alt

উপ-সম্পাদকীয়

পণ্য বয়কট : বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোকাকোলা বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তর্ক-বিতর্ক। বাংলাদেশে পক্ষে এবং বিপক্ষের লোকসংখ্যা বের করার জন্য জরিপও হয়েছে, জরিপে পরিলক্ষিত হয়েছে ৮৯ শতাংশ লোক কোকাকোলা বর্জনের পক্ষে। গত বছর অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে কোকাকোলা বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে খুব সাড়া মেলেনি। সম্প্রতি কোকাকোলার একটি বিজ্ঞাপন স্তিমিত বয়কটের প্রচারণাকে উসকে দিয়েছে। কোকাকোলার মালিক কোন ইহুদি নয় এবং এর কারখানা গাজায়ও আছেÑএমন কথা বলে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর আবার নতুন উদ্যমে কোকাকোলা বয়কটের আহ্বান আসছে। এই সুযোগে দেশীয় কোমল পানীয়গুলোর বিক্রি বাড়াতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আবেগকে কাজে লাগানো হচ্ছে।

দেশীয় পণ্য ‘মোজো’র প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মোজো সাপোর্ট ফিলিস্তিন’ নামে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম পানীয় উৎপাদনকারী কোকাকোলা ইসরায়েলের পণ্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য। কোকাকোলার নির্দিষ্ট কোন মালিক নেই, এটা একটা পাবলিক লিমিটেড মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি। কোকাকোলা একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে- তাই শেয়ারহোল্ডারাই হচ্ছে কোকাকোলার মালিক। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বে ১৮৮৬ সালে কোকাকোলার বিপণন শুরু হয়।

কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া ব্যতীত সারা বিশ্বে কোকাকোলা বিক্রি এবং তৈরি হয়, ইসরায়েল এবং গাজায় কোকাকোলার দুটি কারখানা আছে। ইসরায়েলে ব্যবসা করতে অস্বীকার করায় কোকাকোলাকে এক সময় ইহুদি-বিরোধী বলে মনে করা হয়েছিল। ইসরায়েলে কোকাকোলার কোন কারখানা না থাকায় আমেরিকার একটি জায়নবাদী গোষ্ঠী ১৯৬৬ সালে কোকাকোলা বয়কট করেছিল, তাদের অভিযোগ ছিল কোকাকোলা আরব দেশগুলোর সমর্থক।

জাতিগত বিদ্বেষের দুর্নাম ঘোচাতে ১৯৬৬ সালে ইসরায়েলে কোকাকোলার কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলে কোকাকোলার কারখানা করার কারণে আরব বিশ্ব কোকাকোলা বয়কট করে। পেপসি এই সুযোগে ইসরায়েলের বাজারে না গিয়ে আরব দেশগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং এজন্য ইসরায়েলের ইহুদিরা পেপসি বয়কট করে। এই জাতীয় সমস্যা উত্তরণে মার্কিন কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতীয়তা বা জাতীয় উৎসের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি বা ব্যবসার প্রতি বৈষম্য করাকে বেআইনি ঘোষণা করে। ফলে ১৯৯২ সালে পেপসি ইসরায়েলেও প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

আমেরিকার অন্যান্য পণ্য বয়কট না করে শুধু কোকাকোলা বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে কেন? বলা হচ্ছে, এক- কোকাকোলা কোম্পানিটি মার্কিন-ইসরায়েলি চেম্বার অব কমার্স অ্যাওয়ার্ডসকে স্পনসর করে এবং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে; দুই- ২০০৯ সালে কোকাকোলা আইপ্যাকের মাধ্যমে লবিংয়ের জন্য যে পুরস্কারটি স্পনসর করেছিল তা গাজায় জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে; আইপ্যাকের কাজ হলো ইসরায়েল সম্পর্কিত বিষয় এবং আইন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে লবিং করা। তিন- ২০০৯ সালে কোকাকোলা যে বেন-এলিয়েজারকে সংবর্ধনা দেয় সেই এলিয়েজার ইসরায়েলের হাতে বন্দী তিন শতাধিক মিসরীয়কে মৃত্যুদ- দিয়েছিল; চার- কোকাকোলার প্রধান শেয়ারহোল্ডার ওয়ারেন বাফেট ইসরায়েলি বল্কের শক্তিশালী প্রচারক এবং ইসরায়েলের বড় বড় কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ রয়েছে।

কোকাকোলার সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কের অনুসন্ধান চললেও কোকাকোলা আমেরিকান পণ্য বলেই বর্জনীয়- এই কথাটি শক্তভাবে কেউ বলছে না। বয়কট এখন বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার। সাম্প্রতিককালে বয়কট সারা বিশ্বেই হচ্ছে। আমেরিকা এখন কথায় কথায় বিভিন্ন দেশের পণ্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। শুধু নিজেদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়, তাদের করা নিষিদ্ধ পণ্য অন্যকেও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর আমলে কিউবার কাছে চটের বস্তা বিক্রি করার কারণে আমেরিকা বাংলাদেশে দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দিয়েছিল। কিউবা, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের শুধু পণ্য নয়, পুরো দেশকেই আমেরিকা বর্জন করে চলেছে এবং এই দেশগুলোর সঙ্গে যারা ব্যবসা করে সেই দেশগুলোর ওপরও নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্যে চীনকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, চীনের প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমছে। বর্তমানে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার কবলে রাশিয়া; রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো বয়কটের নানাবিধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে স্বদেশী আন্দোলনে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করে স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের ডাক দেয়া হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনকে সফল করার জন্য বর্জননীতি ছিল মূল হাতিয়ার। এই স্বদেশী আন্দোলনে ব্রিটিশদের পণ্য বিক্রি ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় পোস্টারে মহাত্মা গান্ধীকে চরকায় সুতা কাটতে দেখা গেছে, তখন দেশি খাদি কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল, খাদিই ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর একমাত্র পরিধেয় বস্ত্র। তবে দেশীয় পণ্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার লক্ষ্যে তাঁত শিল্পে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অন্য কোন সেক্টরে সফলতা আসেনি; সফলতা না আসলেও স্বদেশী আন্দলনের কারণে দেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনের প্রতি ভারতীয়দের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ইহুদি-খ্রিস্টানদের পণ্য ও প্রযুক্তি বর্জন করলে আমাদের জীবন অচল হয়ে যাবে। আমেরিকার মদদে ইসরায়েল বেপরোয়া, আমেরিকার অস্ত্রের আঘাতে গাজায় ৩৮ হাজার নিরস্ত্র জনতা মারা গেছে এবং আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে। তাই শুধু কোকাকোলা নয়, আমেরিকার সব পণ্য বর্জন করা ফরজ; কিন্তু সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় বলেই বয়কটের জন্য শুধু কোকাকোলাকে বেছে নেয়া হয়েছে, কারণ এই পণ্যটি গণমানুষের নিকট সুপরিচিত, বর্জনের আন্দোলনে সাধারণ লোকও অংশ নিতে পারছে। এছাড়াও পণ্যটি মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্যও নয়, বরং পণ্যটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও খেতে ইচ্ছে হলে কোকাকোলার বিকল্প পানীয় বাজারে রয়েছে।

কিন্তু মুসলিমদের জন্য দুঃখজনক হচ্ছে, তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র হচ্ছে প্রতিপক্ষের পণ্য বর্জন। কিন্তু প্রতিকারের কোন অস্ত্র তাদের হাতে নেই। মুসলমানেরা এখনও মহাবীর গাজী সালাউদ্দিনের বীরত্বের স্মৃতিগাথায় আত্মহারা। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, আগের মতো এখন আর পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধ নেই। এখন যুদ্ধ চলছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। এই যুদ্ধে সফল না হলে ৭০ লক্ষ অধিবাসীর ইসরায়েল কখনো ২০০ কোটি মুসলমানের ৫৬টি দেশকে সমীহ করবে না। ইসরায়েল জাতিসংঘের সিদ্ধান্তও মানছে না। এই না মানার প্রধান কারণ হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনায় আরব লীগের মৌন সম্মতি।

কোকাকোলা বর্জন করছে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে আরব লীগ আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় ওঠবস করছে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ ইসরায়েলকে বয়কট করলেও আরব লীগ করেনি; বরং হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে ইসরায়েলের অভিযানে আরব লীগের অধিকাংশ দেশের মৌন সম্মতি রয়েছে। হামাসদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে আরব লীগের কোন কর্মকা- নজরে আসেনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ‘উম্মাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন মুসলিম দেশ মামলা করেনি, মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। অন্যদিকে তুরস্ক শুধু বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, বড় বড় কথা বলছে, কাজের কাজ কিছুই করছে না। তুরস্ক পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মিসর ও জর্ডান ইসরায়েলে রপ্তানি বায়িয়ে দিয়েছে। কোকাকোলা বর্জনের কোন প্রয়োজন হতো না, যদি সব মুসলিম দেশ একযোগে ইসরায়েলকে বর্জন করত। ইসরায়েলকে বর্জন না করে জর্ডান ইরানের ছোড়া গোলা ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র দেশ যে দেশটির জন্ম থেকেই ইসরায়েলকে বর্জন করে চলছে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পণ্য বয়কট : বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোকাকোলা বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তর্ক-বিতর্ক। বাংলাদেশে পক্ষে এবং বিপক্ষের লোকসংখ্যা বের করার জন্য জরিপও হয়েছে, জরিপে পরিলক্ষিত হয়েছে ৮৯ শতাংশ লোক কোকাকোলা বর্জনের পক্ষে। গত বছর অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে কোকাকোলা বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে খুব সাড়া মেলেনি। সম্প্রতি কোকাকোলার একটি বিজ্ঞাপন স্তিমিত বয়কটের প্রচারণাকে উসকে দিয়েছে। কোকাকোলার মালিক কোন ইহুদি নয় এবং এর কারখানা গাজায়ও আছেÑএমন কথা বলে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর আবার নতুন উদ্যমে কোকাকোলা বয়কটের আহ্বান আসছে। এই সুযোগে দেশীয় কোমল পানীয়গুলোর বিক্রি বাড়াতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আবেগকে কাজে লাগানো হচ্ছে।

দেশীয় পণ্য ‘মোজো’র প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মোজো সাপোর্ট ফিলিস্তিন’ নামে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম পানীয় উৎপাদনকারী কোকাকোলা ইসরায়েলের পণ্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য। কোকাকোলার নির্দিষ্ট কোন মালিক নেই, এটা একটা পাবলিক লিমিটেড মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি। কোকাকোলা একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে- তাই শেয়ারহোল্ডারাই হচ্ছে কোকাকোলার মালিক। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বে ১৮৮৬ সালে কোকাকোলার বিপণন শুরু হয়।

কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া ব্যতীত সারা বিশ্বে কোকাকোলা বিক্রি এবং তৈরি হয়, ইসরায়েল এবং গাজায় কোকাকোলার দুটি কারখানা আছে। ইসরায়েলে ব্যবসা করতে অস্বীকার করায় কোকাকোলাকে এক সময় ইহুদি-বিরোধী বলে মনে করা হয়েছিল। ইসরায়েলে কোকাকোলার কোন কারখানা না থাকায় আমেরিকার একটি জায়নবাদী গোষ্ঠী ১৯৬৬ সালে কোকাকোলা বয়কট করেছিল, তাদের অভিযোগ ছিল কোকাকোলা আরব দেশগুলোর সমর্থক।

জাতিগত বিদ্বেষের দুর্নাম ঘোচাতে ১৯৬৬ সালে ইসরায়েলে কোকাকোলার কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলে কোকাকোলার কারখানা করার কারণে আরব বিশ্ব কোকাকোলা বয়কট করে। পেপসি এই সুযোগে ইসরায়েলের বাজারে না গিয়ে আরব দেশগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং এজন্য ইসরায়েলের ইহুদিরা পেপসি বয়কট করে। এই জাতীয় সমস্যা উত্তরণে মার্কিন কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতীয়তা বা জাতীয় উৎসের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি বা ব্যবসার প্রতি বৈষম্য করাকে বেআইনি ঘোষণা করে। ফলে ১৯৯২ সালে পেপসি ইসরায়েলেও প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

আমেরিকার অন্যান্য পণ্য বয়কট না করে শুধু কোকাকোলা বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে কেন? বলা হচ্ছে, এক- কোকাকোলা কোম্পানিটি মার্কিন-ইসরায়েলি চেম্বার অব কমার্স অ্যাওয়ার্ডসকে স্পনসর করে এবং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে; দুই- ২০০৯ সালে কোকাকোলা আইপ্যাকের মাধ্যমে লবিংয়ের জন্য যে পুরস্কারটি স্পনসর করেছিল তা গাজায় জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে; আইপ্যাকের কাজ হলো ইসরায়েল সম্পর্কিত বিষয় এবং আইন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে লবিং করা। তিন- ২০০৯ সালে কোকাকোলা যে বেন-এলিয়েজারকে সংবর্ধনা দেয় সেই এলিয়েজার ইসরায়েলের হাতে বন্দী তিন শতাধিক মিসরীয়কে মৃত্যুদ- দিয়েছিল; চার- কোকাকোলার প্রধান শেয়ারহোল্ডার ওয়ারেন বাফেট ইসরায়েলি বল্কের শক্তিশালী প্রচারক এবং ইসরায়েলের বড় বড় কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ রয়েছে।

কোকাকোলার সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কের অনুসন্ধান চললেও কোকাকোলা আমেরিকান পণ্য বলেই বর্জনীয়- এই কথাটি শক্তভাবে কেউ বলছে না। বয়কট এখন বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার। সাম্প্রতিককালে বয়কট সারা বিশ্বেই হচ্ছে। আমেরিকা এখন কথায় কথায় বিভিন্ন দেশের পণ্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। শুধু নিজেদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়, তাদের করা নিষিদ্ধ পণ্য অন্যকেও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর আমলে কিউবার কাছে চটের বস্তা বিক্রি করার কারণে আমেরিকা বাংলাদেশে দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দিয়েছিল। কিউবা, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের শুধু পণ্য নয়, পুরো দেশকেই আমেরিকা বর্জন করে চলেছে এবং এই দেশগুলোর সঙ্গে যারা ব্যবসা করে সেই দেশগুলোর ওপরও নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্যে চীনকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, চীনের প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমছে। বর্তমানে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার কবলে রাশিয়া; রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো বয়কটের নানাবিধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে স্বদেশী আন্দোলনে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করে স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের ডাক দেয়া হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনকে সফল করার জন্য বর্জননীতি ছিল মূল হাতিয়ার। এই স্বদেশী আন্দোলনে ব্রিটিশদের পণ্য বিক্রি ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় পোস্টারে মহাত্মা গান্ধীকে চরকায় সুতা কাটতে দেখা গেছে, তখন দেশি খাদি কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল, খাদিই ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর একমাত্র পরিধেয় বস্ত্র। তবে দেশীয় পণ্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার লক্ষ্যে তাঁত শিল্পে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অন্য কোন সেক্টরে সফলতা আসেনি; সফলতা না আসলেও স্বদেশী আন্দলনের কারণে দেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনের প্রতি ভারতীয়দের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ইহুদি-খ্রিস্টানদের পণ্য ও প্রযুক্তি বর্জন করলে আমাদের জীবন অচল হয়ে যাবে। আমেরিকার মদদে ইসরায়েল বেপরোয়া, আমেরিকার অস্ত্রের আঘাতে গাজায় ৩৮ হাজার নিরস্ত্র জনতা মারা গেছে এবং আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে। তাই শুধু কোকাকোলা নয়, আমেরিকার সব পণ্য বর্জন করা ফরজ; কিন্তু সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় বলেই বয়কটের জন্য শুধু কোকাকোলাকে বেছে নেয়া হয়েছে, কারণ এই পণ্যটি গণমানুষের নিকট সুপরিচিত, বর্জনের আন্দোলনে সাধারণ লোকও অংশ নিতে পারছে। এছাড়াও পণ্যটি মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্যও নয়, বরং পণ্যটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও খেতে ইচ্ছে হলে কোকাকোলার বিকল্প পানীয় বাজারে রয়েছে।

কিন্তু মুসলিমদের জন্য দুঃখজনক হচ্ছে, তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র হচ্ছে প্রতিপক্ষের পণ্য বর্জন। কিন্তু প্রতিকারের কোন অস্ত্র তাদের হাতে নেই। মুসলমানেরা এখনও মহাবীর গাজী সালাউদ্দিনের বীরত্বের স্মৃতিগাথায় আত্মহারা। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, আগের মতো এখন আর পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধ নেই। এখন যুদ্ধ চলছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। এই যুদ্ধে সফল না হলে ৭০ লক্ষ অধিবাসীর ইসরায়েল কখনো ২০০ কোটি মুসলমানের ৫৬টি দেশকে সমীহ করবে না। ইসরায়েল জাতিসংঘের সিদ্ধান্তও মানছে না। এই না মানার প্রধান কারণ হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনায় আরব লীগের মৌন সম্মতি।

কোকাকোলা বর্জন করছে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে আরব লীগ আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় ওঠবস করছে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ ইসরায়েলকে বয়কট করলেও আরব লীগ করেনি; বরং হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে ইসরায়েলের অভিযানে আরব লীগের অধিকাংশ দেশের মৌন সম্মতি রয়েছে। হামাসদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে আরব লীগের কোন কর্মকা- নজরে আসেনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ‘উম্মাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন মুসলিম দেশ মামলা করেনি, মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। অন্যদিকে তুরস্ক শুধু বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, বড় বড় কথা বলছে, কাজের কাজ কিছুই করছে না। তুরস্ক পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মিসর ও জর্ডান ইসরায়েলে রপ্তানি বায়িয়ে দিয়েছে। কোকাকোলা বর্জনের কোন প্রয়োজন হতো না, যদি সব মুসলিম দেশ একযোগে ইসরায়েলকে বর্জন করত। ইসরায়েলকে বর্জন না করে জর্ডান ইরানের ছোড়া গোলা ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র দেশ যে দেশটির জন্ম থেকেই ইসরায়েলকে বর্জন করে চলছে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]

back to top