বশিরুল ইসলাম
চলতি বছর দেশের ইতিহাসে একটানা তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বড় রেকর্ড গড়েছিল। ৩১ মার্চ থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয়, যা ৬ মে পর্যন্ত টানা ৩৭ দিন ধরে চলে। প্রচ- তাপপ্রবাহের কারণে দেশজুড়ে সতর্কবার্তা বা হিট অ্যালার্টও জারি করেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। হিটস্ট্রোকে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন।
এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। চলমান তাপপ্রবাহ বারবার দেশের পরিবেশ ও জলবায়ুর নাজুক পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কেন জানি আসছে না বড় কোনো পরিবর্তন, নেয়া হচ্ছে না শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্যসহ সব সেক্টরেই ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমের মুকুল ঝরে গেছে; দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। চরম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সহসাই এ থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক মানদ-ে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে, যা রীতিমতো লজ্জাজনক।
আসলে, এরকম নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ প্রতি বছরই দেখা যায়। এখন ভাবার সময় হয়েছে, আমরা নিজেরা কতটা যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি! আমরা কয়টা গাছ লাগিয়েছি! আমরা পরিবেশ ধ্বংস করেই নিজেরা পরিবেশবাদী কিনা? এ বছর পরিবেশ দিবসে প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু ছিল, করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা।
ভূমি পুনরুদ্ধার বলতে বোঝানো হয় যে, আমরা যে সব জমি বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলোকে পুনরায় উর্বর করতে হবে এবং সেগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি শুধু মাটি ও পানি সংরক্ষণের জন্যই নয়, বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর মরুময়তা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ভূমি ক্রমাগত শুষ্ক এবং উৎপাদনশীলতা হারাতে থাকে। এই প্রক্রিয়া রোধ করতে হলে আমাদেরকে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে এবং পানি সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার-বেসরকারি সংস্থা এবং সাধারণ জনগণ মিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আমরা মানবজাতি বুঝে না বুঝে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করছি সব থেকে বেশি। তাপপ্রবাহের এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রেখে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস পরিবেশবিজ্ঞানীদের জন্য নতুন আঙ্গিকে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠবে। পরিবেশ রক্ষায় জনমত তৈরি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সচেতন হতে হবে সবার আগে আমাদের নিজেদের।
একবার ভেবে দেখুন প্রকৃতির সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, পানির সঙ্গে, বৃক্ষের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে আসছি আমরা? আইন করেও পলিথিনের অধিক ব্যবহার আমরা আজও কমাতে পারিনি। ঢাকার আশপাশের ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। নগরায়ণ নামে আমরা বনাঞ্চল কেটে ঘরবাড়ি বানাচ্ছি, যার ফলে পশুপাখির অভয়ারণ্য এই পৃথিবীর জায়গা ছোট করে দিচ্ছি। পানি, মাটি সবকিছু দূষণ করে চলছি। আমরা যদি ঢাকা শহরের কোনো উঁচু দালান থেকে এ শহরের দিকে তাকাই তাহলে দেখব দালানে দালানে পুরো নগর এখন ঠাসাঠাসি। ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। আর গাছপালা যেন সোনার হরিণ। এইতো, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বিরতিহীন বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল রাজধানী ঢাকার অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক। এতে বেশির ভাগ এলাকাতেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ফলে নগরবাসী চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।
আসলে, আমরা যতই আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছি, ততই পরিবেশের উপরে চাপ পড়ছে। ফলে বাড়ছে কল কারখানার কালো বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্য। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য, বাসস্থান এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে বনাঞ্চল, নদী-নালা, খাল-বিল। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব স্থানে বসবাস করা বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় বন্যপ্রাণী। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি সংক্ষরণ বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বৃক্ষ। বৃক্ষকে বলা হয় মানুষের পরম বন্ধু। আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন বৃক্ষ সরবরাহ করে এবং মানুষের ত্যাগ করা দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃক্ষ গ্রহণ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯০০ সালের চেয়ে বর্তমানে ১২ গুণ বেশি কার্বন ডাই-আক্সইড নিঃসরণ হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা শহরে তাপদ্বীপ সৃষ্টি করছে। এছাড়া বৃক্ষ আমাদের ফলমূল দিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা এই পরম বন্ধুকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি। অধিক জনসংখ্যার চাপে বন উজাড় করে তৈরি করছি বাসস্থান। তাই বন উজাড়ের বদলে সময় এসেছে বনায়ন বাড়ানোর।
জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি। উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাওয়াসহ, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কিংবা বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধিÑ এ প্রভাবগুলো ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। পরিবর্তিত পরিবেশে, সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, তথা প্রযুক্তি অবলম্বনের মাধ্যমে সঠিক অভিযোজন প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, এ বিষয়ে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অবশ্য জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বন্যপ্রাণীর প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে সেটি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। বাংলাদেশে ১৬০০ প্রাণীর কথা বলা হয়, যার অর্ধেক আজ বিপন্ন। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানের জন্য আপনি বা আমি দায়ী। বিজ্ঞানে পড়েছি, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সব নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আর পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। এর ফলে আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশ হয় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ বিসুখের কারণে। বায়ুদূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয়। পানি দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে চর্মরোগ, টাইফয়েড জন্ডিস বা হেপাইটটিসের মতো রোগ ছড়াতে পারে। দূষণের ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত বা মৃত শিশু প্রসবের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, মাছের মাধ্যমে মানব শরীরে সিসা, প্লাস্টিক কণা ঢুকে যাচ্ছে, শব্দদূষণে হাইপারটেনশন বৃদ্ধি পায়, এমনকি বধির হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১, জাতীয় পরিবেশ নীতি-২০১৮, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এ ধরনের এতসব আইন-বিধি আর নীতিমালার পরেও পরিবেশ বিপর্যয় কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিভিন্ন ধরনের প্রচার ও শিক্ষা কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং আরও বেশি মানুষকে এ কাজে জড়াতে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া, নীতি ও আইনের আওতায় প্রাকৃতিক সভ্যতার নির্মাণ ও সবুজ উন্নয়নের অনুশীলন ত্বরান্বিত করতে হবে। পরিবেশের জন্য গাছ লাগানোর ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। কীভাবে গাছ লাগাতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যাপারে ট্রেনিং ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সরকারের একার পক্ষে দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমি পুনরুদ্ধার করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে।
আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যতই উন্নয়ন করি, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করি না কেন, তা হতে হবে প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষা করে। পরিবেশের ক্ষতি করে, বনাঞ্চল ধ্বংস করে জীববৈচিত্রকে হুমকির মুখে ফেলে কোনো উন্নয়ন করা যাবে না। এটা করলে মানুষ তার নিজের বিপদ নিজেরাই বয়ে আনবে।
[লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]
বশিরুল ইসলাম
সোমবার, ১০ জুন ২০২৪
চলতি বছর দেশের ইতিহাসে একটানা তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বড় রেকর্ড গড়েছিল। ৩১ মার্চ থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয়, যা ৬ মে পর্যন্ত টানা ৩৭ দিন ধরে চলে। প্রচ- তাপপ্রবাহের কারণে দেশজুড়ে সতর্কবার্তা বা হিট অ্যালার্টও জারি করেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। হিটস্ট্রোকে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন।
এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। চলমান তাপপ্রবাহ বারবার দেশের পরিবেশ ও জলবায়ুর নাজুক পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কেন জানি আসছে না বড় কোনো পরিবর্তন, নেয়া হচ্ছে না শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্যসহ সব সেক্টরেই ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমের মুকুল ঝরে গেছে; দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। চরম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সহসাই এ থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক মানদ-ে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে, যা রীতিমতো লজ্জাজনক।
আসলে, এরকম নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ প্রতি বছরই দেখা যায়। এখন ভাবার সময় হয়েছে, আমরা নিজেরা কতটা যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি! আমরা কয়টা গাছ লাগিয়েছি! আমরা পরিবেশ ধ্বংস করেই নিজেরা পরিবেশবাদী কিনা? এ বছর পরিবেশ দিবসে প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু ছিল, করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা।
ভূমি পুনরুদ্ধার বলতে বোঝানো হয় যে, আমরা যে সব জমি বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলোকে পুনরায় উর্বর করতে হবে এবং সেগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি শুধু মাটি ও পানি সংরক্ষণের জন্যই নয়, বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর মরুময়তা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ভূমি ক্রমাগত শুষ্ক এবং উৎপাদনশীলতা হারাতে থাকে। এই প্রক্রিয়া রোধ করতে হলে আমাদেরকে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে এবং পানি সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার-বেসরকারি সংস্থা এবং সাধারণ জনগণ মিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আমরা মানবজাতি বুঝে না বুঝে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করছি সব থেকে বেশি। তাপপ্রবাহের এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রেখে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস পরিবেশবিজ্ঞানীদের জন্য নতুন আঙ্গিকে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠবে। পরিবেশ রক্ষায় জনমত তৈরি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সচেতন হতে হবে সবার আগে আমাদের নিজেদের।
একবার ভেবে দেখুন প্রকৃতির সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, পানির সঙ্গে, বৃক্ষের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে আসছি আমরা? আইন করেও পলিথিনের অধিক ব্যবহার আমরা আজও কমাতে পারিনি। ঢাকার আশপাশের ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। নগরায়ণ নামে আমরা বনাঞ্চল কেটে ঘরবাড়ি বানাচ্ছি, যার ফলে পশুপাখির অভয়ারণ্য এই পৃথিবীর জায়গা ছোট করে দিচ্ছি। পানি, মাটি সবকিছু দূষণ করে চলছি। আমরা যদি ঢাকা শহরের কোনো উঁচু দালান থেকে এ শহরের দিকে তাকাই তাহলে দেখব দালানে দালানে পুরো নগর এখন ঠাসাঠাসি। ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। আর গাছপালা যেন সোনার হরিণ। এইতো, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বিরতিহীন বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল রাজধানী ঢাকার অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক। এতে বেশির ভাগ এলাকাতেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ফলে নগরবাসী চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।
আসলে, আমরা যতই আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছি, ততই পরিবেশের উপরে চাপ পড়ছে। ফলে বাড়ছে কল কারখানার কালো বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্য। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য, বাসস্থান এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে বনাঞ্চল, নদী-নালা, খাল-বিল। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব স্থানে বসবাস করা বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় বন্যপ্রাণী। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি সংক্ষরণ বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বৃক্ষ। বৃক্ষকে বলা হয় মানুষের পরম বন্ধু। আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন বৃক্ষ সরবরাহ করে এবং মানুষের ত্যাগ করা দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃক্ষ গ্রহণ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯০০ সালের চেয়ে বর্তমানে ১২ গুণ বেশি কার্বন ডাই-আক্সইড নিঃসরণ হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা শহরে তাপদ্বীপ সৃষ্টি করছে। এছাড়া বৃক্ষ আমাদের ফলমূল দিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা এই পরম বন্ধুকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি। অধিক জনসংখ্যার চাপে বন উজাড় করে তৈরি করছি বাসস্থান। তাই বন উজাড়ের বদলে সময় এসেছে বনায়ন বাড়ানোর।
জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি। উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাওয়াসহ, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কিংবা বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধিÑ এ প্রভাবগুলো ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। পরিবর্তিত পরিবেশে, সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, তথা প্রযুক্তি অবলম্বনের মাধ্যমে সঠিক অভিযোজন প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, এ বিষয়ে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অবশ্য জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বন্যপ্রাণীর প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে সেটি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। বাংলাদেশে ১৬০০ প্রাণীর কথা বলা হয়, যার অর্ধেক আজ বিপন্ন। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানের জন্য আপনি বা আমি দায়ী। বিজ্ঞানে পড়েছি, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সব নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আর পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। এর ফলে আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশ হয় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ বিসুখের কারণে। বায়ুদূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয়। পানি দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে চর্মরোগ, টাইফয়েড জন্ডিস বা হেপাইটটিসের মতো রোগ ছড়াতে পারে। দূষণের ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত বা মৃত শিশু প্রসবের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, মাছের মাধ্যমে মানব শরীরে সিসা, প্লাস্টিক কণা ঢুকে যাচ্ছে, শব্দদূষণে হাইপারটেনশন বৃদ্ধি পায়, এমনকি বধির হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১, জাতীয় পরিবেশ নীতি-২০১৮, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এ ধরনের এতসব আইন-বিধি আর নীতিমালার পরেও পরিবেশ বিপর্যয় কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিভিন্ন ধরনের প্রচার ও শিক্ষা কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং আরও বেশি মানুষকে এ কাজে জড়াতে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া, নীতি ও আইনের আওতায় প্রাকৃতিক সভ্যতার নির্মাণ ও সবুজ উন্নয়নের অনুশীলন ত্বরান্বিত করতে হবে। পরিবেশের জন্য গাছ লাগানোর ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। কীভাবে গাছ লাগাতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যাপারে ট্রেনিং ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সরকারের একার পক্ষে দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমি পুনরুদ্ধার করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে।
আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যতই উন্নয়ন করি, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করি না কেন, তা হতে হবে প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষা করে। পরিবেশের ক্ষতি করে, বনাঞ্চল ধ্বংস করে জীববৈচিত্রকে হুমকির মুখে ফেলে কোনো উন্নয়ন করা যাবে না। এটা করলে মানুষ তার নিজের বিপদ নিজেরাই বয়ে আনবে।
[লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]