এম এ হোসাইন
শ্রীলঙ্কার প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনূঢ়া দিশানায়েকের নির্বাচনে জয়লাভের পর দেশটির রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তার নেতৃত্বে দেশের নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পথচলা কিভাবে গতি পাবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। অর্থনৈতিক সংকট, ঋণ, বেকারত্ব এবং পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তার কি ভূমিকা হবে তা দেশটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বামপন্থি অবস্থান এবং অতীতের রাজনৈতিক আদর্শ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর বিশ্লেষণের।
অনূঢ়া দিশানায়েকের নেতৃত্বে জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) এবং ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)-এর জোট একটি নাটকীয় বিজয় অর্জন করেছে। ২২৫ আসনের সংসদে মাত্র তিনটি আসনের দল থেকে তিনি এখন দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ নির্বাচন মূলত শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
দিশানায়েকে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে শ্রীলঙ্কার প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করবেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে পরিবারতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার দাপটে দেশ শাসন করে এসেছে, মূলত এর বিরুদ্ধেই দিশানায়েকে জনগণ বেছে নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মানুষ দুই পুরোনো দলের বাইরে নতুন বিকল্প খুঁজছিলেন এবং দিশানায়েকের নেতৃত্বে তারা এই নতুন আশার দিকে হাত বাড়িয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয়বার গণনায় গিয়েছে। প্রথম গণনায় দিশানায়েকে ৪২.৩১% ভোট পেয়েছিলেন, যেখানে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা ৩২.৭৬% ভোট পেয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন আইন অনুযায়ী, প্রথম গণনায় ৫০% ভোট না পেলে দ্বিতীয় গণনায় যেতে হয়, যেখানে প্রেফারেন্সিয়াল ব্যালট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ভোটাররা তাদের পছন্দের তিনজন প্রার্থীকে ক্রম অনুসারে বেছে নিতে পারেন। দ্বিতীয় গণনায় দিশানায়েকে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, যা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি গত কয়েক বছরে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। ২০২২ সালে দেশটি ঋতখেলাপি হয়ে যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যে নেমে এসেছিল এবং সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছিল ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে বাকি ছিল। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার জনগণের ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গণবিদ্রোহ ঘটে।
অনূঢ়া দিশানায়েকের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা। বর্তমান সরকার আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে ২.৯ বিলিয়ন ডলারের বেলআউট প্যাকেজ গ্রহণ করেছে, যা শর্ত হিসেবে ২০২৮ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দিশানায়েকে প্রচারণার সময় বলেছিলেন যে তিনি শ্রীলঙ্কার ঋত পরিশোধের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন এবং আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। তবে এই ঋণের চাপ কিভাবে তিনি সামলাবেন এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পুনরুদ্ধার করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
দিশানায়েকের দল জেভিপির সংসদে মাত্র তিনটি আসন রয়েছে, যা দিয়ে স্বাধীনভাবে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই তার প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি হবে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেওয়া। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল এবং জোট সংসদে অধিক আসন পেলে তিনি শক্তিশালী সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন। বর্তমানে সংসদে অন্য দলের ২২২ জন সদস্য রয়েছেন, যারা নতুন প্রেসিডেন্টকে কতটা সমর্থন দেবেন, তা একটি বড় প্রশ্ন।
দিশানায়েকে ইতোমধ্যে বলেছেন যে, ক্ষমতায় এসে তিনি সংসদ বিলোপ করবেন, কারণ বর্তমান সংসদ জনগণের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করে না। তবে, যদি বিরোধী দল তাকে সহযোগিতা না করে, তাহলে দেশের শাসনব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে এবং শ্রীলঙ্কা নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে।
শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। বিশেষত, শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে দিশানায়েকের পররাষ্ট্র নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। দিশানায়েকে বামপন্থি হলেও তিনি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবেন। তবে, তার অতীতের ভারত-বিরোধী অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আমি মনে করি যে দিশানায়েকের পররাষ্ট্র নীতি ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত শ্রীলঙ্কাকে তৎক্ষণাৎ সহায়তা প্রদান করেছিল, যা দিশানায়েকের নতুন সরকারকে মনে রাখতে হবে। তিনি ভারতকে উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না, কারণ দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের সমর্থন প্রয়োজন।
চীন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিশেষ সহায়তা প্রদান না করলেও, দেশটির বামপন্থি নেতাদের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিশানায়েকে কীভাবে ভারত এবং চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবেন, তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমা এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে দেশটি ভারত ও চীনের উভয়ের নজরে রয়েছে। তাই দিশানায়েকে যদি চীনের প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পঙেন, তবে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে।
দিশানায়েকের চ্যালেঞ্জ হবে এ সম্পর্কটি এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে ভারতের সাথে দূরত্ব না তৈরি হয়, কারণ ভারত শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের প্রতি তার নীতি সম্ভবত অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের ওপর জোর দেবে, একইসঙ্গে নিশ্চিত করবে যে শ্রীলঙ্কার আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ বিঘিœত না হয়।
দিশানায়েকের নির্বাচনে জয়লাভের পর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং শ্রীলঙ্কার সমাজের বঞ্চিত অংশের পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে, তার দলের পূর্বের সশস্ত্র আন্দোলন এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। জনগণ এখন দেখবে, তিনি তার প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন এবং দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে পারেন কিনা?
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে নতুন এ অধ্যায় শুরু হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিশেষত, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিশানায়েকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন তার নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শ্রীলঙ্কার প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনূঢ়া দিশানায়েকের নির্বাচনে জয়লাভের পর দেশটির রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তার নেতৃত্বে দেশের নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পথচলা কিভাবে গতি পাবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। অর্থনৈতিক সংকট, ঋণ, বেকারত্ব এবং পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তার কি ভূমিকা হবে তা দেশটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বামপন্থি অবস্থান এবং অতীতের রাজনৈতিক আদর্শ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর বিশ্লেষণের।
অনূঢ়া দিশানায়েকের নেতৃত্বে জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) এবং ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)-এর জোট একটি নাটকীয় বিজয় অর্জন করেছে। ২২৫ আসনের সংসদে মাত্র তিনটি আসনের দল থেকে তিনি এখন দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ নির্বাচন মূলত শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
দিশানায়েকে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে শ্রীলঙ্কার প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করবেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে পরিবারতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার দাপটে দেশ শাসন করে এসেছে, মূলত এর বিরুদ্ধেই দিশানায়েকে জনগণ বেছে নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মানুষ দুই পুরোনো দলের বাইরে নতুন বিকল্প খুঁজছিলেন এবং দিশানায়েকের নেতৃত্বে তারা এই নতুন আশার দিকে হাত বাড়িয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয়বার গণনায় গিয়েছে। প্রথম গণনায় দিশানায়েকে ৪২.৩১% ভোট পেয়েছিলেন, যেখানে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা ৩২.৭৬% ভোট পেয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন আইন অনুযায়ী, প্রথম গণনায় ৫০% ভোট না পেলে দ্বিতীয় গণনায় যেতে হয়, যেখানে প্রেফারেন্সিয়াল ব্যালট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ভোটাররা তাদের পছন্দের তিনজন প্রার্থীকে ক্রম অনুসারে বেছে নিতে পারেন। দ্বিতীয় গণনায় দিশানায়েকে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, যা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি গত কয়েক বছরে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। ২০২২ সালে দেশটি ঋতখেলাপি হয়ে যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যে নেমে এসেছিল এবং সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছিল ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে বাকি ছিল। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার জনগণের ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গণবিদ্রোহ ঘটে।
অনূঢ়া দিশানায়েকের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা। বর্তমান সরকার আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে ২.৯ বিলিয়ন ডলারের বেলআউট প্যাকেজ গ্রহণ করেছে, যা শর্ত হিসেবে ২০২৮ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দিশানায়েকে প্রচারণার সময় বলেছিলেন যে তিনি শ্রীলঙ্কার ঋত পরিশোধের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন এবং আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। তবে এই ঋণের চাপ কিভাবে তিনি সামলাবেন এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পুনরুদ্ধার করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
দিশানায়েকের দল জেভিপির সংসদে মাত্র তিনটি আসন রয়েছে, যা দিয়ে স্বাধীনভাবে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই তার প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি হবে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেওয়া। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল এবং জোট সংসদে অধিক আসন পেলে তিনি শক্তিশালী সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন। বর্তমানে সংসদে অন্য দলের ২২২ জন সদস্য রয়েছেন, যারা নতুন প্রেসিডেন্টকে কতটা সমর্থন দেবেন, তা একটি বড় প্রশ্ন।
দিশানায়েকে ইতোমধ্যে বলেছেন যে, ক্ষমতায় এসে তিনি সংসদ বিলোপ করবেন, কারণ বর্তমান সংসদ জনগণের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করে না। তবে, যদি বিরোধী দল তাকে সহযোগিতা না করে, তাহলে দেশের শাসনব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে এবং শ্রীলঙ্কা নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে।
শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। বিশেষত, শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে দিশানায়েকের পররাষ্ট্র নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। দিশানায়েকে বামপন্থি হলেও তিনি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবেন। তবে, তার অতীতের ভারত-বিরোধী অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আমি মনে করি যে দিশানায়েকের পররাষ্ট্র নীতি ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত শ্রীলঙ্কাকে তৎক্ষণাৎ সহায়তা প্রদান করেছিল, যা দিশানায়েকের নতুন সরকারকে মনে রাখতে হবে। তিনি ভারতকে উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না, কারণ দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের সমর্থন প্রয়োজন।
চীন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিশেষ সহায়তা প্রদান না করলেও, দেশটির বামপন্থি নেতাদের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিশানায়েকে কীভাবে ভারত এবং চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবেন, তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমা এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে দেশটি ভারত ও চীনের উভয়ের নজরে রয়েছে। তাই দিশানায়েকে যদি চীনের প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পঙেন, তবে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে।
দিশানায়েকের চ্যালেঞ্জ হবে এ সম্পর্কটি এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে ভারতের সাথে দূরত্ব না তৈরি হয়, কারণ ভারত শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের প্রতি তার নীতি সম্ভবত অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের ওপর জোর দেবে, একইসঙ্গে নিশ্চিত করবে যে শ্রীলঙ্কার আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ বিঘিœত না হয়।
দিশানায়েকের নির্বাচনে জয়লাভের পর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং শ্রীলঙ্কার সমাজের বঞ্চিত অংশের পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে, তার দলের পূর্বের সশস্ত্র আন্দোলন এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। জনগণ এখন দেখবে, তিনি তার প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন এবং দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে পারেন কিনা?
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে নতুন এ অধ্যায় শুরু হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিশেষত, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিশানায়েকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন তার নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]