alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪
image

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ পরিবারের সন্তানদের এত অংশগ্রহণ করার কারণ কী? কী এর অন্তর্নিহিত বার্তা?

মানুষের মন নাকি সবচেয়ে সহজে পাঠ করতে পারেন রাজনৈতিক নেতা-নেতৃরা। দীর্ঘদিন যদি রাজনৈতিক নেতা-নেতৃদের ‘মন পাঠের’ প্রয়োজন না হয় অথবা তারা প্রয়োজন বোধ না করেন তাহলে কী হয়? তাহলে ‘অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস’ হয়। এর ফলে মন পাঠের বিদ্যা হারিয়ে যায়। এই বিদ্যা হারিয়ে যাওয়া দেশের জন্য বড় বিপদ। সাধারণকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অবজ্ঞা করা তখন স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। ধামা-ধরা মানুষ যারা প্রশস্তি করে প্রশান্তি দেন তারাই তখন অসাধারণ হয়ে যান। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের খুব কাছে যারা ঘুরঘুর করেন তারা হলেন আইন ও শাসন বিভাগের মানুষরা। শাসকদের কাছে তারা বড় প্রিয়। এই প্রিয় হওয়ার কারণ কী? রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তারা ভূমিকা রাখতে পারেন। আইন বিভাগের মানুষের ধ্যান-জ্ঞানে আইন নেই। তারা সব বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা দিয়ে সম্পদ গড়তে চান। মহামতি টলস্টয়ের গল্পের মতো। জমির উপর দিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যতটুকু হাঁটতে পারা যাবে ততটুকুর মালিকানা নিশ্চিত। লোভ, মোহের শেষ নেই। সূর্য ডোবার আগে অগনতি মাইল হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যু। টলস্টয়ে গল্পে লোভী মানুষের মৃত্যু হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মৃত্যু হয় না, কারণ সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য তাদের হাঁটতেও হয় না।

মন পাঠের কথা বললে আমার বিশেষ একজন মানুষের কথা মনে হয়। তিনি হলেন আবেদ আলী ভাই। গ্রামের বাড়িতে প্রতি বছর টিনের চাল মেরামতের কাজ করতেন তিনি। তখন শৈশব। তিনি এলেই আমি তার পিছু পিছু ঘুরতাম। লোকটার প্রতি এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ ছিল। তার ব্যক্তিত্ব আমাকে কাছে টানত। টিনের চাল খুলে উঠোনে বসে মেরামত করতেন। তার মধ্যে একটি বাউল ভাব ছিল। অনেক কথাই তিনি বলতেন। অপরিণত বয়সে সব কথার মর্ম বোঝা কঠিন হতো। একদিন কাজ করতে করতে কালো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভাইরে, মানুষের মন আর আর আকাশের রঙ, এ-দুটো বোঝা বড় দায়, যারা বোঝে তারা হলো বুঝপাতা’। এ কেমন কথা! আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বোঝার ভান করে তার পাশে বসে সময় কাটিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এই কথাটি অনেকের মুখে শুনেছি এবং এর অর্থও বুঝতে পেরেছি হয়তো কিছুটা।

পরিণত বয়সে একটি কথা অন্তত বুঝেছি, সাধারণ মানুষরা সাধারণ নন; তারা বড়ই অসাধারণ। প্রকৃতি তাদের হাতে একটি অদৃশ্য জাদুর কাঠি দিয়ে রেখেছেন। তারা এই জাদুরকাঠি সাধারণত ব্যবহার করেন না। অদৃশ্য কাঠিটি অদৃশ্যই থেকে যায়। প্রয়োজনে কাঠিটি বেরিয়ে আসে, যখন বেরিয়ে আসে এর ক্ষমতা বোঝার সাধ্য থাকে না কারও। সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞান বা ‘কমনসেন্স’ বড় কম বলে অনেকেই মনে করেন। তাদের ‘কমনসেন্স’ যে কম ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। কমনসেন্স বিষয়টি বড় আনকমন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘কমনসেন্স ইজ দ্যাট সেন্স উইচ ইজ ভেরি আনকমন’। কথাটি আমার কাছে, ‘সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, পশ্চিম দিকে অস্ত যায়’ এই কথাটির মতো সত্য। ইতিহাসের পাতায় সাধারণ মানুষের বীরত্ব গাঁথা লেখা থাকে না। কেনো থাকে না? সাধারণ মানুষ ইতিহাস লেখেন না, ইতিহাস লেখেন ক্ষমতার কাছে থাকা মানুষেরা। শুধু ইতিহাস লেখেনই না তারা লেখার পর ক্ষমতাধরদের কাছ থকে অনুমোদন নিয়ে প্রকাশ করেন। তাহলে কী দাঁড়ালো, দিনের শেষে যারা ইতিহাস নির্মাণ করেন তারা ইতিহাস বইয়ের ভেতরের চরিত্র হতে পারেন না। তারা অপাঙক্তেয়, প্রান্তজন। ক্ষমতার কালো মেঘ তাদের মুখগুলোকে ঢেকে দেয়। সময়ের স্রোত তাদের মুখে প্রলেপ ফেলে ফেলে একসময় নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তবে রণাঙ্গনে অধিকাংশ মানুষ ছিলেন সাধারণ। একাত্তরের যুদ্ধ শেষে আমরা দেখতে পেলাম খুব কম খেতাব দেয়া হয়েছে সাধারণ যোদ্ধাদের। আজমিরিগঞ্জের জগতজ্যোতির মতো প্রান্তজন যারা ছিলেন তাদেরকেও দেয়া যেত আরও সম্মানজনক খেতাব। তারামন বিবির মতো সামান্যসংখ্যক নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বীকৃতি এবং নাম আছে এরকম প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বড় কম।

হাল আমলে সব কর্মকা-ের কেন্দ্রে যাদের রাখা উচিত তাদের রাজনীতিবিদরা রেখেছেন সাইডলাইনের বাইরে। মানুষকে কাছে ডাকতে ভয়, তাদের কথা শুনতে ভয়। তাদের দলে নানা পদ দিয়ে ক্ষমতায়িত করতে হয়। আসলে এই যে বললাম ‘তাদেরকে ডাকতে হয়’, এই ‘কথাটিও একনায়ক সুলভ, স্বৈরাচারের স্বরে উচ্চারণ। আপনি কে হে, আপনি তাদের ডাকার তো কেউ নন। আপনি, আমি সুবিধাবাদী মানুষদের সরিয়ে যখন নবীনরা নতুন দর্শনে, সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্রত নেবে তখন প্রান্তজনেরা থাকবে সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটি আমার মতো হাঁদারামের একটি স্বপ্ন।

প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের সময় এসেছে। এই প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনকে বড় ভয় পায়। কাছে ডাকলে, বুকে টানলে হৃৎস্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়। শ্রমজীবী মানুষের শরীরের ঘামের গন্ধ বড় মধুর। বিশেষ করে সৎ মানুষের গায়ের গন্ধ। তাদের শরীরে সুগন্ধি মাখার প্রয়োজন হয় না। যাদের গা থেকে সব সময় দুর্গন্ধ বেরনোর ভয় তারাই নিজেদের গায়ে কৃত্রিম গন্ধ ছিটান। যারা মানুষের শরীরের ঘাম পান করে কোলোস্টল বৃদ্ধি করেন, তারা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কৃত্রিম মানুষ। এ কারণে সুবর্ণভূমির পলি দিয়ে গড়া মানুষদের বড় ভয় তাদের।

মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, মনি সিংহ, মোজাফফর আহমেদ মানুষের অন্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন তারা, তাই তাদের মানুষ বিশ্বাস করত। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কোন পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে না।

ভয়ের সংস্কৃতিকে আমাদের সব দলের নেতারা লালন করেন। কখনো, কখনো সহিংস উপায়ে তারা মানুষকে ভয় দেখাতে পছন্দ করেন। মনে রাখা উচিত সহিংস উপায়ে ভয় দেখিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না। ঔপনিবেশিক রাজনীতির গায়ে প্রলেপ মাখিয়ে আমরা নব্য ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করে লালন-পালন করে যাচ্ছি। শাসক সেবক হতে না পারলে, তারা মানুষের কাতারে আসতে পারেন না। হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শাসক হতে চেষ্টা করেননি, তারা আজীবন মানুষের সেবক হতে চেষ্টা করে গেছেন।

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ পরিবারের সন্তানদের এত অংশগ্রহণ করার কারণ কী? কী এর অন্তর্নিহিত বার্তা? এর মূল বার্তা হলো শ্রেণীতে শ্রেণীতে বৈষম্য হ্রাস। এই আন্দোলনের নাম তাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। বৈষম্যের কথা উচ্চারণ করা উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর। বৈষম্য নিয়ে কারও কথা নেই। তরুণরাই সাহস করে বলতে পেরেছে। আন্দোলনের একপর্যায়ে সেøাগান রচনায় ওদের ভুল হয়েছে। ভুলটি ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু পরদিনই তারা ‘রাজাকার’ নিয়ে সেøাগানটি সংশোধন করে ফেলেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে যে মূল্যবান কথাটি উঠে এসেছে সেটি হলো, বৈষম্য হ্রাস, বৈষম্য বিলোপ। এবার রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তরুণদের আন্দোলনের বার্তা গ্রহণ করা। রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবা। গত কিছুদিন থেকে দুর্নীতি, অপশাসনের যে অবিশ্বাস্য কাহিনী বেরিয়ে আসছে মানুষের ধারণা হওয়া খুব স্বাভাবিক যে প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বোধ হয় সামান্য কিছু বের হলো। রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে এসব কা- ঘটছে। ফোকাস কিন্তু দেয়া হচ্ছে চারশ কোটি টাকার পিয়ন, ড্রাইভার আবেদ আলীর কর্মকা-ে। মঞ্চের নেপথ্যে আর কারা ছিল যাদের মুখ আমরা এখনও দেখতে পাইনি। তাদের মুখ দেখতে উদগ্রীব দেশের সাধারণ মানুষরা। প্রাক্তন মহাপরিদর্শক, রাজস্ব মতিউরের মতো যারা ঘটনাক্রমে পাদ প্রদীপের সামনে এসেছেন, তাদের বাইরে যারা দেশের অর্থ ভা-ারকে লুণ্ঠন করে খোল নলচে বদলে দেয়ার চেষ্টা করছেন তাদের মুখ এখন মানুষ দেখতে চায়।

স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ঔপনিবেশিক শোষণ বহাল থাকতে পারে না। দেশপ্রেম মানে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নিশ্চিত করা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আমরা বদলাতে পারিনি। তাই রাজার বদল হয়েছে, শাসক চরিত্রের তেমন বদল হয়নি। এ কাজটি করতে না পারলে আমাদের পরিবর্তনগুলোকে আমরা শুধু বক্তৃতাতে দেখতে পাব। অপসংস্কৃতি ব্যবহার করে রাজনীতির নামে সুবিধাবাদীরা বিভিন্ন কৌশলে লুণ্ঠন করে দেশকে উজাড় করে ফেলবে। সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার আগে তাই দ্রুত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন, না হলে তারাপদ রায়ের বিখ্যাত কবিতার পংক্তির মতো আমাদের বলতে হবে ‘আমরা বুঝতে পারিনি/ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

শেখর ভট্টাচার্য

image

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ পরিবারের সন্তানদের এত অংশগ্রহণ করার কারণ কী? কী এর অন্তর্নিহিত বার্তা?

বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

মানুষের মন নাকি সবচেয়ে সহজে পাঠ করতে পারেন রাজনৈতিক নেতা-নেতৃরা। দীর্ঘদিন যদি রাজনৈতিক নেতা-নেতৃদের ‘মন পাঠের’ প্রয়োজন না হয় অথবা তারা প্রয়োজন বোধ না করেন তাহলে কী হয়? তাহলে ‘অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস’ হয়। এর ফলে মন পাঠের বিদ্যা হারিয়ে যায়। এই বিদ্যা হারিয়ে যাওয়া দেশের জন্য বড় বিপদ। সাধারণকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অবজ্ঞা করা তখন স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। ধামা-ধরা মানুষ যারা প্রশস্তি করে প্রশান্তি দেন তারাই তখন অসাধারণ হয়ে যান। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের খুব কাছে যারা ঘুরঘুর করেন তারা হলেন আইন ও শাসন বিভাগের মানুষরা। শাসকদের কাছে তারা বড় প্রিয়। এই প্রিয় হওয়ার কারণ কী? রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তারা ভূমিকা রাখতে পারেন। আইন বিভাগের মানুষের ধ্যান-জ্ঞানে আইন নেই। তারা সব বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা দিয়ে সম্পদ গড়তে চান। মহামতি টলস্টয়ের গল্পের মতো। জমির উপর দিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যতটুকু হাঁটতে পারা যাবে ততটুকুর মালিকানা নিশ্চিত। লোভ, মোহের শেষ নেই। সূর্য ডোবার আগে অগনতি মাইল হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যু। টলস্টয়ে গল্পে লোভী মানুষের মৃত্যু হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মৃত্যু হয় না, কারণ সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য তাদের হাঁটতেও হয় না।

মন পাঠের কথা বললে আমার বিশেষ একজন মানুষের কথা মনে হয়। তিনি হলেন আবেদ আলী ভাই। গ্রামের বাড়িতে প্রতি বছর টিনের চাল মেরামতের কাজ করতেন তিনি। তখন শৈশব। তিনি এলেই আমি তার পিছু পিছু ঘুরতাম। লোকটার প্রতি এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ ছিল। তার ব্যক্তিত্ব আমাকে কাছে টানত। টিনের চাল খুলে উঠোনে বসে মেরামত করতেন। তার মধ্যে একটি বাউল ভাব ছিল। অনেক কথাই তিনি বলতেন। অপরিণত বয়সে সব কথার মর্ম বোঝা কঠিন হতো। একদিন কাজ করতে করতে কালো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভাইরে, মানুষের মন আর আর আকাশের রঙ, এ-দুটো বোঝা বড় দায়, যারা বোঝে তারা হলো বুঝপাতা’। এ কেমন কথা! আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বোঝার ভান করে তার পাশে বসে সময় কাটিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এই কথাটি অনেকের মুখে শুনেছি এবং এর অর্থও বুঝতে পেরেছি হয়তো কিছুটা।

পরিণত বয়সে একটি কথা অন্তত বুঝেছি, সাধারণ মানুষরা সাধারণ নন; তারা বড়ই অসাধারণ। প্রকৃতি তাদের হাতে একটি অদৃশ্য জাদুর কাঠি দিয়ে রেখেছেন। তারা এই জাদুরকাঠি সাধারণত ব্যবহার করেন না। অদৃশ্য কাঠিটি অদৃশ্যই থেকে যায়। প্রয়োজনে কাঠিটি বেরিয়ে আসে, যখন বেরিয়ে আসে এর ক্ষমতা বোঝার সাধ্য থাকে না কারও। সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞান বা ‘কমনসেন্স’ বড় কম বলে অনেকেই মনে করেন। তাদের ‘কমনসেন্স’ যে কম ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। কমনসেন্স বিষয়টি বড় আনকমন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘কমনসেন্স ইজ দ্যাট সেন্স উইচ ইজ ভেরি আনকমন’। কথাটি আমার কাছে, ‘সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, পশ্চিম দিকে অস্ত যায়’ এই কথাটির মতো সত্য। ইতিহাসের পাতায় সাধারণ মানুষের বীরত্ব গাঁথা লেখা থাকে না। কেনো থাকে না? সাধারণ মানুষ ইতিহাস লেখেন না, ইতিহাস লেখেন ক্ষমতার কাছে থাকা মানুষেরা। শুধু ইতিহাস লেখেনই না তারা লেখার পর ক্ষমতাধরদের কাছ থকে অনুমোদন নিয়ে প্রকাশ করেন। তাহলে কী দাঁড়ালো, দিনের শেষে যারা ইতিহাস নির্মাণ করেন তারা ইতিহাস বইয়ের ভেতরের চরিত্র হতে পারেন না। তারা অপাঙক্তেয়, প্রান্তজন। ক্ষমতার কালো মেঘ তাদের মুখগুলোকে ঢেকে দেয়। সময়ের স্রোত তাদের মুখে প্রলেপ ফেলে ফেলে একসময় নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তবে রণাঙ্গনে অধিকাংশ মানুষ ছিলেন সাধারণ। একাত্তরের যুদ্ধ শেষে আমরা দেখতে পেলাম খুব কম খেতাব দেয়া হয়েছে সাধারণ যোদ্ধাদের। আজমিরিগঞ্জের জগতজ্যোতির মতো প্রান্তজন যারা ছিলেন তাদেরকেও দেয়া যেত আরও সম্মানজনক খেতাব। তারামন বিবির মতো সামান্যসংখ্যক নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বীকৃতি এবং নাম আছে এরকম প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বড় কম।

হাল আমলে সব কর্মকা-ের কেন্দ্রে যাদের রাখা উচিত তাদের রাজনীতিবিদরা রেখেছেন সাইডলাইনের বাইরে। মানুষকে কাছে ডাকতে ভয়, তাদের কথা শুনতে ভয়। তাদের দলে নানা পদ দিয়ে ক্ষমতায়িত করতে হয়। আসলে এই যে বললাম ‘তাদেরকে ডাকতে হয়’, এই ‘কথাটিও একনায়ক সুলভ, স্বৈরাচারের স্বরে উচ্চারণ। আপনি কে হে, আপনি তাদের ডাকার তো কেউ নন। আপনি, আমি সুবিধাবাদী মানুষদের সরিয়ে যখন নবীনরা নতুন দর্শনে, সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্রত নেবে তখন প্রান্তজনেরা থাকবে সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটি আমার মতো হাঁদারামের একটি স্বপ্ন।

প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের সময় এসেছে। এই প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনকে বড় ভয় পায়। কাছে ডাকলে, বুকে টানলে হৃৎস্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়। শ্রমজীবী মানুষের শরীরের ঘামের গন্ধ বড় মধুর। বিশেষ করে সৎ মানুষের গায়ের গন্ধ। তাদের শরীরে সুগন্ধি মাখার প্রয়োজন হয় না। যাদের গা থেকে সব সময় দুর্গন্ধ বেরনোর ভয় তারাই নিজেদের গায়ে কৃত্রিম গন্ধ ছিটান। যারা মানুষের শরীরের ঘাম পান করে কোলোস্টল বৃদ্ধি করেন, তারা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কৃত্রিম মানুষ। এ কারণে সুবর্ণভূমির পলি দিয়ে গড়া মানুষদের বড় ভয় তাদের।

মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, মনি সিংহ, মোজাফফর আহমেদ মানুষের অন্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন তারা, তাই তাদের মানুষ বিশ্বাস করত। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কোন পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে না।

ভয়ের সংস্কৃতিকে আমাদের সব দলের নেতারা লালন করেন। কখনো, কখনো সহিংস উপায়ে তারা মানুষকে ভয় দেখাতে পছন্দ করেন। মনে রাখা উচিত সহিংস উপায়ে ভয় দেখিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না। ঔপনিবেশিক রাজনীতির গায়ে প্রলেপ মাখিয়ে আমরা নব্য ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করে লালন-পালন করে যাচ্ছি। শাসক সেবক হতে না পারলে, তারা মানুষের কাতারে আসতে পারেন না। হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শাসক হতে চেষ্টা করেননি, তারা আজীবন মানুষের সেবক হতে চেষ্টা করে গেছেন।

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ পরিবারের সন্তানদের এত অংশগ্রহণ করার কারণ কী? কী এর অন্তর্নিহিত বার্তা? এর মূল বার্তা হলো শ্রেণীতে শ্রেণীতে বৈষম্য হ্রাস। এই আন্দোলনের নাম তাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। বৈষম্যের কথা উচ্চারণ করা উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর। বৈষম্য নিয়ে কারও কথা নেই। তরুণরাই সাহস করে বলতে পেরেছে। আন্দোলনের একপর্যায়ে সেøাগান রচনায় ওদের ভুল হয়েছে। ভুলটি ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু পরদিনই তারা ‘রাজাকার’ নিয়ে সেøাগানটি সংশোধন করে ফেলেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে যে মূল্যবান কথাটি উঠে এসেছে সেটি হলো, বৈষম্য হ্রাস, বৈষম্য বিলোপ। এবার রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তরুণদের আন্দোলনের বার্তা গ্রহণ করা। রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবা। গত কিছুদিন থেকে দুর্নীতি, অপশাসনের যে অবিশ্বাস্য কাহিনী বেরিয়ে আসছে মানুষের ধারণা হওয়া খুব স্বাভাবিক যে প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বোধ হয় সামান্য কিছু বের হলো। রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে এসব কা- ঘটছে। ফোকাস কিন্তু দেয়া হচ্ছে চারশ কোটি টাকার পিয়ন, ড্রাইভার আবেদ আলীর কর্মকা-ে। মঞ্চের নেপথ্যে আর কারা ছিল যাদের মুখ আমরা এখনও দেখতে পাইনি। তাদের মুখ দেখতে উদগ্রীব দেশের সাধারণ মানুষরা। প্রাক্তন মহাপরিদর্শক, রাজস্ব মতিউরের মতো যারা ঘটনাক্রমে পাদ প্রদীপের সামনে এসেছেন, তাদের বাইরে যারা দেশের অর্থ ভা-ারকে লুণ্ঠন করে খোল নলচে বদলে দেয়ার চেষ্টা করছেন তাদের মুখ এখন মানুষ দেখতে চায়।

স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ঔপনিবেশিক শোষণ বহাল থাকতে পারে না। দেশপ্রেম মানে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নিশ্চিত করা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আমরা বদলাতে পারিনি। তাই রাজার বদল হয়েছে, শাসক চরিত্রের তেমন বদল হয়নি। এ কাজটি করতে না পারলে আমাদের পরিবর্তনগুলোকে আমরা শুধু বক্তৃতাতে দেখতে পাব। অপসংস্কৃতি ব্যবহার করে রাজনীতির নামে সুবিধাবাদীরা বিভিন্ন কৌশলে লুণ্ঠন করে দেশকে উজাড় করে ফেলবে। সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার আগে তাই দ্রুত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন, না হলে তারাপদ রায়ের বিখ্যাত কবিতার পংক্তির মতো আমাদের বলতে হবে ‘আমরা বুঝতে পারিনি/ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top