বিজয়ের মাস
সাদেকুর রহমান
একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর সীমান্ত এলাকাসহ পুরো বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রচন্ড লড়াই। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধের তৃতীয় দিন। শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী ও দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পূর্বে আর কখনো পড়েনি হানাদার বাহিনী। দিনটি তাদের জন্য আসন্ন চরম বিপর্যয়ের বার্তাই বয়ে এনেছিল। ঢাকার আকাশ পুরোপুরি মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর সব জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ সময়ে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠে, সম্মুখসমরের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিমানবাহিনী এদিন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এদিনের পর ঢাকার আকাশে আর কোনো জঙ্গি বিমান ওড়েনি। এর একদিন পরই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের খবর আসছে।
একাত্তরের এদিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। পাকিস্তানের কূটনৈতিক কূটকৌশলে মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল তৎকালীন দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বশিবির দুভাগে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। আগের দিন (৪ ডিসেম্বর) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের নগ্নভাবে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রেক্ষাপটে এদিন (৫ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে।’ এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন জানায়।
কিন্তু চীন ভেটো প্রদান করে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে অপর দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে নিজেদের বিরত রাখে। এতে করে পাকিস্তানের প্রত্যাশার শেষ আলোটুকুও ফিকে হয়ে যায়।
এদিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনরূপ শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।
সে সময়কার স্মৃতি তুলে ধরে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর-প্রতীক বলছিলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতিতে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, স্থলবাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে যুদ্ধে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ৫ ডিসেম্বর। কিন্তু তখনো রাস্তা অনেক দূর ছিল। আন্তর্জাতিক মহলে তখন অনেকগুলো বিষয় চলছিল। পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ, ইউরোপের কিছু দেশ। তারা জাতিসংঘের কাছে যুদ্ধবিরতির সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তখনো অনুকূলে ছিল না। তখন আমাদের মুজিবনগর সরকার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছিল বিভিন্ন দেশে। যারা তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছিলেন, তারাও কাজ করেছেন বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করতে।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রও পাকিস্তানের প্রতিকূলে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের এদিনে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সব বিদেশি জাহাজগুলোকে বন্দর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশি জাহাজগুলো এ সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে, শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এদিন লেফট্যানেন্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
জামালপুর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, ঝিনাইদহ, সান্তাহার, ময়মনসিংহ ইয়ার্ড মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। বাংলার উন্মুক্ত আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান অবাধে বিচরণ করে। জামালপুরে বিমান হামলায় কয়েকশ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে বিজয় দেখে এগিয়ে যায়।
মিত্রবাহিনীর বিজয় দেখে জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানি বাহিনীকে পেছনের দিকে সরে আসার নির্দেশ দেন। ভারতের অকৃত্রিম সাহায্য-সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সফলতা বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাবে, এদিন বারো ঘণ্টায় ২৩২ বারে ঢাকার তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মতো বোমা ফেলা হয়েছে। এতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। শত্রুবাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গিবিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যবোঝাই কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমারও ধ্বংস হয়।
সাবমেরিন গাজী পাকিস্তানি নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথকমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল।
মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
হানাদার বাহিনী যশোরের চৌগাছার সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। এই তিন দিন যশোর অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড হয়। সীমান্ত এলাকা থেকে মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাসসহ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমানহামলা চালায় ও গোলা নিক্ষেপ করে। ৫ ডিসেম্বর থেকে পর্যুদস্ত দখলদার বাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিন সকাল ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচন্ড লড়াই হয়।
এদিকে, ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়ামুক্ত হওয়ার পর কিছু শত্রুসৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ১৬০ জন মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
এছাড়া এদিন কুড়িগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, কুমিল্লার দেবিদ্বার, শেরপুরের ঝিনাইগাতী, যশোরের ঝিকরগাছা, মুন্সীনগর ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর কবল মুক্ত হয়। যতই শত্রু হটানোর খবর চাউর হচ্ছে ততই স্বাধীনতাকামী মানুষসহ মুক্তিবাহিনী উজ্জীবিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে হানাদার বাহিনী লেজ গোটানোর সময়ও সন্নিকটবর্তী হচ্ছে।
তদানীন্তন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘বাংলাদেশের জন্ম’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সকালে কুমিল্লায় ব্যাটালিয়ন আত্মসমর্পণ করার দুঃসংবাদ জানানো হয়। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হতে থাকে।’ (পৃষ্ঠা ১২৩-১২৪)
অন্যদিকে, রাও ফরমান আলী ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্ত হস্তে সবাইকে দান করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সেনাপ্রধান অন্য এক ঘোষণায় অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সব সৈনিককে নিকটস্থ রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য আবার নির্দেশ দেন।
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে আড়াল করতে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে বলে বেতারে ফের ঘোষণা দেন পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান। কিন্তু তাতে বরাবরের মতোই কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। একাত্তরেও বাঁকা পথ অবলম্বন করে বাঙালিদের দমিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। সাক্ষাৎ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেই বাঙালিরা নিজেদের জাত চিনিয়ে দেয়। গুটিকতক দেশ ছাড়া, বিশ্বও স্বাধীনতাকামী বাঙালির পক্ষেই ছিল।
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]
বিজয়ের মাস
সাদেকুর রহমান
মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩
একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর সীমান্ত এলাকাসহ পুরো বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রচন্ড লড়াই। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধের তৃতীয় দিন। শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী ও দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পূর্বে আর কখনো পড়েনি হানাদার বাহিনী। দিনটি তাদের জন্য আসন্ন চরম বিপর্যয়ের বার্তাই বয়ে এনেছিল। ঢাকার আকাশ পুরোপুরি মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর সব জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ সময়ে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠে, সম্মুখসমরের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিমানবাহিনী এদিন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এদিনের পর ঢাকার আকাশে আর কোনো জঙ্গি বিমান ওড়েনি। এর একদিন পরই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের খবর আসছে।
একাত্তরের এদিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। পাকিস্তানের কূটনৈতিক কূটকৌশলে মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল তৎকালীন দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বশিবির দুভাগে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। আগের দিন (৪ ডিসেম্বর) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের নগ্নভাবে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রেক্ষাপটে এদিন (৫ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে।’ এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন জানায়।
কিন্তু চীন ভেটো প্রদান করে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে অপর দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে নিজেদের বিরত রাখে। এতে করে পাকিস্তানের প্রত্যাশার শেষ আলোটুকুও ফিকে হয়ে যায়।
এদিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনরূপ শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।
সে সময়কার স্মৃতি তুলে ধরে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর-প্রতীক বলছিলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতিতে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, স্থলবাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে যুদ্ধে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ৫ ডিসেম্বর। কিন্তু তখনো রাস্তা অনেক দূর ছিল। আন্তর্জাতিক মহলে তখন অনেকগুলো বিষয় চলছিল। পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ, ইউরোপের কিছু দেশ। তারা জাতিসংঘের কাছে যুদ্ধবিরতির সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তখনো অনুকূলে ছিল না। তখন আমাদের মুজিবনগর সরকার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছিল বিভিন্ন দেশে। যারা তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছিলেন, তারাও কাজ করেছেন বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করতে।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রও পাকিস্তানের প্রতিকূলে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের এদিনে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সব বিদেশি জাহাজগুলোকে বন্দর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশি জাহাজগুলো এ সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে, শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এদিন লেফট্যানেন্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
জামালপুর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, ঝিনাইদহ, সান্তাহার, ময়মনসিংহ ইয়ার্ড মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। বাংলার উন্মুক্ত আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান অবাধে বিচরণ করে। জামালপুরে বিমান হামলায় কয়েকশ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে বিজয় দেখে এগিয়ে যায়।
মিত্রবাহিনীর বিজয় দেখে জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানি বাহিনীকে পেছনের দিকে সরে আসার নির্দেশ দেন। ভারতের অকৃত্রিম সাহায্য-সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সফলতা বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাবে, এদিন বারো ঘণ্টায় ২৩২ বারে ঢাকার তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মতো বোমা ফেলা হয়েছে। এতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। শত্রুবাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গিবিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যবোঝাই কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমারও ধ্বংস হয়।
সাবমেরিন গাজী পাকিস্তানি নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথকমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল।
মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
হানাদার বাহিনী যশোরের চৌগাছার সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। এই তিন দিন যশোর অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড হয়। সীমান্ত এলাকা থেকে মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাসসহ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমানহামলা চালায় ও গোলা নিক্ষেপ করে। ৫ ডিসেম্বর থেকে পর্যুদস্ত দখলদার বাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিন সকাল ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচন্ড লড়াই হয়।
এদিকে, ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়ামুক্ত হওয়ার পর কিছু শত্রুসৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ১৬০ জন মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
এছাড়া এদিন কুড়িগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, কুমিল্লার দেবিদ্বার, শেরপুরের ঝিনাইগাতী, যশোরের ঝিকরগাছা, মুন্সীনগর ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর কবল মুক্ত হয়। যতই শত্রু হটানোর খবর চাউর হচ্ছে ততই স্বাধীনতাকামী মানুষসহ মুক্তিবাহিনী উজ্জীবিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে হানাদার বাহিনী লেজ গোটানোর সময়ও সন্নিকটবর্তী হচ্ছে।
তদানীন্তন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘বাংলাদেশের জন্ম’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সকালে কুমিল্লায় ব্যাটালিয়ন আত্মসমর্পণ করার দুঃসংবাদ জানানো হয়। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হতে থাকে।’ (পৃষ্ঠা ১২৩-১২৪)
অন্যদিকে, রাও ফরমান আলী ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্ত হস্তে সবাইকে দান করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সেনাপ্রধান অন্য এক ঘোষণায় অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সব সৈনিককে নিকটস্থ রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য আবার নির্দেশ দেন।
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে আড়াল করতে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে বলে বেতারে ফের ঘোষণা দেন পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান। কিন্তু তাতে বরাবরের মতোই কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। একাত্তরেও বাঁকা পথ অবলম্বন করে বাঙালিদের দমিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। সাক্ষাৎ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেই বাঙালিরা নিজেদের জাত চিনিয়ে দেয়। গুটিকতক দেশ ছাড়া, বিশ্বও স্বাধীনতাকামী বাঙালির পক্ষেই ছিল।
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]