alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

ভুটান-ভারতের স্বীকৃতি

সাদেকুর রহমান

: বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর (২০ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ) ছিল সোমবার। এ দিনটি ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালির জন্য খুবই সুখের একটি দিন। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবল আরো বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর (বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিপ্যাড হিসেবে ব্যবহার হয়) অকেজো হওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলটরা তৃতীয় দেশের সাহায্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

এদিন বেলা এগারোটার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ থেকে ঘোষণা করা হলো- ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। এর সূত্র ধরে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) ও আজাদের (অধুনালুপ্ত) খবর অনুযায়ী, এদিন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে ‘বৈধ সরকার’ বলেও ঘোষণা দেন। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেওয়া এক চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী তার এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তার আগেই ভুটানের রাজা মি. জিগমে ওয়ানচুক বাংলাদেশের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেন।

প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ নিয়ে বহু বছর বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে স্পষ্ট করা হয়েছে, ভুটানই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি তারবার্তার মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী মি. শেরিং তোবগে। তাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর পর ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠায়।’

একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের ওই তারবার্তায় দেশটির তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’

পাকিস্তান সরকারের আমলা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে সেদিন ভারত সরকারের তৎপরতার কথা স্মরণ করেন এভাবে- ‘৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা কয়েকজন সচিব ও কর্মকর্তা ভারতীয় উচ্চপর্যায়ের সফরকারী দলের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। ভারতীয় দলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। বৈঠক চলার সময়েই লক্ষ্য করলাম চারদিকে একটা চাঞ্চল্য। পাশের ঘরে রেডিও শোনা যাচ্ছে। গভীর আগ্রহের সাথে ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তা রেডিও শুনছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ভাষণ দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস গান্ধীর দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে এল। ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনি আর করতালি দিয়ে সকলে সংবাদটিকে স্বাগত জানালেন। ... বিকাল ৪টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হলো কয়েক ঘণ্টার নোটিশে। আলোচ্য বিষয় : ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং রণক্ষেত্রে অগ্রগতি।’ (আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ : অক্টোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩২৪-৩২৫)

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এদিনের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে এভাবে- ‘নিয়াজীর নির্দেশে পাকবাহিনী বেসামাল হয়ে পড়ে। এগোনো অসম্ভব, পিছু হটা আরও অসম্ভব। ময়নামতি, জামালপুর, হিলি, চট্টগ্রামে ওরা যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়ে গেল কিন্তু সিলেট এবং যশোরের ঘাঁটি ছেড়ে পালাল। মিত্রবাহিনী একই চেষ্টা করছে যাতে পাকবাহিনী কোথাও জড়ো হতে না পারে। এরই মধ্যে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তুমুল করতালির মধ্যে সংসদে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করলেন। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ বিপুলভাবে মিত্রবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। একজন অধ্যাপক টিনের বহর মাথায় নিয়ে গেছেন তিন মাইল, মহিলারা পর্যন্ত ব্রিজ তৈরিতে সাহায্য করেছেন।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর একটি তথ্যবহুল ও বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম ‘নিউজউইক’। ওই নিবন্ধে বলা হয়- ‘এই সংঘাত ঠেকাতে বৃহৎ শক্তিগুলো কোন তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিচ্ছে না। চারশ কোটি ডলার খরচ করে ওয়াশিংটন ইয়াহিয়াকে রক্ষার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না।’

এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় বলেন, ‘আমাদের বাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। শত্রুকে পছন্দমত জায়গায় এনে আক্রমণ করাই আমাদের লক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি এলাকা দখল করেছে এ দাবি শুধু ভিত্তিহীনই নয়, হাস্যকরও বটে! বরং শত্রুকে ঢুকতে দেওয়া আমাদের যুদ্ধকৌশলেরই একটা অংশ।’

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমিন সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘স্বাভাবিক এবং সময়োপযোগী’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ভারত ‘অস্তিত্বহীন বাংলাদেশ’ নিয়ে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মেতেছে। ভারতীয় হামলা প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীর সাফল্য কামনা করে ৭ ডিসেম্বর বিশেষ মোনাজাত করার জন্য গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে এদিন প্রথম কোনো জেলা শহর হিসেবে যশোর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। এর দুদিন পর ৮ ডিসেম্বর যশোর শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় মুক্তিবাহিনী। ১১ ডিসেম্বর স্থানীয় টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, যশোরের এমপিএ অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘যশোর গেজেটিয়ার’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘৬ তারিখ সন্ধ্যা হতে না হতেই পাকবাহিনীর সবাই যশোর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ আট নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর ও মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিং যশোরে প্রবেশ করেন। তখনো তারা জানতেন না যে, যশোর ক্যান্টনমেন্ট শূন্য। তারা বিস্মিত হন কোনো প্রতিরোধ না দেখে।’

এদিন বিকেলে শত্রুমুক্ত হয় তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমা (বর্তমানে জেলা)। এছাড়াও একাত্তরের এদিনে ফেনী, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ও কঠোর প্রতিরোধে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। হানাদারদের হটিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয় এসব এলাকায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি (Bottomless Basket)’ বলেছেন কিনা- এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার শলাপরামর্শেই তৎকালীন নিক্সন-সরকার স্বাধীনতাকামী বাঙালির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেই বিষয়ে সমসাময়িক ইতিহাস লেখক ও গবেষকদের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায় না। একই সাথে বেশিরভাগ তথ্য প্রমাণ নির্দেশ করে যে, কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বাংলাদেশকে পরোক্ষভাবে ‘বাস্কেট কেইস (Basket Case)’ বলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ইউএসএইড (USAID)-এর সহকারী প্রশাসক মরিস জে. উইলিয়ামসের সাথে এক কথোপকথনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো ‘বাস্কেট কেইজ’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়। ‘বাস্কেট-কেইস’ শব্দটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রচলিত হয়। এটি একটি সামরিক অপভাষা। যেসব সৈন্য যুদ্ধে তাদের চারটি হাত-পা-ই হারিয়েছে তাদের ‘বাস্কেট কেইস’ বলে অভিহিত করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এরকম আহত সৈনিকরা পুরোপুরি পরনির্ভরশীল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন করুণ ছিল যে কিসিঞ্জার হয়তো ভেবেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে আর স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব ছিল না। তবে শতবর্ষী কিসিঞ্জার গত ২৯ নভেম্বর মারা যাওয়ার আগে এক বিস্ময়কর বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছিলেন।

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

ভুটান-ভারতের স্বীকৃতি

সাদেকুর রহমান

বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর (২০ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ) ছিল সোমবার। এ দিনটি ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালির জন্য খুবই সুখের একটি দিন। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবল আরো বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর (বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিপ্যাড হিসেবে ব্যবহার হয়) অকেজো হওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলটরা তৃতীয় দেশের সাহায্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

এদিন বেলা এগারোটার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ থেকে ঘোষণা করা হলো- ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। এর সূত্র ধরে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) ও আজাদের (অধুনালুপ্ত) খবর অনুযায়ী, এদিন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে ‘বৈধ সরকার’ বলেও ঘোষণা দেন। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেওয়া এক চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী তার এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তার আগেই ভুটানের রাজা মি. জিগমে ওয়ানচুক বাংলাদেশের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেন।

প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ নিয়ে বহু বছর বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে স্পষ্ট করা হয়েছে, ভুটানই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি তারবার্তার মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী মি. শেরিং তোবগে। তাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর পর ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠায়।’

একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের ওই তারবার্তায় দেশটির তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’

পাকিস্তান সরকারের আমলা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে সেদিন ভারত সরকারের তৎপরতার কথা স্মরণ করেন এভাবে- ‘৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা কয়েকজন সচিব ও কর্মকর্তা ভারতীয় উচ্চপর্যায়ের সফরকারী দলের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। ভারতীয় দলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। বৈঠক চলার সময়েই লক্ষ্য করলাম চারদিকে একটা চাঞ্চল্য। পাশের ঘরে রেডিও শোনা যাচ্ছে। গভীর আগ্রহের সাথে ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তা রেডিও শুনছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ভাষণ দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস গান্ধীর দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে এল। ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনি আর করতালি দিয়ে সকলে সংবাদটিকে স্বাগত জানালেন। ... বিকাল ৪টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হলো কয়েক ঘণ্টার নোটিশে। আলোচ্য বিষয় : ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং রণক্ষেত্রে অগ্রগতি।’ (আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ : অক্টোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩২৪-৩২৫)

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এদিনের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে এভাবে- ‘নিয়াজীর নির্দেশে পাকবাহিনী বেসামাল হয়ে পড়ে। এগোনো অসম্ভব, পিছু হটা আরও অসম্ভব। ময়নামতি, জামালপুর, হিলি, চট্টগ্রামে ওরা যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়ে গেল কিন্তু সিলেট এবং যশোরের ঘাঁটি ছেড়ে পালাল। মিত্রবাহিনী একই চেষ্টা করছে যাতে পাকবাহিনী কোথাও জড়ো হতে না পারে। এরই মধ্যে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তুমুল করতালির মধ্যে সংসদে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করলেন। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ বিপুলভাবে মিত্রবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। একজন অধ্যাপক টিনের বহর মাথায় নিয়ে গেছেন তিন মাইল, মহিলারা পর্যন্ত ব্রিজ তৈরিতে সাহায্য করেছেন।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর একটি তথ্যবহুল ও বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম ‘নিউজউইক’। ওই নিবন্ধে বলা হয়- ‘এই সংঘাত ঠেকাতে বৃহৎ শক্তিগুলো কোন তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিচ্ছে না। চারশ কোটি ডলার খরচ করে ওয়াশিংটন ইয়াহিয়াকে রক্ষার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না।’

এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় বলেন, ‘আমাদের বাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। শত্রুকে পছন্দমত জায়গায় এনে আক্রমণ করাই আমাদের লক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি এলাকা দখল করেছে এ দাবি শুধু ভিত্তিহীনই নয়, হাস্যকরও বটে! বরং শত্রুকে ঢুকতে দেওয়া আমাদের যুদ্ধকৌশলেরই একটা অংশ।’

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমিন সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘স্বাভাবিক এবং সময়োপযোগী’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ভারত ‘অস্তিত্বহীন বাংলাদেশ’ নিয়ে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মেতেছে। ভারতীয় হামলা প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীর সাফল্য কামনা করে ৭ ডিসেম্বর বিশেষ মোনাজাত করার জন্য গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে এদিন প্রথম কোনো জেলা শহর হিসেবে যশোর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। এর দুদিন পর ৮ ডিসেম্বর যশোর শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় মুক্তিবাহিনী। ১১ ডিসেম্বর স্থানীয় টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, যশোরের এমপিএ অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘যশোর গেজেটিয়ার’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘৬ তারিখ সন্ধ্যা হতে না হতেই পাকবাহিনীর সবাই যশোর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ আট নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর ও মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিং যশোরে প্রবেশ করেন। তখনো তারা জানতেন না যে, যশোর ক্যান্টনমেন্ট শূন্য। তারা বিস্মিত হন কোনো প্রতিরোধ না দেখে।’

এদিন বিকেলে শত্রুমুক্ত হয় তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমা (বর্তমানে জেলা)। এছাড়াও একাত্তরের এদিনে ফেনী, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ও কঠোর প্রতিরোধে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। হানাদারদের হটিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয় এসব এলাকায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি (Bottomless Basket)’ বলেছেন কিনা- এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার শলাপরামর্শেই তৎকালীন নিক্সন-সরকার স্বাধীনতাকামী বাঙালির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেই বিষয়ে সমসাময়িক ইতিহাস লেখক ও গবেষকদের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায় না। একই সাথে বেশিরভাগ তথ্য প্রমাণ নির্দেশ করে যে, কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বাংলাদেশকে পরোক্ষভাবে ‘বাস্কেট কেইস (Basket Case)’ বলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ইউএসএইড (USAID)-এর সহকারী প্রশাসক মরিস জে. উইলিয়ামসের সাথে এক কথোপকথনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো ‘বাস্কেট কেইজ’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়। ‘বাস্কেট-কেইস’ শব্দটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রচলিত হয়। এটি একটি সামরিক অপভাষা। যেসব সৈন্য যুদ্ধে তাদের চারটি হাত-পা-ই হারিয়েছে তাদের ‘বাস্কেট কেইস’ বলে অভিহিত করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এরকম আহত সৈনিকরা পুরোপুরি পরনির্ভরশীল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন করুণ ছিল যে কিসিঞ্জার হয়তো ভেবেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে আর স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব ছিল না। তবে শতবর্ষী কিসিঞ্জার গত ২৯ নভেম্বর মারা যাওয়ার আগে এক বিস্ময়কর বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছিলেন।

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

back to top