনের প্রেম একসময় ট্রাজেডিতে রূপ নেয়। চন্দ্রাবতীর প্রেমিক নতুন করে প্রেমে পড়ে যান স্থানীয় কাজির সুন্দরী মেয়ে আসমানির। মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেন আসমানীকে। জীবন ওলটপালট হয়ে যায় চন্দ্রাবতীর। বাবার নির্দেশে জীবনভর কুমারী থাকা আর ফুলেশ্বর নদীর তীরে মন্দীর স্থাপন করে শিবপুজোয় মন দেন চন্দ্রা। একসময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রবতীর কাছে ছুটে আসেন প্রেমিক জয়ানন্দ। প্রেমিকাকে একটিবার দেখার আকুতি জয়ানন্দের সব আনন্দ যেন হারিয়ে যায়।

‘দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই/জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই। কোন আকুতি মিনতিতে অভিমানী চন্দ্রার মন গলেনি, খোলেননি মন্দিরের দরজা। অনেক ডাকাডাকির পর সন্ধ্যা মালতীর ফুল দিয়ে মন্দিরের কাঠের দরজায় চার লাইনের একটি বেদনাময় কাব্য লিখেন জয়ানন্দ। ‘শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৈবন কালের সাথী/ অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী/ পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত/ বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।’ অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিক জয়ানন্দ। অবশেষে আত্মহত্যা করেন। প্রেমিকের আত্মহত্যার খবরে চন্দ্রাবতীও আত্মহত্যা করেন।

কমলা : কাহিনীনির্ভর এ গীতিকার আরেকটি বিয়োগাত্মক পালা দ্বিজ ঈশানের ‘কমলা’। মূল চরিত্র কমলার নামে নামকরণ করা হয় পালাটির। প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণ করতে রাজা জানকীনাথ মল্লিক স্ত্রী কমলার নামে খনন করেন ‘কমলা সায়র’ দিঘি। কিন্তু দিঘিতে কোনো জল উঠলো না। আর এতে রাজার পূর্বপূরুষেরা নরকপ্রাপ্ত হতে পারেন বলে রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এক রাতে রাজা স্বপ্ন দেখেন রানী যদি ভরা কলসি নিয়ে দিঘির তলদেশে নামেন তবেই দিঘীতে জল উঠবে। রাজা রানীকে তার স্বপ্নের কথা বললেন।

‘তুমি যদি নামগো রাণী পুষ্কন্নীর তলে,

ভরিয়া উঠিবে তালাব পাতালের জলে।’

এটি শুনে রানী রাজাকে উদ্ধারে এগিয়ে এলেন। নিজের দুধের শিশুকে দাসীদের হাতে দিয়ে সদ্য খনন করা দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। রানীকে হারানোর শোক সইতে না পেরে রাজাও মৃত্যুবরণ করেন। এমন মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে রচিত হয় ‘কমলা’ পালা।

দেয়ান ভাবনা :

মৈমনসিংহ গীতিকার একটি করুণ রসাত্মক পালা দেয়ান ভাবনা। মাত্র দশ বছর বয়সে রূপসী সুনাই পিতৃহারা হয়ে মায়ের সঙ্গে মামা ভাড়–ক ঠাকুরের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। অসম্ভব রূপবতী সুনাইয়ের রূপের প্রশংসা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। এর মধ্যে একদিন জমিদার নন্দন মাধবের সঙ্গে সুনাইয়ের দৃষ্টিবিনিময় হয়। এবং দুজনের সম্পর্ক প্রণয়ে পরিণত হয়। কিন্তু দুর্জন সুনাইয়ের রূপ-গুণের খবর পেয়ে তার মামার কাছে নানা জমিজমা ও ধনসম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সুনাইয়ের লোভী মামা তাতে রাজি হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সুনাই মাধবের কাছে পত্র পাঠায় তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অন্যদিকে দেয়ান ভাবনার লোকেরা সুনাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে মাধবের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। মধাব সুনাইকে উদ্ধার করে নিয়ে বিয়ে করে ফেলে। এতে দেয়ান ভাবনা ক্ষিপ্ত হয়ে মাধবের বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। পিতাকে উদ্ধার করতে গেলে দেয়ান মাধবকে বন্দী করে তার পিতাকে ছেড়ে দেয় এবং বলে সুনাইকে ফিরিয়ে দিলে তাকে ছেড়ে দেবে। একমাত্র পুত্র মাধবকে রক্ষা করতে বললে সুনাই শ^শুরের কথায় দেয়ান ভাবনার কাছে চলে আসে। সুনাইকে পেয়ে দেয়ান মাধবকে ছেড়ে দেয়। সুনাইয়ের সঙ্গে মিলনের আশায় দেয়ান গভীর রাতে তার ঘরে গিয়ে দেখে সুনাই বিষমিশ্রিত লাড্ডু খেয়ে খাটের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। এতে সুনাইয়ের মৃত্যু হয়।

দস্যু-কেনারাম : পালাগুলোর মধ্যে যে পালাটিতে প্রেমের কোনো ভূমিকা নেই সেটি হলো দস্যু-কেনারাম পালা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রচনা এটি।

জালিয়া হাওর পারে বাকুলিয়া গ্রামে বাস করে দ্বিজ খেলারাম ও যশোধারা। সন্তানহীন এ দম্পতিকে গ্রামের মানুষ কটাক্ষ করে বলতো আটখুর। অপমান সইতে না পেরে মনের দুঃখে খেলারাম একদিন শপথ করে সন্তান না হলে তিনি কিছুই আহার করবেন না। এমনকি পানিও খাবেন না, সূর্যের মুখ দেখবেন না। দ্বিতীয় দিন পার হলে তৃতীয় দিন খেলারামের স্ত্রী যশোধারার স্বপ্নে দেখা দিলেন এক দেবী। জানালেন পুত্র সন্তান হবে তার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে দুজন আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে পাঠা বলি দিয়ে পুজো করলেন দেবীর চরণে। মাস না গড়াতেই যশোধারার শরীরে ফুটে ওঠে গর্ভবতীর চিন্থ। অবশেষে তাদের কোলে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় কেনারাম। জন্মের কিছু দিনের মধ্যে শিশু কেনারামকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। মাত্র সাত মাস বয়সে মাতৃহারা হয়ে আশ্রয় নিতে হয় মামার বাড়িতে। স্ত্রী হারানোর শোক সইতে না পেরে খেলারাম পাড়ি জমালেন নিরুদ্দেশে। মামির আদর শাসনে কেনারাম বেড়ে উঠতে থাকে। অনাবৃষ্টির কারণে এর মধ্যে একবার ফসল হয়নি কোথাও। ফলে খাবারের তীব্র অভাবে মাত্র ৫ কাঠা ধানের বিনিময়ে কেনারামকে তারা হালুয়া ডাকাতের কাছে বিক্রি করে দেয়। হালুয়ার সাত পুত্রই ডাকাতের সর্দার। একসময় ডাকাত পুত্রদের সঙ্গে ডাকাতি শুরু করল কেনারাম। অল্প দিনেই ভয়ংকর ডাকাত হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং সে দস্যুদের সর্দার হয়ে ওঠে। এক সন্নাসীর র্স্পশে অবশেষে তার দস্যুপনা বন্ধ হলো। সে তার জন্মদাতা পিতা। ধর্মের কথা বলে নরকের কথা বলে কেনারামকে মানুষ হত্যা থেকে ফিরে আসতে বলে। না হয় যেন পিতাকে হত্যা করে সে। পিতার এমন আর্জিতে পুত্রের মন বিগলিত হয়। এভাবে কেনারামকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে পিতা খেলারাম।

[লেখক: সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]

back to top