alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রচারণায় তারা ভারতীয় পণ্যের বদলে দেশের বা অন্য কোন দেশের পণ্য ব্যবহার করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠেছে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের একটি ভারতীয় চাদর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। আমার ধারণা ছিল, এরপর বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজ নিজ ঘর থেকে শাড়ি, চাদরসহ ভারতীয় পণ্য রাস্তায় এনে লাগাতার পুড়তে থাকবে; কিন্তু নয়াপল্টনের পর ভারতীয় পণ্যের আর একটিও বহ্নি উৎসব হয়নি।

ভারতের পণ্য বর্জন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে, তবে এ বর্জন শুধু মিডিয়ায়। ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ১৯৪৭ সালে যা ছিল এখনো তাই আছে, অনুপাত বিবেচনায় কমেওনি, বাড়েওনি। বিএনপি কিন্তু রিজভীর হটকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়নি; ভারতীয় চাদর পুড়িয়ে দেওয়াকে বিএনপি রিজভীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছে। বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারা জানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা শুধু দেশ নয়, দলীয় সরকারের জন্যও অপরিহার্য।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন একবার ভারতকে বাদ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। এক পেঁয়াজের ধাক্কায় বাংলাদেশ বেসামাল হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ পেঁয়াজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে ধর্ণা দিয়ে মিসর থেকে ডিম্বাকৃতির যে বড় বড় পেঁয়াজ আমদানি করেছিল তার কোন ঝাঁজ ছিল না, কারো খাওয়ার রুচি হয়নি। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভারতের বিরুদ্ধে উষ্কিয়ে দিচ্ছে, রিজভী সাহেব সেই উষ্কানির ফাঁদে পা দিয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ না করেই নিজের দামি কাশ্মীরি শালটি পুড়িয়ে দিলেন। রিজভী সাহেব কুমিল্লার খদ্দর না কিনে কাশ্মীরের দামি শাল কিনতে গেলেন কেন? বাম রাজনীতির আমার এক ভাগ্নেকে ‘খদ্দর কাশেম’ না বললে কেউ এলাকায় চিনে না। বাংলাদেশের তাত, জামদানি এবং টাঙ্গাইল শাডড়র কদর ভারতেও রয়েছে, আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের কসমেটিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতীয় শাড়ির কদর কমার সম্ভাবনা রয়েছে। হজ্ব করে আসার পর আমার স্ত্রীকেও আর শাড়ি পরতে দেখি না। শাড়ি পরলে নাকি নারীর আবরু ঢাকা থাকে নাÑ এমন প্রচারণাও জোরেশোরে চলছে। তবে আমার বিয়ের শাড়ি ভারত থেকে এসেছিল, তা এখনো আলমারিতে আছে। বউকে পুড়তে বলেছিলাম, রাজি হয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন, ভারত পাশে থাকায় জাতীয় নির্বাচনে অন্য কোনো দেশ অশুভ খেলার সাহস করেনি।

পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে সমর্থন বা দেশগুলোর বিরোধিতা করে থাকে। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প বিবৃতি দিয়ে বরিস জনসনকে সমর্থন করেছিলেন, আবার রাশিয়া সমর্থন করে ডনাল্ড ট্রাম্পকে। চীনের সমর্থন থাকায় মায়ানমার গোটা বিশ্বকেই থোড়াই কেয়ার করে। আমেরিকার সমর্থন থাকায় ইসরায়েল ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠাতে শুধু একটি ধাক্কার অপেক্ষায় ছিল বিএনপি। ভারতও এমনই নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যাচ্ছে।

রাজনীতিতে বিএনপির ভারত বিরোধী অবস্থান পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মতো। ভারত বিরোধিতা আছে বলেই বিএনপি পাকিস্তানপন্থি এবং চীনপন্থিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে থাকে। তাই কারণে-অকারণে ভারত বিরোধিতা বিএনপির রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো যে চাপ সৃষ্টি করেছিলো তা ভেস্তে গেছে ভারতের কারণে। আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলো স্বার্থ ব্যতিরেকে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই চাপ তৈরি করেনি। এমন স্বার্থ ভারতেরও আছে।

ভারত চাইবে না তার সীমান্তে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইর ঘাঁটি আবার গড়ে উঠুক, ভারত চাইবে না বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মতো আবারো ১০ ট্রাক অস্ত্র এনে ভারতের সশস্ত্র গ্রুপের হাতে কেউ তুলে দিক, ভারত চাইবে না বিএনপির খালেদা জিয়ার মতো পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত বাতিল করে তাদের রাষ্ট্রপতিকে আবার কেউ অপমান করুক, ভারত চাইবে না পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য ফেনী পর্যন্ত দখল করার অপবাদ আবার তাদের ঘাড়ে এসে পড়–ক। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হলে বাংলাদেশ সহজেই ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারে। ভারতও এক সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সংরক্ষণমূলক নীতির কারণে ১৯৭৭ সালে ভারত থেকে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছিল জনপ্রিয় পানীয় প্রস্তুতকারক সংস্থা কোকা কোলা এবং সফটওয়্যার জায়ান্ট আইবিএম।

ভারতের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই নিজেদের তৈরি অ্যাম্বাসেডর মোটরগাড়ি ব্যবহার করেছেন দীর্ঘদিন। ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ প্রবল, তারা বাংলাদেশ বেড়াতে এলে কিছুই কেনে না। আর ইদ এলেই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি কোলকাতা নিউমার্কেটে গিয়ে বস্তায় বস্তায় জিনিস কেনে। লক্ষ লক্ষ লোক চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়, ঘুরে এসে দল-মত নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। ভিসা ফি, বিমান-হোটেল ভাড়া, খাবার, পরিবহন, কেনাকাটি প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সব অর্থ পাচ্ছে ভারত; কিন্তু রিজভী সাহেবের ডাকে বাংলাদেশের মানুষ কেন সাড়া দিচ্ছে না, কেন বিএনপির অন্ধ সমর্থকরাও বয়কট মানছে না, তা রিজভী সাহেব ভালো করেই জানেন।

বাংলাদেশের ছোট্ট ভূখ-টি ১৮ কোটি মানুষের খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে, জমির স্বল্পতার কারণে একটা ফসল উৎপাদন করতে গেলে অন্য ফসলের উৎপাদন ছেঙে দিতে হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকায় ফসলি জমি ভরাট হচ্ছে, ইটের ভবন তৈরি হচ্ছে। তাই এখন আলুও আমদানি করতে হয়। আলপিন থেকে উঙজাহাজ সবই বাংলাদেশ আমদানি করে, আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের দ্বিগুণ। তাই ভারতের পণ্য বয়কট করার সুযোগ একেবারেই নেই। কারণ কোন দেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করা হবে তা সরকার নির্ধারণ করে না, নির্ধারণ করে ব্যবসায়ী। যেখানে কম মূল্যে পণ্য পাবে ব্যবসায়ী সেখান থেকেই পণ্য কিনবে। যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। ভারত থেকে বছরে আমদানি হয় কম-বেশি ১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, একই পণ্য অন্য দেশ থেকে আনতে ব্যয় হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ভারত থেকে আমদানিতে সময় ও পরিবহন খরচ কম লাগে। তাই বেনাপোল দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়পড়তা ৩৫০ ট্রাক আসত, ভারত বয়কটের ডাক দেওয়ার পর এখন আসে ৪০০ ট্রাক।

ভারতীয় পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া গেলে অবশ্যই এই বর্জন সমর্থনযোগ্য; কিন্তু বাংলাদেশের নাক কেটে ভারতের যাত্রাভঙ্গ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সারা পৃথিবীতে ভারত যা রপ্তানি করে তার মাত্র ৩.৫ শতাংশ আসে বাংলাদেশে। তাই ভারতীয় পণ্য বয়কট করলে অচল হয়ে যাবে বাংলাদেশ, ভারত নয়। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৬৪৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ভারত বয়কটের আওয়াজ প্রথম শুরু হয়েছে বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের তরফ থেকে, বিএনপির নীতি নির্ধারক এখন তারা। এদের প্রচারণায় বিএনপি নির্বাচনের সময়ও বিভ্রান্ত হয়েছে।

ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি হয় ৯৭টি পণ্য। যেসব পণ্যের তালিকা দিয়ে বয়কট করতে বলা হচ্ছে সেসব পণ্যের আমদানি ব্যয় মোট আমদানির একটি ক্ষুদ্র অংশ। বেশিরভাগ খরচ হয় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। জ্বালানি ও ভোজ্য তেল, কয়লা, খাদ্যশস্য আমদানির জন্যও কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ভারতের তুলা না হলে বস্ত্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, ভারত থেকে ইঞ্জিন এবং যন্ত্রাংশ আমদানি না করলে পরিবহন সেক্টর অচল হয়ে যাবে। রিজভী সাহেবকে মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে ব্যবসা করার জন্য, লোকসান দিয়ে ভারতকে ঠেকানোর জন্য নয়। অবশ্য ডলার সংকট থাকলে আমদানি এমনিতেই কমে যাবে, বয়কটের প্রয়োজন হবে না।

মালদ্বীপ কিছুদিন ভারতের বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন করে এখন জরুরিভিত্তিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাতে ভারতকে করজোড়ে অনুরোধ করছে। ভারত মালদ্বীপের অনুরোধে সাড়া দিয়ে পণ্য পাঠাচ্ছে। ঠিক তদ্রƒপ বর্জনের ডাক দিয়েও বিএনপি ভারতের কূটনৈতিকদের দাওয়াত করে ইফতার করিয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ভারতকে পাশে থাকার অনুরোধ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের বর্জন নিয়ে হিউমারও আছে, কৌতুক করে বলা হচ্ছে- ভারতের সব বর্জন করা বিএনপির পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের স্ত্রীর বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রচারণায় তারা ভারতীয় পণ্যের বদলে দেশের বা অন্য কোন দেশের পণ্য ব্যবহার করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠেছে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের একটি ভারতীয় চাদর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। আমার ধারণা ছিল, এরপর বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজ নিজ ঘর থেকে শাড়ি, চাদরসহ ভারতীয় পণ্য রাস্তায় এনে লাগাতার পুড়তে থাকবে; কিন্তু নয়াপল্টনের পর ভারতীয় পণ্যের আর একটিও বহ্নি উৎসব হয়নি।

ভারতের পণ্য বর্জন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে, তবে এ বর্জন শুধু মিডিয়ায়। ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ১৯৪৭ সালে যা ছিল এখনো তাই আছে, অনুপাত বিবেচনায় কমেওনি, বাড়েওনি। বিএনপি কিন্তু রিজভীর হটকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়নি; ভারতীয় চাদর পুড়িয়ে দেওয়াকে বিএনপি রিজভীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছে। বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারা জানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা শুধু দেশ নয়, দলীয় সরকারের জন্যও অপরিহার্য।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন একবার ভারতকে বাদ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। এক পেঁয়াজের ধাক্কায় বাংলাদেশ বেসামাল হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ পেঁয়াজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে ধর্ণা দিয়ে মিসর থেকে ডিম্বাকৃতির যে বড় বড় পেঁয়াজ আমদানি করেছিল তার কোন ঝাঁজ ছিল না, কারো খাওয়ার রুচি হয়নি। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভারতের বিরুদ্ধে উষ্কিয়ে দিচ্ছে, রিজভী সাহেব সেই উষ্কানির ফাঁদে পা দিয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ না করেই নিজের দামি কাশ্মীরি শালটি পুড়িয়ে দিলেন। রিজভী সাহেব কুমিল্লার খদ্দর না কিনে কাশ্মীরের দামি শাল কিনতে গেলেন কেন? বাম রাজনীতির আমার এক ভাগ্নেকে ‘খদ্দর কাশেম’ না বললে কেউ এলাকায় চিনে না। বাংলাদেশের তাত, জামদানি এবং টাঙ্গাইল শাডড়র কদর ভারতেও রয়েছে, আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের কসমেটিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতীয় শাড়ির কদর কমার সম্ভাবনা রয়েছে। হজ্ব করে আসার পর আমার স্ত্রীকেও আর শাড়ি পরতে দেখি না। শাড়ি পরলে নাকি নারীর আবরু ঢাকা থাকে নাÑ এমন প্রচারণাও জোরেশোরে চলছে। তবে আমার বিয়ের শাড়ি ভারত থেকে এসেছিল, তা এখনো আলমারিতে আছে। বউকে পুড়তে বলেছিলাম, রাজি হয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন, ভারত পাশে থাকায় জাতীয় নির্বাচনে অন্য কোনো দেশ অশুভ খেলার সাহস করেনি।

পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে সমর্থন বা দেশগুলোর বিরোধিতা করে থাকে। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প বিবৃতি দিয়ে বরিস জনসনকে সমর্থন করেছিলেন, আবার রাশিয়া সমর্থন করে ডনাল্ড ট্রাম্পকে। চীনের সমর্থন থাকায় মায়ানমার গোটা বিশ্বকেই থোড়াই কেয়ার করে। আমেরিকার সমর্থন থাকায় ইসরায়েল ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠাতে শুধু একটি ধাক্কার অপেক্ষায় ছিল বিএনপি। ভারতও এমনই নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যাচ্ছে।

রাজনীতিতে বিএনপির ভারত বিরোধী অবস্থান পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মতো। ভারত বিরোধিতা আছে বলেই বিএনপি পাকিস্তানপন্থি এবং চীনপন্থিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে থাকে। তাই কারণে-অকারণে ভারত বিরোধিতা বিএনপির রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো যে চাপ সৃষ্টি করেছিলো তা ভেস্তে গেছে ভারতের কারণে। আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলো স্বার্থ ব্যতিরেকে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই চাপ তৈরি করেনি। এমন স্বার্থ ভারতেরও আছে।

ভারত চাইবে না তার সীমান্তে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইর ঘাঁটি আবার গড়ে উঠুক, ভারত চাইবে না বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মতো আবারো ১০ ট্রাক অস্ত্র এনে ভারতের সশস্ত্র গ্রুপের হাতে কেউ তুলে দিক, ভারত চাইবে না বিএনপির খালেদা জিয়ার মতো পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত বাতিল করে তাদের রাষ্ট্রপতিকে আবার কেউ অপমান করুক, ভারত চাইবে না পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য ফেনী পর্যন্ত দখল করার অপবাদ আবার তাদের ঘাড়ে এসে পড়–ক। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হলে বাংলাদেশ সহজেই ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারে। ভারতও এক সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সংরক্ষণমূলক নীতির কারণে ১৯৭৭ সালে ভারত থেকে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছিল জনপ্রিয় পানীয় প্রস্তুতকারক সংস্থা কোকা কোলা এবং সফটওয়্যার জায়ান্ট আইবিএম।

ভারতের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই নিজেদের তৈরি অ্যাম্বাসেডর মোটরগাড়ি ব্যবহার করেছেন দীর্ঘদিন। ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ প্রবল, তারা বাংলাদেশ বেড়াতে এলে কিছুই কেনে না। আর ইদ এলেই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি কোলকাতা নিউমার্কেটে গিয়ে বস্তায় বস্তায় জিনিস কেনে। লক্ষ লক্ষ লোক চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়, ঘুরে এসে দল-মত নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। ভিসা ফি, বিমান-হোটেল ভাড়া, খাবার, পরিবহন, কেনাকাটি প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সব অর্থ পাচ্ছে ভারত; কিন্তু রিজভী সাহেবের ডাকে বাংলাদেশের মানুষ কেন সাড়া দিচ্ছে না, কেন বিএনপির অন্ধ সমর্থকরাও বয়কট মানছে না, তা রিজভী সাহেব ভালো করেই জানেন।

বাংলাদেশের ছোট্ট ভূখ-টি ১৮ কোটি মানুষের খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে, জমির স্বল্পতার কারণে একটা ফসল উৎপাদন করতে গেলে অন্য ফসলের উৎপাদন ছেঙে দিতে হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকায় ফসলি জমি ভরাট হচ্ছে, ইটের ভবন তৈরি হচ্ছে। তাই এখন আলুও আমদানি করতে হয়। আলপিন থেকে উঙজাহাজ সবই বাংলাদেশ আমদানি করে, আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের দ্বিগুণ। তাই ভারতের পণ্য বয়কট করার সুযোগ একেবারেই নেই। কারণ কোন দেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করা হবে তা সরকার নির্ধারণ করে না, নির্ধারণ করে ব্যবসায়ী। যেখানে কম মূল্যে পণ্য পাবে ব্যবসায়ী সেখান থেকেই পণ্য কিনবে। যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। ভারত থেকে বছরে আমদানি হয় কম-বেশি ১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, একই পণ্য অন্য দেশ থেকে আনতে ব্যয় হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ভারত থেকে আমদানিতে সময় ও পরিবহন খরচ কম লাগে। তাই বেনাপোল দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়পড়তা ৩৫০ ট্রাক আসত, ভারত বয়কটের ডাক দেওয়ার পর এখন আসে ৪০০ ট্রাক।

ভারতীয় পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া গেলে অবশ্যই এই বর্জন সমর্থনযোগ্য; কিন্তু বাংলাদেশের নাক কেটে ভারতের যাত্রাভঙ্গ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সারা পৃথিবীতে ভারত যা রপ্তানি করে তার মাত্র ৩.৫ শতাংশ আসে বাংলাদেশে। তাই ভারতীয় পণ্য বয়কট করলে অচল হয়ে যাবে বাংলাদেশ, ভারত নয়। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৬৪৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ভারত বয়কটের আওয়াজ প্রথম শুরু হয়েছে বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের তরফ থেকে, বিএনপির নীতি নির্ধারক এখন তারা। এদের প্রচারণায় বিএনপি নির্বাচনের সময়ও বিভ্রান্ত হয়েছে।

ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি হয় ৯৭টি পণ্য। যেসব পণ্যের তালিকা দিয়ে বয়কট করতে বলা হচ্ছে সেসব পণ্যের আমদানি ব্যয় মোট আমদানির একটি ক্ষুদ্র অংশ। বেশিরভাগ খরচ হয় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। জ্বালানি ও ভোজ্য তেল, কয়লা, খাদ্যশস্য আমদানির জন্যও কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ভারতের তুলা না হলে বস্ত্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, ভারত থেকে ইঞ্জিন এবং যন্ত্রাংশ আমদানি না করলে পরিবহন সেক্টর অচল হয়ে যাবে। রিজভী সাহেবকে মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে ব্যবসা করার জন্য, লোকসান দিয়ে ভারতকে ঠেকানোর জন্য নয়। অবশ্য ডলার সংকট থাকলে আমদানি এমনিতেই কমে যাবে, বয়কটের প্রয়োজন হবে না।

মালদ্বীপ কিছুদিন ভারতের বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন করে এখন জরুরিভিত্তিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাতে ভারতকে করজোড়ে অনুরোধ করছে। ভারত মালদ্বীপের অনুরোধে সাড়া দিয়ে পণ্য পাঠাচ্ছে। ঠিক তদ্রƒপ বর্জনের ডাক দিয়েও বিএনপি ভারতের কূটনৈতিকদের দাওয়াত করে ইফতার করিয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ভারতকে পাশে থাকার অনুরোধ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের বর্জন নিয়ে হিউমারও আছে, কৌতুক করে বলা হচ্ছে- ভারতের সব বর্জন করা বিএনপির পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের স্ত্রীর বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]

back to top