এম এ হোসাইন
লেবাননে ইরানের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। হিজবুল্লাহও তাদের সক্ষমতা দিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়। একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের জল্পনার মধ্যে ইরান নীরব রয়েছে, যা তার প্রতিশোধের ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক। এখন এটি স্পষ্ট যে, ইরানের রক্ষণশীল ফোরামের মধ্যে ইসরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা, ইরানের এই সতর্ক পন্থার পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে।
১৯৮০ এর দশকে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর সহায়তায় গঠিত হিজবুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের পররাষ্ট্র নীতির একটি মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠী ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্সি বাহিনী হিসেবে কাজ করে, বিশেষত ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সংঘাতের ক্ষেত্রে। ইরানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব হয়েছে। তেহরান অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সহায়তা করেছে, যা ইসরায়েলের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ইরানের প্রভাব ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে।
ইরান হিজবুল্লাহকে অস্ত্র এবং উন্নত সামরিক সরঞ্জাম, যেমন মিসাইল ও ড্রোনের পাশাপাশি প্রচুর আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে। মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান হিজবুল্লাহকে প্রতি বছর প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়, যা তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ বজায় রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এ সম্পর্ক হিজবুল্লাহকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে, যা প্রায়শই ইরানের বৃহত্তর আঞ্চলিক এজেন্ডায় প্রথম প্রতিরক্ষার স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।
বর্তমানে, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনের পরও ইরান একটি সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং প্রকাশ্যে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত রয়েছে। এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কারণ ঐতিহাসিকভাবে ইরান এ ধরনের প্ররোচনার দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের বক্তব্যে এই নতুন অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। পেজেশকিয়ান তার বক্তব্যে গাজা এবং লেবাননের সংঘাতগুলোতে ইসরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করেন, তবে এটি ছিল তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক কম আক্রমণাত্মক। উত্তেজনাপূর্ণ ভাষা বা হুমকি দেয়ার পরিবর্তে, পেজেশকিয়ান ইরানের শান্তির ইচ্ছার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তেহরান উত্তেজনা বাড়াতে চায় না বলে ইঙ্গিত দেন।
পেজেশকিয়ানের এই সংযমী পদক্ষেপ পূর্ববর্তী ইরানি রাষ্ট্রপতিদের থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যারা অতীতে সাধারণত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। গত জুলাই মাসে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির স্বাক্ষরকারীদের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যা সামরিক সংঘাতের পরিবর্তে কূটনীতির প্রতি তার অগ্রাধিকারকে তুলে ধরেছে। ইরানের অন্য কর্মকর্তারা, বিশেষ করে আইআরজিসির কমান্ডাররা, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
ইরানের এই সংযত প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে দেশের রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে। ইরানের কট্টরপন্থীরা, যারা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তারা ক্রমশ অস্বস্তি প্রকাশ করছেন। তারা যুক্তি দেন যে ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিক্রিয়া না দেখানোতে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে ইরানের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণœ হচ্ছে। বিশেষত, যখন হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন তারা মনে করেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেয়ায় আইআরজিসির সমর্থকদের মধ্যে তাদের অবস্থান দুর্বল করতে পারে।
যখন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছেন তখন অনেক রক্ষণশীল ব্যক্তি এটিকে ইরানের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করছেন। ইরানের পররাষ্ট্র নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী সংস্থা আইআরজিসি, যারা ঐতিহাসিকভাবে হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে বর্তমান আইআরজিসির নেতৃত্ব ইসরায়েলের বিরুদ্ধে খুবই সতর্কতামূলক কৌশল গ্রহণ করছে, যা সম্ভবত ইরানের বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত।
সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি যিনি ইরানের পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার অধিকারী। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেয়ার বিষয়ে তার সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক নীরবতা যা ইরানের বৃহত্তর কৌশল নিয়ে জল্পনার জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ভাষণে খামেনির সরাসরি হুমকির উল্লেখ ছিল না, যা কিনা হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের বিষয়ে ইরানের কৌশলগত পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই পরিবর্তনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। ইরানের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হলো, যদি ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় তবে এটি মার্কিন সামরিক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। ইরানের যে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ মার্কিন বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘাতের কারণ হতে পারে, যা ইরান সম্ভবত এড়াতে চাইছে, বিশেষ করে দেশের দুর্বল অর্থনীতি এবং চলমান অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং দেশটি ক্রমবর্ধমানভাবে বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ উভয় চাপের সম্মুখীন।
ইরানের নেতৃত্ব সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর পর তা পরবর্তী প্রভাব বিবেচনা করছে। হিজবুল্লাহ ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেছে বলে জানা গেছে, তবে ইরানি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এটি সঠিক সময় না-ও হতে পারে। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকে, ইরান হয়তো তার সম্পদ সংরক্ষণ করতে এবং একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে, যা কিনা দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তে ইরানের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে। হিজবুল্লাহই একমাত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী নয়, যা ইরানের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে ইরান একটি প্রক্সি বাহিনীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যারা আর্থিক এবং সামরিক সহায়তার জন্য তেহরানের ওপর নির্ভরশীল। যদি সংকটের সময় ইরান তার মিত্রদের সমর্থন করতে ইচ্ছুক না বলে প্রতীয়মান হয়, তবে এই গোষ্ঠীগুলোর আনুগত্য দুর্বল হতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবকে ক্ষুণœ করতে পারে এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তিশালী করবে।
অন্যদিকে, শক্তিশালী ইরানি প্রতিক্রিয়ার অভাবে ইসরায়েলকে হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার আগ্রাসী কৌশল চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে। ইসরায়েল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামোতে আঘাত করতে পিছপা হবে না এবং ইরানের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রতিরোধ না থাকলে, এই আক্রমণগুলো অব্যাহত থাকতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে অঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে তার ক্ষমতা হারাতে পারে।
হিজবুল্লাহর ওপর ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ইরানের প্রতিশোধ না নেয়ার ঘটনায় দেশের নেতৃত্বের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। যেখানে কট্টরপন্থীরা ইরানের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং ইসরায়েলের আরও আগ্রাসন প্রতিহত করতে শক্ত প্রতিক্রিয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে, সেখানে সরকারের অপর বাস্তববাদী অংশ, যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানও রয়েছেন তারা কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বড় ধরনের সংঘাত এড়ানোর জন্য সংযমের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। এই বিষয়ে খামেনির নীরবতা ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব এখনও প্রতিশোধের বিকল্পগুলো বিবেচনা করছে। ইরান মিত্রদের সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।
যেহেতু পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে জটিল হয়ে উঠছে তাই ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেহরান শেষ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করবে নাকি সংযমকে অগ্রাধিকার দেবে, তার প্রভাব শুধু হিজবুল্লাহর জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তেহরানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো শুধু আঞ্চলিক উত্তেজনার ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে না, বরং ইরানের কৌশলগত অবস্থান ও তার মিত্রদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর ২০২৪
লেবাননে ইরানের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। হিজবুল্লাহও তাদের সক্ষমতা দিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়। একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের জল্পনার মধ্যে ইরান নীরব রয়েছে, যা তার প্রতিশোধের ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক। এখন এটি স্পষ্ট যে, ইরানের রক্ষণশীল ফোরামের মধ্যে ইসরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা, ইরানের এই সতর্ক পন্থার পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে।
১৯৮০ এর দশকে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর সহায়তায় গঠিত হিজবুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের পররাষ্ট্র নীতির একটি মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠী ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্সি বাহিনী হিসেবে কাজ করে, বিশেষত ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সংঘাতের ক্ষেত্রে। ইরানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব হয়েছে। তেহরান অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সহায়তা করেছে, যা ইসরায়েলের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ইরানের প্রভাব ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে।
ইরান হিজবুল্লাহকে অস্ত্র এবং উন্নত সামরিক সরঞ্জাম, যেমন মিসাইল ও ড্রোনের পাশাপাশি প্রচুর আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে। মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান হিজবুল্লাহকে প্রতি বছর প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়, যা তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ বজায় রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এ সম্পর্ক হিজবুল্লাহকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে, যা প্রায়শই ইরানের বৃহত্তর আঞ্চলিক এজেন্ডায় প্রথম প্রতিরক্ষার স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।
বর্তমানে, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনের পরও ইরান একটি সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং প্রকাশ্যে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত রয়েছে। এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কারণ ঐতিহাসিকভাবে ইরান এ ধরনের প্ররোচনার দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের বক্তব্যে এই নতুন অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। পেজেশকিয়ান তার বক্তব্যে গাজা এবং লেবাননের সংঘাতগুলোতে ইসরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করেন, তবে এটি ছিল তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক কম আক্রমণাত্মক। উত্তেজনাপূর্ণ ভাষা বা হুমকি দেয়ার পরিবর্তে, পেজেশকিয়ান ইরানের শান্তির ইচ্ছার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তেহরান উত্তেজনা বাড়াতে চায় না বলে ইঙ্গিত দেন।
পেজেশকিয়ানের এই সংযমী পদক্ষেপ পূর্ববর্তী ইরানি রাষ্ট্রপতিদের থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যারা অতীতে সাধারণত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। গত জুলাই মাসে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির স্বাক্ষরকারীদের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যা সামরিক সংঘাতের পরিবর্তে কূটনীতির প্রতি তার অগ্রাধিকারকে তুলে ধরেছে। ইরানের অন্য কর্মকর্তারা, বিশেষ করে আইআরজিসির কমান্ডাররা, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
ইরানের এই সংযত প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে দেশের রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে। ইরানের কট্টরপন্থীরা, যারা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তারা ক্রমশ অস্বস্তি প্রকাশ করছেন। তারা যুক্তি দেন যে ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিক্রিয়া না দেখানোতে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে ইরানের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণœ হচ্ছে। বিশেষত, যখন হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন তারা মনে করেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেয়ায় আইআরজিসির সমর্থকদের মধ্যে তাদের অবস্থান দুর্বল করতে পারে।
যখন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছেন তখন অনেক রক্ষণশীল ব্যক্তি এটিকে ইরানের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করছেন। ইরানের পররাষ্ট্র নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী সংস্থা আইআরজিসি, যারা ঐতিহাসিকভাবে হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে বর্তমান আইআরজিসির নেতৃত্ব ইসরায়েলের বিরুদ্ধে খুবই সতর্কতামূলক কৌশল গ্রহণ করছে, যা সম্ভবত ইরানের বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত।
সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি যিনি ইরানের পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার অধিকারী। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেয়ার বিষয়ে তার সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক নীরবতা যা ইরানের বৃহত্তর কৌশল নিয়ে জল্পনার জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ভাষণে খামেনির সরাসরি হুমকির উল্লেখ ছিল না, যা কিনা হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের বিষয়ে ইরানের কৌশলগত পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই পরিবর্তনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। ইরানের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হলো, যদি ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় তবে এটি মার্কিন সামরিক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। ইরানের যে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ মার্কিন বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘাতের কারণ হতে পারে, যা ইরান সম্ভবত এড়াতে চাইছে, বিশেষ করে দেশের দুর্বল অর্থনীতি এবং চলমান অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং দেশটি ক্রমবর্ধমানভাবে বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ উভয় চাপের সম্মুখীন।
ইরানের নেতৃত্ব সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর পর তা পরবর্তী প্রভাব বিবেচনা করছে। হিজবুল্লাহ ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেছে বলে জানা গেছে, তবে ইরানি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এটি সঠিক সময় না-ও হতে পারে। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকে, ইরান হয়তো তার সম্পদ সংরক্ষণ করতে এবং একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে, যা কিনা দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তে ইরানের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে। হিজবুল্লাহই একমাত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী নয়, যা ইরানের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে ইরান একটি প্রক্সি বাহিনীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যারা আর্থিক এবং সামরিক সহায়তার জন্য তেহরানের ওপর নির্ভরশীল। যদি সংকটের সময় ইরান তার মিত্রদের সমর্থন করতে ইচ্ছুক না বলে প্রতীয়মান হয়, তবে এই গোষ্ঠীগুলোর আনুগত্য দুর্বল হতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবকে ক্ষুণœ করতে পারে এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তিশালী করবে।
অন্যদিকে, শক্তিশালী ইরানি প্রতিক্রিয়ার অভাবে ইসরায়েলকে হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার আগ্রাসী কৌশল চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে। ইসরায়েল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামোতে আঘাত করতে পিছপা হবে না এবং ইরানের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রতিরোধ না থাকলে, এই আক্রমণগুলো অব্যাহত থাকতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে অঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে তার ক্ষমতা হারাতে পারে।
হিজবুল্লাহর ওপর ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ইরানের প্রতিশোধ না নেয়ার ঘটনায় দেশের নেতৃত্বের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। যেখানে কট্টরপন্থীরা ইরানের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং ইসরায়েলের আরও আগ্রাসন প্রতিহত করতে শক্ত প্রতিক্রিয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে, সেখানে সরকারের অপর বাস্তববাদী অংশ, যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানও রয়েছেন তারা কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বড় ধরনের সংঘাত এড়ানোর জন্য সংযমের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। এই বিষয়ে খামেনির নীরবতা ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব এখনও প্রতিশোধের বিকল্পগুলো বিবেচনা করছে। ইরান মিত্রদের সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।
যেহেতু পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে জটিল হয়ে উঠছে তাই ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেহরান শেষ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করবে নাকি সংযমকে অগ্রাধিকার দেবে, তার প্রভাব শুধু হিজবুল্লাহর জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তেহরানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো শুধু আঞ্চলিক উত্তেজনার ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে না, বরং ইরানের কৌশলগত অবস্থান ও তার মিত্রদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]