শেখর ভট্টাচার্য
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৭ জানুয়ারি
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, জনতার জন্য মমতার কথা তত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্ষমতা যারা চাচ্ছেন তারা কিন্তু তাদের জন্য ক্ষমতা চাচ্ছেন না। জনতার মমতায় তারা ক্ষমতা নিতে চাচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ মানুষ বোধ হয় সংসদ সদস্য হতে চাচ্ছেন। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’ কেন সোনার হরিণ পেতেই হবে? সোনার হরিণ হলো- আরব্য রজনীর আলাদিনের প্রদীপ। শপথ নেয়ার পরপরই বিজয়ীরা প্রদীপকে সামনে রেখে তিনবার তালি দেবেন। দৈত্য হাজির। কী চাই মালিক? জনতার হাতে সকল ক্ষমতা অর্পণ করতে চান নাকি সমতার সমাজ গড়তে চান। জনতার দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য তাদের বলবেন ইট-বালি, সিমেন্ট কিন্তু উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হলো ইট-বালি সিমেন্টের ভেতরে বসে থাকা মানুষ যারা তোমাদের সেবক। সেবকেরা তোমাদের সেবা দিতে বাধ্য, জনাব আপনি তা নিশ্চিত করতে চান?
দৈত্য এই পর্যন্ত বলে তাকিয়ে থাকবে মালিকের দিকে। মালিক কী বলবেন, কী বলে আসছেন এতদিন তার মতো অন্য সাংসদ বা জনপ্রতিনিধি, কী রকম ছিল তাদের মুখের অভিব্যক্তি?
মালিক দৈত্যের দিকে তাকাবেন। অট্টহাসিতে তার গলা, মুখ, বুক যেন ফেটে পড়তে চাচ্ছে। কী বোকা দৈত্য। জনতার প্রতি মমতা! দিন-রাত গলা ফাটিয়ে ভোটারদের সামনে কেঁদে কেঁদে এসব কথা বলেছেন বিষয়টি কী বোকা দৈত্য বুঝে না? এসব হলো নির্বাচনী বৈতরণী কিংবা ফুলসিরাত পার হওয়ার মন্ত্র। এগুলো অন্তর থেকে আসে না। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসে জিহ্বার সাহায্যে। তাহলে অন্তরের কথা কী। অন্তরে তার মমতা জনতার প্রতি নয়, মমতা হলো প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার প্রতি।
বোকা দৈত্য বড়ই বোকা। সে জানে না আমাদের একজন মহান কবি ছিলেন। তিনি রা’্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। প্রায় দশ বছর ছুঁই ছুঁই সময় পার করেছেন রা’্রপতি হিসেবে। একই অঙ্গে ছিল তার বহু রূপ। মন ভুলাতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সে রমণীর মন কিংবা কবির মন। বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি তার কাব্য সাধনা দেখে দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন- ‘রাইফেলের আগায় প্রজাপতি’। রাইফেল ধরে থাকলে কী হবে মনটি প্রজাপতির মতো বর্ণিল। বড়ই কোমল। তিনি হলেন এ দেশের সব ক্ষমতা প্রত্যাশীদের আদর্শ।
এই যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চলছে, সবাই মনে মনে সেই নেতার আদর্শ অনুসরণ করেন। দৈত্যকে ক্ষমতা প্রত্যাশী সাংসদেরা সব সময় বলেন ‘চাই আরও ক্ষমতা, আরও অর্থ, আরও বিত্ত’। রবি ঠাকুরের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার পঙ্ক্তির মতো- ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,/চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু’। শুধু চাই চাই চাই। তবে এখানে চাওয়াটা শুধু নিজের জন্য। বড় স্বার্থপরের মতো চাওয়া। চাই অর্থ এমন ভাবে অর্থ পেতে হবে ফুলে ফেঁপে উঠবে সুইস ব্যাংক। বেগমপাড়ার বাড়ি হবে রাজপ্রাসাদ। সন্তানেরা হবে সকল অর্থে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। অর্থ কিংবা অন্য যে কোন কিছু পাচারের যেন কোন বাধা না থাকে। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে প্রদীপের শরীর ঘসে তিনবার করে তালিয়া বাজবে নিজের জীবনকে মমতার সাথে গড়ে তোলার জন্য।
চাহিদা অসীম। চাহিদাকে মিটিয়ে দেয়ার জোগান দিতে যেন পিছ-পা না হয় দৈত্য। দৈত্যের মালিক তো জনপ্রতিনিধি এমনি এমনি হয়ে যাননি। কুলার কিংবা হিটার লাগানো ঘর থেকে বেরিয়ে নোংরা গলি, নোংরা মানুষদের সাথে গলা গলি, ঢলা-ঢলি করতে হয়েছে। হাতে হাত মেলাতে হয়েছে। দৈত্যকে হতে হবে নিরঙ্কুশ অধীন। দৈত্য মালিক মালিক বলে অস্থির থাকবে। দৈত্য বলবে মালিক, হুকুম করুন, পৃথিবীর কোন কোনে আপানার জন্য সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। যিনি জনপ্রতিনিধি, সাংসদ, জনতার মমতায় মূর্ছা যাওয়ার অভিনয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি প্রয়োজনের তালিকা ধরিয়ে দেবেন দৈত্যকে। প্রয়োজন শুধুমাত্র প্রিয়জনদের জন্য। অন্য আর কারো জন্য নয় কোনভাবেই।
জনতার জন্য যতটুকু ক্ষমতা সে ক্ষমতায় ইট-বালি সিমেন্ট দিয়ে অত্যাধুনিক স্থাপনা তৈরি করতে হবে। স্থাপনাগুলো দেখে জনতার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে তারা বলবেন, ‘হে মহামানব, উন্নয়নের বিজয় রথ চালিয়ে যান’, আমরা আমৃত্যু আপনার সাথে আছি। এভাবে উন্নয়ন কোনটা আর শোষণ কোনটা সেটা বুঝতে হলে যে জ্ঞান গম্মি প্রয়োজন তা কখনো দেয়া হবে না এসব মানুষদের। এ জন্য তিনি ভ্রম তৈরি করে ফেলবেন। ভ্রম বড় কঠিন বিষয়। ভ্রমের ভেতর কুয়াশায় পরিপূর্ণ। ভ্রম মনের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ভ্রমের ভেতর আলোকে আঁধার, আঁধারকে আলো মনে হয়। উন্নয়নের নামে যে সব স্থাপনা তৈরি করা হয়, সেখানে যে জনসেবা পাওয়া যাবে না তা জনতা কোনভাবেই বুঝতে পারবে না। উন্নয়নের ঝকমকে আলো বুদ্ধি বিবেচনাকে গ্রাস করে ফেলবে। এই দ্বন্দ্বের ভেতরে কুয়াশাচ্ছন্ন পথ থাকবে, সেই পথ দিয়েই ক্রমাগত এগিয়ে যাবেন নির্বাচিত সাংসদ কিংবা জননেতা। তিনি রবিঠাকুর ভক্ত হয়ে কবিতা আওড়াবেন- ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,/আমরা সবাই (দুজন) চলতি হাওয়ার পন্থী।’
চলতি হাওয়া কী বলে? চলতি হাওয়া বলে মানবাধিকার, সমতার সমাজ, সুশাসন, জনতার ক্ষমতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজের মধ্যে বৈচিত্র্যকে সম্মান জানানো, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণসহ অনেক জনকেন্দ্রিক বিষয়। আব্রাহাম লিংকনের ভাবনাতে যা ছিলো না আমাদের সাংসদ যারা ছিলেন, আছেন, নির্বাচিত হবেন তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে আছে গভীর ধারণা এবং বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়প্রত্যয় আছে(!)। আমাদের রাজনৈতিক দলের আছে প্যাকেজ কর্মসূচি। নির্বাচন-পূর্ব এ সময়ে তারা জনতার জন্য পরম মমতায় আকাশের চাঁদ উপহার দিতে প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য চাই ক্ষমতা। চাই ছাড়পত্র। যেনতেন প্রকারেণ প্রথমত ক্ষমতার ঘর বা পাওয়ার হাউসে প্রবেশের ছাড়পত্র ছাড়া এত মমতা প্রদর্শন সম্ভব নয়।
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, জনতার জন্য মমতার কথা তত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্ষমতা যারা চাচ্ছেন তারা কিন্তু তাদের জন্য ক্ষমতা চাচ্ছেন না। জনতার মমতায় তারা ক্ষমতা নিতে চাচ্ছেন
যিনি জুতা পরে হাঁটেন তিনি জানেন জুতার ভেতরে ঢুকে যাওয়া পিন তাকে পা ফেলতে কতটুকু কষ্ট দিচ্ছে। ইংরেজিতে বলে ‘দ্য ওয়ারার নোস, হোয়ার দ্য শু পিঞ্চেস’। প্রশ্ন হলো যারা সতেরো কোটির মধ্যে বারো কোটি মানুষের প্রতিনিধি হবেন তারা কী কখনো খালি পায়ে, লাঙ্গল নিয়ে কিংবা ট্রাক্টর চালিয়ে ভরা গ্রীষ্মে কিংবা বর্ষায় সকাল-সন্ধ্যা ফসলের মাঠে কাজ করেছেন। তার কী জানেন উত্তরার আজমপুরে শেষ রাতে যারা নিজেদের বিক্রি করতে আসেন দিনমজুর হিসেবে দিন শেষ যখন সামান্য মজুরি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তখন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়। অথবা যাদের ভগ্ন স্বাস্থ্যে কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অবিক্রি থেকে যান তারা কী মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে জীবন-যাপন করেন। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের নারীকর্মী, ওষুধ শিল্পের শ্রমিক, আমাদের কৃষক যারা বৈশ্বিক মহামারিগুলোর ভেতর সকাল সন্ধ্যা বিরামহীন পরিশ্রম করে আমাদের কাঁচাবাজারে প্রয়োজনীয় ফসলের অভাব বোধ করতে দেননি, তাদের একটি সকাল, সন্ধ্যা কী আমাদের মনোয়ন প্রত্যাশী কিংবা মনোনীতরা কখনো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
জনগণের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া কে বন্ধ করে দিয়ে, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করতে চাচ্ছি। এই যে সকলেই অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন চাচ্ছেন, তারা কী জনসংলাপের মাধ্যমে জনগণের সমস্যা বের করে নিয়ে এসেছেন। আমাদের জানামতে শোডাউন করার জন্য মজুরি দিয়ে কিনে আনা জনগণ দিয়ে বড় বড় মহাসমাবেশ ছাড়া সরাসরি কোন জন সংলাপের আমাদের কাছে নেই। ক্ষমতার জন্য নাকি কান্না আমরা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ণের কর্মসূচির কথা শুনতে পাইনি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সকল কর্মসূচির মূল কথা হলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। স্থিতাবস্থার মধ্যে থাকার মধ্যে এক ধরনের সুখ আছে। নীরবতা আছে, কৃত্রিম সন্তুষ্টি আছে, যেখানে সাধারণের নেতৃত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা নেই। সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেদের চিত্তের উন্নয়ন না করে বিত্তের উন্নয়ন ঘটানো যায় নির্বিবাদে। তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বলে না কোন দল। সব রাজনৈতিক দলের সব কর্মসূচির মূল কথা হলো- নির্বাচনী প্রক্রিয়া এমন হবে যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দল সেফ ল্যান্ডিং কিংবা নিরাপদে জয়লাভ করতে পারবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না করে, জনগণকে রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়ে আসতে না পারলে শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের মতো স্বচ্ছ করে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমরা রাষ্ট্রকে দেখতে চাই প্রকৃত অর্থে গণপ্রজাতন্ত্রী। রাষ্ট্রের মালিকানা যখন কিছু মানুষের হাত থেকে অধিকাংশ মানুষের হাতে অর্পিত হবে তখন প্রকৃত অর্থে মানুষের ক্ষমতায়ন সংঘটিত হবে। ধোঁয়াশার মধ্যে বহমান শোষণ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে না পারলে বৈষম্যের বাংলাদেশ সামান্যসংখ্যক মানুষের অধীনে চলে যাবে। আমার যারা নিজেদের প্রান্তিক, সাধারণ মানুষের পক্ষের শক্তি ভাবি-আমরা কি তা চাই?
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক ]
শেখর ভট্টাচার্য
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৭ জানুয়ারি
বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, জনতার জন্য মমতার কথা তত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্ষমতা যারা চাচ্ছেন তারা কিন্তু তাদের জন্য ক্ষমতা চাচ্ছেন না। জনতার মমতায় তারা ক্ষমতা নিতে চাচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ মানুষ বোধ হয় সংসদ সদস্য হতে চাচ্ছেন। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’ কেন সোনার হরিণ পেতেই হবে? সোনার হরিণ হলো- আরব্য রজনীর আলাদিনের প্রদীপ। শপথ নেয়ার পরপরই বিজয়ীরা প্রদীপকে সামনে রেখে তিনবার তালি দেবেন। দৈত্য হাজির। কী চাই মালিক? জনতার হাতে সকল ক্ষমতা অর্পণ করতে চান নাকি সমতার সমাজ গড়তে চান। জনতার দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য তাদের বলবেন ইট-বালি, সিমেন্ট কিন্তু উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হলো ইট-বালি সিমেন্টের ভেতরে বসে থাকা মানুষ যারা তোমাদের সেবক। সেবকেরা তোমাদের সেবা দিতে বাধ্য, জনাব আপনি তা নিশ্চিত করতে চান?
দৈত্য এই পর্যন্ত বলে তাকিয়ে থাকবে মালিকের দিকে। মালিক কী বলবেন, কী বলে আসছেন এতদিন তার মতো অন্য সাংসদ বা জনপ্রতিনিধি, কী রকম ছিল তাদের মুখের অভিব্যক্তি?
মালিক দৈত্যের দিকে তাকাবেন। অট্টহাসিতে তার গলা, মুখ, বুক যেন ফেটে পড়তে চাচ্ছে। কী বোকা দৈত্য। জনতার প্রতি মমতা! দিন-রাত গলা ফাটিয়ে ভোটারদের সামনে কেঁদে কেঁদে এসব কথা বলেছেন বিষয়টি কী বোকা দৈত্য বুঝে না? এসব হলো নির্বাচনী বৈতরণী কিংবা ফুলসিরাত পার হওয়ার মন্ত্র। এগুলো অন্তর থেকে আসে না। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসে জিহ্বার সাহায্যে। তাহলে অন্তরের কথা কী। অন্তরে তার মমতা জনতার প্রতি নয়, মমতা হলো প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার প্রতি।
বোকা দৈত্য বড়ই বোকা। সে জানে না আমাদের একজন মহান কবি ছিলেন। তিনি রা’্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। প্রায় দশ বছর ছুঁই ছুঁই সময় পার করেছেন রা’্রপতি হিসেবে। একই অঙ্গে ছিল তার বহু রূপ। মন ভুলাতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সে রমণীর মন কিংবা কবির মন। বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি তার কাব্য সাধনা দেখে দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন- ‘রাইফেলের আগায় প্রজাপতি’। রাইফেল ধরে থাকলে কী হবে মনটি প্রজাপতির মতো বর্ণিল। বড়ই কোমল। তিনি হলেন এ দেশের সব ক্ষমতা প্রত্যাশীদের আদর্শ।
এই যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চলছে, সবাই মনে মনে সেই নেতার আদর্শ অনুসরণ করেন। দৈত্যকে ক্ষমতা প্রত্যাশী সাংসদেরা সব সময় বলেন ‘চাই আরও ক্ষমতা, আরও অর্থ, আরও বিত্ত’। রবি ঠাকুরের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার পঙ্ক্তির মতো- ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,/চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু’। শুধু চাই চাই চাই। তবে এখানে চাওয়াটা শুধু নিজের জন্য। বড় স্বার্থপরের মতো চাওয়া। চাই অর্থ এমন ভাবে অর্থ পেতে হবে ফুলে ফেঁপে উঠবে সুইস ব্যাংক। বেগমপাড়ার বাড়ি হবে রাজপ্রাসাদ। সন্তানেরা হবে সকল অর্থে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। অর্থ কিংবা অন্য যে কোন কিছু পাচারের যেন কোন বাধা না থাকে। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে প্রদীপের শরীর ঘসে তিনবার করে তালিয়া বাজবে নিজের জীবনকে মমতার সাথে গড়ে তোলার জন্য।
চাহিদা অসীম। চাহিদাকে মিটিয়ে দেয়ার জোগান দিতে যেন পিছ-পা না হয় দৈত্য। দৈত্যের মালিক তো জনপ্রতিনিধি এমনি এমনি হয়ে যাননি। কুলার কিংবা হিটার লাগানো ঘর থেকে বেরিয়ে নোংরা গলি, নোংরা মানুষদের সাথে গলা গলি, ঢলা-ঢলি করতে হয়েছে। হাতে হাত মেলাতে হয়েছে। দৈত্যকে হতে হবে নিরঙ্কুশ অধীন। দৈত্য মালিক মালিক বলে অস্থির থাকবে। দৈত্য বলবে মালিক, হুকুম করুন, পৃথিবীর কোন কোনে আপানার জন্য সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। যিনি জনপ্রতিনিধি, সাংসদ, জনতার মমতায় মূর্ছা যাওয়ার অভিনয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি প্রয়োজনের তালিকা ধরিয়ে দেবেন দৈত্যকে। প্রয়োজন শুধুমাত্র প্রিয়জনদের জন্য। অন্য আর কারো জন্য নয় কোনভাবেই।
জনতার জন্য যতটুকু ক্ষমতা সে ক্ষমতায় ইট-বালি সিমেন্ট দিয়ে অত্যাধুনিক স্থাপনা তৈরি করতে হবে। স্থাপনাগুলো দেখে জনতার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে তারা বলবেন, ‘হে মহামানব, উন্নয়নের বিজয় রথ চালিয়ে যান’, আমরা আমৃত্যু আপনার সাথে আছি। এভাবে উন্নয়ন কোনটা আর শোষণ কোনটা সেটা বুঝতে হলে যে জ্ঞান গম্মি প্রয়োজন তা কখনো দেয়া হবে না এসব মানুষদের। এ জন্য তিনি ভ্রম তৈরি করে ফেলবেন। ভ্রম বড় কঠিন বিষয়। ভ্রমের ভেতর কুয়াশায় পরিপূর্ণ। ভ্রম মনের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ভ্রমের ভেতর আলোকে আঁধার, আঁধারকে আলো মনে হয়। উন্নয়নের নামে যে সব স্থাপনা তৈরি করা হয়, সেখানে যে জনসেবা পাওয়া যাবে না তা জনতা কোনভাবেই বুঝতে পারবে না। উন্নয়নের ঝকমকে আলো বুদ্ধি বিবেচনাকে গ্রাস করে ফেলবে। এই দ্বন্দ্বের ভেতরে কুয়াশাচ্ছন্ন পথ থাকবে, সেই পথ দিয়েই ক্রমাগত এগিয়ে যাবেন নির্বাচিত সাংসদ কিংবা জননেতা। তিনি রবিঠাকুর ভক্ত হয়ে কবিতা আওড়াবেন- ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,/আমরা সবাই (দুজন) চলতি হাওয়ার পন্থী।’
চলতি হাওয়া কী বলে? চলতি হাওয়া বলে মানবাধিকার, সমতার সমাজ, সুশাসন, জনতার ক্ষমতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজের মধ্যে বৈচিত্র্যকে সম্মান জানানো, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণসহ অনেক জনকেন্দ্রিক বিষয়। আব্রাহাম লিংকনের ভাবনাতে যা ছিলো না আমাদের সাংসদ যারা ছিলেন, আছেন, নির্বাচিত হবেন তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে আছে গভীর ধারণা এবং বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়প্রত্যয় আছে(!)। আমাদের রাজনৈতিক দলের আছে প্যাকেজ কর্মসূচি। নির্বাচন-পূর্ব এ সময়ে তারা জনতার জন্য পরম মমতায় আকাশের চাঁদ উপহার দিতে প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য চাই ক্ষমতা। চাই ছাড়পত্র। যেনতেন প্রকারেণ প্রথমত ক্ষমতার ঘর বা পাওয়ার হাউসে প্রবেশের ছাড়পত্র ছাড়া এত মমতা প্রদর্শন সম্ভব নয়।
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, জনতার জন্য মমতার কথা তত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্ষমতা যারা চাচ্ছেন তারা কিন্তু তাদের জন্য ক্ষমতা চাচ্ছেন না। জনতার মমতায় তারা ক্ষমতা নিতে চাচ্ছেন
যিনি জুতা পরে হাঁটেন তিনি জানেন জুতার ভেতরে ঢুকে যাওয়া পিন তাকে পা ফেলতে কতটুকু কষ্ট দিচ্ছে। ইংরেজিতে বলে ‘দ্য ওয়ারার নোস, হোয়ার দ্য শু পিঞ্চেস’। প্রশ্ন হলো যারা সতেরো কোটির মধ্যে বারো কোটি মানুষের প্রতিনিধি হবেন তারা কী কখনো খালি পায়ে, লাঙ্গল নিয়ে কিংবা ট্রাক্টর চালিয়ে ভরা গ্রীষ্মে কিংবা বর্ষায় সকাল-সন্ধ্যা ফসলের মাঠে কাজ করেছেন। তার কী জানেন উত্তরার আজমপুরে শেষ রাতে যারা নিজেদের বিক্রি করতে আসেন দিনমজুর হিসেবে দিন শেষ যখন সামান্য মজুরি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তখন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়। অথবা যাদের ভগ্ন স্বাস্থ্যে কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অবিক্রি থেকে যান তারা কী মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে জীবন-যাপন করেন। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের নারীকর্মী, ওষুধ শিল্পের শ্রমিক, আমাদের কৃষক যারা বৈশ্বিক মহামারিগুলোর ভেতর সকাল সন্ধ্যা বিরামহীন পরিশ্রম করে আমাদের কাঁচাবাজারে প্রয়োজনীয় ফসলের অভাব বোধ করতে দেননি, তাদের একটি সকাল, সন্ধ্যা কী আমাদের মনোয়ন প্রত্যাশী কিংবা মনোনীতরা কখনো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
জনগণের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া কে বন্ধ করে দিয়ে, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করতে চাচ্ছি। এই যে সকলেই অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন চাচ্ছেন, তারা কী জনসংলাপের মাধ্যমে জনগণের সমস্যা বের করে নিয়ে এসেছেন। আমাদের জানামতে শোডাউন করার জন্য মজুরি দিয়ে কিনে আনা জনগণ দিয়ে বড় বড় মহাসমাবেশ ছাড়া সরাসরি কোন জন সংলাপের আমাদের কাছে নেই। ক্ষমতার জন্য নাকি কান্না আমরা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ণের কর্মসূচির কথা শুনতে পাইনি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সকল কর্মসূচির মূল কথা হলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। স্থিতাবস্থার মধ্যে থাকার মধ্যে এক ধরনের সুখ আছে। নীরবতা আছে, কৃত্রিম সন্তুষ্টি আছে, যেখানে সাধারণের নেতৃত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা নেই। সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেদের চিত্তের উন্নয়ন না করে বিত্তের উন্নয়ন ঘটানো যায় নির্বিবাদে। তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বলে না কোন দল। সব রাজনৈতিক দলের সব কর্মসূচির মূল কথা হলো- নির্বাচনী প্রক্রিয়া এমন হবে যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দল সেফ ল্যান্ডিং কিংবা নিরাপদে জয়লাভ করতে পারবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না করে, জনগণকে রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়ে আসতে না পারলে শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের মতো স্বচ্ছ করে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমরা রাষ্ট্রকে দেখতে চাই প্রকৃত অর্থে গণপ্রজাতন্ত্রী। রাষ্ট্রের মালিকানা যখন কিছু মানুষের হাত থেকে অধিকাংশ মানুষের হাতে অর্পিত হবে তখন প্রকৃত অর্থে মানুষের ক্ষমতায়ন সংঘটিত হবে। ধোঁয়াশার মধ্যে বহমান শোষণ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে না পারলে বৈষম্যের বাংলাদেশ সামান্যসংখ্যক মানুষের অধীনে চলে যাবে। আমার যারা নিজেদের প্রান্তিক, সাধারণ মানুষের পক্ষের শক্তি ভাবি-আমরা কি তা চাই?
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক ]