alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০২৪

পরিবেশ সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২২ এপ্রিল বিশ্বের ১৯৩টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ‘ধরিত্রী দিবস’ বা ‘আর্থ ডে’। পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখাই হলো এই দিনটির মূল লক্ষ্য। পৃথিবীকে রক্ষা করা ও বাসযোগ্য রাখতে বছরের এই দিনটি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। আর ধরিত্রী শব্দটি এসেছে ধরণি বা ধরা থেকে। যার অর্থ হলো পৃথিবী। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসম্মতভাবে ধার্য করা একটি দিবস হলো বিশ্ব ধরিত্রী দিবস।

১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল প্রথমবার পালিত হয়েছিল এই দিবস। ১৯৬৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাককনেল পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটা দিন উৎসর্গ করতে প্রস্তাব করেন। তবে ১৯৭০-এর ২১ মার্চ উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিনে এই দিনটি উদযাপিত হয়।

পরবর্তীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গেলর্ড নেলসন ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল ‘আর্থ ডে’-এর প্রচলন করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহায়তায় এ দিন আয়োজন করা হয় প্রথম ধরিত্রী দিবস। প্রায় ২ কোটি মানুষ দিনটি উদযাপন করেছিলেন। জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমেরিকার প্রচুর মানুষ এ দিন রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই থেকেই দিনটির সূত্রপাত। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে ১৯৭০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন আইন। তবুও আজ পৃথিবী সংকটের মুখে।

জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাঙানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, পৃথিবীকে সুরক্ষিত ও বাসযোগ্য রাখতে বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয় এবং পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বার্তা দেয়া হয়।

পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। সাধারণ মানুষ প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকেই দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপদাহ। এমন তীব্র তাপদাহে হাঁপিয়ে উঠছে জনজীবন। এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং আরও বাড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প অস্বস্তি আরও বাড়াতে পারে।

সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪২.৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রার তেমন কোনো পার্থক্য না থাকায় এ অঞ্চলের জনজীবন খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই প্রচ- গরমে শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সতর্ক না হলে যে কেউ সাধারণ পানিশূন্যতা, বদহজম থেকে হিটস্ট্রোকে ভুগতে পারে।

বাংলাদেশ এখন নিয়মিত তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তীব্র গরমের কারণে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও ৭ দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকছে।

তাই আমরা পৃথিবীকে যদি মানুষের বাসযোগ্য রাখতে চাই, তবে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। গাছকে ভালোবাসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গাছ লাগালেই হবে না। গাছ বাঁচাতে হবে। আসছে বর্ষায় যদি আমরা সবাই কমপক্ষে দুটি করে গাছ লাগাই তবে আগামী ১০ বছরে তাপমাত্রা বাড়ার বদলে উল্টো সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে এবং ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসও কমবে। আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে। সরকারিভাবে আরও গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা উচিত আর সরকারের অনুমতি ছাড়া বড় গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন পুরো মানবজাতির বড় ইস্যু হয়ে গেছে। আর আমাদের বসবাসযোগ্য এ ধরিত্রীর বয়স আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর।

ধরিত্রীর এ দীর্ঘ পরিক্রমায় ধরিত্রী যেমন সুগঠিত হয়েছে, তেমন ধারণ করেছে নানা প্রাকৃতিক উপাদান। যেখানে মানবজাতির আগমন অনেক পরে। ধরিত্রী নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। এ নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই দেখা দেয় বিপর্যয়। ধরিত্রীর এ শৃঙ্খল তার প্রতিটি উপাদানকে একটি একক নিয়মে আবদ্ধ করে রাখে। তাই যখন ধরিত্রীর এই শৃঙ্খলে কোনোভাবে আঘাত আসে, তখন তার প্রভাব প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের ওপর পরে। আমরা মানবজাতি প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন হওয়ার সুবিধার্থে পরিবেশ-প্রকৃতি তথা ধরিত্রীকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের সুযোগটা আমরাই নিয়ে থাকি। কিন্তু পরিবেশের প্রতি আমাদের প্রভুত্বমূলক আচরণ, প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার, উন্নত জীবনযাপন করতে গিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্যে আঘাতÑ এসবই ধরিত্রীর আজকের বিপর্যয়ের কারণ।

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির সবকিছু একপক্ষীয়ভাবে ভোগ করে আসছে, যার কারণে আমরা আমাদের চাহিদার সীমানাকে নির্দিষ্ট করতে ভুলে গেছি। আমাদের ভোগ-বিলাসপূর্ণ অফুরন্ত চাহিদা আর উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনভূমির ধ্বংস, কলকারখানা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউস গ্যাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের নিঃসরণ, ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ব্যবহারসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত আছি, যার আবশ্যিক ফল হিসেবে মাটি, পানি, বায়ুদূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, মানুষের দেহে করোনার মতো আরও অনেক নিরাময়অযোগ্য ভয়াবহ রোগের আক্রমণ। এসবই আমাদের মানবসমাজের কৃতকর্মের প্রতি আঙুল দেখিয়ে দিয়ে যায়। তাই আমরা কোনোভাবেই শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আমাদের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যেতে পারি না।

১৮০০ সালের আগপর্যন্ত ধরিত্রী এবং ধরিত্রীর সংকট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর না থাকলেও পৃথিবীর বিরূপ আচরণ মানুষকে পৃথিবী নিয়ে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দেয়, যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানা আন্দোলন। এরকম কিছু আন্দোলনের মধ্যে সত্তরের দশকে নরওয়েজিয়ান দার্শনিক আর্ন নায়েস ও জর্জ সেশনের নেতৃত্বে ‘গভীর বাস্তুবিদ্যা’ আন্দোলন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেধা পটেকারের নেতৃত্বে ‘নর্দমা বাঁচাও’, ‘জঙ্গল বাঁচাও’ আন্দোলন, পক্ষীবিশারদ সেলিম আলীর নেতৃত্বে ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ আন্দোলন, অতি সম্প্রতি পরিবেশদূষণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে ১৬ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া সুইডিশ বালিকা গ্রেটা থুনবার্গের ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এসবই ধরিত্রী রক্ষা করার একেকটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।

এসব বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ছাড়াও ধরিত্রী বাঁচাতে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু নৈতিক কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে যায়। এ জায়গা থেকে আমরা কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো আমরা মানবজাতি একটি স্বতন্ত্র উপাদান। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত হবে না প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান, যেমনÑ অন্য প্রাণী, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র বালুকণা পর্যন্ত কোনো উপাদানকে নিজেদের সীমিত প্রয়োজনের বাইরে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য নির্বিচারে ব্যবহার করা।

আমাদের উচিত প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে সম্মান করা। যেহেতু জীবন ধারণে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেহেতু প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের নিজেদের জীবন রক্ষার সঙ্গেই সমানুপাতিক। আর প্রকৃতি কিংবা এই ধরিত্রীর একটা সুনির্দিষ্ট ব্যালেন্স রয়েছে। পৃথিবীর মানুষ যখন সেই ব্যালেন্সকে নানাভাবে উৎপীড়নের মাধ্যমে ধ্বংস করে, তখন ধরিত্রী এর বিপরীতে কঠিন আচরণ করে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, তোরা মানুষ হ। কিন্তু আমরা তারপরেও সেই রূঢ় আচরণ থেকে পিছপা হই না।

শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমেই মানুষ প্রথমে এই ধরিত্রীকে নষ্ট করার কৌশল রপ্ত করেছে। যুগে যুগে নগরায়ন পদ্ধতিগুলো এই প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য অন্যতম ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি। বন উজাড় করে শিল্প গড়ে তোলাও তাই। ফলে ধরিত্রীর ওপর একটা চাপ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতির প্রাণী বৈচিত্র্যের যে স্বাভাবিকতা, সেটা নষ্ট হওয়ার ফলেই এসব মহামারী সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরেও এই ধরিত্রীর যতœ নেয়ার জন্য মানুষের মধ্যে কোনো সাড়া জাগেনি। এটাই একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

তাই আমাদের উচিত হবে আরও সচেতন হওয়া। অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বিপর্যয়মুক্ত পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধের স্থান থেকে আজকের ধরিত্রী দিবসের শপথ হোকÑ প্রকৃতিকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে মানবঅস্তিত্বের সংকটকে উত্তরণ।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০২৪

পরিবেশ সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২২ এপ্রিল বিশ্বের ১৯৩টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ‘ধরিত্রী দিবস’ বা ‘আর্থ ডে’। পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখাই হলো এই দিনটির মূল লক্ষ্য। পৃথিবীকে রক্ষা করা ও বাসযোগ্য রাখতে বছরের এই দিনটি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। আর ধরিত্রী শব্দটি এসেছে ধরণি বা ধরা থেকে। যার অর্থ হলো পৃথিবী। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসম্মতভাবে ধার্য করা একটি দিবস হলো বিশ্ব ধরিত্রী দিবস।

১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল প্রথমবার পালিত হয়েছিল এই দিবস। ১৯৬৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাককনেল পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটা দিন উৎসর্গ করতে প্রস্তাব করেন। তবে ১৯৭০-এর ২১ মার্চ উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিনে এই দিনটি উদযাপিত হয়।

পরবর্তীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গেলর্ড নেলসন ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল ‘আর্থ ডে’-এর প্রচলন করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহায়তায় এ দিন আয়োজন করা হয় প্রথম ধরিত্রী দিবস। প্রায় ২ কোটি মানুষ দিনটি উদযাপন করেছিলেন। জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমেরিকার প্রচুর মানুষ এ দিন রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই থেকেই দিনটির সূত্রপাত। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে ১৯৭০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন আইন। তবুও আজ পৃথিবী সংকটের মুখে।

জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাঙানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, পৃথিবীকে সুরক্ষিত ও বাসযোগ্য রাখতে বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয় এবং পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বার্তা দেয়া হয়।

পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। সাধারণ মানুষ প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকেই দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপদাহ। এমন তীব্র তাপদাহে হাঁপিয়ে উঠছে জনজীবন। এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং আরও বাড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প অস্বস্তি আরও বাড়াতে পারে।

সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪২.৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রার তেমন কোনো পার্থক্য না থাকায় এ অঞ্চলের জনজীবন খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই প্রচ- গরমে শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সতর্ক না হলে যে কেউ সাধারণ পানিশূন্যতা, বদহজম থেকে হিটস্ট্রোকে ভুগতে পারে।

বাংলাদেশ এখন নিয়মিত তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তীব্র গরমের কারণে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও ৭ দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকছে।

তাই আমরা পৃথিবীকে যদি মানুষের বাসযোগ্য রাখতে চাই, তবে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। গাছকে ভালোবাসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গাছ লাগালেই হবে না। গাছ বাঁচাতে হবে। আসছে বর্ষায় যদি আমরা সবাই কমপক্ষে দুটি করে গাছ লাগাই তবে আগামী ১০ বছরে তাপমাত্রা বাড়ার বদলে উল্টো সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে এবং ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসও কমবে। আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে। সরকারিভাবে আরও গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা উচিত আর সরকারের অনুমতি ছাড়া বড় গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন পুরো মানবজাতির বড় ইস্যু হয়ে গেছে। আর আমাদের বসবাসযোগ্য এ ধরিত্রীর বয়স আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর।

ধরিত্রীর এ দীর্ঘ পরিক্রমায় ধরিত্রী যেমন সুগঠিত হয়েছে, তেমন ধারণ করেছে নানা প্রাকৃতিক উপাদান। যেখানে মানবজাতির আগমন অনেক পরে। ধরিত্রী নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। এ নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই দেখা দেয় বিপর্যয়। ধরিত্রীর এ শৃঙ্খল তার প্রতিটি উপাদানকে একটি একক নিয়মে আবদ্ধ করে রাখে। তাই যখন ধরিত্রীর এই শৃঙ্খলে কোনোভাবে আঘাত আসে, তখন তার প্রভাব প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের ওপর পরে। আমরা মানবজাতি প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন হওয়ার সুবিধার্থে পরিবেশ-প্রকৃতি তথা ধরিত্রীকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের সুযোগটা আমরাই নিয়ে থাকি। কিন্তু পরিবেশের প্রতি আমাদের প্রভুত্বমূলক আচরণ, প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার, উন্নত জীবনযাপন করতে গিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্যে আঘাতÑ এসবই ধরিত্রীর আজকের বিপর্যয়ের কারণ।

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির সবকিছু একপক্ষীয়ভাবে ভোগ করে আসছে, যার কারণে আমরা আমাদের চাহিদার সীমানাকে নির্দিষ্ট করতে ভুলে গেছি। আমাদের ভোগ-বিলাসপূর্ণ অফুরন্ত চাহিদা আর উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনভূমির ধ্বংস, কলকারখানা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউস গ্যাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের নিঃসরণ, ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ব্যবহারসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত আছি, যার আবশ্যিক ফল হিসেবে মাটি, পানি, বায়ুদূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, মানুষের দেহে করোনার মতো আরও অনেক নিরাময়অযোগ্য ভয়াবহ রোগের আক্রমণ। এসবই আমাদের মানবসমাজের কৃতকর্মের প্রতি আঙুল দেখিয়ে দিয়ে যায়। তাই আমরা কোনোভাবেই শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আমাদের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যেতে পারি না।

১৮০০ সালের আগপর্যন্ত ধরিত্রী এবং ধরিত্রীর সংকট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর না থাকলেও পৃথিবীর বিরূপ আচরণ মানুষকে পৃথিবী নিয়ে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দেয়, যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানা আন্দোলন। এরকম কিছু আন্দোলনের মধ্যে সত্তরের দশকে নরওয়েজিয়ান দার্শনিক আর্ন নায়েস ও জর্জ সেশনের নেতৃত্বে ‘গভীর বাস্তুবিদ্যা’ আন্দোলন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেধা পটেকারের নেতৃত্বে ‘নর্দমা বাঁচাও’, ‘জঙ্গল বাঁচাও’ আন্দোলন, পক্ষীবিশারদ সেলিম আলীর নেতৃত্বে ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ আন্দোলন, অতি সম্প্রতি পরিবেশদূষণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে ১৬ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া সুইডিশ বালিকা গ্রেটা থুনবার্গের ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এসবই ধরিত্রী রক্ষা করার একেকটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।

এসব বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ছাড়াও ধরিত্রী বাঁচাতে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু নৈতিক কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে যায়। এ জায়গা থেকে আমরা কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো আমরা মানবজাতি একটি স্বতন্ত্র উপাদান। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত হবে না প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান, যেমনÑ অন্য প্রাণী, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র বালুকণা পর্যন্ত কোনো উপাদানকে নিজেদের সীমিত প্রয়োজনের বাইরে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য নির্বিচারে ব্যবহার করা।

আমাদের উচিত প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে সম্মান করা। যেহেতু জীবন ধারণে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেহেতু প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের নিজেদের জীবন রক্ষার সঙ্গেই সমানুপাতিক। আর প্রকৃতি কিংবা এই ধরিত্রীর একটা সুনির্দিষ্ট ব্যালেন্স রয়েছে। পৃথিবীর মানুষ যখন সেই ব্যালেন্সকে নানাভাবে উৎপীড়নের মাধ্যমে ধ্বংস করে, তখন ধরিত্রী এর বিপরীতে কঠিন আচরণ করে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, তোরা মানুষ হ। কিন্তু আমরা তারপরেও সেই রূঢ় আচরণ থেকে পিছপা হই না।

শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমেই মানুষ প্রথমে এই ধরিত্রীকে নষ্ট করার কৌশল রপ্ত করেছে। যুগে যুগে নগরায়ন পদ্ধতিগুলো এই প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য অন্যতম ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি। বন উজাড় করে শিল্প গড়ে তোলাও তাই। ফলে ধরিত্রীর ওপর একটা চাপ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতির প্রাণী বৈচিত্র্যের যে স্বাভাবিকতা, সেটা নষ্ট হওয়ার ফলেই এসব মহামারী সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরেও এই ধরিত্রীর যতœ নেয়ার জন্য মানুষের মধ্যে কোনো সাড়া জাগেনি। এটাই একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

তাই আমাদের উচিত হবে আরও সচেতন হওয়া। অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বিপর্যয়মুক্ত পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধের স্থান থেকে আজকের ধরিত্রী দিবসের শপথ হোকÑ প্রকৃতিকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে মানবঅস্তিত্বের সংকটকে উত্তরণ।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

back to top