বিজয়ের মাস
সাদেকুর রহমান
লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই রচিত হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধ জয়ের অমরগাথা। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- মেঘনা তীরবর্তী জনপদগুলোর মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া ফেডারেশন) হুমকিতে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের যাত্রা থমকে যাওয়া।
এদিন বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এখন ঢাকা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আছি।’ এর আগেই চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে।
আর ভারতীয় সেনাবহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো, নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’
এদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মার্কিন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার (গত ২৯ নভেম্বর মারা যান) তাকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিতে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল এই সপ্তম নৌবহর আসার কথা শুনে যৌথবাহিনীর মনোবল ভেঙে যাবে; কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই কথা জেনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
সেদিন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র, তৎকালীন বিশ্বের আরেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু হওয়ার পরই থেমে যায়। এই শক্তিশালী নৌবহরের গঠন ছিল বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌসেনা অবতরণ করা।
মার্কিন নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সপ্তম নৌবহর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল ভূখন্ডের বাইরে সবচেয়ে বড় নৌবহর। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের একটি অংশ। ১৯৪৩ সালের ১৫ মার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে প্রথম সপ্তম নৌবহর তৈরি করা হয়। বর্তমানে এর গ্যারিসন ঘাঁটি জাপানের ইয়োকোসুকা। এই নৌবহরের অধীনে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি যুদ্ধ জাহাজ, ২০০-৩০০টি যুদ্ধ বিমান ও প্রায় ৪০ হাজার নৌসেনা। ১৯৭১ সালে নিক্সন-সরকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালায়। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারনে সপ্তম নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজ ভিয়েতনামের কাছাকাছি ছিল।
এদিন জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানি দলের নেতা মাহমুদ আলী দেশে ফিরে এসে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিত বিশ্ব শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো। চীন ও আমেরিকার সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’
ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক বসে এদিন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের উক্ত যৌথ বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী কোনো এক এলাকায় ৭শ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
এদিন চাঁদপুর ও কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকা হানাদার মুক্ত করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় মেঘনা তীরের অঞ্চলগুলো মুক্তির প্রক্রিয়া। দিন না পার হতেই মেঘনার পুরো পূর্বাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রু মুক্ত হয়। দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
এদিকে ৯ ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি ‘মালিক-ফরমান আলী বার্তা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। মূলত এই বার্তার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহবান করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমাবর্ষণের কারণে গভর্নর ডা. মালিকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হতে থাকে।
[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]
বিজয়ের মাস
সাদেকুর রহমান
শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই রচিত হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধ জয়ের অমরগাথা। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- মেঘনা তীরবর্তী জনপদগুলোর মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া ফেডারেশন) হুমকিতে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের যাত্রা থমকে যাওয়া।
এদিন বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এখন ঢাকা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আছি।’ এর আগেই চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে।
আর ভারতীয় সেনাবহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো, নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’
এদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মার্কিন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার (গত ২৯ নভেম্বর মারা যান) তাকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিতে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল এই সপ্তম নৌবহর আসার কথা শুনে যৌথবাহিনীর মনোবল ভেঙে যাবে; কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই কথা জেনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
সেদিন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র, তৎকালীন বিশ্বের আরেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু হওয়ার পরই থেমে যায়। এই শক্তিশালী নৌবহরের গঠন ছিল বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌসেনা অবতরণ করা।
মার্কিন নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সপ্তম নৌবহর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল ভূখন্ডের বাইরে সবচেয়ে বড় নৌবহর। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের একটি অংশ। ১৯৪৩ সালের ১৫ মার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে প্রথম সপ্তম নৌবহর তৈরি করা হয়। বর্তমানে এর গ্যারিসন ঘাঁটি জাপানের ইয়োকোসুকা। এই নৌবহরের অধীনে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি যুদ্ধ জাহাজ, ২০০-৩০০টি যুদ্ধ বিমান ও প্রায় ৪০ হাজার নৌসেনা। ১৯৭১ সালে নিক্সন-সরকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালায়। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারনে সপ্তম নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজ ভিয়েতনামের কাছাকাছি ছিল।
এদিন জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানি দলের নেতা মাহমুদ আলী দেশে ফিরে এসে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিত বিশ্ব শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো। চীন ও আমেরিকার সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’
ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক বসে এদিন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের উক্ত যৌথ বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী কোনো এক এলাকায় ৭শ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
এদিন চাঁদপুর ও কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকা হানাদার মুক্ত করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় মেঘনা তীরের অঞ্চলগুলো মুক্তির প্রক্রিয়া। দিন না পার হতেই মেঘনার পুরো পূর্বাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রু মুক্ত হয়। দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
এদিকে ৯ ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি ‘মালিক-ফরমান আলী বার্তা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। মূলত এই বার্তার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহবান করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমাবর্ষণের কারণে গভর্নর ডা. মালিকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হতে থাকে।
[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]