জিয়াউদ্দীন আহমেদ
৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার অপেক্ষার অবসান হয়েছে
কাতারের দোহায় লুসাইল ফুটবল স্টেডিয়ামে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। বিগত ৩৬ বছর যাবত কাপ জেতার লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা সুবিধা করতে পারেনি। ফ্রান্সকে পেনাল্টি শুটআউটে হারিয়ে আর্জেন্টিনার কাপ জেতার অপেক্ষার অবসান হলো। মেসির হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি দেখে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠেছে বাংলাদেশের মেসিভক্তরা। ম্যাচ শেষে আতশবাজি ফোটানো শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর জেগে ওঠে, ভুভুজেলার শব্দে ব্রাজিল সমর্থকদের ঘুম ভেঙে যায়। চারিদিকে আনন্দ মিছিল আর সবার স্লোগানে ছিল ‘মেসি মেসি’। প্রায় এক মাস যাবত বিশ্বকাপই ছিল সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, বিশ্বকাপ ছিল সবার আলোচনার বিষয়বস্তু। আর্জেন্টিনা দুর্দান্ত খেলে ম্যাচ জিতেছে, চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফ্রান্স খেলার শুরুতেই হতোদ্যম হয়ে পড়ে, ফাইনাল খেলাটি ছিল তাদের সবচেয়ে বাজে ম্যাচ।
ফেসবুকে একটি পোস্টে দেখলাম, আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের ফাইনাল খেলা চলাকালে কুমিল্লার দেবিদ্বারে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলের মাঠ ফাঁকা, কোন শ্রোতা নেই, খেলা শুরু হওয়ার আগে সবাই খেলা দেখতে চলে গেছে। শুধু তাই নয় বিশ্বকাপ ফাইনাল ফুটবল খেলার কারণে আরেকটি ওয়াজ মাহফিল বাতিল করতে হয়েছে। আরেক ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ চলাকালীন মাইক নষ্ট হয়ে গেলে মাইকম্যানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, কারণ তিনি টিভিতে খেলা দেখতে চলে গেছেন। প্রায় প্রতিটি ওয়াজে বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে বলা সত্বেও বাংলাদেশের লোকজন বিশ্বকাপ নিয়ে উল্লাস করা থেকে বিরত থাকেনি। অনেককে বলতে শোনা গেছে, বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে ওয়াজিদের ফতোয়া সঠিক নয়।
প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতি ধর্ম মানলেও কোন উৎসব থেকে বিরত থাকে না, উৎসব পালনে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করে। ইহকাল যত ক্ষণস্থায়ী হোক না কেন তার আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে পরকালের জান্নাতের লোভনীয় পুরস্কারে আগ্রহী নয়; তারা দুটোই চায়। বিশ্বকাপ উপভোগের সময় পরকালের কথা বাঙালি ভুলেই গিয়েছিল। বাঙালি ঘুষের টাকা দিয়ে হালাল খাবার খোঁজ করে, বাঙালি সুদে অর্থ বিনিয়োগ করে সুদ নয়, ‘মুনাফা’ অর্জন করে, দুর্নীতির টাকা ভোগ করলেও হজে যাওয়ার ব্যয় নির্বাহে সহি অর্থের অনুসন্ধান করে। নিজ কর্মের পবিত্রতা প্রমাণ করতে হাদিস নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আমোদজনক একটি বিষয় এই বিশ্বকাপে উন্মোচিত হয়েছে- আমাদের ওয়াজি আলেমরা বিশ্বকাপ ফুটবলের বিরুদ্ধে অনবরত বিষোদগার করেছেন। অনেক আলেম ফতোয়া দিয়েছেন, বিভিন্ন নিষিদ্ধ উপসর্গ যোগ হওয়ার কারণে বিশ্বকাপ দেখা নাজায়েজ, বিশ্বকাপ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করা নাজায়েজ, বিশ্বকাপকে সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়াও নাজায়েজ, এমনকি ফুটবল মাঠে সেজদা দেয়াও বিদআত। বিশ্বকাপের সঙ্গে বিশেষ করে পুরস্কার বা অর্থের লেনদেন থাকায়, খেলোয়াড়দের গতর ঢাকা না থাকায় এই খেলা নাজায়েজ।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী শুধু ঘোড়দৌড়, উটের দৌড় এবং তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার থাকতে পারবে, অন্য খেলায় পুরস্কার থাকা নাজায়েজ; ওই ৩টি খেলা ব্যতীত অন্য খেলায় পুরস্কার নিলে তা জুয়া হিসেবে ধর্ম গণ্য করবে। অনেক আলেমের মতে সব নির্দোষ খেলাই জায়েজ যদি তার সঙ্গে শুধু শরীর গঠন এবং দুনিয়া বা আখেরাতের কোন লাভ সংশ্লিষ্ট থাকে।
মাসব্যাপী কাতার ধনী লোকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। গ্যালারিতে বসে বিয়ার খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনেক দর্শক মনক্ষুণœ হয়েছিলেন। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফা ছিল অনড়। সাম্বা নাচও এবার দেখা যায়নি। তবে উদ্বোধন এবং সমাপ্তিতে নাচ গান হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এত হৈচৈ, অথচ আমাদের দেশেরও কিছু দর্শককেও ফাইনাল খেলার দিন গ্যালারিতে দেখা গেছে। এই খেলার কারণে বিরোধী দলের আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়লেও বিশ্বকাপের উত্তেজনাপূর্ণ খেলা বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি লোক আনন্দ সহকারে উপভোগ করেছে।
ফুটবল খেলা এখনও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নিজের সমর্থিত দলের বিজয়ের আনন্দে অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, অনেকে আবার পরাজয়ে কেঁদেছেন। খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের কান্নাও আমাদের বিমর্ষ করেছে। সংস্কারমুক্ত মানুষগুলোও বিশ্বকাপে সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। অনেকের বিশ্বাস, খেলা দেখলে তাদের দল হেরে যাবে, তাই তারা খেলা না দেখে সমর্থকদের উল্লাসধ্বনি শোনার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এই অন্ধসংস্কারে সমর্পিত ব্যক্তি বিপক্ষ দলের সমর্থকদের উল্লাসধ্বনিতে মাঝে মাঝে প্রতারিত হয়েছেন। এমন আবেগ তৈরি করার ক্ষমতা শুধু বিশ্বকাপের রয়েছে।
খেলার শুরুতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোক আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলকে সমর্থন করেছে, আরও যে ৩০টি দেশ খেলছে তা বাংলাদেশি সমর্থকদের কাছে গুরুত্বহীন ছিল। কিন্তু অন্য দেশগুলোও ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব পেয়েছে; ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ফুটবল দলগুলো ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ব্রাজিল খেলা থেকে বিদায় নেয়ার পর ব্রাজিলের সমর্থকদের অধিকাংশ আর্জেন্টিনার পরাজয় কামনা করেছেন। আর্জেন্টিনার পরাজয় কামনা করতে গিয়ে তারা ক্রোয়েশীয়া বা মরক্কোকে সমর্থন করেছেন। মরক্কোকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বহির্প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। মরক্কোর ভালো খেলাকে স্বীকৃতি না দিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ধর্মীয় একাত্মবোধকে। মোহাম্মদ আলী ক্লে সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ তার মুষ্টির শক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, কিন্তু আমরা করেছি তার মুসলমানিত্বের প্রশংসা। একসময় যে ফ্রান্সকে আমাদের দেশের মুসলমানরা বয়কট করার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই ফ্রান্স বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হওয়ায় অনেকের আপন হয়ে গিয়েছিল।
কাতার এই বিশ্বকাপের আয়োজনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে এবং প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এই খেলা থেকে ফিফাও অনেক টাকা পাবে। বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা দল পেয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা, রানার্সআপ ফ্রান্স পেয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থান অধিকারী ক্রোয়েশিয়া পেয়েছে ২৮৩ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় ক্রোয়েশিয়ার কাছে পরাজিত চতুর্থ হওয়া মরক্কো পেয়েছে ২৬২ কোটি টাকা। মোট ৩২টি দল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে, বাকি ২৮টি দলও প্রচুর টাকা পেয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অগণিত দর্শক বিশ্বকাপ উপভোগ করার জন্য কাতার গিয়েছেন।
বিশ্বকাপ খেলায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও কিছুটা সচল হয়েছে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের জার্সি আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই পরেছে, শুধু এই জার্সির জন্য বাংলাদেশে ৫০০ কোটি টাকার একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে মিতব্যয়ী হতে পরামর্শ দিয়েছেন, সঞ্চয়ী হতে বলছেন। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য, নিম্নবিত্তের মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ খরচ স্বাভাবিক রাখাই শ্রেয় বলে মনে হয়।
আমরা প্রায় সবাই বিপ্লবীযোদ্ধা চে গুয়েভারার নাম শুনেছি। তিনি সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ছিলেন, অনেকগুলো দেশে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তিনি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিলে একনায়ক বাতিস্তাকে উৎখাতের আন্দোলনে যোগ দেন, কঙ্গোয় গিয়ে প্যাট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীগোষ্ঠীকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন, বলিভিয়ায় গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক বারিয়েন্তোসের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে আহত চে গুয়েভারাকে বলিভিয়ার সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এই চে গুয়েভারা ছিলেন আর্জেন্টিনার মানুষ।
এই আর্জেন্টাইনকে আমরা চিনি মেরাডোনার দেশ বলে, এই আর্জেন্টিনা মেসির দেশ বলেই আমাদের এত প্রিয়। ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, মরক্কো বা আর্জেন্টিনা জিতলে বাংলাদেশের কোন লাভ-লোকসান নেই; কিন্তু ভালোবাসার টিমের জয়ে বাংলাদেশের মানুষ উদ্বেলিত হয়, পছন্দের টিমের জয়ে নিজেদের সফলতা খুঁজে পায়। অভিনন্দন আর্জেন্টিনা, অভিবাদন প্রিয় মেসি।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার অপেক্ষার অবসান হয়েছে
শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২
কাতারের দোহায় লুসাইল ফুটবল স্টেডিয়ামে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। বিগত ৩৬ বছর যাবত কাপ জেতার লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা সুবিধা করতে পারেনি। ফ্রান্সকে পেনাল্টি শুটআউটে হারিয়ে আর্জেন্টিনার কাপ জেতার অপেক্ষার অবসান হলো। মেসির হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি দেখে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠেছে বাংলাদেশের মেসিভক্তরা। ম্যাচ শেষে আতশবাজি ফোটানো শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর জেগে ওঠে, ভুভুজেলার শব্দে ব্রাজিল সমর্থকদের ঘুম ভেঙে যায়। চারিদিকে আনন্দ মিছিল আর সবার স্লোগানে ছিল ‘মেসি মেসি’। প্রায় এক মাস যাবত বিশ্বকাপই ছিল সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, বিশ্বকাপ ছিল সবার আলোচনার বিষয়বস্তু। আর্জেন্টিনা দুর্দান্ত খেলে ম্যাচ জিতেছে, চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফ্রান্স খেলার শুরুতেই হতোদ্যম হয়ে পড়ে, ফাইনাল খেলাটি ছিল তাদের সবচেয়ে বাজে ম্যাচ।
ফেসবুকে একটি পোস্টে দেখলাম, আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের ফাইনাল খেলা চলাকালে কুমিল্লার দেবিদ্বারে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলের মাঠ ফাঁকা, কোন শ্রোতা নেই, খেলা শুরু হওয়ার আগে সবাই খেলা দেখতে চলে গেছে। শুধু তাই নয় বিশ্বকাপ ফাইনাল ফুটবল খেলার কারণে আরেকটি ওয়াজ মাহফিল বাতিল করতে হয়েছে। আরেক ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ চলাকালীন মাইক নষ্ট হয়ে গেলে মাইকম্যানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, কারণ তিনি টিভিতে খেলা দেখতে চলে গেছেন। প্রায় প্রতিটি ওয়াজে বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে বলা সত্বেও বাংলাদেশের লোকজন বিশ্বকাপ নিয়ে উল্লাস করা থেকে বিরত থাকেনি। অনেককে বলতে শোনা গেছে, বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে ওয়াজিদের ফতোয়া সঠিক নয়।
প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতি ধর্ম মানলেও কোন উৎসব থেকে বিরত থাকে না, উৎসব পালনে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করে। ইহকাল যত ক্ষণস্থায়ী হোক না কেন তার আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে পরকালের জান্নাতের লোভনীয় পুরস্কারে আগ্রহী নয়; তারা দুটোই চায়। বিশ্বকাপ উপভোগের সময় পরকালের কথা বাঙালি ভুলেই গিয়েছিল। বাঙালি ঘুষের টাকা দিয়ে হালাল খাবার খোঁজ করে, বাঙালি সুদে অর্থ বিনিয়োগ করে সুদ নয়, ‘মুনাফা’ অর্জন করে, দুর্নীতির টাকা ভোগ করলেও হজে যাওয়ার ব্যয় নির্বাহে সহি অর্থের অনুসন্ধান করে। নিজ কর্মের পবিত্রতা প্রমাণ করতে হাদিস নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আমোদজনক একটি বিষয় এই বিশ্বকাপে উন্মোচিত হয়েছে- আমাদের ওয়াজি আলেমরা বিশ্বকাপ ফুটবলের বিরুদ্ধে অনবরত বিষোদগার করেছেন। অনেক আলেম ফতোয়া দিয়েছেন, বিভিন্ন নিষিদ্ধ উপসর্গ যোগ হওয়ার কারণে বিশ্বকাপ দেখা নাজায়েজ, বিশ্বকাপ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করা নাজায়েজ, বিশ্বকাপকে সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়াও নাজায়েজ, এমনকি ফুটবল মাঠে সেজদা দেয়াও বিদআত। বিশ্বকাপের সঙ্গে বিশেষ করে পুরস্কার বা অর্থের লেনদেন থাকায়, খেলোয়াড়দের গতর ঢাকা না থাকায় এই খেলা নাজায়েজ।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী শুধু ঘোড়দৌড়, উটের দৌড় এবং তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার থাকতে পারবে, অন্য খেলায় পুরস্কার থাকা নাজায়েজ; ওই ৩টি খেলা ব্যতীত অন্য খেলায় পুরস্কার নিলে তা জুয়া হিসেবে ধর্ম গণ্য করবে। অনেক আলেমের মতে সব নির্দোষ খেলাই জায়েজ যদি তার সঙ্গে শুধু শরীর গঠন এবং দুনিয়া বা আখেরাতের কোন লাভ সংশ্লিষ্ট থাকে।
মাসব্যাপী কাতার ধনী লোকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। গ্যালারিতে বসে বিয়ার খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনেক দর্শক মনক্ষুণœ হয়েছিলেন। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফা ছিল অনড়। সাম্বা নাচও এবার দেখা যায়নি। তবে উদ্বোধন এবং সমাপ্তিতে নাচ গান হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এত হৈচৈ, অথচ আমাদের দেশেরও কিছু দর্শককেও ফাইনাল খেলার দিন গ্যালারিতে দেখা গেছে। এই খেলার কারণে বিরোধী দলের আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়লেও বিশ্বকাপের উত্তেজনাপূর্ণ খেলা বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি লোক আনন্দ সহকারে উপভোগ করেছে।
ফুটবল খেলা এখনও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নিজের সমর্থিত দলের বিজয়ের আনন্দে অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, অনেকে আবার পরাজয়ে কেঁদেছেন। খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের কান্নাও আমাদের বিমর্ষ করেছে। সংস্কারমুক্ত মানুষগুলোও বিশ্বকাপে সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। অনেকের বিশ্বাস, খেলা দেখলে তাদের দল হেরে যাবে, তাই তারা খেলা না দেখে সমর্থকদের উল্লাসধ্বনি শোনার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এই অন্ধসংস্কারে সমর্পিত ব্যক্তি বিপক্ষ দলের সমর্থকদের উল্লাসধ্বনিতে মাঝে মাঝে প্রতারিত হয়েছেন। এমন আবেগ তৈরি করার ক্ষমতা শুধু বিশ্বকাপের রয়েছে।
খেলার শুরুতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোক আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলকে সমর্থন করেছে, আরও যে ৩০টি দেশ খেলছে তা বাংলাদেশি সমর্থকদের কাছে গুরুত্বহীন ছিল। কিন্তু অন্য দেশগুলোও ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব পেয়েছে; ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ফুটবল দলগুলো ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ব্রাজিল খেলা থেকে বিদায় নেয়ার পর ব্রাজিলের সমর্থকদের অধিকাংশ আর্জেন্টিনার পরাজয় কামনা করেছেন। আর্জেন্টিনার পরাজয় কামনা করতে গিয়ে তারা ক্রোয়েশীয়া বা মরক্কোকে সমর্থন করেছেন। মরক্কোকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বহির্প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। মরক্কোর ভালো খেলাকে স্বীকৃতি না দিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ধর্মীয় একাত্মবোধকে। মোহাম্মদ আলী ক্লে সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ তার মুষ্টির শক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, কিন্তু আমরা করেছি তার মুসলমানিত্বের প্রশংসা। একসময় যে ফ্রান্সকে আমাদের দেশের মুসলমানরা বয়কট করার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই ফ্রান্স বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হওয়ায় অনেকের আপন হয়ে গিয়েছিল।
কাতার এই বিশ্বকাপের আয়োজনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে এবং প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এই খেলা থেকে ফিফাও অনেক টাকা পাবে। বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা দল পেয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা, রানার্সআপ ফ্রান্স পেয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থান অধিকারী ক্রোয়েশিয়া পেয়েছে ২৮৩ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় ক্রোয়েশিয়ার কাছে পরাজিত চতুর্থ হওয়া মরক্কো পেয়েছে ২৬২ কোটি টাকা। মোট ৩২টি দল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে, বাকি ২৮টি দলও প্রচুর টাকা পেয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অগণিত দর্শক বিশ্বকাপ উপভোগ করার জন্য কাতার গিয়েছেন।
বিশ্বকাপ খেলায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও কিছুটা সচল হয়েছে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের জার্সি আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই পরেছে, শুধু এই জার্সির জন্য বাংলাদেশে ৫০০ কোটি টাকার একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে মিতব্যয়ী হতে পরামর্শ দিয়েছেন, সঞ্চয়ী হতে বলছেন। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য, নিম্নবিত্তের মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ খরচ স্বাভাবিক রাখাই শ্রেয় বলে মনে হয়।
আমরা প্রায় সবাই বিপ্লবীযোদ্ধা চে গুয়েভারার নাম শুনেছি। তিনি সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ছিলেন, অনেকগুলো দেশে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তিনি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিলে একনায়ক বাতিস্তাকে উৎখাতের আন্দোলনে যোগ দেন, কঙ্গোয় গিয়ে প্যাট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীগোষ্ঠীকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন, বলিভিয়ায় গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক বারিয়েন্তোসের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে আহত চে গুয়েভারাকে বলিভিয়ার সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এই চে গুয়েভারা ছিলেন আর্জেন্টিনার মানুষ।
এই আর্জেন্টাইনকে আমরা চিনি মেরাডোনার দেশ বলে, এই আর্জেন্টিনা মেসির দেশ বলেই আমাদের এত প্রিয়। ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, মরক্কো বা আর্জেন্টিনা জিতলে বাংলাদেশের কোন লাভ-লোকসান নেই; কিন্তু ভালোবাসার টিমের জয়ে বাংলাদেশের মানুষ উদ্বেলিত হয়, পছন্দের টিমের জয়ে নিজেদের সফলতা খুঁজে পায়। অভিনন্দন আর্জেন্টিনা, অভিবাদন প্রিয় মেসি।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]