alt

উপ-সম্পাদকীয়

কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ বিষয়ক রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ৯৩ শতাংশ মেধা, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণ করতে বলেছে। ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কোটা প্রথা বাতিল করে; ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল করে, সরকার হাইকোর্টের রায় বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিলের রায় হওয়ার আগেই পুনরায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। অনগ্রসর শ্রেণী বা জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নির্ধারণ করা সরকারের কাজ, কিন্তু একবার কোন বিষয় আদালত আমলে নিলে তা আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়, আদালতে বিচারধীন থাকা অবস্থায় একই বিষয়ে সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ব্যতীত কোটা সমস্যার সমাধান করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২০১৮ সালের আগে যে কোটা নীতির প্রচলন ছিল তাতে ৪৪ ভাগ ছিল মেধা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ জেলা, ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ ভাগ ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এখন আর জেলা ও নারী কোটা থাকবে না। আগে মেধা ব্যতীত আর সব কোটাতেই জেলার জনসংখ্যাভিত্তিক কোটা বণ্টন করে নিয়োগ দেয়া হতো। তবে কোটায় নিয়োগ পেতে হলেও সব প্রার্থীকে মেধাবীদের সঙ্গে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্যানেলভুক্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১০০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নেয়া হয়, এর মধ্যে মাত্র ১ জন নারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮১ সালে আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম, একজন নারী উত্তীর্ণ হলেও সে চাকরিতে যোগ দেয়নি। এখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মেধা প্রতিযোগিতায় সমকক্ষ হলেও সংখ্যায় কম। কারণ স্কুল-কলেজে মেয়েরা ভালো ফলাফল করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বিচারে বেশি নয়। এক সময় নারী কোটা ছিল বলেই অনেক নারী চাকরি পেয়েছেন, তাই অফিস আদালতে এখন নারী কর্মী চোখে পড়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে মেয়েরা তাদের জন্য কোটার প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেন; কিন্তু যারা বলেছেন তারা সারা বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এখনও সমাজে মেয়েরা অবহেলিত, নিগৃহীত, পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধা ডিঙিয়ে তাদের এগোতে হচ্ছে; তাই চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ আবার রুদ্ধ হয়ে যাবে, তারা আবার পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় অবিকল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নারী কোটা না থাকায় সমাজে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন যুক্তিতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কিন্তু বর্তমানের ৫ শতাংশও কি তাদের কোন কাজে লাগবে? বর্তমান নীতি অনুযায়ী নাতি-নাতনি জন্য এই কোটা আর প্রযোজ্য নয়, অন্যদিকে কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই, তাহলে এই ৫ শতাংশ কার জন্য? তৃতীয় লিঙ্গ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এই সেকশনের লোকজন শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত, এদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথে হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকায় এরা চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না। পরিশেষে প্রকৃতপক্ষে কোনো কোটাই থাকল না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের উকিল উল্লেখ করেছেন যে, ২১ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দেয়া হয়নি; অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উক্তি, ‘আর কত, ৫৩ বছর কোটার সুবিধা নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা’। শুধু ২১ বছর কোটা থেকে বঞ্চিত ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা এত কোণঠাসা ছিল যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেও বিব্রত বোধ করত। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখন তাদের জন্য আর কোনো কোটা চায় না। কোটার নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে তা কোনো কিছু দিয়ে ঘোচানো যাবে না।

সংবিধান মোতাবেক দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা। সংবিধানের এই কথার সঙ্গে কোটা প্রথা সাংঘর্ষিক, কারণ কোটা থাকলে কোটার আওতাভুক্ত সেকশন বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু সংবিধানেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে, অনগ্রসর সেকশন বা জনগোষ্ঠীকে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের চাকরি পাওয়া ও জীবনমান উন্নয়নের অনুকূল বিধান সরকার প্রণয়ন করতে পারবে। সমাজের বাস্তবতা বিচার করেই সংবিধানে এমন প্রভিশন রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে মানসম্মত কোন স্কুল-কলেজ নেই, দেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে নৌকা দিয়ে বা নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে শিশুদের স্কুলে যেতে হয়। দেশে এমন অসংখ্য হতদরিদ্র, গরিব, নিঃস্ব পরিবারের শিশু রয়েছে যাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে শিশু শ্রমিক বানানো পরিবারের জন্য বেশি কল্যাণকর। এরাই সমাজের সুবিধাভোগীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী। যারা গ্রামের স্কুল-কলেজের মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে কোনভাবে লড়তে লড়তে কোনো তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে তারা শহরের উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় টিকবে কেন? তাই তাদের জন্য কোটা দরকার ছিল।

সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা বিধান এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। এছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাও সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের এই নির্দেশনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইহজিন্দিগিতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের ছোট ভূখ-টিতে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ কম। এছাড়া বিপুল জনসংখ্যার সবার জন্য সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের নীতি অনুসরণ করাও সম্ভব নয়, কারণ পুঁজির চরম বিকাশ ছাড়া দারিদ্রের সমতা বিধান নিরর্থক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মান ও মাত্রা দেশের সব এলাকায় সমানভাবে একই গতিতে করাও সম্ভব হয় না, তাই এলাকা বিচারে জনগণের প্রাপ্তির বৈষম্য আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। মানুষের অবস্থানগত বৈষম্য, শিক্ষার বৈষম্য, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য দূর না করে কোটার বৈষম্য দূর করে শুধু সুবিধাভোগীদেরই লাভ হবে, কারণ সমাজের সুবিধাভোগীদের সন্তানরাই নামকরা স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।

কোটা থাকার কারণেই সংসদে নারীরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে, আইন প্রণয়নে সমর্থ হচ্ছে। যারাই কোটায় সাংসদ হয়েছেন তারাই অভিজাত শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদ নারী দ্বারা পূরণের যে সময়সীমা নির্বাচন কমিশন বেঁধে দিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আর রাখা হয়নি; কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই শর্ত পূরণ করা আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। নারীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষ প্রার্থীর চেয়ে কম, বাংলাদেশে নারীরাও নারী প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করে না। এ কারণেই স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও সাংসদ হতে নারীদের কোটা লাগে। বিগত ৫৩ বছর ধরে যারা চাকরির কোটার সুযোগ নিয়ে বড় বড় শহরে বসবাস করছেন তাদের সন্তানরা আজ আর কোটা চায় না। এটা জগতের নিয়ম। বাসে উঠেই সব যাত্রী অন্য কোনো যাত্রীর ওঠাকে পছন্দ করে না।

কোটা আন্দোলনের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আদালতের বিষয়টি রাজপথে চলে এলো। সবই রাজনৈতিক খেলা, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ক্ষমতায়। নির্বাচন কমিশনের শর্ত পরিপালন না করায় জামায়াতে ইসলাম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের জন্য তাদের শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, রাজনৈতিক শত্রু। আওয়ামী লীগ সরকারের চরম বিপর্যয় তাদের কাম্য। ক্ষমতায় যাওয়ার খেলা বিএনপি খেলবেই, না চাইলেও জামায়েত-বিএনপিকে সহায়তা করবে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে তাদের এই খেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে এই খেলায় জীবনহানি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, উন্নয়নের গতি শ্লথ হচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিনাশ কাম্য বলেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে ভর করেছিল, এই ভর করাটাও রাজনৈতিক কৌশল; কিন্তু জানমালের যে ক্ষতি হলো তার দায় নেবে কে? আন্দোলনে জীবনহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের যে বিমর্ষ চেহারা তা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে, এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ বিষয়ক রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ৯৩ শতাংশ মেধা, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণ করতে বলেছে। ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কোটা প্রথা বাতিল করে; ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল করে, সরকার হাইকোর্টের রায় বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিলের রায় হওয়ার আগেই পুনরায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। অনগ্রসর শ্রেণী বা জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নির্ধারণ করা সরকারের কাজ, কিন্তু একবার কোন বিষয় আদালত আমলে নিলে তা আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়, আদালতে বিচারধীন থাকা অবস্থায় একই বিষয়ে সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ব্যতীত কোটা সমস্যার সমাধান করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২০১৮ সালের আগে যে কোটা নীতির প্রচলন ছিল তাতে ৪৪ ভাগ ছিল মেধা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ জেলা, ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ ভাগ ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এখন আর জেলা ও নারী কোটা থাকবে না। আগে মেধা ব্যতীত আর সব কোটাতেই জেলার জনসংখ্যাভিত্তিক কোটা বণ্টন করে নিয়োগ দেয়া হতো। তবে কোটায় নিয়োগ পেতে হলেও সব প্রার্থীকে মেধাবীদের সঙ্গে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্যানেলভুক্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১০০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নেয়া হয়, এর মধ্যে মাত্র ১ জন নারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮১ সালে আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম, একজন নারী উত্তীর্ণ হলেও সে চাকরিতে যোগ দেয়নি। এখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মেধা প্রতিযোগিতায় সমকক্ষ হলেও সংখ্যায় কম। কারণ স্কুল-কলেজে মেয়েরা ভালো ফলাফল করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বিচারে বেশি নয়। এক সময় নারী কোটা ছিল বলেই অনেক নারী চাকরি পেয়েছেন, তাই অফিস আদালতে এখন নারী কর্মী চোখে পড়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে মেয়েরা তাদের জন্য কোটার প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেন; কিন্তু যারা বলেছেন তারা সারা বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এখনও সমাজে মেয়েরা অবহেলিত, নিগৃহীত, পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধা ডিঙিয়ে তাদের এগোতে হচ্ছে; তাই চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ আবার রুদ্ধ হয়ে যাবে, তারা আবার পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় অবিকল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নারী কোটা না থাকায় সমাজে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন যুক্তিতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কিন্তু বর্তমানের ৫ শতাংশও কি তাদের কোন কাজে লাগবে? বর্তমান নীতি অনুযায়ী নাতি-নাতনি জন্য এই কোটা আর প্রযোজ্য নয়, অন্যদিকে কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই, তাহলে এই ৫ শতাংশ কার জন্য? তৃতীয় লিঙ্গ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এই সেকশনের লোকজন শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত, এদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথে হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকায় এরা চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না। পরিশেষে প্রকৃতপক্ষে কোনো কোটাই থাকল না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের উকিল উল্লেখ করেছেন যে, ২১ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দেয়া হয়নি; অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উক্তি, ‘আর কত, ৫৩ বছর কোটার সুবিধা নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা’। শুধু ২১ বছর কোটা থেকে বঞ্চিত ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা এত কোণঠাসা ছিল যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেও বিব্রত বোধ করত। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখন তাদের জন্য আর কোনো কোটা চায় না। কোটার নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে তা কোনো কিছু দিয়ে ঘোচানো যাবে না।

সংবিধান মোতাবেক দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা। সংবিধানের এই কথার সঙ্গে কোটা প্রথা সাংঘর্ষিক, কারণ কোটা থাকলে কোটার আওতাভুক্ত সেকশন বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু সংবিধানেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে, অনগ্রসর সেকশন বা জনগোষ্ঠীকে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের চাকরি পাওয়া ও জীবনমান উন্নয়নের অনুকূল বিধান সরকার প্রণয়ন করতে পারবে। সমাজের বাস্তবতা বিচার করেই সংবিধানে এমন প্রভিশন রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে মানসম্মত কোন স্কুল-কলেজ নেই, দেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে নৌকা দিয়ে বা নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে শিশুদের স্কুলে যেতে হয়। দেশে এমন অসংখ্য হতদরিদ্র, গরিব, নিঃস্ব পরিবারের শিশু রয়েছে যাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে শিশু শ্রমিক বানানো পরিবারের জন্য বেশি কল্যাণকর। এরাই সমাজের সুবিধাভোগীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী। যারা গ্রামের স্কুল-কলেজের মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে কোনভাবে লড়তে লড়তে কোনো তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে তারা শহরের উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় টিকবে কেন? তাই তাদের জন্য কোটা দরকার ছিল।

সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা বিধান এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। এছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাও সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের এই নির্দেশনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইহজিন্দিগিতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের ছোট ভূখ-টিতে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ কম। এছাড়া বিপুল জনসংখ্যার সবার জন্য সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের নীতি অনুসরণ করাও সম্ভব নয়, কারণ পুঁজির চরম বিকাশ ছাড়া দারিদ্রের সমতা বিধান নিরর্থক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মান ও মাত্রা দেশের সব এলাকায় সমানভাবে একই গতিতে করাও সম্ভব হয় না, তাই এলাকা বিচারে জনগণের প্রাপ্তির বৈষম্য আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। মানুষের অবস্থানগত বৈষম্য, শিক্ষার বৈষম্য, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য দূর না করে কোটার বৈষম্য দূর করে শুধু সুবিধাভোগীদেরই লাভ হবে, কারণ সমাজের সুবিধাভোগীদের সন্তানরাই নামকরা স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।

কোটা থাকার কারণেই সংসদে নারীরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে, আইন প্রণয়নে সমর্থ হচ্ছে। যারাই কোটায় সাংসদ হয়েছেন তারাই অভিজাত শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদ নারী দ্বারা পূরণের যে সময়সীমা নির্বাচন কমিশন বেঁধে দিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আর রাখা হয়নি; কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই শর্ত পূরণ করা আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। নারীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষ প্রার্থীর চেয়ে কম, বাংলাদেশে নারীরাও নারী প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করে না। এ কারণেই স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও সাংসদ হতে নারীদের কোটা লাগে। বিগত ৫৩ বছর ধরে যারা চাকরির কোটার সুযোগ নিয়ে বড় বড় শহরে বসবাস করছেন তাদের সন্তানরা আজ আর কোটা চায় না। এটা জগতের নিয়ম। বাসে উঠেই সব যাত্রী অন্য কোনো যাত্রীর ওঠাকে পছন্দ করে না।

কোটা আন্দোলনের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আদালতের বিষয়টি রাজপথে চলে এলো। সবই রাজনৈতিক খেলা, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ক্ষমতায়। নির্বাচন কমিশনের শর্ত পরিপালন না করায় জামায়াতে ইসলাম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের জন্য তাদের শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, রাজনৈতিক শত্রু। আওয়ামী লীগ সরকারের চরম বিপর্যয় তাদের কাম্য। ক্ষমতায় যাওয়ার খেলা বিএনপি খেলবেই, না চাইলেও জামায়েত-বিএনপিকে সহায়তা করবে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে তাদের এই খেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে এই খেলায় জীবনহানি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, উন্নয়নের গতি শ্লথ হচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিনাশ কাম্য বলেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে ভর করেছিল, এই ভর করাটাও রাজনৈতিক কৌশল; কিন্তু জানমালের যে ক্ষতি হলো তার দায় নেবে কে? আন্দোলনে জীবনহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের যে বিমর্ষ চেহারা তা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে, এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

‘আবার তোরা মানুষ হ’

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ বিষয়ক রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ৯৩ শতাংশ মেধা, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণ করতে বলেছে। ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কোটা প্রথা বাতিল করে; ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল করে, সরকার হাইকোর্টের রায় বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিলের রায় হওয়ার আগেই পুনরায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। অনগ্রসর শ্রেণী বা জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নির্ধারণ করা সরকারের কাজ, কিন্তু একবার কোন বিষয় আদালত আমলে নিলে তা আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়, আদালতে বিচারধীন থাকা অবস্থায় একই বিষয়ে সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ব্যতীত কোটা সমস্যার সমাধান করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২০১৮ সালের আগে যে কোটা নীতির প্রচলন ছিল তাতে ৪৪ ভাগ ছিল মেধা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ জেলা, ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ ভাগ ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এখন আর জেলা ও নারী কোটা থাকবে না। আগে মেধা ব্যতীত আর সব কোটাতেই জেলার জনসংখ্যাভিত্তিক কোটা বণ্টন করে নিয়োগ দেয়া হতো। তবে কোটায় নিয়োগ পেতে হলেও সব প্রার্থীকে মেধাবীদের সঙ্গে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্যানেলভুক্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১০০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নেয়া হয়, এর মধ্যে মাত্র ১ জন নারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮১ সালে আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম, একজন নারী উত্তীর্ণ হলেও সে চাকরিতে যোগ দেয়নি। এখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মেধা প্রতিযোগিতায় সমকক্ষ হলেও সংখ্যায় কম। কারণ স্কুল-কলেজে মেয়েরা ভালো ফলাফল করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বিচারে বেশি নয়। এক সময় নারী কোটা ছিল বলেই অনেক নারী চাকরি পেয়েছেন, তাই অফিস আদালতে এখন নারী কর্মী চোখে পড়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে মেয়েরা তাদের জন্য কোটার প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেন; কিন্তু যারা বলেছেন তারা সারা বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এখনও সমাজে মেয়েরা অবহেলিত, নিগৃহীত, পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধা ডিঙিয়ে তাদের এগোতে হচ্ছে; তাই চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ আবার রুদ্ধ হয়ে যাবে, তারা আবার পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় অবিকল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নারী কোটা না থাকায় সমাজে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন যুক্তিতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কিন্তু বর্তমানের ৫ শতাংশও কি তাদের কোন কাজে লাগবে? বর্তমান নীতি অনুযায়ী নাতি-নাতনি জন্য এই কোটা আর প্রযোজ্য নয়, অন্যদিকে কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই, তাহলে এই ৫ শতাংশ কার জন্য? তৃতীয় লিঙ্গ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এই সেকশনের লোকজন শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত, এদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথে হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকায় এরা চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না। পরিশেষে প্রকৃতপক্ষে কোনো কোটাই থাকল না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের উকিল উল্লেখ করেছেন যে, ২১ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দেয়া হয়নি; অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উক্তি, ‘আর কত, ৫৩ বছর কোটার সুবিধা নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা’। শুধু ২১ বছর কোটা থেকে বঞ্চিত ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা এত কোণঠাসা ছিল যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেও বিব্রত বোধ করত। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখন তাদের জন্য আর কোনো কোটা চায় না। কোটার নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে তা কোনো কিছু দিয়ে ঘোচানো যাবে না।

সংবিধান মোতাবেক দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা। সংবিধানের এই কথার সঙ্গে কোটা প্রথা সাংঘর্ষিক, কারণ কোটা থাকলে কোটার আওতাভুক্ত সেকশন বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু সংবিধানেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে, অনগ্রসর সেকশন বা জনগোষ্ঠীকে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের চাকরি পাওয়া ও জীবনমান উন্নয়নের অনুকূল বিধান সরকার প্রণয়ন করতে পারবে। সমাজের বাস্তবতা বিচার করেই সংবিধানে এমন প্রভিশন রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে মানসম্মত কোন স্কুল-কলেজ নেই, দেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে নৌকা দিয়ে বা নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে শিশুদের স্কুলে যেতে হয়। দেশে এমন অসংখ্য হতদরিদ্র, গরিব, নিঃস্ব পরিবারের শিশু রয়েছে যাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে শিশু শ্রমিক বানানো পরিবারের জন্য বেশি কল্যাণকর। এরাই সমাজের সুবিধাভোগীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী। যারা গ্রামের স্কুল-কলেজের মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে কোনভাবে লড়তে লড়তে কোনো তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে তারা শহরের উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় টিকবে কেন? তাই তাদের জন্য কোটা দরকার ছিল।

সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা বিধান এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। এছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাও সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের এই নির্দেশনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইহজিন্দিগিতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের ছোট ভূখ-টিতে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ কম। এছাড়া বিপুল জনসংখ্যার সবার জন্য সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের নীতি অনুসরণ করাও সম্ভব নয়, কারণ পুঁজির চরম বিকাশ ছাড়া দারিদ্রের সমতা বিধান নিরর্থক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মান ও মাত্রা দেশের সব এলাকায় সমানভাবে একই গতিতে করাও সম্ভব হয় না, তাই এলাকা বিচারে জনগণের প্রাপ্তির বৈষম্য আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। মানুষের অবস্থানগত বৈষম্য, শিক্ষার বৈষম্য, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য দূর না করে কোটার বৈষম্য দূর করে শুধু সুবিধাভোগীদেরই লাভ হবে, কারণ সমাজের সুবিধাভোগীদের সন্তানরাই নামকরা স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।

কোটা থাকার কারণেই সংসদে নারীরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে, আইন প্রণয়নে সমর্থ হচ্ছে। যারাই কোটায় সাংসদ হয়েছেন তারাই অভিজাত শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদ নারী দ্বারা পূরণের যে সময়সীমা নির্বাচন কমিশন বেঁধে দিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আর রাখা হয়নি; কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই শর্ত পূরণ করা আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। নারীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষ প্রার্থীর চেয়ে কম, বাংলাদেশে নারীরাও নারী প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করে না। এ কারণেই স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও সাংসদ হতে নারীদের কোটা লাগে। বিগত ৫৩ বছর ধরে যারা চাকরির কোটার সুযোগ নিয়ে বড় বড় শহরে বসবাস করছেন তাদের সন্তানরা আজ আর কোটা চায় না। এটা জগতের নিয়ম। বাসে উঠেই সব যাত্রী অন্য কোনো যাত্রীর ওঠাকে পছন্দ করে না।

কোটা আন্দোলনের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আদালতের বিষয়টি রাজপথে চলে এলো। সবই রাজনৈতিক খেলা, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ক্ষমতায়। নির্বাচন কমিশনের শর্ত পরিপালন না করায় জামায়াতে ইসলাম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের জন্য তাদের শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, রাজনৈতিক শত্রু। আওয়ামী লীগ সরকারের চরম বিপর্যয় তাদের কাম্য। ক্ষমতায় যাওয়ার খেলা বিএনপি খেলবেই, না চাইলেও জামায়েত-বিএনপিকে সহায়তা করবে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে তাদের এই খেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে এই খেলায় জীবনহানি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, উন্নয়নের গতি শ্লথ হচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিনাশ কাম্য বলেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে ভর করেছিল, এই ভর করাটাও রাজনৈতিক কৌশল; কিন্তু জানমালের যে ক্ষতি হলো তার দায় নেবে কে? আন্দোলনে জীবনহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের যে বিমর্ষ চেহারা তা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে, এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ বিষয়ক রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ৯৩ শতাংশ মেধা, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণ করতে বলেছে। ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কোটা প্রথা বাতিল করে; ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল করে, সরকার হাইকোর্টের রায় বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিলের রায় হওয়ার আগেই পুনরায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। অনগ্রসর শ্রেণী বা জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নির্ধারণ করা সরকারের কাজ, কিন্তু একবার কোন বিষয় আদালত আমলে নিলে তা আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়, আদালতে বিচারধীন থাকা অবস্থায় একই বিষয়ে সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ব্যতীত কোটা সমস্যার সমাধান করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২০১৮ সালের আগে যে কোটা নীতির প্রচলন ছিল তাতে ৪৪ ভাগ ছিল মেধা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ জেলা, ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ ভাগ ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এখন আর জেলা ও নারী কোটা থাকবে না। আগে মেধা ব্যতীত আর সব কোটাতেই জেলার জনসংখ্যাভিত্তিক কোটা বণ্টন করে নিয়োগ দেয়া হতো। তবে কোটায় নিয়োগ পেতে হলেও সব প্রার্থীকে মেধাবীদের সঙ্গে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্যানেলভুক্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১০০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নেয়া হয়, এর মধ্যে মাত্র ১ জন নারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮১ সালে আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম, একজন নারী উত্তীর্ণ হলেও সে চাকরিতে যোগ দেয়নি। এখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মেধা প্রতিযোগিতায় সমকক্ষ হলেও সংখ্যায় কম। কারণ স্কুল-কলেজে মেয়েরা ভালো ফলাফল করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বিচারে বেশি নয়। এক সময় নারী কোটা ছিল বলেই অনেক নারী চাকরি পেয়েছেন, তাই অফিস আদালতে এখন নারী কর্মী চোখে পড়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে মেয়েরা তাদের জন্য কোটার প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেন; কিন্তু যারা বলেছেন তারা সারা বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এখনও সমাজে মেয়েরা অবহেলিত, নিগৃহীত, পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধা ডিঙিয়ে তাদের এগোতে হচ্ছে; তাই চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ আবার রুদ্ধ হয়ে যাবে, তারা আবার পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় অবিকল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নারী কোটা না থাকায় সমাজে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন যুক্তিতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কিন্তু বর্তমানের ৫ শতাংশও কি তাদের কোন কাজে লাগবে? বর্তমান নীতি অনুযায়ী নাতি-নাতনি জন্য এই কোটা আর প্রযোজ্য নয়, অন্যদিকে কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই, তাহলে এই ৫ শতাংশ কার জন্য? তৃতীয় লিঙ্গ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এই সেকশনের লোকজন শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত, এদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথে হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকায় এরা চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না। পরিশেষে প্রকৃতপক্ষে কোনো কোটাই থাকল না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের উকিল উল্লেখ করেছেন যে, ২১ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দেয়া হয়নি; অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উক্তি, ‘আর কত, ৫৩ বছর কোটার সুবিধা নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা’। শুধু ২১ বছর কোটা থেকে বঞ্চিত ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা এত কোণঠাসা ছিল যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেও বিব্রত বোধ করত। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখন তাদের জন্য আর কোনো কোটা চায় না। কোটার নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে তা কোনো কিছু দিয়ে ঘোচানো যাবে না।

সংবিধান মোতাবেক দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা। সংবিধানের এই কথার সঙ্গে কোটা প্রথা সাংঘর্ষিক, কারণ কোটা থাকলে কোটার আওতাভুক্ত সেকশন বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু সংবিধানেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে, অনগ্রসর সেকশন বা জনগোষ্ঠীকে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের চাকরি পাওয়া ও জীবনমান উন্নয়নের অনুকূল বিধান সরকার প্রণয়ন করতে পারবে। সমাজের বাস্তবতা বিচার করেই সংবিধানে এমন প্রভিশন রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে মানসম্মত কোন স্কুল-কলেজ নেই, দেশে এমন এলাকাও আছে যেখানে নৌকা দিয়ে বা নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে শিশুদের স্কুলে যেতে হয়। দেশে এমন অসংখ্য হতদরিদ্র, গরিব, নিঃস্ব পরিবারের শিশু রয়েছে যাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে শিশু শ্রমিক বানানো পরিবারের জন্য বেশি কল্যাণকর। এরাই সমাজের সুবিধাভোগীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী। যারা গ্রামের স্কুল-কলেজের মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে কোনভাবে লড়তে লড়তে কোনো তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে তারা শহরের উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় টিকবে কেন? তাই তাদের জন্য কোটা দরকার ছিল।

সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা বিধান এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। এছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাও সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের এই নির্দেশনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইহজিন্দিগিতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের ছোট ভূখ-টিতে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ কম। এছাড়া বিপুল জনসংখ্যার সবার জন্য সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের নীতি অনুসরণ করাও সম্ভব নয়, কারণ পুঁজির চরম বিকাশ ছাড়া দারিদ্রের সমতা বিধান নিরর্থক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মান ও মাত্রা দেশের সব এলাকায় সমানভাবে একই গতিতে করাও সম্ভব হয় না, তাই এলাকা বিচারে জনগণের প্রাপ্তির বৈষম্য আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। মানুষের অবস্থানগত বৈষম্য, শিক্ষার বৈষম্য, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য দূর না করে কোটার বৈষম্য দূর করে শুধু সুবিধাভোগীদেরই লাভ হবে, কারণ সমাজের সুবিধাভোগীদের সন্তানরাই নামকরা স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।

কোটা থাকার কারণেই সংসদে নারীরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে, আইন প্রণয়নে সমর্থ হচ্ছে। যারাই কোটায় সাংসদ হয়েছেন তারাই অভিজাত শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদ নারী দ্বারা পূরণের যে সময়সীমা নির্বাচন কমিশন বেঁধে দিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আর রাখা হয়নি; কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই শর্ত পূরণ করা আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। নারীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষ প্রার্থীর চেয়ে কম, বাংলাদেশে নারীরাও নারী প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করে না। এ কারণেই স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও সাংসদ হতে নারীদের কোটা লাগে। বিগত ৫৩ বছর ধরে যারা চাকরির কোটার সুযোগ নিয়ে বড় বড় শহরে বসবাস করছেন তাদের সন্তানরা আজ আর কোটা চায় না। এটা জগতের নিয়ম। বাসে উঠেই সব যাত্রী অন্য কোনো যাত্রীর ওঠাকে পছন্দ করে না।

কোটা আন্দোলনের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আদালতের বিষয়টি রাজপথে চলে এলো। সবই রাজনৈতিক খেলা, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ক্ষমতায়। নির্বাচন কমিশনের শর্ত পরিপালন না করায় জামায়াতে ইসলাম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের জন্য তাদের শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, রাজনৈতিক শত্রু। আওয়ামী লীগ সরকারের চরম বিপর্যয় তাদের কাম্য। ক্ষমতায় যাওয়ার খেলা বিএনপি খেলবেই, না চাইলেও জামায়েত-বিএনপিকে সহায়তা করবে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে তাদের এই খেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে এই খেলায় জীবনহানি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, উন্নয়নের গতি শ্লথ হচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিনাশ কাম্য বলেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলনে ভর করেছিল, এই ভর করাটাও রাজনৈতিক কৌশল; কিন্তু জানমালের যে ক্ষতি হলো তার দায় নেবে কে? আন্দোলনে জীবনহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের যে বিমর্ষ চেহারা তা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে, এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top