alt

উপ-সম্পাদকীয়

ত্যাগী নেতৃত্ব, না দুধের মাছিদের রাজনীতি?

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪
image

রাজনৈতিক দলে এক সময় জবাবদিহি ছিলো জনগণের কাছে, এখন জবাবদিহি ঊর্ধ্বমুখী

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন মূলত বেনিফিসিয়ারি বা সুবিধাভোগীদের দলে পরিণত হয়েছে। সুবিধাভোগীরা মূল কর্মজীবনে গাছেরটা খান আর অবসর অথবা চাকরি, ব্যবসা জীবনের ইন্টারভ্যালে নিচেরটাও দুই হাত ভরে কুড়িয়ে ঘরে তুলেন। রাজনৈতিক দলগুলোতে সুবিধাভোগীদের জয়-জয়কার। সরকারি দলে দুধের মাছিরা সব সময়ই ভিড় করে। তবে সুবিধাভোগীদের ওপর এতো নির্ভরশীলতা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যখন রাষ্ট্রের একদল লোক ঐক্যবদ্ধ আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থ সাধনের ব্যাপারে সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করে তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলা হয়। ঐক্যবদ্ধ আদর্শের বিষয়টি এখন অপ্রাসঙ্গিক। যাদের অর্থ, বিত্ত, লোকজনের অভাব নেই তাদের বড় দলগুলো সব সময় স্বাগত জানায়। একসময় গহিন গ্রাম থেকে নিবেদন, প্রতিশ্রুতি, আদর্শ, দেশপ্রেম এসব মানবিক গুণাবলী নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসতেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এখন নির্বাচনের পূর্বে অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, লোকবল(!) দিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার টিকেট কিনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারেন যারা তারাই নেতা।

নেতা বলতে আমরা যাদের চিনতাম সেই ভাবমূর্তির নেতা আর দেশে নেই। সফেদ পাঞ্জাবী, সাদামাটা লুঙ্গি পরে নৌকায় রেঁধে বেড়ে খেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানের তেইশ বছরের অধিকাংশ সময় জেলেই ছিলো শেখ মুজিবের বাড়ি ঘর। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হতো বছরের হাতেগোনা কয়েকটি দিন। কতো ঈদ, পার্বন কেটেছে তার জেলে। সাদা ঢোলা পায়াজামা, পাঞ্জাবি আর কালো ওয়াচ কোট ছিলো তার সম্বল। চিন্তা করা যায় এতো বড় দলের একজন ডাকসাইটে নেতা তাকে চাকরি করতে হতো একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে। আজকাল এই মাপের নেতাদের নিজস্ব মালিকানায় থাকে কতো ব্যাঙ্ক, শিল্পকারখানা, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ কতো কিছু। পচন মাথা থেকে শুরু হলে বড় বিপদ। আমাদের পচনও শুরু হয়েছে মাথা বা মাথাদের কাছ থেকে। নেতারা আমাদের মাথা। সম্প্রতি তাদের কর্মকা- দেখে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে।

রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট শুরু হয়েছে মধ্য সত্তর থেকে। আমরা দেখেছি একজন মহান মানুষ রাজনীতিসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দেখে সংবাদপত্রে তার লেখা কলামে কতো হাহাকার করে বেড়িয়েছেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ‘গাছ-পাথর’ ছদ্মনামে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘সময় বহিয়া যায়’ নামে একটি রাজনৈতিক কলাম লিখতেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি এই কলামে রাজনৈতিক, সামাজিক বিশ্লেষণ লিখে গেছেন। তার কলামে প্রায়ই একটি হাহাকার উঠে আসতো সে সময় আর সেটি হলো সমাজ বিশেষ করে তরুণদের কাছে অনুসরণ করার মতো জাতীয় কোন নায়ক নেই। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট থেকে শুরু করে সাতাত্তরের এ সময়টি সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থানে নতুন নতুন সামরিক শাসক আসছেন আর জনসমাজে তাদের ভিত্তি তৈরির জন্য তরুণ, যুবাদের নানা টোপ ফেলে রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক কর্মকা-ের জন্য অর্থ, অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে বিপথগামী করে তুলছেন। সামরিক শাসনের এই অন্ধকার সময়ে আলোর রেখাকে ধরার জন্য মনে হয় শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই আক্ষেপ করতেন।

সময় সত্যি ‘বহিয়া গিয়াছে’। ক্রান্তিকাল যেন অনন্ত সময় ধরে আমাদের আঁকড়ে ধরে আছে। অনেকেই এসব বাস্তব কথাকে অপছন্দ করেন। প্রশ্ন হলো চোখ বন্ধ রাখলে কী প্রলয় বন্ধ হবে। যদি তাই হয় আসুন আমরা সকলে মিলে চোখ বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করি।

ক্রান্তিকালে কেনো আলোর রেখা দেখা যায় না। এর কারণ হলো ত্যাগী নেতার অভাব। আদর্শ থেকে যারা দ্রুত বিচ্যুত হয়ে যান তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও দূরে সরে যান। প্রান্তিক মানুষের ওপর নির্ভর করতে তারা ভয় পান। যে দেশের মানুষেরা মরণঘাতী অস্ত্রের সামনে নিজেদের বুক পেতে দিতে জানে সে দেশের মানূষের ওপর যারা আস্থা রাখতে পারেন না তারা কোন পর্যায়ের নেতৃত্বের গুণাবলী বয়ে বেড়ান তা বলাই বাহুল্য।

গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে যারা মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুবিধাভোগীদের ওপর নির্ভর করেন তারা মনে করেন বহমান সময়ে তারা খাপ খাইয়েটিকে থাকবেন। যারা মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করে রাজনীতি করতে চান তারা সেকেলে রাজনীতির পাঠ নিয়ে সমসাময়িক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চান, এটি হলো সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদের কথা। তারা ভুলে যান আদর্শগতভাবে রাজনৈতিক দল হচ্ছে নাগরিকদের এমন একটি সংগঠন যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করার উদ্দেশ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়। সমষ্টিগত কল্যাণ কিংবা তাদের সমর্থকদের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তাবিত কিছু নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐকমত্য পোষণ করে মানুষের কল্যাণ করাই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য। হাল আমালে ক্ষমতাই হলো সবচেয়ে বড় আদর্শ। এই ক্ষমতাকে টেকসই করার জন্য যতো প্রকার কৌশল ব্যবহার করা যায় তাই হলো রাজনীতি এবং তা বাস্তবায়ন করতে যারা মরিয়া তারা হলো রাজনৈতিক দল।

ক্ষমতায়টিকে থাকার স্বার্থে সুবিধাভোগী বা বেনিফিসিয়ারিদের কেনো স্বাগত জানানো হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোতে। সুবিধাভোগীরা ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল উদ্ভাবন এবং বাস্তবায়ন করবেন এর বিনিময়ে তারা যতো রকমের সুযোগ সুবিধা আছে তা ভোগ করবেন। সমষ্টিগত কল্যাণ ততটুকু করা হবে যতটুকু করলে তাদের ভাগে কিছু কম না পড়ে।

এক সময় আমরা দেখতাম ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা দল গুলো অন্যায়ের শিকার হলে মানূষের কাছে ছুটে যেতে। জনগণ হচ্ছেন রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির উৎস। আমরা হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবকে দেখেছি সারা বাংলার আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে। ছয় দফা পেশের পর শেখ মুজিবকে সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। জনগণ ভেবেছে আমাদের প্রানের মানুষ যে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে আমাদের মতামত নিচ্ছেন আবার কর্মসূচি বাস্তবায়নও হচ্ছে জনমতকে ভিত্তি করে। এগুলো কোন রূপকথা নয়, এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেতৃত্বের মহান গুণাবলী। আমরা কেনো আমাদের মহান নেতাদের এসব গুণাবলীকে অনুসরন না করে সহজ পথে ক্ষমতা ভোগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করছি। এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

আমরা জবাদিহি করতে বড় ভয় পাই। রাজনৈতিক দলে এক সময় জবাবদিহি ছিলো জনগণের কাছে, এখন জবাদিহি ঊর্ধ্বমুখী। ক্ষমতা ধীরে ধীরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে উপরের দিকে। ইউনিয়ন নেতারা খুশি রাখেন উপজেলা নেতাদের। উপজেলার জবাদিহি জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে আর এভাবে এক সময় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কঠিনভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। উল্টোমুখী এই দায়বদ্ধতা জনগণকে রাজনীতি থেকে বিয়োজিত করে ফেলে। জনগণ বিয়োজিত রাজনীতিতে তাই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাধারীদের খুশি করলেই চলে। মূলত আমাদের সকল রাজনৈতিক দলে এখন দুধের মাছিদের রাজত্ব। দুধের মাছিরা বুঝে ফেলছেন রাজনীতির নামে ক্ষমতা ভোগের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে মধ্য সত্তরের পর থেকে সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের কথা, পরামর্শ ছাড়া অপরাজনীতির মসৃণ(!) পথে এগোনো অসম্ভব।

দুধের মাছিদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলো কী নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে? এসব সুবিধাভোগীদের দলের প্রতি সামান্য আনুগত্য নেই। যেহেতু তারা দলের আদর্শের থেকে কতো বেশি সুবিধা পাবে এই বিবেচনাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করে থাকে এ’কারণে তারা দলের জন্য সম্পদ নয়। তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতাদের মতো নিবেদন নিয়ে দলীয় কর্মকান্ডে তারা অংশগ্রহণ করেন না। যেকোন সংকট মোকাবেলায় দলের আদর্শবাদী নেতাদের মতো সকল সদস্যদের নিয়ে এগিয়ে যেতে ভয় পাঞ তারা। দিনের শেষে দলীয় শীর্ষ নেতার কাছ থেকে বাহবা কুড়ানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। বাহবা তাদের মূলধণ। এই মূলধন ভাঙ্গিয়ে তারা অর্থ, সম্পদের পাহাড়কে স্ফীত করতে সক্ষম হয়। এ কারণে সংকটকালে তারা এক নৌকা ছেড়ে অন্য নৌকায় গিয়ে হাল ধরতে পারেন। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী এই মানুষদের নীরবে দল ছেড়ে অপকর্মের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে আমরা বহুবার দেখেছি। ভোগের সময় তাদের তৎপর দেখা গেলেও সংকটের সময় তাদের দায় এড়নো দেখে আমরা অভ্যস্ত।

সময় এসেছে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা এবং সংস্কারের। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংখ্যাগুরু প্রান্তিক মানুষের আস্থা অর্জনের রাজনীতিতে অবিচল থাকে তাহলে মানুষের ভালোবাসায় তারা নিশ্চিতভাবে সাহস নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। সামান্য কিছু মানুষের কূট-কৌশলের ওপর নির্ভর করে প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমতার সমাজ গড়া সম্ভব নয়। ভয়াবহ এই সংকটকালে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কী এ বিষয়টি ভেবে দেখবে?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

‘আবার তোরা মানুষ হ’

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ত্যাগী নেতৃত্ব, না দুধের মাছিদের রাজনীতি?

শেখর ভট্টাচার্য

image

রাজনৈতিক দলে এক সময় জবাবদিহি ছিলো জনগণের কাছে, এখন জবাবদিহি ঊর্ধ্বমুখী

সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন মূলত বেনিফিসিয়ারি বা সুবিধাভোগীদের দলে পরিণত হয়েছে। সুবিধাভোগীরা মূল কর্মজীবনে গাছেরটা খান আর অবসর অথবা চাকরি, ব্যবসা জীবনের ইন্টারভ্যালে নিচেরটাও দুই হাত ভরে কুড়িয়ে ঘরে তুলেন। রাজনৈতিক দলগুলোতে সুবিধাভোগীদের জয়-জয়কার। সরকারি দলে দুধের মাছিরা সব সময়ই ভিড় করে। তবে সুবিধাভোগীদের ওপর এতো নির্ভরশীলতা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যখন রাষ্ট্রের একদল লোক ঐক্যবদ্ধ আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থ সাধনের ব্যাপারে সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করে তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলা হয়। ঐক্যবদ্ধ আদর্শের বিষয়টি এখন অপ্রাসঙ্গিক। যাদের অর্থ, বিত্ত, লোকজনের অভাব নেই তাদের বড় দলগুলো সব সময় স্বাগত জানায়। একসময় গহিন গ্রাম থেকে নিবেদন, প্রতিশ্রুতি, আদর্শ, দেশপ্রেম এসব মানবিক গুণাবলী নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসতেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এখন নির্বাচনের পূর্বে অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, লোকবল(!) দিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার টিকেট কিনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারেন যারা তারাই নেতা।

নেতা বলতে আমরা যাদের চিনতাম সেই ভাবমূর্তির নেতা আর দেশে নেই। সফেদ পাঞ্জাবী, সাদামাটা লুঙ্গি পরে নৌকায় রেঁধে বেড়ে খেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানের তেইশ বছরের অধিকাংশ সময় জেলেই ছিলো শেখ মুজিবের বাড়ি ঘর। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হতো বছরের হাতেগোনা কয়েকটি দিন। কতো ঈদ, পার্বন কেটেছে তার জেলে। সাদা ঢোলা পায়াজামা, পাঞ্জাবি আর কালো ওয়াচ কোট ছিলো তার সম্বল। চিন্তা করা যায় এতো বড় দলের একজন ডাকসাইটে নেতা তাকে চাকরি করতে হতো একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে। আজকাল এই মাপের নেতাদের নিজস্ব মালিকানায় থাকে কতো ব্যাঙ্ক, শিল্পকারখানা, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ কতো কিছু। পচন মাথা থেকে শুরু হলে বড় বিপদ। আমাদের পচনও শুরু হয়েছে মাথা বা মাথাদের কাছ থেকে। নেতারা আমাদের মাথা। সম্প্রতি তাদের কর্মকা- দেখে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে।

রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট শুরু হয়েছে মধ্য সত্তর থেকে। আমরা দেখেছি একজন মহান মানুষ রাজনীতিসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দেখে সংবাদপত্রে তার লেখা কলামে কতো হাহাকার করে বেড়িয়েছেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ‘গাছ-পাথর’ ছদ্মনামে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘সময় বহিয়া যায়’ নামে একটি রাজনৈতিক কলাম লিখতেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি এই কলামে রাজনৈতিক, সামাজিক বিশ্লেষণ লিখে গেছেন। তার কলামে প্রায়ই একটি হাহাকার উঠে আসতো সে সময় আর সেটি হলো সমাজ বিশেষ করে তরুণদের কাছে অনুসরণ করার মতো জাতীয় কোন নায়ক নেই। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট থেকে শুরু করে সাতাত্তরের এ সময়টি সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থানে নতুন নতুন সামরিক শাসক আসছেন আর জনসমাজে তাদের ভিত্তি তৈরির জন্য তরুণ, যুবাদের নানা টোপ ফেলে রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক কর্মকা-ের জন্য অর্থ, অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে বিপথগামী করে তুলছেন। সামরিক শাসনের এই অন্ধকার সময়ে আলোর রেখাকে ধরার জন্য মনে হয় শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই আক্ষেপ করতেন।

সময় সত্যি ‘বহিয়া গিয়াছে’। ক্রান্তিকাল যেন অনন্ত সময় ধরে আমাদের আঁকড়ে ধরে আছে। অনেকেই এসব বাস্তব কথাকে অপছন্দ করেন। প্রশ্ন হলো চোখ বন্ধ রাখলে কী প্রলয় বন্ধ হবে। যদি তাই হয় আসুন আমরা সকলে মিলে চোখ বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করি।

ক্রান্তিকালে কেনো আলোর রেখা দেখা যায় না। এর কারণ হলো ত্যাগী নেতার অভাব। আদর্শ থেকে যারা দ্রুত বিচ্যুত হয়ে যান তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও দূরে সরে যান। প্রান্তিক মানুষের ওপর নির্ভর করতে তারা ভয় পান। যে দেশের মানুষেরা মরণঘাতী অস্ত্রের সামনে নিজেদের বুক পেতে দিতে জানে সে দেশের মানূষের ওপর যারা আস্থা রাখতে পারেন না তারা কোন পর্যায়ের নেতৃত্বের গুণাবলী বয়ে বেড়ান তা বলাই বাহুল্য।

গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে যারা মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুবিধাভোগীদের ওপর নির্ভর করেন তারা মনে করেন বহমান সময়ে তারা খাপ খাইয়েটিকে থাকবেন। যারা মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করে রাজনীতি করতে চান তারা সেকেলে রাজনীতির পাঠ নিয়ে সমসাময়িক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চান, এটি হলো সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদের কথা। তারা ভুলে যান আদর্শগতভাবে রাজনৈতিক দল হচ্ছে নাগরিকদের এমন একটি সংগঠন যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করার উদ্দেশ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়। সমষ্টিগত কল্যাণ কিংবা তাদের সমর্থকদের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তাবিত কিছু নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐকমত্য পোষণ করে মানুষের কল্যাণ করাই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য। হাল আমালে ক্ষমতাই হলো সবচেয়ে বড় আদর্শ। এই ক্ষমতাকে টেকসই করার জন্য যতো প্রকার কৌশল ব্যবহার করা যায় তাই হলো রাজনীতি এবং তা বাস্তবায়ন করতে যারা মরিয়া তারা হলো রাজনৈতিক দল।

ক্ষমতায়টিকে থাকার স্বার্থে সুবিধাভোগী বা বেনিফিসিয়ারিদের কেনো স্বাগত জানানো হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোতে। সুবিধাভোগীরা ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল উদ্ভাবন এবং বাস্তবায়ন করবেন এর বিনিময়ে তারা যতো রকমের সুযোগ সুবিধা আছে তা ভোগ করবেন। সমষ্টিগত কল্যাণ ততটুকু করা হবে যতটুকু করলে তাদের ভাগে কিছু কম না পড়ে।

এক সময় আমরা দেখতাম ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা দল গুলো অন্যায়ের শিকার হলে মানূষের কাছে ছুটে যেতে। জনগণ হচ্ছেন রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির উৎস। আমরা হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবকে দেখেছি সারা বাংলার আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে। ছয় দফা পেশের পর শেখ মুজিবকে সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। জনগণ ভেবেছে আমাদের প্রানের মানুষ যে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে আমাদের মতামত নিচ্ছেন আবার কর্মসূচি বাস্তবায়নও হচ্ছে জনমতকে ভিত্তি করে। এগুলো কোন রূপকথা নয়, এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেতৃত্বের মহান গুণাবলী। আমরা কেনো আমাদের মহান নেতাদের এসব গুণাবলীকে অনুসরন না করে সহজ পথে ক্ষমতা ভোগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করছি। এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

আমরা জবাদিহি করতে বড় ভয় পাই। রাজনৈতিক দলে এক সময় জবাবদিহি ছিলো জনগণের কাছে, এখন জবাদিহি ঊর্ধ্বমুখী। ক্ষমতা ধীরে ধীরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে উপরের দিকে। ইউনিয়ন নেতারা খুশি রাখেন উপজেলা নেতাদের। উপজেলার জবাদিহি জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে আর এভাবে এক সময় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কঠিনভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। উল্টোমুখী এই দায়বদ্ধতা জনগণকে রাজনীতি থেকে বিয়োজিত করে ফেলে। জনগণ বিয়োজিত রাজনীতিতে তাই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাধারীদের খুশি করলেই চলে। মূলত আমাদের সকল রাজনৈতিক দলে এখন দুধের মাছিদের রাজত্ব। দুধের মাছিরা বুঝে ফেলছেন রাজনীতির নামে ক্ষমতা ভোগের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে মধ্য সত্তরের পর থেকে সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের কথা, পরামর্শ ছাড়া অপরাজনীতির মসৃণ(!) পথে এগোনো অসম্ভব।

দুধের মাছিদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলো কী নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে? এসব সুবিধাভোগীদের দলের প্রতি সামান্য আনুগত্য নেই। যেহেতু তারা দলের আদর্শের থেকে কতো বেশি সুবিধা পাবে এই বিবেচনাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করে থাকে এ’কারণে তারা দলের জন্য সম্পদ নয়। তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতাদের মতো নিবেদন নিয়ে দলীয় কর্মকান্ডে তারা অংশগ্রহণ করেন না। যেকোন সংকট মোকাবেলায় দলের আদর্শবাদী নেতাদের মতো সকল সদস্যদের নিয়ে এগিয়ে যেতে ভয় পাঞ তারা। দিনের শেষে দলীয় শীর্ষ নেতার কাছ থেকে বাহবা কুড়ানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। বাহবা তাদের মূলধণ। এই মূলধন ভাঙ্গিয়ে তারা অর্থ, সম্পদের পাহাড়কে স্ফীত করতে সক্ষম হয়। এ কারণে সংকটকালে তারা এক নৌকা ছেড়ে অন্য নৌকায় গিয়ে হাল ধরতে পারেন। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী এই মানুষদের নীরবে দল ছেড়ে অপকর্মের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে আমরা বহুবার দেখেছি। ভোগের সময় তাদের তৎপর দেখা গেলেও সংকটের সময় তাদের দায় এড়নো দেখে আমরা অভ্যস্ত।

সময় এসেছে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা এবং সংস্কারের। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংখ্যাগুরু প্রান্তিক মানুষের আস্থা অর্জনের রাজনীতিতে অবিচল থাকে তাহলে মানুষের ভালোবাসায় তারা নিশ্চিতভাবে সাহস নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। সামান্য কিছু মানুষের কূট-কৌশলের ওপর নির্ভর করে প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমতার সমাজ গড়া সম্ভব নয়। ভয়াবহ এই সংকটকালে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কী এ বিষয়টি ভেবে দেখবে?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top