alt

উপ-সম্পাদকীয়

মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা : এই নাটকের শেষ কোথায়?

বশীর আহমেদ

: মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের সরকারি চাকরিতে বাতিল করা ৩০% কোটা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ বর্ষণকারী প্রচুর পোষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিটির অবিশ্বাস্য নীরবতা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন হলো কেন?

এর কারণ খুঁজলে প্রথমেই সামনে আসবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গিজগিজ করা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রসঙ্গটি। স্বঘোষিত এ মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ব্যক্তিদের জন্যই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গণসমাজে তাদের সম্মান ও মর্যাদা হারিয়েছে। এ ভুয়াদের তো কোন আদর্শ নেই। সেটা থাকলে তারা তালিকায় নাম লেখাতেই আসতো না। গ্রেফ প্রাপ্তির লোভে তারা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। এদের আসল পরিচয় তাদের সন্তান সন্ততি ও স্বজনেরা ভালো করে জানে। ফলে মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ সুবিধায় ভাগ বসালেও তারা আসলে সবংশেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রধান শত্রু। গণসমাজ এদের ভুয়া প্রতারক বলে উপহাস করে। সেই ক্ষোভে তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সহ্য করতে পারে না। এদের কারণে মুক্তিযোদ্ধা নামের সাথে ভুয়া শব্দ জড়িয়ে গেছে। এদের যন্ত্রণায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই এখন নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পর্যন্ত আড়ালে রাখতে বাধ্য হন। যে কারণে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের কটূক্তি করলেও আগের মতো আর প্রতিবাদ জাগ্রত হতে দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও দেশপ্রেমিক ইমেজ আগের জায়গায় ফেরাতে বিদ্যমান তালিকা আগাছামুক্ত করার কোন বিকল্প নেই।

‘সাত নকলে আসল খাস্তা’ প্রবাদের মতো প্রায় আড়াই লাখ নাম বুকে ধারণ করে যে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা আত্মপ্রকাশ করেছে তা কি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে ভারাক্রান্তই থাকবে? এটা কি জঞ্জালমুক্ত করা একেবারেই কঠিন কোন কাজ? এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নেবার মতো উপায় উপকরণ যে একেবারে নেই তাও তো নয়। যদিও বয়সের ভারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে গেছে; তথাপি অনেকেই তারা জীবিত রয়েছেন এখনও। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ভুয়ামুক্ত করা অসম্ভব কোন কাজ নয় মোটেই। শুধু তালিকা করার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ কাজে পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। আর এটা দেখতেও হবে অরাজনৈতিক চোখে, একাত্তরের চোখ দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী এমন কি রাজাকারের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অভিযোগের পরও তা নানা জটিলতায় সংশোধন হচ্ছে না। আবার ক্ষেত্র বিশেষে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামও বাদ দেয়া হয়েছে। এগুলো কি মেনে নেবার মতো? মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কোন রাজনীতির আইটেম নয়, এটা জাতীয় এবং ঐতিহাসিক ইস্যু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সেই যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক নামের তালিকা। এটা অবশ্যই কোন হেলাফেলার বস্তু হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই তালিকা করতে চরম অবহেলাই কেবল নয়, তালিকার প্রতি পরতে যেভাবে জালিয়াতির ক্ষতচিহ্ন তৈরি করা হয়েছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের যেন রীতিমত উপহাস করছে।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকার গোড়ার কথা যা জানা যায় তা হলো, প্রথম তালিকা করা হয়েছিল সরকারি উদ্যোগে এরশাদ যমানায়। ৮৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তালিকাটি চুড়ান্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ২ হাজারের মত। অতঃপর দীর্ঘ দিনেও সে তালিকা সম্পর্কে কোন আপত্তি ওঠেনি। তবে তালিকাটি ছিল অসম্পূর্ণ। একটি বৃহৎ সংখ্যার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তাতে অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় ছিল। এই তালিকা করতে গিয়ে তখন আরও একটি নিখুঁত তালিকার জন্ম হয়েছিল যা ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত। তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট সংরক্ষণ করেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর এফ এফ যোদ্ধা। এতে নাম রয়েছে ৬২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার। এরশাদ আমলে করা ১ লাখ ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এই ভারতীয় তালিকার প্রায় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। উল্লেখ্য, এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন আর্থিক সুবিধা না থাকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত অন্য কেউ তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী হয়নি।

এর পরের তালিকাটি ১৯৯৫ সালে করা মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকা; যাতে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। এই তালিকা থেকেই মূলত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটে। কারণ তখন থেকে সরকারি চাকরিতে ৩০% সন্তান কোটা আরম্ভ হতে চলেছিল। এরপর আসে মুক্তিবার্তা তালিকা যার সূচনা ১৯৯৮ সালে এবং এতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় তালিকার ইতিহাসে সর্বাধিক- প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার। এতেও ঢুকেছে বিশাল সংখ্যায় ভুয়া ব্যক্তির নাম। এরপর ২০০৫ সালে করা হয় মুক্তিযোদ্ধার গেজেট। গেজেট তৈরীর সময় তালিকায় আরেক দফা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। কারণ ততদিনে সন্তান কোটার সাথে আর্থিক অনুদান দেয়াও শুরু হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৪ সালে আসে অনলাইনে আবেদনের পর্ব। এতে একজনের ডকুমেন্ট অসংখ্য ব্যক্তি কপি করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখানোর ঘটনাও ঘটে। অনলাইনে আবেদন জমা পড়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজারের মতো, যাদের ৯৫% ভুয়া এবং মুক্তিযোদ্ধার মিথ্যা দাবিদার বলে অনুমান করা যায়। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এরা অধিকাংশই চুড়ান্ত তালিকায় ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে খন্ড খন্ড গেজেট করেও অনেকে নাম লিখিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। এক নজরে এই হলো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাস্তব চিত্র।

এতদসত্ত্বেও বলা যায়, এরশাদ পরবর্তী সবগুলো তালিকাতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো কমবেশি ঘুরেফিরে এসেছে। সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছে ভুয়া ব্যক্তিদের নাম। এখন তালিকা ঘেঁটে, কার্যকর পদ্ধতিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো আলাদা করাই হলো সময়ের দাবী। কিন্তু বিধিবিধানের জটিলতায় সে কাজটি পড়ে গেছে ব্যাকফুটে। এখন সরকার চাইলে ভুলে ভরা বিদ্যমান তালিকা একপাশে সরিয়ে রেখে সঠিক তালিকার জন্য ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। এর শুরুটা করতে হবে গোড়া থেকে। পরীক্ষামূলকভাবে হলেও দু-একটি জেলা বা উপজেলায় পদ্ধতিটা প্রয়োগ করে ফলাফল দেখা যেতে পারে। দেশবাসী জানেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে প্রশাসনবিহীন এই দেশটি প্রায় ২ মাস অস্ত্রহাতে পাহারা দিয়েছেন রণাঙ্গন ফেরা মুক্তিযোদ্ধারা।

এজন্য দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে, থানা ও জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বউদ্যোগে ক্যাম্প করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। এখন আগে করা দরকার সে ক্যাম্পগুলোর তালিকা। অতঃপর ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের দায়িত্ব দেয়া যায় ক্যাম্পের অধীন এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কারা, তা খুঁজে বের করার। এটাই হতে পারে পদ্ধতিগত ন্যায্যতা। উপজেলা সদরে বসে থাকা এক শ্রেণির কমান্ডার এবং এক-দু জন প্রতিনিধি দিয়ে তালিকা তো করা হয়েছে। তার নমুনা হলো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় ভারাক্রান্ত বিদ্যমান তালিকা। এটা থামানো দরকার। কারণ অনেক উপজেলায় কমান্ডার নিজেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। প্রস্তাবিত পদ্ধতি প্রয়োগ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আইনগত সুরক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্ভবত এ পথেই কেবল পাওয়া সম্ভব মুক্তিযোদ্ধার সুবৃহৎ অংশের সঠিক তালিকা। প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে সেই ক্যাম্পগুলো এবং তাতে একাত্তরে দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজার কাজটি অতি সহজে এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে করা কোন অসম্ভব কাজ নয়। কথা হলো, সহজ বিষয় সহজভাবে মাথায় ঢুকবে কিনা? জটিল করলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে চলমান গোলক ধাঁধাঁ শেষ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, তাতে থেকে যাবে ভুয়া ব্যক্তিদের বিষাক্ত নামগুলো।

এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। বাহাত্তরে সমরাস্ত্র সমর্পণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সুবৃহৎ অংশ প্রায় দুই মাসের মতো সরকারিভাবে গঠিত জাতীয় মিলিশিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সময় কাটিয়েছেন। সরকারি রেশন খেয়েছেন, নগদে পকেট মানিও নিয়েছেন। কাজেই তাদের নামের তালিকা অবশ্যই জেলা ও মহুকুমা সদরে সংরক্ষিত থাকা উচিত। জেলা এবং মহুকুমা সদরের মিলিশিয়া ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার খোঁজ নেয়া হয় না কেন? ওই তালিকা বের করা গেলে ভুয়া এবং প্রতারক এমনিতেই ধরা পড়বে; যাচাই বাছাইও দরকার হবে না। যাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে স্বাধীন এই দেশ, নতুন জাতিরাষ্ট্রের গর্বিত পরিচয়; তাদের নামের সঠিক তালিকা করতে এসব নাটক বিস্ময়কর। এ কাজটা কি এতই অ-দরকারি?

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা : এই নাটকের শেষ কোথায়?

বশীর আহমেদ

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের সরকারি চাকরিতে বাতিল করা ৩০% কোটা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ বর্ষণকারী প্রচুর পোষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিটির অবিশ্বাস্য নীরবতা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন হলো কেন?

এর কারণ খুঁজলে প্রথমেই সামনে আসবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গিজগিজ করা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রসঙ্গটি। স্বঘোষিত এ মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ব্যক্তিদের জন্যই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গণসমাজে তাদের সম্মান ও মর্যাদা হারিয়েছে। এ ভুয়াদের তো কোন আদর্শ নেই। সেটা থাকলে তারা তালিকায় নাম লেখাতেই আসতো না। গ্রেফ প্রাপ্তির লোভে তারা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। এদের আসল পরিচয় তাদের সন্তান সন্ততি ও স্বজনেরা ভালো করে জানে। ফলে মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ সুবিধায় ভাগ বসালেও তারা আসলে সবংশেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রধান শত্রু। গণসমাজ এদের ভুয়া প্রতারক বলে উপহাস করে। সেই ক্ষোভে তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সহ্য করতে পারে না। এদের কারণে মুক্তিযোদ্ধা নামের সাথে ভুয়া শব্দ জড়িয়ে গেছে। এদের যন্ত্রণায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই এখন নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পর্যন্ত আড়ালে রাখতে বাধ্য হন। যে কারণে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের কটূক্তি করলেও আগের মতো আর প্রতিবাদ জাগ্রত হতে দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও দেশপ্রেমিক ইমেজ আগের জায়গায় ফেরাতে বিদ্যমান তালিকা আগাছামুক্ত করার কোন বিকল্প নেই।

‘সাত নকলে আসল খাস্তা’ প্রবাদের মতো প্রায় আড়াই লাখ নাম বুকে ধারণ করে যে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা আত্মপ্রকাশ করেছে তা কি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে ভারাক্রান্তই থাকবে? এটা কি জঞ্জালমুক্ত করা একেবারেই কঠিন কোন কাজ? এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নেবার মতো উপায় উপকরণ যে একেবারে নেই তাও তো নয়। যদিও বয়সের ভারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে গেছে; তথাপি অনেকেই তারা জীবিত রয়েছেন এখনও। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ভুয়ামুক্ত করা অসম্ভব কোন কাজ নয় মোটেই। শুধু তালিকা করার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ কাজে পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। আর এটা দেখতেও হবে অরাজনৈতিক চোখে, একাত্তরের চোখ দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী এমন কি রাজাকারের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অভিযোগের পরও তা নানা জটিলতায় সংশোধন হচ্ছে না। আবার ক্ষেত্র বিশেষে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামও বাদ দেয়া হয়েছে। এগুলো কি মেনে নেবার মতো? মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কোন রাজনীতির আইটেম নয়, এটা জাতীয় এবং ঐতিহাসিক ইস্যু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সেই যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক নামের তালিকা। এটা অবশ্যই কোন হেলাফেলার বস্তু হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই তালিকা করতে চরম অবহেলাই কেবল নয়, তালিকার প্রতি পরতে যেভাবে জালিয়াতির ক্ষতচিহ্ন তৈরি করা হয়েছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের যেন রীতিমত উপহাস করছে।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকার গোড়ার কথা যা জানা যায় তা হলো, প্রথম তালিকা করা হয়েছিল সরকারি উদ্যোগে এরশাদ যমানায়। ৮৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তালিকাটি চুড়ান্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ২ হাজারের মত। অতঃপর দীর্ঘ দিনেও সে তালিকা সম্পর্কে কোন আপত্তি ওঠেনি। তবে তালিকাটি ছিল অসম্পূর্ণ। একটি বৃহৎ সংখ্যার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তাতে অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় ছিল। এই তালিকা করতে গিয়ে তখন আরও একটি নিখুঁত তালিকার জন্ম হয়েছিল যা ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত। তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট সংরক্ষণ করেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর এফ এফ যোদ্ধা। এতে নাম রয়েছে ৬২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার। এরশাদ আমলে করা ১ লাখ ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এই ভারতীয় তালিকার প্রায় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। উল্লেখ্য, এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন আর্থিক সুবিধা না থাকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত অন্য কেউ তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী হয়নি।

এর পরের তালিকাটি ১৯৯৫ সালে করা মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকা; যাতে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। এই তালিকা থেকেই মূলত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটে। কারণ তখন থেকে সরকারি চাকরিতে ৩০% সন্তান কোটা আরম্ভ হতে চলেছিল। এরপর আসে মুক্তিবার্তা তালিকা যার সূচনা ১৯৯৮ সালে এবং এতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় তালিকার ইতিহাসে সর্বাধিক- প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার। এতেও ঢুকেছে বিশাল সংখ্যায় ভুয়া ব্যক্তির নাম। এরপর ২০০৫ সালে করা হয় মুক্তিযোদ্ধার গেজেট। গেজেট তৈরীর সময় তালিকায় আরেক দফা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। কারণ ততদিনে সন্তান কোটার সাথে আর্থিক অনুদান দেয়াও শুরু হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৪ সালে আসে অনলাইনে আবেদনের পর্ব। এতে একজনের ডকুমেন্ট অসংখ্য ব্যক্তি কপি করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখানোর ঘটনাও ঘটে। অনলাইনে আবেদন জমা পড়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজারের মতো, যাদের ৯৫% ভুয়া এবং মুক্তিযোদ্ধার মিথ্যা দাবিদার বলে অনুমান করা যায়। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এরা অধিকাংশই চুড়ান্ত তালিকায় ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে খন্ড খন্ড গেজেট করেও অনেকে নাম লিখিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। এক নজরে এই হলো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাস্তব চিত্র।

এতদসত্ত্বেও বলা যায়, এরশাদ পরবর্তী সবগুলো তালিকাতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো কমবেশি ঘুরেফিরে এসেছে। সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছে ভুয়া ব্যক্তিদের নাম। এখন তালিকা ঘেঁটে, কার্যকর পদ্ধতিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো আলাদা করাই হলো সময়ের দাবী। কিন্তু বিধিবিধানের জটিলতায় সে কাজটি পড়ে গেছে ব্যাকফুটে। এখন সরকার চাইলে ভুলে ভরা বিদ্যমান তালিকা একপাশে সরিয়ে রেখে সঠিক তালিকার জন্য ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। এর শুরুটা করতে হবে গোড়া থেকে। পরীক্ষামূলকভাবে হলেও দু-একটি জেলা বা উপজেলায় পদ্ধতিটা প্রয়োগ করে ফলাফল দেখা যেতে পারে। দেশবাসী জানেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে প্রশাসনবিহীন এই দেশটি প্রায় ২ মাস অস্ত্রহাতে পাহারা দিয়েছেন রণাঙ্গন ফেরা মুক্তিযোদ্ধারা।

এজন্য দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে, থানা ও জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বউদ্যোগে ক্যাম্প করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। এখন আগে করা দরকার সে ক্যাম্পগুলোর তালিকা। অতঃপর ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের দায়িত্ব দেয়া যায় ক্যাম্পের অধীন এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কারা, তা খুঁজে বের করার। এটাই হতে পারে পদ্ধতিগত ন্যায্যতা। উপজেলা সদরে বসে থাকা এক শ্রেণির কমান্ডার এবং এক-দু জন প্রতিনিধি দিয়ে তালিকা তো করা হয়েছে। তার নমুনা হলো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় ভারাক্রান্ত বিদ্যমান তালিকা। এটা থামানো দরকার। কারণ অনেক উপজেলায় কমান্ডার নিজেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। প্রস্তাবিত পদ্ধতি প্রয়োগ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আইনগত সুরক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্ভবত এ পথেই কেবল পাওয়া সম্ভব মুক্তিযোদ্ধার সুবৃহৎ অংশের সঠিক তালিকা। প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে সেই ক্যাম্পগুলো এবং তাতে একাত্তরে দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজার কাজটি অতি সহজে এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে করা কোন অসম্ভব কাজ নয়। কথা হলো, সহজ বিষয় সহজভাবে মাথায় ঢুকবে কিনা? জটিল করলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে চলমান গোলক ধাঁধাঁ শেষ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, তাতে থেকে যাবে ভুয়া ব্যক্তিদের বিষাক্ত নামগুলো।

এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। বাহাত্তরে সমরাস্ত্র সমর্পণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সুবৃহৎ অংশ প্রায় দুই মাসের মতো সরকারিভাবে গঠিত জাতীয় মিলিশিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সময় কাটিয়েছেন। সরকারি রেশন খেয়েছেন, নগদে পকেট মানিও নিয়েছেন। কাজেই তাদের নামের তালিকা অবশ্যই জেলা ও মহুকুমা সদরে সংরক্ষিত থাকা উচিত। জেলা এবং মহুকুমা সদরের মিলিশিয়া ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার খোঁজ নেয়া হয় না কেন? ওই তালিকা বের করা গেলে ভুয়া এবং প্রতারক এমনিতেই ধরা পড়বে; যাচাই বাছাইও দরকার হবে না। যাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে স্বাধীন এই দেশ, নতুন জাতিরাষ্ট্রের গর্বিত পরিচয়; তাদের নামের সঠিক তালিকা করতে এসব নাটক বিস্ময়কর। এ কাজটা কি এতই অ-দরকারি?

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

back to top