alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

সাদেকুর রহমান

: রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

১৯৭১ সালে প্রচলিত গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিকার পাতায় ১১ ডিসেম্বর ছিল শনিবার। এ দিন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এদিকে এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা (তৎকালীন তেজগাঁও) বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশেষ গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডের সর্বশেষ প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে ১১ ডিসেম্বরের প্রধান প্রধান ঘটনা আলোকপাত করেছেন এভাবে- ‘(ক) পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে তারবার্তা প্রেরণ। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এই সংবাদের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং জাতিসংঘে অবস্থানকারী প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক এই আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। (খ) বগুড়া ও ময়মনসিংহ এলাকা মুক্ত ঘোষণা। (গ) ঢাকার অদূরে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর প্যারাস্যুটের মাধ্যমে অবতরণ। রাজশাহী, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ মুক্ত ঘোষণা। (ঘ) মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের গুজব প্রচার।’ (আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ : অক্টোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩২৮)

প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন যশোর গেলেন সরেজমিন পরিদর্শন করতে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর সফর এই প্রথম। এর আগেও গেছেন মুক্তাঞ্চলে, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সন্তর্পণে এবং যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়ে। এবারের পরিদর্শন বিজয়ীর বেশে এবং প্রকাশ্যে। ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখার মতো! সকলেই উল্লসিত। মুক্ত যশোরে টাউন হল ময়দানের জনসভায় প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো- (১) বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দিদের বিচার করবে। (২) ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি, দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। (৩) সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। (৪) জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামী ইসলামী এ চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হবে।

এদিনই বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবো, যা চব্বিশ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।’

গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে।

জামালপুর থেকে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। সম্মিলিত বাহিনীর এই অংশটিই প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনায় এই দলের ভূমিকা ছিল প্রধান। জামালপুর পতনের পর টাঙ্গাইলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা শহর ছাড়তে শুরু করে।

ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে চারিদিক থেকে ট্যাংকসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তিসেনারা এগিয়ে আসছিল। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর পড়ছিল সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে উড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন মুক্তিবাহিনীর বীর ক্র্যাক প্লাটুন সকাল ১০টায় তোপখানা রোডের মার্কিন তথ্যকেন্দ্র (বর্তমান সিরডাপ ভবন) অভ্যন্তরে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলারা সারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি। ঢাকার চারপাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রীসেনা অবতরণ করায়।

এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় কোনো হামলা চালায়নি। বিদেশি যাত্রীদের সুবিধার্থে ঢাকা (অধুনালুপ্ত তেজগাঁও) বিমানবন্দরে মেরামত ও যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। খানসেনাদের ওপর ঢাকা ত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এমএ মালিক জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি; কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এ আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। খানসেনাদের সামনে একটি উপায় ছিল আত্মসমর্পণ করা।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিকের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকচ করে দেন। ‘পাকিস্তানের তাঁবেদার’ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক মিজ ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লেখা রিপোর্টে উল্লেখ করেন, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। শর্তগুলো হচ্ছে- ১. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত যেতে দিতে হবে। ৪. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে দিতে হবে। ৫. সত্তরের (১৯৭০) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।

এদিন তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক ড. হেনরি কিসিঞ্জার (গত ২৯ নভেম্বর শতবর্ষী এ কূটনীতিকের জীবনাবসান ঘটে) ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত (বর্তমান রাশিয়া ফেডারেশন) প্রতিনিধি ভোরেন্ডসভকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুঁশিয়ারি সামান্যতম মনোবল ভাঙতে পারেনি মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানীদের।

একাত্তরের এদিন (১১ ডিসেম্বর) জেনারেল এ কে নিয়াজী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একই সাথে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান বিধ্বংসী যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল সেটিও পরিদর্শন করেন তিনি। সেই সময় জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। নিজের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে তখনকার ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন সিদ্দিক সালিক। তিনি বইটিতে এদিনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন- ‘নিয়াজী যখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলেন তখন ছয়-সাতজন নার্স এসে জেনারেল নিয়াজীকে তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেন।

ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ থেকেই ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরালো আক্রমণ শুরু হয়। নার্সরা জেনারেল নিয়াজীকে বললেন যে, তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীত। তিনি নার্সদের আশ্বস্ত করলেন, বড় ধরনের বিদেশি সাহায্য আসছে এবং চিন্তার কোন কারণ নেই। জেনারেল নিয়াজী নার্সদের বললেন, তাদের কোনভাবেই মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়তে দেওয়া হবে না। ‘যদি সাহায্য নাও আসে তাহলে তোমরা মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়ার আগে আমরাই তোমাদের হত্যা করব।’ এ কথা বলে সেখান থেকে বিদায় নিলেন জেনারেল নিয়াজী।

সেখান থেকে ফিরে আসার সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে থামেন জেনারেল নিয়াজী। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল- ‘ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য আপনার কি যথেষ্ট শক্তি আছে?’

জবাবে জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘আমার লাশের উপর দিয়ে ঢাকার পতন হবে। আমার বুকের উপর দিয়ে তাদের ট্যাংক চালাতে হবে।’ জেনারেল নিয়াজীর সে দম্ভ চূর্ণ হতে বেশি সময় লাগেনি, ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য!

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা।]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

সাদেকুর রহমান

রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

১৯৭১ সালে প্রচলিত গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিকার পাতায় ১১ ডিসেম্বর ছিল শনিবার। এ দিন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এদিকে এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা (তৎকালীন তেজগাঁও) বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশেষ গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডের সর্বশেষ প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে ১১ ডিসেম্বরের প্রধান প্রধান ঘটনা আলোকপাত করেছেন এভাবে- ‘(ক) পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে তারবার্তা প্রেরণ। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এই সংবাদের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং জাতিসংঘে অবস্থানকারী প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক এই আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। (খ) বগুড়া ও ময়মনসিংহ এলাকা মুক্ত ঘোষণা। (গ) ঢাকার অদূরে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর প্যারাস্যুটের মাধ্যমে অবতরণ। রাজশাহী, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ মুক্ত ঘোষণা। (ঘ) মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের গুজব প্রচার।’ (আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ : অক্টোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩২৮)

প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন যশোর গেলেন সরেজমিন পরিদর্শন করতে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর সফর এই প্রথম। এর আগেও গেছেন মুক্তাঞ্চলে, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সন্তর্পণে এবং যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়ে। এবারের পরিদর্শন বিজয়ীর বেশে এবং প্রকাশ্যে। ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখার মতো! সকলেই উল্লসিত। মুক্ত যশোরে টাউন হল ময়দানের জনসভায় প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো- (১) বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দিদের বিচার করবে। (২) ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি, দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। (৩) সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। (৪) জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামী ইসলামী এ চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হবে।

এদিনই বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবো, যা চব্বিশ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।’

গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে।

জামালপুর থেকে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। সম্মিলিত বাহিনীর এই অংশটিই প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনায় এই দলের ভূমিকা ছিল প্রধান। জামালপুর পতনের পর টাঙ্গাইলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা শহর ছাড়তে শুরু করে।

ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে চারিদিক থেকে ট্যাংকসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তিসেনারা এগিয়ে আসছিল। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর পড়ছিল সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে উড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন মুক্তিবাহিনীর বীর ক্র্যাক প্লাটুন সকাল ১০টায় তোপখানা রোডের মার্কিন তথ্যকেন্দ্র (বর্তমান সিরডাপ ভবন) অভ্যন্তরে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলারা সারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি। ঢাকার চারপাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রীসেনা অবতরণ করায়।

এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় কোনো হামলা চালায়নি। বিদেশি যাত্রীদের সুবিধার্থে ঢাকা (অধুনালুপ্ত তেজগাঁও) বিমানবন্দরে মেরামত ও যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। খানসেনাদের ওপর ঢাকা ত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এমএ মালিক জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি; কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এ আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। খানসেনাদের সামনে একটি উপায় ছিল আত্মসমর্পণ করা।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিকের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকচ করে দেন। ‘পাকিস্তানের তাঁবেদার’ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক মিজ ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লেখা রিপোর্টে উল্লেখ করেন, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। শর্তগুলো হচ্ছে- ১. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত যেতে দিতে হবে। ৪. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে দিতে হবে। ৫. সত্তরের (১৯৭০) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।

এদিন তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক ড. হেনরি কিসিঞ্জার (গত ২৯ নভেম্বর শতবর্ষী এ কূটনীতিকের জীবনাবসান ঘটে) ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত (বর্তমান রাশিয়া ফেডারেশন) প্রতিনিধি ভোরেন্ডসভকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুঁশিয়ারি সামান্যতম মনোবল ভাঙতে পারেনি মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানীদের।

একাত্তরের এদিন (১১ ডিসেম্বর) জেনারেল এ কে নিয়াজী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একই সাথে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান বিধ্বংসী যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল সেটিও পরিদর্শন করেন তিনি। সেই সময় জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। নিজের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে তখনকার ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন সিদ্দিক সালিক। তিনি বইটিতে এদিনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন- ‘নিয়াজী যখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলেন তখন ছয়-সাতজন নার্স এসে জেনারেল নিয়াজীকে তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেন।

ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ থেকেই ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরালো আক্রমণ শুরু হয়। নার্সরা জেনারেল নিয়াজীকে বললেন যে, তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীত। তিনি নার্সদের আশ্বস্ত করলেন, বড় ধরনের বিদেশি সাহায্য আসছে এবং চিন্তার কোন কারণ নেই। জেনারেল নিয়াজী নার্সদের বললেন, তাদের কোনভাবেই মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়তে দেওয়া হবে না। ‘যদি সাহায্য নাও আসে তাহলে তোমরা মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়ার আগে আমরাই তোমাদের হত্যা করব।’ এ কথা বলে সেখান থেকে বিদায় নিলেন জেনারেল নিয়াজী।

সেখান থেকে ফিরে আসার সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে থামেন জেনারেল নিয়াজী। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল- ‘ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য আপনার কি যথেষ্ট শক্তি আছে?’

জবাবে জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘আমার লাশের উপর দিয়ে ঢাকার পতন হবে। আমার বুকের উপর দিয়ে তাদের ট্যাংক চালাতে হবে।’ জেনারেল নিয়াজীর সে দম্ভ চূর্ণ হতে বেশি সময় লাগেনি, ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য!

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা।]

back to top