alt

উপ-সম্পাদকীয়

কী বার্তা দিল কোটা আন্দোলন

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করা হয়।

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলমান অবস্থাতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ নামে একটি সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এপ্রিলে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ৯ এপ্রিল ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং বিভিন্ন সময় আন্দোলকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তিনি সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই সরকার জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে (৯ম থেকে ১৩তম) নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো কোটা বহাল নেই, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে (১৪তম থেকে ২০তম পর্যন্ত) কোটা বহাল রয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীর মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে।

২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার উপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বাতিলকৃত কোটা পুনরায় বহাল করে। যার ফলে পুনরায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন হল থেকে শুরু করে শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়। ৪ জুলাই সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে জমায়েত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা। এর আগে থেকে সেখানে পুলিশ বাহিনীর সুসজ্জিত সদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা সেখানে গেলে পুলিশ পিছু হটে যায়। পরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়ে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সারা দুনিয়ায় কোটা সংরক্ষণ করা হয়। সমতার ভিত্তিতে কোন দেশকে উন্নত করতে কোটা জরুরি। বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থা থাকা স্বাভাবিক। তাহলে কোটা নিয়ে এত বিতর্ক কেন, কেন আন্দোলন? সংশ্লিষ্টদের মতে, কোটা নিয়ে বিতর্ক থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে কারা কতটুকু পিছিয়ে রয়েছে, কত শতাংশ কোটা রাখা প্রয়োজন, এই হিসাবে দেশে কখনোই কোটা চালু ছিল না। সে কারণেই সৃষ্টি হয় জটিলতা।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার প্রচলন ছিল। তবে ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। যথাযথ সংস্কার না হওয়াতেই যত বিপত্তি দেখা দেয়। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে দুটি গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। রায়ের পর পরই তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নেমেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি নতুন নয়। স্বাধীনতার পর নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি পদ কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। পরে মেধায় নিয়োগের হার আরও কিছু বাড়ানো হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় চার ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখেন। একই দাবিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করেছেন। ওই বছর কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে পুরো কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে পরবর্তী সময়ে সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেয়া; সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা; কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

কোটা সংস্কার নিছক কোন সাধারণ আন্দোলন নয়, এর ব্যপ্তি ও ব্যাপকতা অনের গভীরের। এই আন্দোলনকে দেশ জাগরণ ও পরিবর্তনের এক আন্দোলন হিসেবেও গণ্য করা যায়। এ আন্দোলনের তাৎপর্যকে বিবেচনায় রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোটা সংস্কার ২০২৪ জাতির ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। এ সংস্কারে আগামীদিনে আমাদের বোধের এবং বিবেকের সংস্কার আসবে এবং সমাজ সচেতনতা আসবে। আমাদের অধঃপতিত মূল্যবোধকে বিনির্মাণ করতে হবে। হিংসা ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে ন্যায়বোধ, ন্যায় পরায়ণতা, মহানুভবতা ও মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাতিকে নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষায় উজ্জীবিত হতে হবেÑ দেশের জনগণ এ প্রত্যাশাই করছে।

ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি সরকার মেনে নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। তাই আমাদের উচিত এটা খেয়াল রাখা যে, কোন উস্কানি দাতা, মদদদাতার ছোবলে পড়ে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ যেন নষ্ট না হয়ে পড়ে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবারই দায়িত্ব রয়েছে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে সবকিছুকে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ফিরে যেতে হবে তাদের শ্রেণীকক্ষে। মন দিতে হবে পড়াশোনায়। কেননা আজকের ছাত্রসমাজ যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারে তাহলে আগামীতে দেশের নেতৃত্বে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কী বার্তা দিল কোটা আন্দোলন

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করা হয়।

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলমান অবস্থাতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ নামে একটি সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এপ্রিলে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ৯ এপ্রিল ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং বিভিন্ন সময় আন্দোলকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তিনি সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই সরকার জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে (৯ম থেকে ১৩তম) নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো কোটা বহাল নেই, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে (১৪তম থেকে ২০তম পর্যন্ত) কোটা বহাল রয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীর মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে।

২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার উপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বাতিলকৃত কোটা পুনরায় বহাল করে। যার ফলে পুনরায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন হল থেকে শুরু করে শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়। ৪ জুলাই সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে জমায়েত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা। এর আগে থেকে সেখানে পুলিশ বাহিনীর সুসজ্জিত সদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা সেখানে গেলে পুলিশ পিছু হটে যায়। পরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়ে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সারা দুনিয়ায় কোটা সংরক্ষণ করা হয়। সমতার ভিত্তিতে কোন দেশকে উন্নত করতে কোটা জরুরি। বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থা থাকা স্বাভাবিক। তাহলে কোটা নিয়ে এত বিতর্ক কেন, কেন আন্দোলন? সংশ্লিষ্টদের মতে, কোটা নিয়ে বিতর্ক থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে কারা কতটুকু পিছিয়ে রয়েছে, কত শতাংশ কোটা রাখা প্রয়োজন, এই হিসাবে দেশে কখনোই কোটা চালু ছিল না। সে কারণেই সৃষ্টি হয় জটিলতা।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার প্রচলন ছিল। তবে ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। যথাযথ সংস্কার না হওয়াতেই যত বিপত্তি দেখা দেয়। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে দুটি গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। রায়ের পর পরই তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নেমেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি নতুন নয়। স্বাধীনতার পর নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি পদ কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। পরে মেধায় নিয়োগের হার আরও কিছু বাড়ানো হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় চার ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখেন। একই দাবিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করেছেন। ওই বছর কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে পুরো কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে পরবর্তী সময়ে সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেয়া; সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা; কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

কোটা সংস্কার নিছক কোন সাধারণ আন্দোলন নয়, এর ব্যপ্তি ও ব্যাপকতা অনের গভীরের। এই আন্দোলনকে দেশ জাগরণ ও পরিবর্তনের এক আন্দোলন হিসেবেও গণ্য করা যায়। এ আন্দোলনের তাৎপর্যকে বিবেচনায় রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোটা সংস্কার ২০২৪ জাতির ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। এ সংস্কারে আগামীদিনে আমাদের বোধের এবং বিবেকের সংস্কার আসবে এবং সমাজ সচেতনতা আসবে। আমাদের অধঃপতিত মূল্যবোধকে বিনির্মাণ করতে হবে। হিংসা ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে ন্যায়বোধ, ন্যায় পরায়ণতা, মহানুভবতা ও মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাতিকে নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষায় উজ্জীবিত হতে হবেÑ দেশের জনগণ এ প্রত্যাশাই করছে।

ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি সরকার মেনে নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। তাই আমাদের উচিত এটা খেয়াল রাখা যে, কোন উস্কানি দাতা, মদদদাতার ছোবলে পড়ে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ যেন নষ্ট না হয়ে পড়ে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবারই দায়িত্ব রয়েছে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে সবকিছুকে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ফিরে যেতে হবে তাদের শ্রেণীকক্ষে। মন দিতে হবে পড়াশোনায়। কেননা আজকের ছাত্রসমাজ যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারে তাহলে আগামীতে দেশের নেতৃত্বে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top