alt

উপ-সম্পাদকীয়

চিকিৎসা নিতে কেন ভারতে গিয়েছিলাম

আব্দুল মান্নান খান

: শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

যাদের আর্থিক সামর্থ্য বেশি তারা চিকিৎসা নিতে আমেরিকা-লন্ডন যান। যারা তার চেয়ে একটু কম সামর্থ্যবান তারা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান। তার পরের অংশ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। কয়েক বছর আগের খবরে ছিল প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার মানুষ ভারতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ থেকে; যার বড় অংশ যায় চিকিৎসার জন্য। আমি গিয়েছিলাম ভারতে চোখের চিকিৎসা করাতে। এখানে কথা হলো আমার মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ কেন দেশের বাইরে যাবে চিকিৎসা নিতে। দেশে এত বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এত বড় বড় সব ডাক্তার থাকতে কেন গেলাম সেই কথা এ কলামে লিখতে চেয়েও এতদিন হয়ে উঠেনি যে কারণেই হোক।

এর মাঝে টানা তিন বছর (২০২১Ñ২০২৩) আমাকে গ্রামের বাড়ি যশোরে থাকতে হয়েছে। এ সময় দেখেছি গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের লোকও ভারতে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। তাদের বক্তব্য ঢাকায় চিকিৎসা নিতে ঝামেলা পোহাতে হয় বেশি, টাকার কথা পরে। আর ওখানে গেলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে এরকম একটা বিশ^াসও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের গৃহস্থ পরিবার আর আগের মতো কৃষিনির্ভর নেই। যে পরিবারে জমিজেরাত চাষবাস আছে সেই পরিবারে ব্যবসাও আছে চাকরিবাকরিও আছে। এ ধরনের পরিবারগুলোই চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছে। ভারত মানে কেবল যে কলকাতায় যাচ্ছে তা না। ভারতে এখন একেক রাজ্যে একেক ব্যাধির বিশেষায়িত চিকিৎসা পাওয়া যায়। যেমন ক্যানসারের চিকিৎসায় মুম্বাই, হার্টের চিকিৎসায় ভ্যালোরে (চেন্নাই) এরকম আর কী। আমি গিয়েছিলাম চেন্নাই চোখের চিকিৎসা নিতে।

আমার একটা চোখ প্রায় কিছুই দেখছে না আরেকটাও আক্রান্ত। চোখের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশের এক হাসপাতাল থেকে বলা হলো, ‘চোখে রেটিনা প্রবলেম’Ñ ইনজেকশন নিতে হবে চোখে। চোখে ইনজেকশন! একটু ভয়েরই ব্যাপার, শুনলেই যেন গা শিউরে ওঠে। এ অবস্থায় অন্য একটা হাসপাতালে গেলাম, দেখি তারা কী বলে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা বললেন, ইনজেকশন নিতে হবে কি হবে না এটা নিশ্চিত করতে আপনাকে আরেকটা ‘টেস্ট’ করাতে হবে। ঠিক আছে তাই করা হোক। এরপর একদিন বিকালে গিয়ে ওই পরীক্ষার জন্য টাকাপয়সা জমা দিয়ে যথাস্থানে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি একাই গেছি। ছেলে অফিস শেষে ওখানে আসবে এমনই কথা।

কিছু সময় পরে আমার ডাক পড়লো। তারা জানতে চাইলেন আমি ডায়েবেটিস-প্রেসারের ওষুধ খাই কিনা। খাই না বললে তারা আর কোন কথা না বলে আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তারপর ওরা কেমন যেন আমাকে চেয়ারের সঙ্গে একরকম বেঁধে ফেললেন। তারপর একজন একটা ইনজেকশন দিলেন হাতের শিরায়। দেয়ার সময় বললেন, ‘বমি হতে পারে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

এরপর ইনজেকশন দিতে না দিতেই দেখি আমার ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে গেল। উথাল-পাতাল অবস্থা একেবারে। প্রচ- জোরে বমির টান সঙ্গে দুই চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। গা ঘেমে ভিজে গেল। মৃত্যু যে কেমন এ অভিজ্ঞতা কারো নেই; কিন্তু মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। আমি যেন সেই দুয়ার থেকে ফিরে এলাম। কতক্ষণ সে দুয়ারে ছিলাম হিসাব নেই। একসময় ধকল কাটলো। আমাকে উঠিয়ে পাশের সিটে বসানো হলো। একটু সময় নিয়ে বললাম, এটা কী করলেন আপনারা! আমাকে তো মেরেই ফেলেছিলেন। তাদের কেউ একজন বললেন, তেমন কিছু হতে দেখলে আমাদের ব্যবস্থা আছে। অ্যাম্বুলেন্স রেডি থাকে আমাদের। পাশেই অমুক কার্ডিয়াক হসপিটালে ব্যবস্থা রাখা আছে। সেখানে দ্রুত নেয়া হতো আপনাকে। হার্টের রোগীরা অনেক সময় এরকম সমস্যা করে যার জন্য আমাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা থাকে।

ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন, ইনজেকশন নিতে হবে। একান্তে ছেলেকে বললেন, ভয়ের কিছু নেই চোখে ইনজেকশন নেয়াই এর চিকিৎসা। তিনটা ইনজেকশন নিতে হবে। সবচেয়ে কম দামিটার দাম পড়বে দশ হাজার টাকা করে। ইনজেকশন কোনটার কত দাম কত খরচ হবে তার একটা তালিকা ডাক্তারের সহকারী ধরিয়ে দিলেন। আমি আর কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ ফিরে এলাম। ক্রমেই চোখের চিকিৎসা নেয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেললাম। আমার নির্লিপ্ততার কারণেই পরে পরিবার থেকে কথা উঠল দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার।

কাগজপত্র সব প্রস্তুত হলো। ছেলে যেতে পারল না। মেয়ে-জামাইসহ ট্রেনে কলকাতায় গেলাম। ওখানে রাত থেকে পর দিন চেন্নাই এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলাম ১২টার দিকে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। মেঘলা আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও আছে। এটা সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ওই এয়ারপোর্ট চেন্নাই মহানগরীর একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ট্যাক্সি নিয়ে আমরা পৌঁছলাম নগরীর মধ্যবর্তী এলাকায়। হোটেলের অভাব নেই। আমরা একটাতে উঠে পড়লাম যেখান থেকে চোখের হাসপাতাল ‘সংকরনেত্রালয়’ কাছে। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়। রিকশা নেই চেন্নাইতে। প্রচুর অটো। চাইলেই পাওয়া যায়।

সকাল ৭টার আগেই পৌঁছে গিয়ে লাইন দিলাম। তারপর প্রবেশের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এক সময় আমার ডাক পড়লো। জানতে চাওয়া হলো আমি কোন ভাষায় কথা বলতে চাইÑ হিন্দি ইংলিশ না তামিল। আস্তে করে বললাম, ইংরেজি একটু পারি। না বলে কী করবো ওরা যে ইংরেজি বলে তা শুনে ভিমরি খেয়ে পড়া ছাড়া আমার উপায় কী। ইংরেজি বলতে ওদের মুখে কোনো জড়তা কাজ করে না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে বলে দিল, আগামীকাল ওদের অন্য একটা ভবনে যেতে হবে। সেটা কিছুটা দূরে। কাউন্টারে রিপোর্ট করতে হবে সকাল ৮টার মধ্যে। সকালের নাস্তায় কী খেয়ে যেতে হবে তাও বলে দিল।

পর দিন আমরা যথারীতি গিয়ে রিপোর্ট করলাম। ওরা ওই পরীক্ষাটাও করেছে ঢাকাতে যেটা আমার সমস্যা করেছিল। ওখানে বমির টান একটু হয়েছিল এ পর্যন্তই। ডাক পড়লে ভেতরে গেলাম, মেয়ে আছে সঙ্গে। আমার মেয়ের বয়সি ডাক্তার বেটি এত দ্রুত সব বুঝিয়ে দিল যে, আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম; যা বোঝার মেয়ে বুঝলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকিৎসার একটা সামারি সিট আমরা হাতে পেয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গেই। ডাক্তার যা বললেন, চোখের এ রোগের চিকিৎসা একটাইÑ সেটা হলো চোখে ইনজেকশন নিতে হবে। মাসে একটা করে তিন মাসে তিনটা নিলেই যে ভালো হয়ে যাবে এমন বলা যাবে না। বেশিও নিতে হতে পারে। ডাক্তার বললেন, আপনার একটা চোখ ভালো আছে। আরও বললেন, ইজেকশন নিতে চেন্নাই আসতে হবে এমন কোন কথা নেই। কলকাতা থেকে নিতে পারেন। ঢাকায় নিতে পারব কিনা জানতে চাইলে বললেন, আই ডোন্ট নো।

দেখলাম চার নামের চারটা ওষুধের চার রকম দামের কথাও সামারি সিটে উল্লে¬খ আছে। আপনি যেটা নেন। কম দামেরটা ১৬,৫০০ রুপি। তার পরেরটা ৩২,০০০ তার পরেরটা ৬৪,০০০ তার পরেরটা ৯০,০০০ রুপি। ইনজেকশন কোনটা নেয়া উচিত, কোথা থেকে নিলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে তা দেশে ফিরে গিয়ে ঠিক করা যাবেÑ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতাল থেকে। এক সপ্তাহ পরে রিটার্ন টিকিট কলকাতা হয়ে ঢাকা। এ কয়দিন খুব করে ঘোরা হলো চেন্নাই। কন্যাকুমারীও ঘুরে এলাম যে কথা ‘কন্যাকুমারীতে একদিন’ শিরোনামে লিখেছি কলামেই।

ফিরে এসে কী করি কী করি করতে করতে সময় যেতে লাগল। এর মাঝে একদিন টেলিভিশনে দেখলাম চোখের রেটিনা সমস্যা নিয়ে দুই-তিনজন ডাক্তার আলাপ করছেন। মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকলাম। সব চেয়ে কম দামি ওষুধটা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলা হলো, ওটা প্রকৃতপক্ষে ক্যানসারের ওষুধ এবং এর মেয়াদ ২৮ দিন। ওষুধের নামটা এখানে তুলে দিলাম (আধংঃরহ); কারণ এ নিয়ে আরেকটু কথা পরে আছে। এ কথা শোনার পর আমি এ ওষুধটা নেয়া থেকে পিছিয়ে গেলাম। ভাবলাম দ্বিতীয় ওষুধটা নেব। গেলাম এখানকার বড় এক বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন, এটা (দ্বিতীয় ইনজেকশনটা) এখানে দেয়া হয় না। প্রথমটা (আধংঃরহ) নিতে পারেন। প্রথমটা সম্পর্কে আমার টেলিভিশনে শোনা কথাটা বলতে না বলতেই তিনি বললেন, আমরা জানি। আরো বললেন, এটা যদি নেন ১০,০০০ টাকা থেকে আরো কমিয়ে রাখতে পারব। আরেকটা ইনজেকশনের নাম উল্লেখ করে বললেন, এটা যদি নেন তবে ৭০,০০০ টাকা করে পড়বে।

শেষে দেশে আর আমার চিকিৎসা নেয়া হলো না। কলকাতায় গেলাম। সেখানে আমার ডাক্তারকে টেলিভিশনে শোনা কথাটা বললে তিনি বললেন, আমাদের ভারত সরকার ওষুধটা এখনও অনুমোদন করেনি। আমরা ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশন ওষুধটা ব্যবহার করছি। ফলও ভালো আসছে। ইতোমধ্যে ৬ মাস চলে যাওয়াতে চোখের ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। এখন চিকিৎসায় ফল ভালো হবে কিনা ডাক্তার সন্দিহান হলেন। দুইবারে দুটো ইনজেকশন দেয়ার পর কাজ হবে না দেখে থামিয়ে দিলেন। কয়েক বছর হয়ে গেল এখনও একই রকম আছি। তবে ওই আধংঃরহ নামের ইনজেকশনটা আমি নেইনি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চিকিৎসা নিতে কেন ভারতে গিয়েছিলাম

আব্দুল মান্নান খান

শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

যাদের আর্থিক সামর্থ্য বেশি তারা চিকিৎসা নিতে আমেরিকা-লন্ডন যান। যারা তার চেয়ে একটু কম সামর্থ্যবান তারা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান। তার পরের অংশ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। কয়েক বছর আগের খবরে ছিল প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার মানুষ ভারতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ থেকে; যার বড় অংশ যায় চিকিৎসার জন্য। আমি গিয়েছিলাম ভারতে চোখের চিকিৎসা করাতে। এখানে কথা হলো আমার মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ কেন দেশের বাইরে যাবে চিকিৎসা নিতে। দেশে এত বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এত বড় বড় সব ডাক্তার থাকতে কেন গেলাম সেই কথা এ কলামে লিখতে চেয়েও এতদিন হয়ে উঠেনি যে কারণেই হোক।

এর মাঝে টানা তিন বছর (২০২১Ñ২০২৩) আমাকে গ্রামের বাড়ি যশোরে থাকতে হয়েছে। এ সময় দেখেছি গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের লোকও ভারতে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। তাদের বক্তব্য ঢাকায় চিকিৎসা নিতে ঝামেলা পোহাতে হয় বেশি, টাকার কথা পরে। আর ওখানে গেলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে এরকম একটা বিশ^াসও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের গৃহস্থ পরিবার আর আগের মতো কৃষিনির্ভর নেই। যে পরিবারে জমিজেরাত চাষবাস আছে সেই পরিবারে ব্যবসাও আছে চাকরিবাকরিও আছে। এ ধরনের পরিবারগুলোই চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছে। ভারত মানে কেবল যে কলকাতায় যাচ্ছে তা না। ভারতে এখন একেক রাজ্যে একেক ব্যাধির বিশেষায়িত চিকিৎসা পাওয়া যায়। যেমন ক্যানসারের চিকিৎসায় মুম্বাই, হার্টের চিকিৎসায় ভ্যালোরে (চেন্নাই) এরকম আর কী। আমি গিয়েছিলাম চেন্নাই চোখের চিকিৎসা নিতে।

আমার একটা চোখ প্রায় কিছুই দেখছে না আরেকটাও আক্রান্ত। চোখের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশের এক হাসপাতাল থেকে বলা হলো, ‘চোখে রেটিনা প্রবলেম’Ñ ইনজেকশন নিতে হবে চোখে। চোখে ইনজেকশন! একটু ভয়েরই ব্যাপার, শুনলেই যেন গা শিউরে ওঠে। এ অবস্থায় অন্য একটা হাসপাতালে গেলাম, দেখি তারা কী বলে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা বললেন, ইনজেকশন নিতে হবে কি হবে না এটা নিশ্চিত করতে আপনাকে আরেকটা ‘টেস্ট’ করাতে হবে। ঠিক আছে তাই করা হোক। এরপর একদিন বিকালে গিয়ে ওই পরীক্ষার জন্য টাকাপয়সা জমা দিয়ে যথাস্থানে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি একাই গেছি। ছেলে অফিস শেষে ওখানে আসবে এমনই কথা।

কিছু সময় পরে আমার ডাক পড়লো। তারা জানতে চাইলেন আমি ডায়েবেটিস-প্রেসারের ওষুধ খাই কিনা। খাই না বললে তারা আর কোন কথা না বলে আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তারপর ওরা কেমন যেন আমাকে চেয়ারের সঙ্গে একরকম বেঁধে ফেললেন। তারপর একজন একটা ইনজেকশন দিলেন হাতের শিরায়। দেয়ার সময় বললেন, ‘বমি হতে পারে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

এরপর ইনজেকশন দিতে না দিতেই দেখি আমার ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে গেল। উথাল-পাতাল অবস্থা একেবারে। প্রচ- জোরে বমির টান সঙ্গে দুই চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। গা ঘেমে ভিজে গেল। মৃত্যু যে কেমন এ অভিজ্ঞতা কারো নেই; কিন্তু মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। আমি যেন সেই দুয়ার থেকে ফিরে এলাম। কতক্ষণ সে দুয়ারে ছিলাম হিসাব নেই। একসময় ধকল কাটলো। আমাকে উঠিয়ে পাশের সিটে বসানো হলো। একটু সময় নিয়ে বললাম, এটা কী করলেন আপনারা! আমাকে তো মেরেই ফেলেছিলেন। তাদের কেউ একজন বললেন, তেমন কিছু হতে দেখলে আমাদের ব্যবস্থা আছে। অ্যাম্বুলেন্স রেডি থাকে আমাদের। পাশেই অমুক কার্ডিয়াক হসপিটালে ব্যবস্থা রাখা আছে। সেখানে দ্রুত নেয়া হতো আপনাকে। হার্টের রোগীরা অনেক সময় এরকম সমস্যা করে যার জন্য আমাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা থাকে।

ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন, ইনজেকশন নিতে হবে। একান্তে ছেলেকে বললেন, ভয়ের কিছু নেই চোখে ইনজেকশন নেয়াই এর চিকিৎসা। তিনটা ইনজেকশন নিতে হবে। সবচেয়ে কম দামিটার দাম পড়বে দশ হাজার টাকা করে। ইনজেকশন কোনটার কত দাম কত খরচ হবে তার একটা তালিকা ডাক্তারের সহকারী ধরিয়ে দিলেন। আমি আর কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ ফিরে এলাম। ক্রমেই চোখের চিকিৎসা নেয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেললাম। আমার নির্লিপ্ততার কারণেই পরে পরিবার থেকে কথা উঠল দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার।

কাগজপত্র সব প্রস্তুত হলো। ছেলে যেতে পারল না। মেয়ে-জামাইসহ ট্রেনে কলকাতায় গেলাম। ওখানে রাত থেকে পর দিন চেন্নাই এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলাম ১২টার দিকে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। মেঘলা আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও আছে। এটা সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ওই এয়ারপোর্ট চেন্নাই মহানগরীর একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ট্যাক্সি নিয়ে আমরা পৌঁছলাম নগরীর মধ্যবর্তী এলাকায়। হোটেলের অভাব নেই। আমরা একটাতে উঠে পড়লাম যেখান থেকে চোখের হাসপাতাল ‘সংকরনেত্রালয়’ কাছে। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়। রিকশা নেই চেন্নাইতে। প্রচুর অটো। চাইলেই পাওয়া যায়।

সকাল ৭টার আগেই পৌঁছে গিয়ে লাইন দিলাম। তারপর প্রবেশের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এক সময় আমার ডাক পড়লো। জানতে চাওয়া হলো আমি কোন ভাষায় কথা বলতে চাইÑ হিন্দি ইংলিশ না তামিল। আস্তে করে বললাম, ইংরেজি একটু পারি। না বলে কী করবো ওরা যে ইংরেজি বলে তা শুনে ভিমরি খেয়ে পড়া ছাড়া আমার উপায় কী। ইংরেজি বলতে ওদের মুখে কোনো জড়তা কাজ করে না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে বলে দিল, আগামীকাল ওদের অন্য একটা ভবনে যেতে হবে। সেটা কিছুটা দূরে। কাউন্টারে রিপোর্ট করতে হবে সকাল ৮টার মধ্যে। সকালের নাস্তায় কী খেয়ে যেতে হবে তাও বলে দিল।

পর দিন আমরা যথারীতি গিয়ে রিপোর্ট করলাম। ওরা ওই পরীক্ষাটাও করেছে ঢাকাতে যেটা আমার সমস্যা করেছিল। ওখানে বমির টান একটু হয়েছিল এ পর্যন্তই। ডাক পড়লে ভেতরে গেলাম, মেয়ে আছে সঙ্গে। আমার মেয়ের বয়সি ডাক্তার বেটি এত দ্রুত সব বুঝিয়ে দিল যে, আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম; যা বোঝার মেয়ে বুঝলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকিৎসার একটা সামারি সিট আমরা হাতে পেয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গেই। ডাক্তার যা বললেন, চোখের এ রোগের চিকিৎসা একটাইÑ সেটা হলো চোখে ইনজেকশন নিতে হবে। মাসে একটা করে তিন মাসে তিনটা নিলেই যে ভালো হয়ে যাবে এমন বলা যাবে না। বেশিও নিতে হতে পারে। ডাক্তার বললেন, আপনার একটা চোখ ভালো আছে। আরও বললেন, ইজেকশন নিতে চেন্নাই আসতে হবে এমন কোন কথা নেই। কলকাতা থেকে নিতে পারেন। ঢাকায় নিতে পারব কিনা জানতে চাইলে বললেন, আই ডোন্ট নো।

দেখলাম চার নামের চারটা ওষুধের চার রকম দামের কথাও সামারি সিটে উল্লে¬খ আছে। আপনি যেটা নেন। কম দামেরটা ১৬,৫০০ রুপি। তার পরেরটা ৩২,০০০ তার পরেরটা ৬৪,০০০ তার পরেরটা ৯০,০০০ রুপি। ইনজেকশন কোনটা নেয়া উচিত, কোথা থেকে নিলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে তা দেশে ফিরে গিয়ে ঠিক করা যাবেÑ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতাল থেকে। এক সপ্তাহ পরে রিটার্ন টিকিট কলকাতা হয়ে ঢাকা। এ কয়দিন খুব করে ঘোরা হলো চেন্নাই। কন্যাকুমারীও ঘুরে এলাম যে কথা ‘কন্যাকুমারীতে একদিন’ শিরোনামে লিখেছি কলামেই।

ফিরে এসে কী করি কী করি করতে করতে সময় যেতে লাগল। এর মাঝে একদিন টেলিভিশনে দেখলাম চোখের রেটিনা সমস্যা নিয়ে দুই-তিনজন ডাক্তার আলাপ করছেন। মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকলাম। সব চেয়ে কম দামি ওষুধটা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলা হলো, ওটা প্রকৃতপক্ষে ক্যানসারের ওষুধ এবং এর মেয়াদ ২৮ দিন। ওষুধের নামটা এখানে তুলে দিলাম (আধংঃরহ); কারণ এ নিয়ে আরেকটু কথা পরে আছে। এ কথা শোনার পর আমি এ ওষুধটা নেয়া থেকে পিছিয়ে গেলাম। ভাবলাম দ্বিতীয় ওষুধটা নেব। গেলাম এখানকার বড় এক বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন, এটা (দ্বিতীয় ইনজেকশনটা) এখানে দেয়া হয় না। প্রথমটা (আধংঃরহ) নিতে পারেন। প্রথমটা সম্পর্কে আমার টেলিভিশনে শোনা কথাটা বলতে না বলতেই তিনি বললেন, আমরা জানি। আরো বললেন, এটা যদি নেন ১০,০০০ টাকা থেকে আরো কমিয়ে রাখতে পারব। আরেকটা ইনজেকশনের নাম উল্লেখ করে বললেন, এটা যদি নেন তবে ৭০,০০০ টাকা করে পড়বে।

শেষে দেশে আর আমার চিকিৎসা নেয়া হলো না। কলকাতায় গেলাম। সেখানে আমার ডাক্তারকে টেলিভিশনে শোনা কথাটা বললে তিনি বললেন, আমাদের ভারত সরকার ওষুধটা এখনও অনুমোদন করেনি। আমরা ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশন ওষুধটা ব্যবহার করছি। ফলও ভালো আসছে। ইতোমধ্যে ৬ মাস চলে যাওয়াতে চোখের ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। এখন চিকিৎসায় ফল ভালো হবে কিনা ডাক্তার সন্দিহান হলেন। দুইবারে দুটো ইনজেকশন দেয়ার পর কাজ হবে না দেখে থামিয়ে দিলেন। কয়েক বছর হয়ে গেল এখনও একই রকম আছি। তবে ওই আধংঃরহ নামের ইনজেকশনটা আমি নেইনি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top