মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর প্রায় সব কটি একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে নাগরিক জীবনে চরম দুর্ভোগ বয়ে আনছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কমিটমেন্টের অভাব, আইন প্রতিপালন ও বাস্তবায়নের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, উদাসীনতা এবং প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাট এবং জনগণের সচেতনতার অভাবে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের অধিকাংশ খাল হারিয়ে গেছে। টিকে থাকাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও প্রায় কাটা পড়ছে। আর জলাবদ্ধ হয়ে এর পরিণতি ভোগ করছে নগরবাসী।
একটি আদর্শ শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকা এবং ১৫ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন। অথচ রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে, যা ছিল তা দিন দিন ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ২৮ বছরে জলাশয় হারিয়ে যাওয়া হার ৭২ শতাংশ। একই চিত্র নিম্নাঞ্চলের ক্ষেত্রেও। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। একটু গভীরভাবে জলাবদ্ধতার কারণ যদি আমার খুঁজতে যাই তবে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। যেমনÑ জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট, পানি নিষ্কাশন তথা বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নগরীর খালি জায়গা কমে গেছে। অত্যন্ত ঘনবসতি হওয়ায় পয়ঃনিষ্কাশন ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে গেছে, ডাস্টবিন ছাড়া যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়। ফলে পাড়া-মহল্লার পানি নিষ্কাশনের ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষায় অতিরিক্ত খোঁড়াখুঁড়ি, ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়।
একসময় পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে কাঁচাবাজার, হাটবাজার এবং দোকানপাটে এর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পলিথিনগুলো ড্রেন, খাল এমনকি নদ-নদীর তলদেশের গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশেই ফেলে রাখা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে সে ময়লা আবার ড্রেনে গিয়েই পড়ে। সময়মতো বর্জ্য পরিষ্কার করা হয় না। নগরীতে ছোট-বড় অনেক ডাস্টবিন দেয়া হলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক অভিশাপ বলা যেতে পারে নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে তৈরি উপজাতগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার উপর। তারপর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা।
শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি, আমরা কি সরকারের কথা মানছি? আমরা কি আইন মানি? দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কি দায়িত্ব পালন করছে? নাহ! কেউ কিছুই মানছি না। শুধু একে অপরের ওপর দোষ দিয়ে যাচ্ছি। আর শুধু সেবা সংস্থাগুলোই নয়Ñ নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে। আমরা ময়লা-আবর্জনাগুলো নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট জায়গা ফেলতে পারি। কিন্তু সেটা না করে রাস্তার এখানে সেখানে কিংবা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিই। ড্রেন ছাড়া তো এলাকার পানি নিষ্কাশনের বিকল্প কিছু নেই।
সমস্যা যদি থাকে তাহলে সমস্যা সমাধানের উপায়ও আছে। সমস্যা সমাধানে স্বাভাবিকভাবে দুটি উপায় বিদ্যমান থাকে। একটি প্রতিরোধমূলক অপরটি প্রতিকারমূলক। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি কখনও জটিল হতো না। এখন সমস্যা এতটাই জটিল যে, খুব সহজে এর সমাধানের পথ বের করা সম্ভব নয়। তবে আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকালে প্রযুক্তিগত সমাধান অনুকরণের পন্থা খোলা আছে, যদিও তা বেশ ব্যয়বহুল।
উন্নত দেশগুলো জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিরোধমূলক তথা সঠিক ভূমি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে আসছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সমাধানের পথ বের করেছে। অনেক দেশ সড়ক ও আবাসন এলাকা ভেঙে খাল খনন করেছে, আবার কোথাওবা কৃত্রিম নদী খননের নজিরও আছে।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছেÑ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পানি নিষ্কাশনের পথ সুগম করা, পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজকে আধুনিকায়ন করা। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘাটতি আছে বলেও মনে করেন অনেকে।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের ছোট-বড় সব শহরেই কমবেশি জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে প্রতি বছরই ভারি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় দেশবাসীকে। তাই জলবদ্ধতা প্রতিরোধ করতে রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর জলাবদ্ধতা সমস্যা-সমাধানে গণসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এ সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। তাই রাতারাতি নিরসন করাও যাবে না। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেগুলো স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রোববার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর প্রায় সব কটি একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে নাগরিক জীবনে চরম দুর্ভোগ বয়ে আনছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কমিটমেন্টের অভাব, আইন প্রতিপালন ও বাস্তবায়নের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, উদাসীনতা এবং প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাট এবং জনগণের সচেতনতার অভাবে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের অধিকাংশ খাল হারিয়ে গেছে। টিকে থাকাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও প্রায় কাটা পড়ছে। আর জলাবদ্ধ হয়ে এর পরিণতি ভোগ করছে নগরবাসী।
একটি আদর্শ শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকা এবং ১৫ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন। অথচ রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে, যা ছিল তা দিন দিন ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ২৮ বছরে জলাশয় হারিয়ে যাওয়া হার ৭২ শতাংশ। একই চিত্র নিম্নাঞ্চলের ক্ষেত্রেও। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। একটু গভীরভাবে জলাবদ্ধতার কারণ যদি আমার খুঁজতে যাই তবে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। যেমনÑ জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট, পানি নিষ্কাশন তথা বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নগরীর খালি জায়গা কমে গেছে। অত্যন্ত ঘনবসতি হওয়ায় পয়ঃনিষ্কাশন ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে গেছে, ডাস্টবিন ছাড়া যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়। ফলে পাড়া-মহল্লার পানি নিষ্কাশনের ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষায় অতিরিক্ত খোঁড়াখুঁড়ি, ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়।
একসময় পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে কাঁচাবাজার, হাটবাজার এবং দোকানপাটে এর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পলিথিনগুলো ড্রেন, খাল এমনকি নদ-নদীর তলদেশের গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশেই ফেলে রাখা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে সে ময়লা আবার ড্রেনে গিয়েই পড়ে। সময়মতো বর্জ্য পরিষ্কার করা হয় না। নগরীতে ছোট-বড় অনেক ডাস্টবিন দেয়া হলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক অভিশাপ বলা যেতে পারে নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে তৈরি উপজাতগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার উপর। তারপর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা।
শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি, আমরা কি সরকারের কথা মানছি? আমরা কি আইন মানি? দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কি দায়িত্ব পালন করছে? নাহ! কেউ কিছুই মানছি না। শুধু একে অপরের ওপর দোষ দিয়ে যাচ্ছি। আর শুধু সেবা সংস্থাগুলোই নয়Ñ নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে। আমরা ময়লা-আবর্জনাগুলো নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট জায়গা ফেলতে পারি। কিন্তু সেটা না করে রাস্তার এখানে সেখানে কিংবা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিই। ড্রেন ছাড়া তো এলাকার পানি নিষ্কাশনের বিকল্প কিছু নেই।
সমস্যা যদি থাকে তাহলে সমস্যা সমাধানের উপায়ও আছে। সমস্যা সমাধানে স্বাভাবিকভাবে দুটি উপায় বিদ্যমান থাকে। একটি প্রতিরোধমূলক অপরটি প্রতিকারমূলক। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি কখনও জটিল হতো না। এখন সমস্যা এতটাই জটিল যে, খুব সহজে এর সমাধানের পথ বের করা সম্ভব নয়। তবে আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকালে প্রযুক্তিগত সমাধান অনুকরণের পন্থা খোলা আছে, যদিও তা বেশ ব্যয়বহুল।
উন্নত দেশগুলো জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিরোধমূলক তথা সঠিক ভূমি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে আসছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সমাধানের পথ বের করেছে। অনেক দেশ সড়ক ও আবাসন এলাকা ভেঙে খাল খনন করেছে, আবার কোথাওবা কৃত্রিম নদী খননের নজিরও আছে।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছেÑ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পানি নিষ্কাশনের পথ সুগম করা, পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজকে আধুনিকায়ন করা। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘাটতি আছে বলেও মনে করেন অনেকে।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের ছোট-বড় সব শহরেই কমবেশি জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে প্রতি বছরই ভারি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় দেশবাসীকে। তাই জলবদ্ধতা প্রতিরোধ করতে রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর জলাবদ্ধতা সমস্যা-সমাধানে গণসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এ সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। তাই রাতারাতি নিরসন করাও যাবে না। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেগুলো স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]