alt

উপ-সম্পাদকীয়

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই করালগ্রাসী বন্যার আঘাতে জর্জরিত আমাদের দেশের কৃষি। ফলে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা স্বাভাবিক। তবে পুষিয়ে নিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে; কিন্তু নাবি বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে ধানভিত্তিক কৃষি পুনর্বাসন কতখানি কার্যকর হবে কে জানে! কারণ নাবি ফসলের ফলন কখনও সময়মতো প্রতিষ্ঠিত ফসলের মতো হয় না। তদুপরি অগ্রহায়ণের শেষ বা পৌষের প্রথম দিকে হঠাৎ যদি তাপমাত্রা পড়ে যায়, তাহলে তো ধানের ফলন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। সে জন্যই পুনর্বাসন কার্যক্রমে জায়গা বুঝে ধানের বদলে অন্যকোনো ফসলের আবাদ করতে পারলে ভালো। সেই সাথে বন্যার কারণে সংঘটিত ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে বোরো আবাদে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া জরুরি। এজন্য গতানুগতিক উফশী ধানের জাতগুলো যেমন ব্রি ধান-২৮, ব্রি-২৯-এর ওপর নির্ভর না করে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভাবিত জাতগুলো আবাদ করতে হবে।

কারণ এগুলোর ফলন আগের জাতগুলোর চেয়ে হেক্টরপ্রতি ০.৫ টন থেকে দুই টন বেশি। চালের গুণাগুণও উন্নত এবং আকর্ষণীয়। এজন্য স্বল্প জীবনকালীন ব্রি ধান-২৮ এর পরিবর্তে ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৪, ব্রি ধান-৮৬, ব্রি ধান-৮৮, বঙ্গবন্ধু ধান-১০০, ব্রি ধান-১০১ আবাদ করা যায়। ৩৫-৪০ দিনের চারা পৌষের মাঝামাঝি রোপণ করতে পারলে এ জাতগুলোর জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে থাকবে এবং বৈশাখের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কাটা যাবে। তাহলে হাওড় এলাকার স্বাভাবিক বৈশাখী ঢলের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা কমে যাবে। তবে চারার বয়স আরেকটু কমিয়ে পৌষের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে রোপণ করতে পারলে চৈত্র্যের শেষ সপ্তাহে কাটা যাবে। তাহলে বৈশাখী ঢলে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না বললেই চলে। আর যারা ব্রি ধান-২৯ পছন্দ করে তাদের জন্য পরামর্শ হলো-১৫৬ দিনের জাত ব্রি ধান-৮৯-এর আবাদ করা। এ জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.০ টন (বিঘেপ্রতি ৩০ মণ)। একই ধরনের আরেকটি জাত হলো ব্রি ধান-৯২। ব্রি ধান-২৯ এর মতো বা কাছাকাছি জীবনকাল হলেও এদের ফলন ব্রি ধান-৮৯ থেকে বেশি। যাই হোক স্বাভাবিক পরিবেশ ব্রি ধান-২৮ এবং ব্রি ধান-২৯ এর মাঝামাঝি জীবনকাল অথচ ফলন এদের থেকে অনেক বেশি এমন কিছু জাতও কিন্তু আছে। যেমন ব্রি ধান-৫৮, ব্রি ধান-৫৯, ব্রি ধান-৯৬, ব্রি ধান-১০১ ব্রি ধান-১০২, ব্রি ধান-১০৪ এবং ব্রি ধান-১০৫। ব্রি ধান-১০৪ এর ফলন হেক্টর প্রতি ৯ টনের (বিঘে প্রতি ৩৪ মণ) কাছাকাছি, চাল সুগন্ধিযুক্ত এবং দেখতে প্রায় বাসমতির মতন। ব্রি ধান-১০৫ এর ফলন হেক্টর প্রতি ৮ টন এবং ডায়াবেটিস রোগীদের উপযোগী।

বাকিগুলোর ফলন কমপক্ষে হেক্টর প্রতি ৭.০ টন (বিঘে প্রতি ২৫ মন)। ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড ধান যেমন- ব্রি হাইব্রিড ধান-৩, ব্রি হাইব্রিড ধান-৫ আবাদ করা যেতে পারে। এগুলো ১৪৫ দিনের জাত এবং ফলন হেক্টরপ্রতি ৯.০ (বিঘে প্রতি প্রায় ৩৪ মণ) টন করে। লবণাক্ত এলাকার কৃষকেরা ব্রি ধান-৬৭ এবং ব্রি ধান-৯৯ আবাদ করতে পারে। এগুলো সবই ব্রি উদ্ভাবিত জাত এবং আমি দায়িত্ব সহকারেই এগুলো সম্পর্কে বলছি।

যাই হোক শুধু ভালো জাত হলেই চলবে না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। এবং ফসল প্রতিষ্ঠার পরে নিয়ম মেনে পরিচর্যা করতে হবে। এজন্য প্রস্তুতি এখন থেকেই দরকার। প্রথমেই যা বলার যে জাতগুলোর কথা আমি বলেছি, সেগুলোর বীজ বোধ হয় কৃষকদের কাছে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জায়গামাফিক সঠিক মানের সঠিক বীজের অভাব দেখা দেয়। মান সম্পন্ন বীজের উৎস হলো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। জনপ্রিয় জাত না হলে বিএডিসি সেই বীজ উৎপাদন করে না বলে অভিযোগ আছে। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর কাছে কিছু পরিমাণ বীজ থাকে।

প্রতি বছর ব্রি বীজ উৎপাদনকারী সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সব জাত মিলিয়ে ২০০ টনের উপরে ভিত্তি-বীজ উৎপাদন করে থাকে। সেই স্টক থেকে কৃষকদের কোনো বীজ দেওয়া হয় না। তবে নতুন কোনো জাতের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ব্রি প্রতি বছর কিছু পরিমাণ বীজ উৎপাদন করে থাকে। উদ্যোগী কৃষকরা প্রয়োজন বোধে ব্রি থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেই স্টক থেকে অল্প করে বীজ সংগ্রহ করতে পারে। আসন্ন বোরো মৌসুমের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কৃষক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করতে পারে। বীজ সংগ্রহের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরিমাণ সারের সংস্থানও করে রাখতে হবে।

এই প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ফলনে তার প্রভাব পড়বে। য্ইা হোক ধওে নেই; ফসল প্রতিষ্ঠা করা হলো সময় মতো সঠিক জাতটি দিয়ে, সেচের পানিরও অভাব নেই। সারও হাতের কাছে আছে। তারপরে মাঠ-ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যেমন পানি বা সারের সদ্ব্যবহার করা। ফসলের পুষ্টির জন্য সাধারণত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার এবং দস্তার অভাবের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এগুলোর সুষম মাত্রায় প্রয়োগের ব্যাপারে কৃষকেরা তেমন মনোযোগী নয়। ফলে সারের ব্যবহার-উপযোগিতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। তার অর্থ হলো সারের অপচয় হয় এবং পরিবেশের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাহলে সারের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিতÑ প্রত্যেক ফসলের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সারের জন্য একটা সাধারণ মাত্রা বলে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিচালিত কয়েকবছরের প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরীক্ষিত ফলাফলও বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, মাটির বুনট, মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান, প্লাবন ভূমির বৈশিষ্ট্য, শস্যক্রম ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে তিরিশটি কৃষি-অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে।

অঞ্চল ভেদে মাটির উর্বরা শক্তির হেরফের হওয়ায় সব জায়গার সার সুপারিশ একরকম হতে পারে না। তাই এগুলোর ওপর ভিত্তি করে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআন) ও অন্যান্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় বিএআরসি কয়েক বছর পর পর একটি সার সুপারিশমালা হাতবই প্রকাশ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে একই অঞ্চলের একই জাতীয় ভূমির মধ্যেও মাটির উর্বরতা শক্তি ও বুনটের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। তাই নির্দিষ্ট ফসলভিত্তিক যথাযথা কৃষি ব্যবস্থাপনার তাগিদে একজন কৃষককে তার প্রত্যেকটি জমির স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলাদা-আলাদাভাবে জানা দরকার; কিন্তু বিএআরসি প্রণীত উপর্যুক্ত সার সুপারিশ হাতবই থেকে একজন কৃষকের তার কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলের জন্য সার সংক্রান্ত একটি ধারণা করতে পারেন মাত্র।

কিন্তু তার জমির জন্য নির্দিষ্ট করে সারের পরিমাণ জানতে পারেন না। যাই হোক এসআরডিআই প্রত্যেকটি উপজেলার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক ভূমি, মাটি ও সার সুপারিশ সহায়িকা প্রণয়ন করেছে। সেখানে ভূমি শ্রেণি, মাটির উপরের স্তরের বুনট এবং রাসায়নিক গুণাবলী, শস্য ও শস্যক্রম অনুযায়ী সার ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ গবেষণা নির্ভর প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া আছে। সেগুলো থেকেও একজন কৃষক তার জমির না হলেও ইউনিয়নের সার প্রয়োগের একটা ধারণা করতে পারে। তবে এই সহায়িকাগুলো কৃষকদের কাছে সহজপ্রাপ্য নয়।

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বিএআরসি এসআরডিআইয়ের সহায়তায় ইউনিয়ন পর্যায়ের সমস্ত উপাত্ত ব্যবহারের উপযোগী করে একটি মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপ ‘খামারি’ উদ্ভাবন করেছে। এই অ্যাপের সাহায্যে নির্দিষ্ট জমিতে দাঁড়িয়ে কোনো ফসলের জন্য একজন কৃষক তার নিজের জন্য সার সুপারিশ তৈরি করে নিতে পারেন। এই অ্যাপটি বেশ বছর ধরে মাঠ পর্যায়ের পরিচালিত গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এবং এটা কৃষক-বান্ধব। তাই একজন সাধারণ কৃষক একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করে তার ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিজেই জেনে নিতে পারবেন।

এই অ্যাপটি এখন মাঠপর্যায়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সারের উপযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে এটা সামনের বোরো মওসুমের আগেই কৃষকদের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। ধরে নেই সুপারিশ মোতাবেক সার দেওয়া হলো জমিতে; কিন্তু সেটা যদি প্রয়োগের পরপরই মাটিতে মিশিয়ে না দেওয়া হয় তা হলে কিন্তু আশানুরূপ উপযোগিতা পাওয়া যাবে না। প্রায়োগিক উপযোগিতা বৃদ্ধির তাগিদে এক সময়গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু হাত দিয়ে মাটির গভীরে-প্রয়োগ একটি প্রায়োগিক সমস্যা বিধায় এই প্রযুক্তিটি কৃষকরা গ্রহণ করেনি। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সার প্রয়োগের বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছে যেটা দিয়ে দানাদার ইউরিয়া মাটির গভীরে প্রয়োগ করা যায়। এভাবে প্রয়োগ করতে পারলেও যথেষ্ট পরিমাণ সার সাশ্রয় করা সম্ভব। আমাদের দেশে ধানের জমিতে একশ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে মাত্র তিরিশ কেজি কাজে আসে। বাকি ৭০ শতাংশ বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যদি সার ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া যায় তাহলে এই অপচয় ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পঞ্চাশ শতাংশে আনা সম্ভব। তাহলে বিপুল পরিমাণ সার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এই প্রচেষ্টা সামনের বোরো মৌসুম থেকেই শুরু করা উচিত।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই করালগ্রাসী বন্যার আঘাতে জর্জরিত আমাদের দেশের কৃষি। ফলে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা স্বাভাবিক। তবে পুষিয়ে নিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে; কিন্তু নাবি বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে ধানভিত্তিক কৃষি পুনর্বাসন কতখানি কার্যকর হবে কে জানে! কারণ নাবি ফসলের ফলন কখনও সময়মতো প্রতিষ্ঠিত ফসলের মতো হয় না। তদুপরি অগ্রহায়ণের শেষ বা পৌষের প্রথম দিকে হঠাৎ যদি তাপমাত্রা পড়ে যায়, তাহলে তো ধানের ফলন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। সে জন্যই পুনর্বাসন কার্যক্রমে জায়গা বুঝে ধানের বদলে অন্যকোনো ফসলের আবাদ করতে পারলে ভালো। সেই সাথে বন্যার কারণে সংঘটিত ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে বোরো আবাদে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া জরুরি। এজন্য গতানুগতিক উফশী ধানের জাতগুলো যেমন ব্রি ধান-২৮, ব্রি-২৯-এর ওপর নির্ভর না করে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভাবিত জাতগুলো আবাদ করতে হবে।

কারণ এগুলোর ফলন আগের জাতগুলোর চেয়ে হেক্টরপ্রতি ০.৫ টন থেকে দুই টন বেশি। চালের গুণাগুণও উন্নত এবং আকর্ষণীয়। এজন্য স্বল্প জীবনকালীন ব্রি ধান-২৮ এর পরিবর্তে ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৪, ব্রি ধান-৮৬, ব্রি ধান-৮৮, বঙ্গবন্ধু ধান-১০০, ব্রি ধান-১০১ আবাদ করা যায়। ৩৫-৪০ দিনের চারা পৌষের মাঝামাঝি রোপণ করতে পারলে এ জাতগুলোর জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে থাকবে এবং বৈশাখের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কাটা যাবে। তাহলে হাওড় এলাকার স্বাভাবিক বৈশাখী ঢলের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা কমে যাবে। তবে চারার বয়স আরেকটু কমিয়ে পৌষের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে রোপণ করতে পারলে চৈত্র্যের শেষ সপ্তাহে কাটা যাবে। তাহলে বৈশাখী ঢলে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না বললেই চলে। আর যারা ব্রি ধান-২৯ পছন্দ করে তাদের জন্য পরামর্শ হলো-১৫৬ দিনের জাত ব্রি ধান-৮৯-এর আবাদ করা। এ জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.০ টন (বিঘেপ্রতি ৩০ মণ)। একই ধরনের আরেকটি জাত হলো ব্রি ধান-৯২। ব্রি ধান-২৯ এর মতো বা কাছাকাছি জীবনকাল হলেও এদের ফলন ব্রি ধান-৮৯ থেকে বেশি। যাই হোক স্বাভাবিক পরিবেশ ব্রি ধান-২৮ এবং ব্রি ধান-২৯ এর মাঝামাঝি জীবনকাল অথচ ফলন এদের থেকে অনেক বেশি এমন কিছু জাতও কিন্তু আছে। যেমন ব্রি ধান-৫৮, ব্রি ধান-৫৯, ব্রি ধান-৯৬, ব্রি ধান-১০১ ব্রি ধান-১০২, ব্রি ধান-১০৪ এবং ব্রি ধান-১০৫। ব্রি ধান-১০৪ এর ফলন হেক্টর প্রতি ৯ টনের (বিঘে প্রতি ৩৪ মণ) কাছাকাছি, চাল সুগন্ধিযুক্ত এবং দেখতে প্রায় বাসমতির মতন। ব্রি ধান-১০৫ এর ফলন হেক্টর প্রতি ৮ টন এবং ডায়াবেটিস রোগীদের উপযোগী।

বাকিগুলোর ফলন কমপক্ষে হেক্টর প্রতি ৭.০ টন (বিঘে প্রতি ২৫ মন)। ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড ধান যেমন- ব্রি হাইব্রিড ধান-৩, ব্রি হাইব্রিড ধান-৫ আবাদ করা যেতে পারে। এগুলো ১৪৫ দিনের জাত এবং ফলন হেক্টরপ্রতি ৯.০ (বিঘে প্রতি প্রায় ৩৪ মণ) টন করে। লবণাক্ত এলাকার কৃষকেরা ব্রি ধান-৬৭ এবং ব্রি ধান-৯৯ আবাদ করতে পারে। এগুলো সবই ব্রি উদ্ভাবিত জাত এবং আমি দায়িত্ব সহকারেই এগুলো সম্পর্কে বলছি।

যাই হোক শুধু ভালো জাত হলেই চলবে না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। এবং ফসল প্রতিষ্ঠার পরে নিয়ম মেনে পরিচর্যা করতে হবে। এজন্য প্রস্তুতি এখন থেকেই দরকার। প্রথমেই যা বলার যে জাতগুলোর কথা আমি বলেছি, সেগুলোর বীজ বোধ হয় কৃষকদের কাছে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জায়গামাফিক সঠিক মানের সঠিক বীজের অভাব দেখা দেয়। মান সম্পন্ন বীজের উৎস হলো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। জনপ্রিয় জাত না হলে বিএডিসি সেই বীজ উৎপাদন করে না বলে অভিযোগ আছে। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর কাছে কিছু পরিমাণ বীজ থাকে।

প্রতি বছর ব্রি বীজ উৎপাদনকারী সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সব জাত মিলিয়ে ২০০ টনের উপরে ভিত্তি-বীজ উৎপাদন করে থাকে। সেই স্টক থেকে কৃষকদের কোনো বীজ দেওয়া হয় না। তবে নতুন কোনো জাতের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ব্রি প্রতি বছর কিছু পরিমাণ বীজ উৎপাদন করে থাকে। উদ্যোগী কৃষকরা প্রয়োজন বোধে ব্রি থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেই স্টক থেকে অল্প করে বীজ সংগ্রহ করতে পারে। আসন্ন বোরো মৌসুমের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কৃষক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করতে পারে। বীজ সংগ্রহের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরিমাণ সারের সংস্থানও করে রাখতে হবে।

এই প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ফলনে তার প্রভাব পড়বে। য্ইা হোক ধওে নেই; ফসল প্রতিষ্ঠা করা হলো সময় মতো সঠিক জাতটি দিয়ে, সেচের পানিরও অভাব নেই। সারও হাতের কাছে আছে। তারপরে মাঠ-ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যেমন পানি বা সারের সদ্ব্যবহার করা। ফসলের পুষ্টির জন্য সাধারণত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার এবং দস্তার অভাবের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এগুলোর সুষম মাত্রায় প্রয়োগের ব্যাপারে কৃষকেরা তেমন মনোযোগী নয়। ফলে সারের ব্যবহার-উপযোগিতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। তার অর্থ হলো সারের অপচয় হয় এবং পরিবেশের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাহলে সারের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিতÑ প্রত্যেক ফসলের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সারের জন্য একটা সাধারণ মাত্রা বলে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিচালিত কয়েকবছরের প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরীক্ষিত ফলাফলও বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, মাটির বুনট, মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান, প্লাবন ভূমির বৈশিষ্ট্য, শস্যক্রম ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে তিরিশটি কৃষি-অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে।

অঞ্চল ভেদে মাটির উর্বরা শক্তির হেরফের হওয়ায় সব জায়গার সার সুপারিশ একরকম হতে পারে না। তাই এগুলোর ওপর ভিত্তি করে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআন) ও অন্যান্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় বিএআরসি কয়েক বছর পর পর একটি সার সুপারিশমালা হাতবই প্রকাশ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে একই অঞ্চলের একই জাতীয় ভূমির মধ্যেও মাটির উর্বরতা শক্তি ও বুনটের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। তাই নির্দিষ্ট ফসলভিত্তিক যথাযথা কৃষি ব্যবস্থাপনার তাগিদে একজন কৃষককে তার প্রত্যেকটি জমির স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলাদা-আলাদাভাবে জানা দরকার; কিন্তু বিএআরসি প্রণীত উপর্যুক্ত সার সুপারিশ হাতবই থেকে একজন কৃষকের তার কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলের জন্য সার সংক্রান্ত একটি ধারণা করতে পারেন মাত্র।

কিন্তু তার জমির জন্য নির্দিষ্ট করে সারের পরিমাণ জানতে পারেন না। যাই হোক এসআরডিআই প্রত্যেকটি উপজেলার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক ভূমি, মাটি ও সার সুপারিশ সহায়িকা প্রণয়ন করেছে। সেখানে ভূমি শ্রেণি, মাটির উপরের স্তরের বুনট এবং রাসায়নিক গুণাবলী, শস্য ও শস্যক্রম অনুযায়ী সার ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ গবেষণা নির্ভর প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া আছে। সেগুলো থেকেও একজন কৃষক তার জমির না হলেও ইউনিয়নের সার প্রয়োগের একটা ধারণা করতে পারে। তবে এই সহায়িকাগুলো কৃষকদের কাছে সহজপ্রাপ্য নয়।

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বিএআরসি এসআরডিআইয়ের সহায়তায় ইউনিয়ন পর্যায়ের সমস্ত উপাত্ত ব্যবহারের উপযোগী করে একটি মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপ ‘খামারি’ উদ্ভাবন করেছে। এই অ্যাপের সাহায্যে নির্দিষ্ট জমিতে দাঁড়িয়ে কোনো ফসলের জন্য একজন কৃষক তার নিজের জন্য সার সুপারিশ তৈরি করে নিতে পারেন। এই অ্যাপটি বেশ বছর ধরে মাঠ পর্যায়ের পরিচালিত গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এবং এটা কৃষক-বান্ধব। তাই একজন সাধারণ কৃষক একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করে তার ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিজেই জেনে নিতে পারবেন।

এই অ্যাপটি এখন মাঠপর্যায়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সারের উপযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে এটা সামনের বোরো মওসুমের আগেই কৃষকদের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। ধরে নেই সুপারিশ মোতাবেক সার দেওয়া হলো জমিতে; কিন্তু সেটা যদি প্রয়োগের পরপরই মাটিতে মিশিয়ে না দেওয়া হয় তা হলে কিন্তু আশানুরূপ উপযোগিতা পাওয়া যাবে না। প্রায়োগিক উপযোগিতা বৃদ্ধির তাগিদে এক সময়গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু হাত দিয়ে মাটির গভীরে-প্রয়োগ একটি প্রায়োগিক সমস্যা বিধায় এই প্রযুক্তিটি কৃষকরা গ্রহণ করেনি। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সার প্রয়োগের বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছে যেটা দিয়ে দানাদার ইউরিয়া মাটির গভীরে প্রয়োগ করা যায়। এভাবে প্রয়োগ করতে পারলেও যথেষ্ট পরিমাণ সার সাশ্রয় করা সম্ভব। আমাদের দেশে ধানের জমিতে একশ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে মাত্র তিরিশ কেজি কাজে আসে। বাকি ৭০ শতাংশ বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যদি সার ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া যায় তাহলে এই অপচয় ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পঞ্চাশ শতাংশে আনা সম্ভব। তাহলে বিপুল পরিমাণ সার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এই প্রচেষ্টা সামনের বোরো মৌসুম থেকেই শুরু করা উচিত।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top