অরূপরতন চৌধুরী
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ পালনে এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে চৎড়ঃবপঃ ঈযরষফৎববহ ভৎড়স ঞড়নধপপড় ওহফঁংঃৎু ওহঃবৎভবধৎবহপব. প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে- ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ শিশু-কিশোর, তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।
কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এ কারণেই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পনের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! ঝুঁকিপূর্ণ এজন্যই যে, অল্প বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলে-মেয়ে কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তো বা তার উপলক্ষ্য থাকে কোন একটি বিশেষ দিন অথবা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সে ভাবে- আজ শুধু আনন্দ, ফুূর্তি করবো। কাল থেকে আর ধূমপান-মাদক গ্রহণ করবো না, প্রতিজ্ঞা করবো। ধূমপান, মাদকের নেশা খুবই ক্ষতিকর, মারাত্মক আসক্তি সৃষ্টি করে। সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও কৌতূহলবশত যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই তারা ভয়াবহ মাদকের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে, যদিও তারা অমিত সম্ভাবনাময় নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এর ফলে সমাজে এখন ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে; যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকার প্রধানের উদ্বেগ যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে আমাদের। শিশু-কিশোর, তরুণদের নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তারাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। জাতীয় অসংখ্য উদ্যোগ, লক্ষ্যমাত্রা এবং সেগুলোর সাফল্যও নির্ভর করছে তাদের ওপর।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরো একটা অংশ রয়েছে যারা এই গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদ অভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এষড়নধষ ঝপযড়ড়ষ ইধংবফ ঝঃঁফবহঃ ঐবধষঃয ঝঁৎাবু-২০১৪ গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!
নাটক, সিনেমা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধূমপানের দৃশ্য দেখে যা মনে হয়, শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নিজের বাসা ও অফিস সংলগ্ন স্বনামধন্য স্কুলের নবম-দশম শ্রেণীর কিশোর ও কলেজের সদ্য ভর্তি হওয়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ভয়-ডরহীনভাবে হিরোদের মতো প্রকাশ্যে সিগারেট সেবন করতে দেখি প্রায়ই। সেই সঙ্গে ই-সিগারেটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। সিগারেটের ধোঁয়া অভিভাবক সমতুল্য বয়োজেষ্ঠদের নাকে-মুখে ছুড়ছে অবলীলায়! প্রতিবাদ করলে নিজের ওপর বিপদ ধেঁয়ে আসতে পারে ভেবে অনেকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন।
শৈশব, কৈশোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়ে তারা নিজেকে গড়তে শিখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন এবং আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এই সময়ে সে কোন ভুল করে বসে বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তবে, তার পুরো জীবনটাই মূল্যহীন, বৃথা হয়ে যায়। তাই এই সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেজন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেটা করতে পারেন অভিনয় শিল্পী, কলা-কূশলীরা। তো এরাই যদি অকারণে, অযাচিতভাবে বিনোদন মাধ্যমগুলোতে সিগারেট, এলকোহল, মাদকের বিজ্ঞাপন চালায় তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম রসাতলে যাবে। আইডলরা সচেতনভাবেই যদি শিশু-কিশোরদের মগজে ‘নেশার ইনজেকশন’ পুশ করতে থাকেন তবে ফলাফল আরো ভয়াবহ হতে পার। তখন নিজের খেয়ে বনের মোশ তাঁড়ানো সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে আসা আমাদের মতো লোকদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কেননা আমি ১০ জনকে তামাকের নেশা ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করছি কিন্তু, তারা ১০০ জনকে উৎসাহিত করছে! আমাদের প্রচেষ্টা অনেকটা সমুদ্রে বালতি দিয়ে পানি সেচার মতো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অনেক বেশি। তারা সন্তানকে এ ব্যাপারে কথা বলবেন, সাবধান করবেন।
ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ বেড়ে যাচ্ছে। মূলত রেস্টুরেন্ট মালিকদের সুবিধা দিয়ে সেগুলো তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসা প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। লক্ষ্য করলে দেখবেন, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট কোম্পানির কৌশলী বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৫ অনুসারে, তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরেও সিগারেট কোম্পানিগুলো যা করছে তা রীতিমতো আইনের লঙ্ঘণ ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ!
তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! মূলত, কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি দেশে সু-কৌশলে ই-সিগারেট বাজারজাত করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটর জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। ফ্যাশন হিসেবে নিয়ে উঠতি বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। কেননা, ই-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এসব পণ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে; যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আর্কষণের মূল কারণ।
টিসিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে শুধুমাত্র তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় যে, ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এবং ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো সেটার সুযোগ নিচ্ছে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক (বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহারে দেহে ২৫টির বেশি প্রাণঘাতী রোগ হয় যার মধ্যে অনত্যম হলো- ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার অন্যতম। দেশে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, কয়েক লক্ষ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তামাকের কারণে। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষয়-ক্ষতিও অনেক বেশি। গ্লোব্যাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭ তে দেখা যায়, ৩৫.৫% বা ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ মানুষ (৪৬% পুরুষ ও ২৫.২% নারী) তামাক সেবন করে। ১৮% বা ১ কোটি ৯২ লক্ষ মানুষ (পুরুষ ৩৬.২% ও নারী ০.৮%) ধূমপান করে এবং ২০.৬% বা ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ (পুরুষ ১৬.২% ও নারী ২৪.৮%) ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ১৫ বছরের কমবয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আশঙ্কাজনক তথ্য হলো- এর মধ্যে ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন অসুখে ভোগে। অর্থাৎ তামাকের কারণে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোররা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে, যাতে নিজের ভুলে সন্তানদের ভবিষ্যত হুমকিতে না পড়ে যায়!
তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনী পাস করে বাস্তবায়নে জোর দেয়া প্রয়োজন। তাহলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর যে সুবিধা পাওয়ার কথা তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণরা নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিশ^ তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো সব ধরনের অপকৌশল প্রতিহত করার অঙ্গীকার করি।
[লেখক : সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়)]
অরূপরতন চৌধুরী
শনিবার, ০১ জুন ২০২৪
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ পালনে এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে চৎড়ঃবপঃ ঈযরষফৎববহ ভৎড়স ঞড়নধপপড় ওহফঁংঃৎু ওহঃবৎভবধৎবহপব. প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে- ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ শিশু-কিশোর, তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।
কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এ কারণেই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পনের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! ঝুঁকিপূর্ণ এজন্যই যে, অল্প বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলে-মেয়ে কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তো বা তার উপলক্ষ্য থাকে কোন একটি বিশেষ দিন অথবা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সে ভাবে- আজ শুধু আনন্দ, ফুূর্তি করবো। কাল থেকে আর ধূমপান-মাদক গ্রহণ করবো না, প্রতিজ্ঞা করবো। ধূমপান, মাদকের নেশা খুবই ক্ষতিকর, মারাত্মক আসক্তি সৃষ্টি করে। সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও কৌতূহলবশত যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই তারা ভয়াবহ মাদকের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে, যদিও তারা অমিত সম্ভাবনাময় নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এর ফলে সমাজে এখন ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে; যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকার প্রধানের উদ্বেগ যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে আমাদের। শিশু-কিশোর, তরুণদের নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তারাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। জাতীয় অসংখ্য উদ্যোগ, লক্ষ্যমাত্রা এবং সেগুলোর সাফল্যও নির্ভর করছে তাদের ওপর।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরো একটা অংশ রয়েছে যারা এই গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদ অভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এষড়নধষ ঝপযড়ড়ষ ইধংবফ ঝঃঁফবহঃ ঐবধষঃয ঝঁৎাবু-২০১৪ গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!
নাটক, সিনেমা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধূমপানের দৃশ্য দেখে যা মনে হয়, শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নিজের বাসা ও অফিস সংলগ্ন স্বনামধন্য স্কুলের নবম-দশম শ্রেণীর কিশোর ও কলেজের সদ্য ভর্তি হওয়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ভয়-ডরহীনভাবে হিরোদের মতো প্রকাশ্যে সিগারেট সেবন করতে দেখি প্রায়ই। সেই সঙ্গে ই-সিগারেটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। সিগারেটের ধোঁয়া অভিভাবক সমতুল্য বয়োজেষ্ঠদের নাকে-মুখে ছুড়ছে অবলীলায়! প্রতিবাদ করলে নিজের ওপর বিপদ ধেঁয়ে আসতে পারে ভেবে অনেকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন।
শৈশব, কৈশোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়ে তারা নিজেকে গড়তে শিখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন এবং আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এই সময়ে সে কোন ভুল করে বসে বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তবে, তার পুরো জীবনটাই মূল্যহীন, বৃথা হয়ে যায়। তাই এই সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেজন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেটা করতে পারেন অভিনয় শিল্পী, কলা-কূশলীরা। তো এরাই যদি অকারণে, অযাচিতভাবে বিনোদন মাধ্যমগুলোতে সিগারেট, এলকোহল, মাদকের বিজ্ঞাপন চালায় তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম রসাতলে যাবে। আইডলরা সচেতনভাবেই যদি শিশু-কিশোরদের মগজে ‘নেশার ইনজেকশন’ পুশ করতে থাকেন তবে ফলাফল আরো ভয়াবহ হতে পার। তখন নিজের খেয়ে বনের মোশ তাঁড়ানো সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে আসা আমাদের মতো লোকদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কেননা আমি ১০ জনকে তামাকের নেশা ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করছি কিন্তু, তারা ১০০ জনকে উৎসাহিত করছে! আমাদের প্রচেষ্টা অনেকটা সমুদ্রে বালতি দিয়ে পানি সেচার মতো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অনেক বেশি। তারা সন্তানকে এ ব্যাপারে কথা বলবেন, সাবধান করবেন।
ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ বেড়ে যাচ্ছে। মূলত রেস্টুরেন্ট মালিকদের সুবিধা দিয়ে সেগুলো তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসা প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। লক্ষ্য করলে দেখবেন, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট কোম্পানির কৌশলী বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৫ অনুসারে, তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরেও সিগারেট কোম্পানিগুলো যা করছে তা রীতিমতো আইনের লঙ্ঘণ ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ!
তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! মূলত, কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি দেশে সু-কৌশলে ই-সিগারেট বাজারজাত করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটর জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। ফ্যাশন হিসেবে নিয়ে উঠতি বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। কেননা, ই-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এসব পণ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে; যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আর্কষণের মূল কারণ।
টিসিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে শুধুমাত্র তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় যে, ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এবং ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো সেটার সুযোগ নিচ্ছে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক (বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহারে দেহে ২৫টির বেশি প্রাণঘাতী রোগ হয় যার মধ্যে অনত্যম হলো- ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার অন্যতম। দেশে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, কয়েক লক্ষ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তামাকের কারণে। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষয়-ক্ষতিও অনেক বেশি। গ্লোব্যাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭ তে দেখা যায়, ৩৫.৫% বা ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ মানুষ (৪৬% পুরুষ ও ২৫.২% নারী) তামাক সেবন করে। ১৮% বা ১ কোটি ৯২ লক্ষ মানুষ (পুরুষ ৩৬.২% ও নারী ০.৮%) ধূমপান করে এবং ২০.৬% বা ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ (পুরুষ ১৬.২% ও নারী ২৪.৮%) ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ১৫ বছরের কমবয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আশঙ্কাজনক তথ্য হলো- এর মধ্যে ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন অসুখে ভোগে। অর্থাৎ তামাকের কারণে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোররা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে, যাতে নিজের ভুলে সন্তানদের ভবিষ্যত হুমকিতে না পড়ে যায়!
তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনী পাস করে বাস্তবায়নে জোর দেয়া প্রয়োজন। তাহলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর যে সুবিধা পাওয়ার কথা তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণরা নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিশ^ তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো সব ধরনের অপকৌশল প্রতিহত করার অঙ্গীকার করি।
[লেখক : সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়)]