জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি আজ আমরা ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ একটা হিসেব আমার কাছে আছে। এখানে বাংলাদেশের ৩৪টি আবহাওয়া অফিসের গড় হিসেব দেখানো হয়েছে। দেখা গেছে শুধু জানুয়ারি মাস ছাড়া বাকি এগারো মাসের বেলায় তাপমাত্রা বেড়েছে। এই বাড়তির গড় মাত্রা কমবেশি আধা ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে লক্ষণীয় হলো ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে এই পরিবর্তন। ২০০৫ থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত আরও আনেক পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চয়ই। আন্তর্জাতিক প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর হিসাব অনুয়ায়ী ২০১০ থেকে ২০৩৯ পর্যন্ত যদি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ০.৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৪০ থেকে ২০৬৯ পর্যন্ত এই তাপমাত্রার পরিমাণ দাঁড়াবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জুন থেকে আগস্ট ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শতাব্দির শেষ দিকে এই পরিমাণতো আরও অনেক বেশি হবে। এভাবে নির্দিষ্ট সীমা অবধি বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ধানের ফলন তার প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে বাড়তি তাপমাত্রার সঙ্গে অভিযোজন উপযোগী কোনো জাতের বেলায় হয়তো এমনটি নাও হতে পারে। তবে আইপিসিসির হিসেব অনুযায়ী সীমা ছাড়িয়ে গেলে কী হবে বলা যায় না। যাই হোক এখানে তাপমাত্রার প্রকৃত বৃদ্ধি এবং তার সিমুলেটেড সম্ভাব্য বৃদ্ধির মাত্রা দেখে কিছুটা খটকা লাগে। তাপমাত্রা বাড়ছে সত্যি কিন্তু এতটাই কি বাড়ছে! এ ব্যাপারে বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী হাফ ব্রাম্মারের একটি উক্তি মনে করতে হয়। তাপমাত্রা মাপার অবজারভেটরিগুলো সাধারণত এয়ারপোর্টের পাশে বা শহরের পাকা রাস্তার ধার পাকাবাড়ি ঘেঁষে থাকে। সেখান থেকে প্রাপ্ত তাপমাত্রা প্রকৃত প্রাকৃতিক পরিবেশের তাপমাত্রা থেকে বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া পৃথিবী পৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠের প্রকৃত তাপমাত্রাতো সরাসরি মাপা যায়নি। যদিও ১৯৭৯-এর পর থেকে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার আগেতো তেমন বিকল্প ছিল না। তাই প্রকৃত তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সেটার ওপর ভিত্তি করে হিসেব করা সিমুলেটেড তাপমাত্রা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে অবশ্যই কিছুটা বেশি ছিল। পরবর্তীতে কিছুটা সংস্কার করে আইপিসিসি তার সাম্প্রতিক মাত্রা প্রকাশ করছে। যাই হোক তাপমাত্রা বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে কৌলিতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার কারণে প্রধান প্রধান ফসলের ফলন এখন পর্যন্ত বাড়ানো গেলেও প্রাকৃতিক বৈরী পরিবশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিন্তু বেড়েই চলেছে। সে ব্যাপারে এখানে কিছু আলোচনা করা হলো। এবৎসধহধিঃপয’ং ২০২১ এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী-এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৮৫টি চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সুদূর অতীতকাল থেকে বাংলাদেশ সুজলা সুফলা দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। পাশাপাশি বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘুর্ণিঝড়ের দেশ হিসেবেও পরিচিতি কম নয়। মার্কিন সরকারের ২০১৮ এর এক তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ জনগণ বিরাট জলবায়ু-ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। বাংলাদেশ সাগরপাড়ের দেশ। সাগর সমতল থেকে দেশের তিন ভাগের দুই ভাগের উচ্চতা ১৫ ফুটের বেশি নয়। তবে দক্ষিণের বিরাট এলাকা সাগর সমতলের কাছাকাছি। বিজ্ঞানীদের ধারণা বর্তমানের গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের ট্রেন্ড যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাবে আধা মিটার। তাহলে সাগর পাড়ের বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সরে আসতে হবে। এক হিসেব মতে এই সংখ্যা হবে প্রতি সাত জনে এক জন অর্থাৎ প্রায় এক কোটি আশি লাখ মানুষ। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকানের এক তথ্য মতে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা। তাদের মতে ২১০০ সাল নাগাদ সাগরের উচ্চতা দেড় থেকে দুই মিটার বেড়ে যেতে পারে। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ ‘জলবায়ু-শরণার্থী’ সমস্যা। প্রায় ৫ কোটি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্য নতুন জায়গার খোঁজ করতে হবে। সুন্দর-বনসহ বিরাট আবাদি এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। সাইক্লোন প্রটেকশন ভেঙে পড়ায় উপকূলধুয়ে সাগরে মিশে যাবে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাবে। উপকূল থেকে কয়েক ১০০ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত নোনা জলের বিস্তার ঘটবে। ফলে চলমান কৃষির অস্তিত্ব ভয়াবহ ঝুঁকির কবলে পড়বে। পানিয় জলের অভাব দেখা দেবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ শুধু খাবারের অভাবে ভুগবে তা নয় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেও হাবুডুবু খাবে। ইতোমধ্যে লবণাক্ত এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি। অথচ ১৯৭৩-তে লবণাক্ত ছিল ৮.৩ মিলিয়ন হেক্টর। গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। সময়ের বৃষ্টি সময়ে হচ্ছে না। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে হিমালয়ের বরফচাঁই গলে বিপুল জলরাশি আমাদের নদী-নালাগুলোকে ভরিয়ে দিচ্ছে। হিমালয় ধোয়া পলির কারণে আমাদের নদীগুলো তলদেশ ভরে উঠছে। নদীভাঙন বাড়ছে। হাওর-বাওর এমনকি বন্যা বিধৌত মাঠঘাঠ ভরে উঠছে। নদীর গতিপথ প্রভাবিত হচ্ছে। প্লাবনভূমির জায়গা বদল হচ্ছে। ফলে দিন কে দিন ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে হাওড় এলাকা বন্যার প্রকৃতি আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই বন্যার কারণে প্রায় কোটি মানুষের বাসস্থান বদল করতে হয়। তারা নিরাপত্তার তালাশে শহরে ভিড় জমায়। শহরে বাস করা বস্তির মানুষের অর্ধেকের বেশি এই অবস্থার শিকার। বেশির ভাগ মানুষের লক্ষ্য থাকে রাজধানী ঢাকা। অথচ ঢাকায় এখন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। আবাসিক এলাকা থেকে বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এই সংখ্যা আরও বেশি। সাম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী সাইক্লোনের প্রখরতা এবং সংখ্যা বাড়ছে। বঙ্গোপসাগর উল্টোমুখী চুঙ্গোর আকারে বাংলাদেশের অনেক খানি ভিতরে ঢুকে থাকায় সাইক্লোনের বিপত্তি আমাদের জন্য আরও বেশি। বিগত দুই দশকে সংগঠিত সাইক্লোনগুলো বিচার করলে তাই মনে হয়। ২০০৭-এ সাইক্লোন সিডরের কথা আমাদের মনে আছে। ঘণ্টায় বাতাসের গড় গতিবেগ ছিল ২৪০ কিলোমিটার। প্রায় ৩০৪৬ জনের প্রাণ গেছে। এর দুই বছরের মধ্যে দেশ আইলা আক্রান্ত হয়। ১৯০ জনের প্রাণ যায়। দুই লাখ বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়। ২০১৬ সালে সাইক্লোন রোয়ানোর কারণে বিপুল এলাকা পানিতে ডুবে যায়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়। ২৬ জনের প্রাণ যায়। ২০১৯ সালে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলা সাইক্লোন বুলবুলের কারণে সারাদেশ ল-ভ- হয়ে যায়। প্রায় বিশ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়। এর এক বছর পরেই আরেক প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন আমফানের কবলে পড়ে দেশ। ফলে এক লাখ ছিয়াত্তর হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতির কবলে পড়ে। ১০ জন মারা যায়। সাইক্লোন ইয়াস আঘাত হানে ২০২১ এ। চলতি বছর সাইক্লোন রিমেলের কারণে তছনছ হয়ে গেল উপকূল এলাকা। অথচ অতীতের দিকে যদি তাকাই। ১৯৭০-এ ভোলা সাইক্লোনের কথা মনে পড়ে। কোনো নিরাপত্তা ছিল না। জলচ্ছ্বাসে মানুষ-গবাদিপশু-গাছপালা ধুয়ে যায়। মানুষ মারা যায় ৫ থেকে ৬ লাখের মতো। ১৯৯১ এ চট্টগ্রামের সাইক্লোনে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। সেই তুলনায় সাইক্লোনের প্রখরতা বাড়লেও প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। সম্ভবত সাইক্লোনের প্রতি সবার সচেতনতার কারণে। মোট গ্লোবাল গ্রিনহাউস গ্যাস ইমিশনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৫৬ শতাংশ। অথচ এবৎসধহধিঃপয’ং ২০২১ এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবগুলো দেশের মধ্যে সপ্তম। অথচ এইসব ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। যতটুকুই আমাদের উদগীরণ হোক না কেন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে হলে আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের উদগীরণ কমাতে হবে। বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের জনগণের ভেতরে থাকা ঐতিহ্যগত সাধারণ জ্ঞানকে জাগ্রত করতে হবে। অন্যথায় পৃথিবীর বুকে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হবে।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]
জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি আজ আমরা ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ একটা হিসেব আমার কাছে আছে। এখানে বাংলাদেশের ৩৪টি আবহাওয়া অফিসের গড় হিসেব দেখানো হয়েছে। দেখা গেছে শুধু জানুয়ারি মাস ছাড়া বাকি এগারো মাসের বেলায় তাপমাত্রা বেড়েছে। এই বাড়তির গড় মাত্রা কমবেশি আধা ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে লক্ষণীয় হলো ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে এই পরিবর্তন। ২০০৫ থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত আরও আনেক পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চয়ই। আন্তর্জাতিক প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর হিসাব অনুয়ায়ী ২০১০ থেকে ২০৩৯ পর্যন্ত যদি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ০.৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৪০ থেকে ২০৬৯ পর্যন্ত এই তাপমাত্রার পরিমাণ দাঁড়াবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জুন থেকে আগস্ট ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শতাব্দির শেষ দিকে এই পরিমাণতো আরও অনেক বেশি হবে। এভাবে নির্দিষ্ট সীমা অবধি বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ধানের ফলন তার প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে বাড়তি তাপমাত্রার সঙ্গে অভিযোজন উপযোগী কোনো জাতের বেলায় হয়তো এমনটি নাও হতে পারে। তবে আইপিসিসির হিসেব অনুযায়ী সীমা ছাড়িয়ে গেলে কী হবে বলা যায় না। যাই হোক এখানে তাপমাত্রার প্রকৃত বৃদ্ধি এবং তার সিমুলেটেড সম্ভাব্য বৃদ্ধির মাত্রা দেখে কিছুটা খটকা লাগে। তাপমাত্রা বাড়ছে সত্যি কিন্তু এতটাই কি বাড়ছে! এ ব্যাপারে বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী হাফ ব্রাম্মারের একটি উক্তি মনে করতে হয়। তাপমাত্রা মাপার অবজারভেটরিগুলো সাধারণত এয়ারপোর্টের পাশে বা শহরের পাকা রাস্তার ধার পাকাবাড়ি ঘেঁষে থাকে। সেখান থেকে প্রাপ্ত তাপমাত্রা প্রকৃত প্রাকৃতিক পরিবেশের তাপমাত্রা থেকে বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া পৃথিবী পৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠের প্রকৃত তাপমাত্রাতো সরাসরি মাপা যায়নি। যদিও ১৯৭৯-এর পর থেকে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার আগেতো তেমন বিকল্প ছিল না। তাই প্রকৃত তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সেটার ওপর ভিত্তি করে হিসেব করা সিমুলেটেড তাপমাত্রা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে অবশ্যই কিছুটা বেশি ছিল। পরবর্তীতে কিছুটা সংস্কার করে আইপিসিসি তার সাম্প্রতিক মাত্রা প্রকাশ করছে। যাই হোক তাপমাত্রা বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে কৌলিতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার কারণে প্রধান প্রধান ফসলের ফলন এখন পর্যন্ত বাড়ানো গেলেও প্রাকৃতিক বৈরী পরিবশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিন্তু বেড়েই চলেছে। সে ব্যাপারে এখানে কিছু আলোচনা করা হলো। এবৎসধহধিঃপয’ং ২০২১ এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী-এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৮৫টি চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সুদূর অতীতকাল থেকে বাংলাদেশ সুজলা সুফলা দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। পাশাপাশি বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘুর্ণিঝড়ের দেশ হিসেবেও পরিচিতি কম নয়। মার্কিন সরকারের ২০১৮ এর এক তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ জনগণ বিরাট জলবায়ু-ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। বাংলাদেশ সাগরপাড়ের দেশ। সাগর সমতল থেকে দেশের তিন ভাগের দুই ভাগের উচ্চতা ১৫ ফুটের বেশি নয়। তবে দক্ষিণের বিরাট এলাকা সাগর সমতলের কাছাকাছি। বিজ্ঞানীদের ধারণা বর্তমানের গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের ট্রেন্ড যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাবে আধা মিটার। তাহলে সাগর পাড়ের বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সরে আসতে হবে। এক হিসেব মতে এই সংখ্যা হবে প্রতি সাত জনে এক জন অর্থাৎ প্রায় এক কোটি আশি লাখ মানুষ। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকানের এক তথ্য মতে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা। তাদের মতে ২১০০ সাল নাগাদ সাগরের উচ্চতা দেড় থেকে দুই মিটার বেড়ে যেতে পারে। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ ‘জলবায়ু-শরণার্থী’ সমস্যা। প্রায় ৫ কোটি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্য নতুন জায়গার খোঁজ করতে হবে। সুন্দর-বনসহ বিরাট আবাদি এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। সাইক্লোন প্রটেকশন ভেঙে পড়ায় উপকূলধুয়ে সাগরে মিশে যাবে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাবে। উপকূল থেকে কয়েক ১০০ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত নোনা জলের বিস্তার ঘটবে। ফলে চলমান কৃষির অস্তিত্ব ভয়াবহ ঝুঁকির কবলে পড়বে। পানিয় জলের অভাব দেখা দেবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ শুধু খাবারের অভাবে ভুগবে তা নয় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেও হাবুডুবু খাবে। ইতোমধ্যে লবণাক্ত এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি। অথচ ১৯৭৩-তে লবণাক্ত ছিল ৮.৩ মিলিয়ন হেক্টর। গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। সময়ের বৃষ্টি সময়ে হচ্ছে না। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে হিমালয়ের বরফচাঁই গলে বিপুল জলরাশি আমাদের নদী-নালাগুলোকে ভরিয়ে দিচ্ছে। হিমালয় ধোয়া পলির কারণে আমাদের নদীগুলো তলদেশ ভরে উঠছে। নদীভাঙন বাড়ছে। হাওর-বাওর এমনকি বন্যা বিধৌত মাঠঘাঠ ভরে উঠছে। নদীর গতিপথ প্রভাবিত হচ্ছে। প্লাবনভূমির জায়গা বদল হচ্ছে। ফলে দিন কে দিন ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে হাওড় এলাকা বন্যার প্রকৃতি আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই বন্যার কারণে প্রায় কোটি মানুষের বাসস্থান বদল করতে হয়। তারা নিরাপত্তার তালাশে শহরে ভিড় জমায়। শহরে বাস করা বস্তির মানুষের অর্ধেকের বেশি এই অবস্থার শিকার। বেশির ভাগ মানুষের লক্ষ্য থাকে রাজধানী ঢাকা। অথচ ঢাকায় এখন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। আবাসিক এলাকা থেকে বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এই সংখ্যা আরও বেশি। সাম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী সাইক্লোনের প্রখরতা এবং সংখ্যা বাড়ছে। বঙ্গোপসাগর উল্টোমুখী চুঙ্গোর আকারে বাংলাদেশের অনেক খানি ভিতরে ঢুকে থাকায় সাইক্লোনের বিপত্তি আমাদের জন্য আরও বেশি। বিগত দুই দশকে সংগঠিত সাইক্লোনগুলো বিচার করলে তাই মনে হয়। ২০০৭-এ সাইক্লোন সিডরের কথা আমাদের মনে আছে। ঘণ্টায় বাতাসের গড় গতিবেগ ছিল ২৪০ কিলোমিটার। প্রায় ৩০৪৬ জনের প্রাণ গেছে। এর দুই বছরের মধ্যে দেশ আইলা আক্রান্ত হয়। ১৯০ জনের প্রাণ যায়। দুই লাখ বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়। ২০১৬ সালে সাইক্লোন রোয়ানোর কারণে বিপুল এলাকা পানিতে ডুবে যায়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়। ২৬ জনের প্রাণ যায়। ২০১৯ সালে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলা সাইক্লোন বুলবুলের কারণে সারাদেশ ল-ভ- হয়ে যায়। প্রায় বিশ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়। এর এক বছর পরেই আরেক প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন আমফানের কবলে পড়ে দেশ। ফলে এক লাখ ছিয়াত্তর হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতির কবলে পড়ে। ১০ জন মারা যায়। সাইক্লোন ইয়াস আঘাত হানে ২০২১ এ। চলতি বছর সাইক্লোন রিমেলের কারণে তছনছ হয়ে গেল উপকূল এলাকা। অথচ অতীতের দিকে যদি তাকাই। ১৯৭০-এ ভোলা সাইক্লোনের কথা মনে পড়ে। কোনো নিরাপত্তা ছিল না। জলচ্ছ্বাসে মানুষ-গবাদিপশু-গাছপালা ধুয়ে যায়। মানুষ মারা যায় ৫ থেকে ৬ লাখের মতো। ১৯৯১ এ চট্টগ্রামের সাইক্লোনে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। সেই তুলনায় সাইক্লোনের প্রখরতা বাড়লেও প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। সম্ভবত সাইক্লোনের প্রতি সবার সচেতনতার কারণে। মোট গ্লোবাল গ্রিনহাউস গ্যাস ইমিশনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৫৬ শতাংশ। অথচ এবৎসধহধিঃপয’ং ২০২১ এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবগুলো দেশের মধ্যে সপ্তম। অথচ এইসব ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। যতটুকুই আমাদের উদগীরণ হোক না কেন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে হলে আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের উদগীরণ কমাতে হবে। বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের জনগণের ভেতরে থাকা ঐতিহ্যগত সাধারণ জ্ঞানকে জাগ্রত করতে হবে। অন্যথায় পৃথিবীর বুকে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হবে।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]