জাঁ-নেসার ওসমান
‘শুরু করিতেছি বাংলার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত জনগণের নামে যাঁরা পরম করুনাময় এবং অন্তত্য দয়ালু। এই দয়ালু জনগণ যাঁরা দেশের মালিক তাঁদের যেন আজ গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। ডাইনে নড়তে গেলে গলায় টানপড়ে, বামে নড়তে গেলে তো কথাই নেই।
আদরের (মাছ ধরার জন্য যে খাবার ব্যবহার করা হয়) লোভে ইহকাল পরকাল সব ভুলে কেবল মালের ধান্দায় ঘন ঘন লেজ নাড়তে থাকা। মধ্যবিত্তের আফিম খাওয়া!
করিটা কি? এইতো সেদিন পুরো চাকরির পিরিয়ডে বুদ্ধিমত্তা খরচ করে, বন্ধু বান্ধবের সাহায্যে, চাকুরির সুবাদে একটু মাল কামিয়েছি, মাল কতো আর হবে এই সামান্য সাতশ’ কোটি টাকার মতো!
ব্যাস অমনি সবার গাত্রে জ্বালা ধরলো। হিংসায় নীল হয়ে প্রায় সব পত্র-পত্রিকা হলুদ সাংবাদিকতায় খবরের কাগজের পাতায় পাতায় রম্য রচনা শুরু করলো। আর আমার অবস্থা যেন গলায় বেঁধা বড়শির মতো না পারি গিলতে না পারি উগরাতে।
কি করি বলুন? আর এদিকে যারা চার হাজার, পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পগার পার তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই!
সব দোষ ওই বেঁড়ে শালার। বেঁড়ে শালার দোষ কথাটা কোত্থেকে এসেছে জানেন তো?
কি বললেন? জানতেন, কিন্তু মনে নেই? তাহলে ঘটনাটা বলি ইকটু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
অনেক অনেক দিন আগে একদা এক গ্রামের গরিব চাষির পাতা ফাঁদে এক বাঘের লেজ কাটা পড়ে। বাংলা ডিকশনারি অনুসারে লেজকাটাদের মানে লাঙ্গুলহীনদের বেঁড়ে বলা হয়। বাঘটা বেঁড়ে হয়ে পড়লো। তখন বেঁড়ে বাঘ আর অন্য সব বাঘ একত্র হয়ে, দল বেঁধে ওই দরিদ্র কৃষকে খাওয়ার জন্য ওর বাড়ির দিকে এগোতে থাকলো।
জানালা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখে কৃষক হাতে ধানকাটার কাস্তে নিয়ে তাড়াতাড়ি তার উঠানের শিরিষ গাছের মগডালে উঠে পড়ল। কৃষককে গাছের উপরে দেখে বাঘেরা তখন যে বড়সড় বাঘটার লেজ কাটা পড়েছিলো সেই বেঁড়ে বাঘটাকে সবের নিচে বসিয়ে তার পিঠের উপর একজন, আবার আরেক বাঘের পিঠের উপর আর একজন এমনি করে একে একে উঠতে উঠতে যখন বাঘেরা প্রায় কৃষকে ধরে ফেলবে তখন কৃষক চিৎকার করে বলল- ধর শালা বেঁড়ে শালাকে ধর!
আর কৃষকের এই চিৎকার শুনে সবার নিচে থাকা বেঁড়ে বাঘটা ভয়ে নড়ে উঠতেই উপরের সব বাঘগুলো ব্যালেন্স হারিয়ে ধুড়-ধাড় পড়ে গেলো।
বাঘগুলোর কারো পা ভাঙলো, কারো ঘাড় মচকালো। ওরা তখন সব ভয়ে পালিয়ে গেলো আর কৃষকের জান বাঁচলো।
তাই বলছিলাম সব বড় বড় বাঘা বাঘা পিলিয়ারদের বাদদিয়ে আমায় ধরে কেনো টানাটানি শুরু করলেন। আমার দোষটা কোথায়! আমার এখন এমন অবস্থা, গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। নট নড়ন চড়ন। না ডাইনে না বাঁয়ে মোচড় দিতে পারি। কিছু বলতে গেলেই গলায় টান পড়ে। শুধু আমি কেনোÑ ওই যে, আমাদের ফোকটেলের, মানে লোক কাহিনীর ইউসুফ-জুলেখার প্রেম কাহিনীর, অতো বড় বিশ্ববিখ্যাত, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্যাপটেন, বেচারা ইউসুফকে এমন কেচকি মার দিয়েছে যে বেচারা ইফসুফের গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা, নট নড়ন চড়ন।
ইফসুফের জন্য কতো বড় বড় বাঘা বাঘা বিশ্বমানের পাবলিক, কতো দৌড় ঝাঁপ কতো, হামকি ধমকি, কিন্তু না, কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। ইফসুফের গলার বড়শি আর বের হয় না। বেচারা এখন স্যামুয়েল বেকেঁটের ওয়েটিং ফর গোডো নাটকের নায়ক গোডোর জন্য অপেক্ষা করছেন। যদি কোনোদিন দাদা মানে গোডো এসে তার গলার কাঁটা বের করে দেয়!
তাহলে হচ্ছেটা কী? বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় জীবনের পড়ন্তবেলার অশরাফুল মাখলুকাতকে নিয়ে আপনি কোন ব্যবসায়ে মেতে উঠলেন!
কেউ বলে ইয়াবা খায়, কেউ বলে কিডনি খায়! এ যেন খলিলুল্লার মর্গে কলিজা খাওয়ার অবস্থা। এতোদিন এতো নাচানাচি এতো সোশ্যাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়ানো দুরন্ত নাবিকের বর্তমান অবস্থ গলায় বড়শি বেঁধা মাছ। নট নড়ন চড়ন!
প্রকৃতির মাঝে দেখুন যেসব বড় বড় উত্তাল তরঙ্গ সম্বলিত নদ-নদী বিশ্ব মানচিত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছে তারাও আজ বর্ষাকালে মরা নদীতে রূপান্তরিত হয়ে, খালের মতো কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের ওই ইউসুফ জুলেখার ইয়সুফের মতো গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। কিছু করতে গেলেই মমতাময়ী মায়ের আশীর্বাদে নট নড়ন চড়ন!
অথচ সকল লোকের পরম শ্রদ্ধেয় অন্নদা শংকর রায় লিখেছেনÑ ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
বাংলার মালিকরা মানে জনগণ আজ মেট্রোরেলের আশীর্বাদে তাদের জীবনযাত্রা কতো সহজ করেছে। উড়াল সেতু, পদ্মা সেতু, হাইওয়ে সব আজ বাংলার জনগণের সেবায় সদানিয়ত নিয়োজিত। বাংলার প্রতিটি জনগণ আজ দুই হাত তুলে এই সব উন্নয়নের ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য অবিরাম আশীর্বাদ করছেন, আর তখন কিছু নোংরা অর্থপিশাচ লোভী লোকের জন্য, টাকা পাচারকারীর জন্য সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা ওই গলায় বড়শি বেঁধা মাছের মতো। না পারি ডাইনে যেতে না পারি বাঁয়ে।
এখন এই বড়শি যাদের হাতে তাদের উদ্দেশে শ্যামা সঙ্গীতের মতো গেয়ে উঠিÑ ‘সদানন্দময়ী কালী/মহাকালের মনমোহিনী/তুমি...যেমন রাখো তেমনি থাকি মা/যেমন বলাও তেমনি বলি/সদানন্দময়ী কালী...।’
[লেখক : চলচ্চিত্রকার]
জাঁ-নেসার ওসমান
শনিবার, ১১ মে ২০২৪
‘শুরু করিতেছি বাংলার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত জনগণের নামে যাঁরা পরম করুনাময় এবং অন্তত্য দয়ালু। এই দয়ালু জনগণ যাঁরা দেশের মালিক তাঁদের যেন আজ গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। ডাইনে নড়তে গেলে গলায় টানপড়ে, বামে নড়তে গেলে তো কথাই নেই।
আদরের (মাছ ধরার জন্য যে খাবার ব্যবহার করা হয়) লোভে ইহকাল পরকাল সব ভুলে কেবল মালের ধান্দায় ঘন ঘন লেজ নাড়তে থাকা। মধ্যবিত্তের আফিম খাওয়া!
করিটা কি? এইতো সেদিন পুরো চাকরির পিরিয়ডে বুদ্ধিমত্তা খরচ করে, বন্ধু বান্ধবের সাহায্যে, চাকুরির সুবাদে একটু মাল কামিয়েছি, মাল কতো আর হবে এই সামান্য সাতশ’ কোটি টাকার মতো!
ব্যাস অমনি সবার গাত্রে জ্বালা ধরলো। হিংসায় নীল হয়ে প্রায় সব পত্র-পত্রিকা হলুদ সাংবাদিকতায় খবরের কাগজের পাতায় পাতায় রম্য রচনা শুরু করলো। আর আমার অবস্থা যেন গলায় বেঁধা বড়শির মতো না পারি গিলতে না পারি উগরাতে।
কি করি বলুন? আর এদিকে যারা চার হাজার, পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পগার পার তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই!
সব দোষ ওই বেঁড়ে শালার। বেঁড়ে শালার দোষ কথাটা কোত্থেকে এসেছে জানেন তো?
কি বললেন? জানতেন, কিন্তু মনে নেই? তাহলে ঘটনাটা বলি ইকটু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
অনেক অনেক দিন আগে একদা এক গ্রামের গরিব চাষির পাতা ফাঁদে এক বাঘের লেজ কাটা পড়ে। বাংলা ডিকশনারি অনুসারে লেজকাটাদের মানে লাঙ্গুলহীনদের বেঁড়ে বলা হয়। বাঘটা বেঁড়ে হয়ে পড়লো। তখন বেঁড়ে বাঘ আর অন্য সব বাঘ একত্র হয়ে, দল বেঁধে ওই দরিদ্র কৃষকে খাওয়ার জন্য ওর বাড়ির দিকে এগোতে থাকলো।
জানালা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখে কৃষক হাতে ধানকাটার কাস্তে নিয়ে তাড়াতাড়ি তার উঠানের শিরিষ গাছের মগডালে উঠে পড়ল। কৃষককে গাছের উপরে দেখে বাঘেরা তখন যে বড়সড় বাঘটার লেজ কাটা পড়েছিলো সেই বেঁড়ে বাঘটাকে সবের নিচে বসিয়ে তার পিঠের উপর একজন, আবার আরেক বাঘের পিঠের উপর আর একজন এমনি করে একে একে উঠতে উঠতে যখন বাঘেরা প্রায় কৃষকে ধরে ফেলবে তখন কৃষক চিৎকার করে বলল- ধর শালা বেঁড়ে শালাকে ধর!
আর কৃষকের এই চিৎকার শুনে সবার নিচে থাকা বেঁড়ে বাঘটা ভয়ে নড়ে উঠতেই উপরের সব বাঘগুলো ব্যালেন্স হারিয়ে ধুড়-ধাড় পড়ে গেলো।
বাঘগুলোর কারো পা ভাঙলো, কারো ঘাড় মচকালো। ওরা তখন সব ভয়ে পালিয়ে গেলো আর কৃষকের জান বাঁচলো।
তাই বলছিলাম সব বড় বড় বাঘা বাঘা পিলিয়ারদের বাদদিয়ে আমায় ধরে কেনো টানাটানি শুরু করলেন। আমার দোষটা কোথায়! আমার এখন এমন অবস্থা, গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। নট নড়ন চড়ন। না ডাইনে না বাঁয়ে মোচড় দিতে পারি। কিছু বলতে গেলেই গলায় টান পড়ে। শুধু আমি কেনোÑ ওই যে, আমাদের ফোকটেলের, মানে লোক কাহিনীর ইউসুফ-জুলেখার প্রেম কাহিনীর, অতো বড় বিশ্ববিখ্যাত, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্যাপটেন, বেচারা ইউসুফকে এমন কেচকি মার দিয়েছে যে বেচারা ইফসুফের গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা, নট নড়ন চড়ন।
ইফসুফের জন্য কতো বড় বড় বাঘা বাঘা বিশ্বমানের পাবলিক, কতো দৌড় ঝাঁপ কতো, হামকি ধমকি, কিন্তু না, কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। ইফসুফের গলার বড়শি আর বের হয় না। বেচারা এখন স্যামুয়েল বেকেঁটের ওয়েটিং ফর গোডো নাটকের নায়ক গোডোর জন্য অপেক্ষা করছেন। যদি কোনোদিন দাদা মানে গোডো এসে তার গলার কাঁটা বের করে দেয়!
তাহলে হচ্ছেটা কী? বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় জীবনের পড়ন্তবেলার অশরাফুল মাখলুকাতকে নিয়ে আপনি কোন ব্যবসায়ে মেতে উঠলেন!
কেউ বলে ইয়াবা খায়, কেউ বলে কিডনি খায়! এ যেন খলিলুল্লার মর্গে কলিজা খাওয়ার অবস্থা। এতোদিন এতো নাচানাচি এতো সোশ্যাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়ানো দুরন্ত নাবিকের বর্তমান অবস্থ গলায় বড়শি বেঁধা মাছ। নট নড়ন চড়ন!
প্রকৃতির মাঝে দেখুন যেসব বড় বড় উত্তাল তরঙ্গ সম্বলিত নদ-নদী বিশ্ব মানচিত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছে তারাও আজ বর্ষাকালে মরা নদীতে রূপান্তরিত হয়ে, খালের মতো কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের ওই ইউসুফ জুলেখার ইয়সুফের মতো গলায় বড়শি বেঁধা মাছের অবস্থা। কিছু করতে গেলেই মমতাময়ী মায়ের আশীর্বাদে নট নড়ন চড়ন!
অথচ সকল লোকের পরম শ্রদ্ধেয় অন্নদা শংকর রায় লিখেছেনÑ ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
বাংলার মালিকরা মানে জনগণ আজ মেট্রোরেলের আশীর্বাদে তাদের জীবনযাত্রা কতো সহজ করেছে। উড়াল সেতু, পদ্মা সেতু, হাইওয়ে সব আজ বাংলার জনগণের সেবায় সদানিয়ত নিয়োজিত। বাংলার প্রতিটি জনগণ আজ দুই হাত তুলে এই সব উন্নয়নের ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য অবিরাম আশীর্বাদ করছেন, আর তখন কিছু নোংরা অর্থপিশাচ লোভী লোকের জন্য, টাকা পাচারকারীর জন্য সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা ওই গলায় বড়শি বেঁধা মাছের মতো। না পারি ডাইনে যেতে না পারি বাঁয়ে।
এখন এই বড়শি যাদের হাতে তাদের উদ্দেশে শ্যামা সঙ্গীতের মতো গেয়ে উঠিÑ ‘সদানন্দময়ী কালী/মহাকালের মনমোহিনী/তুমি...যেমন রাখো তেমনি থাকি মা/যেমন বলাও তেমনি বলি/সদানন্দময়ী কালী...।’
[লেখক : চলচ্চিত্রকার]