alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

রেজাউল করিম খোকন

: মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪

একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিÑ সব মিলিয়ে আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর চমকপ্রদ উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে দেশের সামগ্রিক আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনে নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে। প্রান্তিক মানুষও এখন ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এটা আজ সবাই উপলদ্ধি করেছেন, আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। আগে দূরবর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বয়স্ক, বিধবা, অস্বচ্ছল, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের অনেক দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হতো। সাধারণ দুস্থ, দরিদ্র অসহায় মানুষের সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিনের অবসান ঘটেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের জাদু সব কষ্ট দুর্ভোগ একনিমিষেই দূর করে দিয়েছে তাদের। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা তাদের ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দ্রুত এবং ঝামেলা ছাড়াই। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস মানে এমএফএস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ এখন হাতে হাতে নগদ লেনদেনের বদলে নগদবিহীন আর্থিক লেনদেনের অর্থাৎ ক্যাশলেস সোসাইটির কথা ভাবছে। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি ঝামেলা ও বিড়ম্বনা এড়াতে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারে ঝুঁকে পড়ছেন দেশের মানুষ। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক প্রকাশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগে প্রবেশের কারণে আমাদের জীবনযাপন অনেকটা পাল্টে গেছে। আজকাল ব্যাংকের শাখায় না গিয়েও চেক উপস্থাপন না করে টাকা তোলা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত এবং খুব কম সময়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা পাঠানোর অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগে ব্যাংকে গিয়ে টিটি কিংবা ডিডি অথবা পে-অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হতো। তাতে অনেক সময় লেগে যেত প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী স্বপ্ন হচ্ছে দেশের সব ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে। নগদ অর্থে আর লেনদেন হবে না, উন্নতির ধারাবাহিকতায় এমন পরিবেশের দিকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে।

ক্যাশলেস সোসাইটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাত্র ৫ সেকেন্ডে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা এই সেবা পাওয়া যাবে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে টাকা পাবে। যে টাকাটা তারা একটা দোকানে গিয়ে খরচ করবে, সেটাও তারা মোবাইলে পেমেন্ট করে দেবে। তাদের হাতে আর ক্যাশ রাখার প্রয়োজন হবে না। তাদের কষ্ট করে আয় করা টাকাটা তাদের থেকে কেউ চুরি করে নিতে পারবে না।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবার বিকাশ এখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে গতিশীল করেছে। মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার ধরনও পাল্টে গেছে এখন। ডিজিটাল ফাইন্যান্স অনুন্নত গ্রামীণ জীবনে অত্যাধুনিক আর্থিক লেনদেন সেবাকে সহজলভ্য করেছে। যা আগের গতানুগতিক, প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না। কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যায়নি তা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন ডিজিটাল রেমিটারের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ খুব কম সময়ের মধ্যে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের মোকাবিলায় সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের জন্যও আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সুবাধে শুধু টাকা জমা দেয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তর নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করতে পারছেন সবাই। এতে ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বেঁচে যাচ্ছে, ব্যাংকে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের চাপ কমছে। তাছাড়া নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি দূর করেছে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। শুধু পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কী ঘটছে, দেখা যায়। এ ধারা থেকে ব্যাংকিং সেক্টর পিছিয়ে থাকবে কেন? একসময় যে ব্যাংক আমানত গ্রহণ, হিসাবরক্ষণ আর ঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ সে ব্যাংকে কী নেই! শুধু একটি অ্যাকাউন্ট থাকলে বেতন গ্রহণ, ইউটিলিটিসহ প্রায় সব ধরনের বিল প্রদান সম্ভব। আগে যে ব্যাংকে সামান্য একটি হিসাব বের করতে লেজার বুক নামে বড় বড় হিসাব খাতা কখনও কখনও ঘণ্টাব্যাপী খুঁজতে হতো, আজ মাত্র একটি ক্লিকে সব হিসাব বের করা সম্ভব।

প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষকে গড়ে তুলেছে স্মার্ট হিসেবে। তারা এখন ঝামেলা পছন্দ করে না। সহজ জিনিসটাই তাদের বেশি পছন্দ। এই জটিল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই। পেপারলেস ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং লেনদেন, যা ইলেকট্রনিক উপায়ে পরিচালিত। এটি কাগজের ব্যবহার কমাতে, প্রক্রিয়াগুলো সংক্ষিপ্ত করতে এবং গ্রাহকদের আরও সুবিধাজনক উপায়ে আর্থিক হিসাব পরিচালনা করার পন্থা জোগায়।

মানুষ আজকাল খুব একটা ক্যাশ বহন করতে চায় না। এতে রয়েছে ঝুঁকি আর ঝামেলা। যেখানে একটি বারকোড স্ক্যান করলে সব পেমেন্ট করা যায়, সেখানে এত ঝামেলা না নেয়াই স্বাভাবিক। তাই এখন ব্যাংকগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকে গিয়ে চেক লেখা, কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো বা নির্দিষ্ট লোকেশনে গিয়ে ব্যাংকের শাখায় টাকা জমা-উত্তোলন যেমন কষ্টের তেমন সময়ের অপচয়। তাই এখন ব্যাংকগুলো ব্যস্ত জায়গাগুলোতে সিআরএম বুথের ব্যবস্থা করেছে, যেখানে অল্প সময়ে টাকা জমা ও উত্তোলন করা যায় কোনো চেক লেখার ঝামেলা ছাড়াই। কোথাও ঘুরতে যাবেন, টিকেট বা হোটেল বুকিং দেয়া প্রয়োজন।

অনলাইনে টিকেট কেটে বা হোটেল বুকিংয়ে পেমেন্টে পাচ্ছেন আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট। কোনো একটি জিনিস পছন্দ হয়েছে; পর্যাপ্ত টাকা নেই। পকেটে থাকা ক্রেডিট কার্ড থাকলে হয়ে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান। মানুষ আজকাল একের ভেতর সব চায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আজ শুধু সঞ্চয়ের জন্য নয়; বেতন গ্রহণ, অর্থ প্রদান, ই-টিকেটিংÑ সব কাজ করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টই যথেষ্ট। বলে রাখা দরকার, এই পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থার নেপথ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ, যার মধ্যে বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থা অন্যতম। তারও নেপথ্যে আছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।

মূলত ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের দেখানো এ স্বপ্ন যত বাস্তব রূপ নিয়েছে, ততই দেশের অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে ব্যাংক খাত দ্রুত পেপারলেস হওয়ার পথে এগিয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন তাদের সব প্রকল্পের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’কে সবচেয়ে সফল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে পেপার মানির ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেবাকে সহজ ও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

রেজাউল করিম খোকন

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪

একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিÑ সব মিলিয়ে আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর চমকপ্রদ উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে দেশের সামগ্রিক আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনে নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে। প্রান্তিক মানুষও এখন ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এটা আজ সবাই উপলদ্ধি করেছেন, আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। আগে দূরবর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বয়স্ক, বিধবা, অস্বচ্ছল, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের অনেক দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হতো। সাধারণ দুস্থ, দরিদ্র অসহায় মানুষের সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিনের অবসান ঘটেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের জাদু সব কষ্ট দুর্ভোগ একনিমিষেই দূর করে দিয়েছে তাদের। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা তাদের ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দ্রুত এবং ঝামেলা ছাড়াই। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস মানে এমএফএস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ এখন হাতে হাতে নগদ লেনদেনের বদলে নগদবিহীন আর্থিক লেনদেনের অর্থাৎ ক্যাশলেস সোসাইটির কথা ভাবছে। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি ঝামেলা ও বিড়ম্বনা এড়াতে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারে ঝুঁকে পড়ছেন দেশের মানুষ। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক প্রকাশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগে প্রবেশের কারণে আমাদের জীবনযাপন অনেকটা পাল্টে গেছে। আজকাল ব্যাংকের শাখায় না গিয়েও চেক উপস্থাপন না করে টাকা তোলা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত এবং খুব কম সময়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা পাঠানোর অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগে ব্যাংকে গিয়ে টিটি কিংবা ডিডি অথবা পে-অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হতো। তাতে অনেক সময় লেগে যেত প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী স্বপ্ন হচ্ছে দেশের সব ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে। নগদ অর্থে আর লেনদেন হবে না, উন্নতির ধারাবাহিকতায় এমন পরিবেশের দিকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে।

ক্যাশলেস সোসাইটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাত্র ৫ সেকেন্ডে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা এই সেবা পাওয়া যাবে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে টাকা পাবে। যে টাকাটা তারা একটা দোকানে গিয়ে খরচ করবে, সেটাও তারা মোবাইলে পেমেন্ট করে দেবে। তাদের হাতে আর ক্যাশ রাখার প্রয়োজন হবে না। তাদের কষ্ট করে আয় করা টাকাটা তাদের থেকে কেউ চুরি করে নিতে পারবে না।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবার বিকাশ এখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে গতিশীল করেছে। মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার ধরনও পাল্টে গেছে এখন। ডিজিটাল ফাইন্যান্স অনুন্নত গ্রামীণ জীবনে অত্যাধুনিক আর্থিক লেনদেন সেবাকে সহজলভ্য করেছে। যা আগের গতানুগতিক, প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না। কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যায়নি তা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন ডিজিটাল রেমিটারের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ খুব কম সময়ের মধ্যে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের মোকাবিলায় সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের জন্যও আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সুবাধে শুধু টাকা জমা দেয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তর নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করতে পারছেন সবাই। এতে ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বেঁচে যাচ্ছে, ব্যাংকে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের চাপ কমছে। তাছাড়া নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি দূর করেছে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। শুধু পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কী ঘটছে, দেখা যায়। এ ধারা থেকে ব্যাংকিং সেক্টর পিছিয়ে থাকবে কেন? একসময় যে ব্যাংক আমানত গ্রহণ, হিসাবরক্ষণ আর ঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ সে ব্যাংকে কী নেই! শুধু একটি অ্যাকাউন্ট থাকলে বেতন গ্রহণ, ইউটিলিটিসহ প্রায় সব ধরনের বিল প্রদান সম্ভব। আগে যে ব্যাংকে সামান্য একটি হিসাব বের করতে লেজার বুক নামে বড় বড় হিসাব খাতা কখনও কখনও ঘণ্টাব্যাপী খুঁজতে হতো, আজ মাত্র একটি ক্লিকে সব হিসাব বের করা সম্ভব।

প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষকে গড়ে তুলেছে স্মার্ট হিসেবে। তারা এখন ঝামেলা পছন্দ করে না। সহজ জিনিসটাই তাদের বেশি পছন্দ। এই জটিল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই। পেপারলেস ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং লেনদেন, যা ইলেকট্রনিক উপায়ে পরিচালিত। এটি কাগজের ব্যবহার কমাতে, প্রক্রিয়াগুলো সংক্ষিপ্ত করতে এবং গ্রাহকদের আরও সুবিধাজনক উপায়ে আর্থিক হিসাব পরিচালনা করার পন্থা জোগায়।

মানুষ আজকাল খুব একটা ক্যাশ বহন করতে চায় না। এতে রয়েছে ঝুঁকি আর ঝামেলা। যেখানে একটি বারকোড স্ক্যান করলে সব পেমেন্ট করা যায়, সেখানে এত ঝামেলা না নেয়াই স্বাভাবিক। তাই এখন ব্যাংকগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকে গিয়ে চেক লেখা, কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো বা নির্দিষ্ট লোকেশনে গিয়ে ব্যাংকের শাখায় টাকা জমা-উত্তোলন যেমন কষ্টের তেমন সময়ের অপচয়। তাই এখন ব্যাংকগুলো ব্যস্ত জায়গাগুলোতে সিআরএম বুথের ব্যবস্থা করেছে, যেখানে অল্প সময়ে টাকা জমা ও উত্তোলন করা যায় কোনো চেক লেখার ঝামেলা ছাড়াই। কোথাও ঘুরতে যাবেন, টিকেট বা হোটেল বুকিং দেয়া প্রয়োজন।

অনলাইনে টিকেট কেটে বা হোটেল বুকিংয়ে পেমেন্টে পাচ্ছেন আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট। কোনো একটি জিনিস পছন্দ হয়েছে; পর্যাপ্ত টাকা নেই। পকেটে থাকা ক্রেডিট কার্ড থাকলে হয়ে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান। মানুষ আজকাল একের ভেতর সব চায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আজ শুধু সঞ্চয়ের জন্য নয়; বেতন গ্রহণ, অর্থ প্রদান, ই-টিকেটিংÑ সব কাজ করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টই যথেষ্ট। বলে রাখা দরকার, এই পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থার নেপথ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ, যার মধ্যে বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থা অন্যতম। তারও নেপথ্যে আছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।

মূলত ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের দেখানো এ স্বপ্ন যত বাস্তব রূপ নিয়েছে, ততই দেশের অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে ব্যাংক খাত দ্রুত পেপারলেস হওয়ার পথে এগিয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন তাদের সব প্রকল্পের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’কে সবচেয়ে সফল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে পেপার মানির ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেবাকে সহজ ও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top