রেজাউল করিম খোকন
২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এক সময়ে দরিদ্রপীড়িত, খরা, মঙ্গা, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত- বিপর্যস্ত জনপদের দেশ হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি ছিল বাংলাদেশের; কিন্তু গত কয়েক দশকের পথপরিক্রমায় এ দেশের মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত গোটা বিশ্বে।
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া। মাথাপিছু কম জমি নিয়ে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করতে পারেনি। এজন্য আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। একটি বিষয় সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে- আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে।
জনবহুল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হন তাহলে সেদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। আমরা আমাদের জনসম্পদকে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে কাজে লাগাই না কেন, তা আমাদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন বার্তা বয়ে আনবে। অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করবে। বাংলাদেশে সমস্যা যেমন বেশি, তেমনি সেগুলোর সমাধানও প্রয়োজন। আর সেখানেই স্টার্টআপের সুযোগ।
স্টার্টআপ হচ্ছে এমন কোনো নতুন উদ্যোগ, যারা একেবারেই নতুন ধরনের (ইউনিক) পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে কাজ করে। যে পণ্য বা পরিষেবার বাজার আছে এবং যার বিকল্প নেই। স্টার্টআপের উদ্যোক্তারা এমন ভাবনা নিয়ে আসে, যার সমাজে চাহিদা আছে কিন্তু জোগান নেই। অর্থাৎ হ্যালো টাস্কের মতোই। শহুরে জীবনে গৃহকর্মীর সহায়তা সবারই প্রয়োজন। এর বিকল্প নেই। তাই অ্যাপের মাধ্যমে ডাকলেই এখন চাহিদা অনুযায়ী গৃহকর্মী হাজির হবে হ্যালো টাস্ক। এক কথায় বলা যায়, স্টার্টআপ হচ্ছে সমাজের প্রচলিত সমস্যার সমাধানভিত্তিক ব্যবসা। বিশ্বব্যাপীই স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশের স্টার্টআপেও তার প্রভাব পড়ছে। তাই এখনই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের সময়।
দেশের উঠতি পর্যায়ের স্টার্টআপ হ্যালো টাস্ক এখন পর্যন্ত এক মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে। যার বেশির ভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে। তারা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের চাকরির প্ল্যাটফর্ম হতে চায়। যেখানে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও তাদের প্রযুক্তিগতভাবে সংযুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পাশাপাশি মানুষও নির্বিঘ্নে সেবা পাবে।
ফোর্বসের বর্ষসেরা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশি দূরশিক্ষণ অ্যাপ শিখো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পুঁজি বিষয়ক বিশ্বখ্যাত এ সাময়িকীর মতে, এ বছর এশিয়ার সেরা একশো স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিখো। ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ক্ষুদ্র কোম্পানি ও স্টার্টআপ নতুন ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃজনশীল পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানে কাজ করে চলেছে, ‘এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ ২০২২’ তালিকায় সেসব কোম্পানিকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপের যে উত্থান ঘটেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরাও যুগোপযোগী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারাবিশ্বে দেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকে স্টার্টআপের ধারণা বিস্তৃত হতে থাকে। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইট ক্যাসল পার্টনারের গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেশের স্টার্টআপের পরিস্থিতি জানা যায়। সেখানে বলা হয়, দেশে এখন ১ হাজার ২০০-এর বেশি সচল স্টার্টআপ আছে। ২০২১ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫০৫ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ৩০২ কোটি টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে, যার মধ্যে ৪৯৮ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা) ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৮০৪ মিলিয়ন ডলারের (৮ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা) বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে ২৩২টি চুক্তি থেকে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসেই এসেছে ৯০ মিলিয়ন ডলার (৯৪৫ কোটি টাকা) বিনিয়োগ। বাংলাদেশে স্টার্টআপে ২০২০ থেকে ২০২১ সালে ১০ গুণ বিনিয়োগ বেড়েছে। স্টার্টআপে যেসব বিনিয়োগ আসছে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ। স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে ফিনটেকে (আর্থিক প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান)। এরপর লজিস্টিক ও মোবিলিটিতে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ই-কমার্স ও রিটেইলে প্রায় ৬ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাত আড়াই শতাংশ, কনজ্যুমার সেবায় ২ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং সফটওয়্যার ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ এসেছে।
আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে। একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতোপূর্বে ছিল না কিংবা কেউ করেনি
বাংলাদেশে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটি প্রায়ই ‘নতুন উদ্যোগ’-এর একটা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। যদিও অনুবাদ করলে স্টার্টআপের অর্থ দাঁড়ায় নতুন ব্যবসা। ধরে নেয়া যেতে পারে, সব স্টার্টআপই নতুন উদ্যোগ, তবে সব নতুন উদ্যোগ যে স্টার্টআপ, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। যেকোনো নতুন উদ্যোগ হয় স্টার্টআপ, নয়তো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমই। তবে উদ্যোগটা স্টার্টআপ নাকি একটি এসএমই-এই চিন্তাধারাই প্রভাবিত করবে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়িক বিকাশ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদনের যোগ্যতা।
এসএমই এবং স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো একটা এসএমই যা ১০ বছরে করে, একটা স্টার্টআপ সেটা ১ বছরে, অথবা তারও কমে করার স্বপ্ন দেখে। যেকোনো স্টার্টআপ থেকে বিনিয়োগকারীরা সবার আগে যা আশা করে, তা হলো ব্যবসা প্রসার করতে পারার সম্ভাবনা। সে জন্য সবার আগেই প্রয়োজন, একটা বড় বাজার বা মার্কেট নিয়ে কাজ করা। বড় অর্থাৎ শুধু কতজন গ্রাহক আছেন তা নয়, বরং মোট কত টাকার ব্যবসা করা সম্ভব সেটা। কোন কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা থেকে নিজের কোন বিজনেস আইডিয়া থেকে কিছু শুরু করাকেই বলা যেতে পারে স্টার্টআপ। প্রতিটি স্টার্টআপের সহজ বাংলা ভাষায় উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতাকে বলা হয় একেকজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইন্টারপ্রেনিওর। আর এই ইন্টারপ্রেনিওর তথা ইন্টারপ্রেনিওরশিপ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বেশি পরিচিত।
একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতোপূর্বে ছিল না কিংবা কেউ করেনি। স্টার্টআপ যে এমন হতে হবে কেউ আগে কখনো করেনি, এমনও কিন্তু নয়। স্টার্টআপগুলো এমনও হতে পারে যে, সেই ধারনাগুলো ইতোপূর্বেও ছিল, তবে সেটিকে নতুন ধাচে ভিন্ন কোন উপায়ে শুরু করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কোন স্টার্টআপ খুব অল্প সময়ে বিকশিত হয়ে সেটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। ফেসবুক যখন মার্ক জাকারবার্গ শুরু করেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি ভাবেননি ফেসবুক এত বড় পরিমাণে সম্প্রসারিত হবে। তবে আজ আমরা দেখছি যে, মার্ক জাকারবার্গ এই স্টার্টআপ পৃথিবীর অন্যতম বড় আইটি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর ফেসবুক (বর্তমান মেটা) হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট।
টাকার জন্য অপেক্ষা কিংবা যাতায়াত খরচের ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর চেয়ে মুহূর্তেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে। ক্রমান্বয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এখন দেশের মানুষের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ দেশের প্রথম সফল স্টার্টআপ। এরপর একে একে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান উঠে আসে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজের লোক খোঁজা- সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়। সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে আসছেন। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে তাই ১০ গুণ বেড়েছে স্টার্টআপ বিনিয়োগ।
স্টার্টআপ ফার্ম মানে কিন্তু এমন নয় যে, ১০০টা শুরু করলে ১০০টাই দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের যদি ১০-২০ শতাংশ সফল হয় তাহলেও কিন্তু অনেক। আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ বয়সী ছেলে মেয়েরা অসাধারণ মেধাবী। তাদের মধ্যে নিত্যনতুন আইডিয়া, নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের অসাধারণ চিন্তাভাবনা রয়েছে। এক সময় এ খাত গার্মেন্টসকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতে পারি। আইসিটি ডিভিশনের পাশাপাশি বিডা থেকেও এদের নিয়ে ভাবা জরুরি। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এক সময়ে দরিদ্রপীড়িত, খরা, মঙ্গা, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত- বিপর্যস্ত জনপদের দেশ হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি ছিল বাংলাদেশের; কিন্তু গত কয়েক দশকের পথপরিক্রমায় এ দেশের মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত গোটা বিশ্বে।
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া। মাথাপিছু কম জমি নিয়ে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করতে পারেনি। এজন্য আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। একটি বিষয় সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে- আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে।
জনবহুল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হন তাহলে সেদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। আমরা আমাদের জনসম্পদকে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে কাজে লাগাই না কেন, তা আমাদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন বার্তা বয়ে আনবে। অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করবে। বাংলাদেশে সমস্যা যেমন বেশি, তেমনি সেগুলোর সমাধানও প্রয়োজন। আর সেখানেই স্টার্টআপের সুযোগ।
স্টার্টআপ হচ্ছে এমন কোনো নতুন উদ্যোগ, যারা একেবারেই নতুন ধরনের (ইউনিক) পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে কাজ করে। যে পণ্য বা পরিষেবার বাজার আছে এবং যার বিকল্প নেই। স্টার্টআপের উদ্যোক্তারা এমন ভাবনা নিয়ে আসে, যার সমাজে চাহিদা আছে কিন্তু জোগান নেই। অর্থাৎ হ্যালো টাস্কের মতোই। শহুরে জীবনে গৃহকর্মীর সহায়তা সবারই প্রয়োজন। এর বিকল্প নেই। তাই অ্যাপের মাধ্যমে ডাকলেই এখন চাহিদা অনুযায়ী গৃহকর্মী হাজির হবে হ্যালো টাস্ক। এক কথায় বলা যায়, স্টার্টআপ হচ্ছে সমাজের প্রচলিত সমস্যার সমাধানভিত্তিক ব্যবসা। বিশ্বব্যাপীই স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশের স্টার্টআপেও তার প্রভাব পড়ছে। তাই এখনই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের সময়।
দেশের উঠতি পর্যায়ের স্টার্টআপ হ্যালো টাস্ক এখন পর্যন্ত এক মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে। যার বেশির ভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে। তারা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের চাকরির প্ল্যাটফর্ম হতে চায়। যেখানে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও তাদের প্রযুক্তিগতভাবে সংযুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পাশাপাশি মানুষও নির্বিঘ্নে সেবা পাবে।
ফোর্বসের বর্ষসেরা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশি দূরশিক্ষণ অ্যাপ শিখো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পুঁজি বিষয়ক বিশ্বখ্যাত এ সাময়িকীর মতে, এ বছর এশিয়ার সেরা একশো স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিখো। ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ক্ষুদ্র কোম্পানি ও স্টার্টআপ নতুন ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃজনশীল পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানে কাজ করে চলেছে, ‘এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ ২০২২’ তালিকায় সেসব কোম্পানিকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপের যে উত্থান ঘটেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরাও যুগোপযোগী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারাবিশ্বে দেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকে স্টার্টআপের ধারণা বিস্তৃত হতে থাকে। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইট ক্যাসল পার্টনারের গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেশের স্টার্টআপের পরিস্থিতি জানা যায়। সেখানে বলা হয়, দেশে এখন ১ হাজার ২০০-এর বেশি সচল স্টার্টআপ আছে। ২০২১ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫০৫ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ৩০২ কোটি টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে, যার মধ্যে ৪৯৮ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা) ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৮০৪ মিলিয়ন ডলারের (৮ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা) বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে ২৩২টি চুক্তি থেকে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসেই এসেছে ৯০ মিলিয়ন ডলার (৯৪৫ কোটি টাকা) বিনিয়োগ। বাংলাদেশে স্টার্টআপে ২০২০ থেকে ২০২১ সালে ১০ গুণ বিনিয়োগ বেড়েছে। স্টার্টআপে যেসব বিনিয়োগ আসছে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ। স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে ফিনটেকে (আর্থিক প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান)। এরপর লজিস্টিক ও মোবিলিটিতে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ই-কমার্স ও রিটেইলে প্রায় ৬ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাত আড়াই শতাংশ, কনজ্যুমার সেবায় ২ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং সফটওয়্যার ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ এসেছে।
আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে। একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতোপূর্বে ছিল না কিংবা কেউ করেনি
বাংলাদেশে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটি প্রায়ই ‘নতুন উদ্যোগ’-এর একটা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। যদিও অনুবাদ করলে স্টার্টআপের অর্থ দাঁড়ায় নতুন ব্যবসা। ধরে নেয়া যেতে পারে, সব স্টার্টআপই নতুন উদ্যোগ, তবে সব নতুন উদ্যোগ যে স্টার্টআপ, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। যেকোনো নতুন উদ্যোগ হয় স্টার্টআপ, নয়তো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমই। তবে উদ্যোগটা স্টার্টআপ নাকি একটি এসএমই-এই চিন্তাধারাই প্রভাবিত করবে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়িক বিকাশ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদনের যোগ্যতা।
এসএমই এবং স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো একটা এসএমই যা ১০ বছরে করে, একটা স্টার্টআপ সেটা ১ বছরে, অথবা তারও কমে করার স্বপ্ন দেখে। যেকোনো স্টার্টআপ থেকে বিনিয়োগকারীরা সবার আগে যা আশা করে, তা হলো ব্যবসা প্রসার করতে পারার সম্ভাবনা। সে জন্য সবার আগেই প্রয়োজন, একটা বড় বাজার বা মার্কেট নিয়ে কাজ করা। বড় অর্থাৎ শুধু কতজন গ্রাহক আছেন তা নয়, বরং মোট কত টাকার ব্যবসা করা সম্ভব সেটা। কোন কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা থেকে নিজের কোন বিজনেস আইডিয়া থেকে কিছু শুরু করাকেই বলা যেতে পারে স্টার্টআপ। প্রতিটি স্টার্টআপের সহজ বাংলা ভাষায় উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতাকে বলা হয় একেকজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইন্টারপ্রেনিওর। আর এই ইন্টারপ্রেনিওর তথা ইন্টারপ্রেনিওরশিপ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বেশি পরিচিত।
একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতোপূর্বে ছিল না কিংবা কেউ করেনি। স্টার্টআপ যে এমন হতে হবে কেউ আগে কখনো করেনি, এমনও কিন্তু নয়। স্টার্টআপগুলো এমনও হতে পারে যে, সেই ধারনাগুলো ইতোপূর্বেও ছিল, তবে সেটিকে নতুন ধাচে ভিন্ন কোন উপায়ে শুরু করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কোন স্টার্টআপ খুব অল্প সময়ে বিকশিত হয়ে সেটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। ফেসবুক যখন মার্ক জাকারবার্গ শুরু করেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি ভাবেননি ফেসবুক এত বড় পরিমাণে সম্প্রসারিত হবে। তবে আজ আমরা দেখছি যে, মার্ক জাকারবার্গ এই স্টার্টআপ পৃথিবীর অন্যতম বড় আইটি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর ফেসবুক (বর্তমান মেটা) হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট।
টাকার জন্য অপেক্ষা কিংবা যাতায়াত খরচের ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর চেয়ে মুহূর্তেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে। ক্রমান্বয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এখন দেশের মানুষের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ দেশের প্রথম সফল স্টার্টআপ। এরপর একে একে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান উঠে আসে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজের লোক খোঁজা- সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়। সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে আসছেন। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে তাই ১০ গুণ বেড়েছে স্টার্টআপ বিনিয়োগ।
স্টার্টআপ ফার্ম মানে কিন্তু এমন নয় যে, ১০০টা শুরু করলে ১০০টাই দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের যদি ১০-২০ শতাংশ সফল হয় তাহলেও কিন্তু অনেক। আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ বয়সী ছেলে মেয়েরা অসাধারণ মেধাবী। তাদের মধ্যে নিত্যনতুন আইডিয়া, নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের অসাধারণ চিন্তাভাবনা রয়েছে। এক সময় এ খাত গার্মেন্টসকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতে পারি। আইসিটি ডিভিশনের পাশাপাশি বিডা থেকেও এদের নিয়ে ভাবা জরুরি। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]